somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চেরোকিদের সেই কান্নাভেজা পথ এবং বিস্ময়কর সেই শ্বেতগোলাপের উপাখ্যান ...

০৩ রা আগস্ট, ২০০৯ বিকাল ৪:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



"Whole Indian Nations have melted away like snowballs in the sun before the white man's advance. Where are the Delewares? They have been reduced to a mere shadow of their former greatness.” চেরোকি চিফ Dragging Canoe.

চেরোকিরা আমেরিকার আদি অধিবাসী। অনেক কাল আগে তারা বাস করত আমেরিকার দক্ষিণপুর্ব অঞ্চলে। মার্কিন সরকার ১৮৩৮ সালে চেরোকিদের তাদে সূদীর্ঘকালের জন্মভূমি থেকে উৎখাত করেছিল। চেরোকিদের যেতে হয়েছিল ৮০০ মাইল পশ্চিমের ওকলোহোমায়। চেরোকিরা রওনা হল। চেরোকি-ইতিহাসে ঐ বিয়োগান্তক ঘটনাটি ‘ট্রেইল অভ টিয়ার্স’ নামে পরিচিত। ‘ট্রেইল অভ টিয়ার্স’ কে আমরা বলব: কান্নাভেজা পথ। বাচ্চাদের কি হবে-এই ভেবে যাত্রার শুরুতে মায়েরা কাঁদতে শুরু করল। বয়স্ক মহিলারা তখন প্রার্থনা করতে লাগল। ইস্, এমন কিছু যদি ঘটত ... যাতে মায়েরা মনের জোর ফিরে পায়। পরের দিনই ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা। সুন্দর সুন্দর গোলাপ ফুটতে শুরু করল ... যেখানে যেখানে.চেরোকি মায়েদের কান্নার ফোঁটা পড়েছিল! শ্বেত গোলাপ ... কান্নার রং। মাঝখানে সোনালি। চেরকিদের কাছ থেকে সোনাদানা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল বলেই। গোলাপের ডাল থেকে সাতটি পাতা ...আশ্চর্য! সাতটি চেরোকি ক্ল্যান ...



চেরোকি নারী

চেরোকিদের নিয়ে পড়তে পড়তে ওদের ধর্মের সঙ্গে জাপানের কামিপন্থি শিন্টোধর্মের ভীষনই সাদৃশ্য পেলাম। বেদ-এর সঙ্গেও সাদৃশ্য পেলাম। বেদ এর মূল কথা একমেবাদ্বীতিয়াম। এক ছাড়া দুই নাই। চেরোকিদের কাছেও জগৎ অখন্ড। আমি মনে করি: এখানেই ওদের গ্রেটনেস। কেননা, চেরোকিরা মনে করে তারা কেবল অন্য মানুষের সঙ্গেই সম্পৃক্ত নয়-প্রতিটি জীবিত প্রাণিকূলের সঙ্গেই সংযুক্ত। এ কারণেই চেরোকিরা ইউরোপের শ্বেতকায়দের দোষারোপ করেছিল। কেন? ইউরোপের শ্বেতকায়রা চেরোকিদের মাতৃভূমিতে ব্যাপক শিকারযজ্ঞ সংঘটিত করেছে। সে জন্যই তো স্মল পক্স হল! ...




সে যাই হোক। বলছিলাম যে-চেরোকিরা মনে করে তারা কেবল অন্য মানুষের সঙ্গেই সম্পৃক্ত নয়-প্রতিটি জীবিত প্রাণিকূলের সঙ্গেই সংযুক্ত। প্রাণশূন্য বস্তুও বাদ নেই। কেননা, চেরোকিদের চোখে চাঁদ ও সূর্য হল ভাইবোন। তবে, পৃথিবী কিন্তু, মানবজাতির মা না। পৃথিবী এমন এক স্থান যেখানে মানুষ জাতি বাস করে। যদিও পৃথিবীও জ্যান্ত। প্রাচীন চেরোকি গাথা-উপকথায় শষ্যমাতা ‘সে-লু’ হচ্ছেন মানুষ জাতির মা । আর, জীবনে সবচে গুরুত্বপূর্ন পানি। কোনও গুরুত্বপূর্ন কাজের আগে পানি দিয়ে গোছল করে নেয় তারা । চেরোকিরা কলোনিয়াল ইউরোপীয়দের কাছ থেকে খ্রিস্টান ধর্ম সম্বন্ধে জেনেছিল। চেরোকিদের জীবনধারা যেন ওল্ড টেস্টামেন্ট উল্লেখিত নানান জাতির সঙ্গে মিলে যায়। তবে একটা কথা... চেরোকিরা প্রতিশোধ বুঝলেও যিশুকে (দেবতা) কেন হত্যা করা হয়েছিল সেটা বোঝেনি! ... এখানেই ওদের গ্রেটনেস।



যাহোক। চেরোকি সমাজে শামানরা গোত্র প্রধানের মতোই শক্তিশালী। স্মলপক্সে বহু শামান মারা গিয়েছিল। যারা বেঁচে গিয়েছিল-তারা ছিল সম্মানীয়।
এবার দেখব। ওরা আমেরিকায় কোত্থেকে এল ...



১২ থেকে ১৪ হাজার আগের কথা। প্যালেও-ইনডিয়ানরা (প্রত্ন-ইন্ডিয়ান বা নেটিভ আমেরিকান) গোটা আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাটি ঘটেছিল প্লেইসটোসেন যুগে। প্লেইসটোসেন যুগের সময়কাল ১৫ লক্ষ বছর থেকে ১০,০০০ বছর। ঐ প্রত্ন-ইনডিয়ানরা ছিল শিকারী ও খাদ্য সংগ্রহকারী। বাইসন কারিবৌ (বা রেইনডিয়ার) ম্যামথ শিকার করত। ম্যামথ কেবল বরফযুগে উত্তর ইউরোপেই ছিল এমন মনে করার কোনও কারণ নেই।
যা হোক। প্রত্ন-ইনডিয়ানদের একটি দলই আমেরিকার দক্ষিণপুবে চলে আসে। এরাই চেরোকিদের পূর্ব পুরুষ। আর্কাইক পিরিয়ডে (৮,০০০ থেকে ২,০০০ খ্রিস্টপূর্ব) চেরোকিরা কৃষিকাজ শুরু করে। লাউ, সূর্যমুখি, ইত্যাদি চাষ করত তারা।



ক্রমশ কৃষির উদবৃত্ত বয়ে আনল অবসর। চেরোকিরা শিল্পে মনোযোগী হল। তৈরি করল কতশত চেরোকি গাথা-উপকথা। বলল: শষ্যমাতা ‘সে-লু’ হচ্ছেন মানুষ জাতির মা । আর, জীবনে সবচে গুরুত্বপূর্ন হল পানি।
মিসিসিপি যুগে (৯০০ থেকে ১৫০০ এর মধ্যে) ভূট্টার চাষ আরম্ভ করে। সে সময়-

সবুজ ভুট্টার ফলনে
গোত্র পরিবার
মাতত উৎসবে।

এমনই সুখের ছিল কলোনিয়াল-পূর্ব জীবন!
ইউরোপীয়রা আমেরিকায় আসার আগে চেরোকিরা দক্ষিণ পুবের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রন করত। যা এখন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, নর্থ ক্যালোলিনা, উত্তর জর্জিয়া এবং উত্তর অ্যালাবামা। অ্যাপালাচিয়ান পাহাড়ে ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে স্প্যানিশ আবিস্কারনক হেরনানদো দ্য সেতো চেরোকিদের দেখতে পায়।



১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে স্মল পক্স এদের জনসংখ্যা কমিয়ে দেয় ১১০০০। উত্তর আমেরিকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চদের বিরোধ লেগেছিল। চেরোকিরা ব্রিটিশদের সমর্থন করে । অবশ্য ১৭৬০ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চেরোকিরা বিদ্রোহ করে।



চেরোকি যোদ্ধা।

উনিশ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুর্বাঞ্চলে শ্বেতাঙ্গদের সংখ্যা হু হু করে বৃদ্ধি পায়। এর অন্যতম কারণ-১৮৩০ এর দিকে জর্জিয়ায় স্বর্নখনি আবিস্কার।






চেরোকিরা তখন প্রধানত মিসিসিপি নদীর পূর্বতীরে বাস করত।

মার্কিন সরকার চেরোকিদের সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অ্যান্ডু জ্যাকসন প্রেসিডেন্ট। তিনি বললেন, চেরোকিরা ভূমির ব্যবহার জানে না অপচয় করে শ্বেতকৃষকদের দেওয়া হবে। চেরোকিদের পশ্চিমে সরিয়ে নেওয়া হবে। এটিই প্রেসিডেন্ট বুশের ...সরি প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডু জ্যাকসন-এর“ ইনডিয়ান রিমুভাল পলিসি।”


প্রেসিডেন্ট অ্যান্ডু জ্যাকসন

১৮৩৮। চেরোকিদের বলপূর্বক অন্তত ১০,০০০ বছর পুরনো মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হল। বাধ্য হয়ে পথে নামল ওরা। কান্নাভেজা পথে। যেতে হবে পুব থেকে পশ্চিমে ৮০০ মাইল দূরের ওকলোহোমা। এই ‘ট্রেইল অভ টিয়ারস।’ মানবজাতির ইতিহাসে অত্যন্ত মর্মান্তিক বিয়োগান্তক ঘটনা।







কান্নাভেজা পথের ভাইস চিফ ছিলেন চালর্স হিকস। তিনি ১৮৩৮ সালের ৪ আগষ্ট বললেন, "We are now about to take our leave and kind farewell to our native land, the country that the Great Spirit gave our Fathers, we are on the eve of leaving that country that gave us birth...it is with sorrow we are forced by the white man to quit the scenes of our childhood... we bid farewell to it and all we hold dear."
পথে ১৫,০০০ এর মধ্যে অসুখে ক্ষুধায় ৪০০০ জন চেরোকি মারা যায়।
তবে সবাই মারা যায়নি। আজও ওরা ওকলোহোমা, জর্জিয়া, নর্থ ও সাউথ ক্যারোলিনা, ভার্জিনিয়া, কেনটাকি এবং টেনেসিতে বেঁচে আছে।



অনেকেই এতদিনে ইউরোপীয় জীবনধারায় অভ্যস্থ হয়ে গেছে। তারপরও প্রায় ২০,০০০ হাজার চেরোকি আজও চেরোকি ইন্ডিয়ান ভাষায় কথা বলে। চেরোকি ইন্ডিয়ান ভাষা হল ইরোকিউইয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অর্ন্তভূক্ত । এই ভাষায় চেরোকি শব্দের মানে: “অন্যভাষার কথক।” নিজেদের ওরা প্রধান জনগনও বলে ।



চেরোকি নাকি নম্র আওয়াজের জটিল ভাষা। ‘হ্যালো’ হচ্ছে ‘ওহসিওহ্’ । ‘ধন্যবাদ’ হচ্ছে, ‘ওয়াহডো’। বিশাল এক চেরোকি পন্ডিতএর নাম সিকিউয়াহ। তিনি চেরোকি লিখনপদ্ধতি আবিস্কার করেছেন। চেরোকি লিখনপদ্ধতি জাপানি ভাষার মতোই সিলেবারি-মানে প্রতিটি সিলেবালের জন্য একটি অক্ষর।
যাক। আজও চেরোকিরা নদীর ধারে গ্রামে বাস করে। ঘর নির্মান করে বাঁশ আর প্লাস্টার। দেখতে অনেকটা কুড়ে ঘরের মত। চাষবাসই মূল। চাষ করে ভূট্টা বীন লাউ সূর্যমূখি। কুড়িয়ে খায় বেরি ও বাদাম। শিকার করে হরিণ, বুনো টারকি; নদীর মাছও ধরে খায়।
কখনও চেরোকিদের বাড়ি গেলে বলবেন: ওহসিওহ্। তারপর ওরা আপনাকে খেতে দেবে ভূট্টার রুটি, স্যূপ, পাথরের উনুনে রাঁধা স্টু। ( স্টু কি সুরুয়া? মানে, ঝোল?) খাওয়ার পর বলবেন: ওয়াহডো।










আর এই সেই শ্বেত গোলাপ ...



মনে থাকার কথা: ...কান্নাভেজা পথের যাত্রার শুরুতে বাচ্চাদের কি হবে-এই ভেবে যাত্রার শুরুতে মায়েরা কাঁদতে শুরু করল। বয়স্ক মহিলারা তখন প্রার্থনা করতে লাগল। ইস্, এমন কিছু যদি ঘটত ... যাতে মায়েরা মনের জোর ফিরে পায়। পরের দিনই ঘটল সেই আশ্চর্য ঘটনা। সুন্দর সুন্দর গোলাপ ফুটতে শুরু করল ... যেখানে যেখানে.চেরোকি মায়েদের কান্নার ফোঁটা পড়েছিল! শ্বেত গোলাপ ... কান্নার রং। মাঝখানে সোনালি। চেরকিদের কাছ থেকে সোনাদানা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল বলেই। গোলাপের ডাল থেকে সাতটি পাতা ...আশ্চর্য! সাতটি চেরোকি ক্ল্যান ...



আজও নাকি পূর্ব ওকলাহোমার পথে বুনো গোলাপ ফোটে।সেই কান্নাভেজা পথের দু’পাশে।






সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৮:৫০
১৮টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×