somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: মহিমা তব উদ্ভাসিত

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৫:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাতের আকাশে কুয়াশার চাদর বেশ পুরু। পূর্ণিমার চাঁদটাও প্রখর। কুয়াশার পুরু চাদর ছিঁড়ে সে যুবতী ধবল চাঁদ সাদা আলো ফেলছে সমস্ত চরাচরে । রাত এখন কত? পৌষের রাতে এই আদিবাসী গ্রামটি কেমন নিঝুম হয়ে আছে। আর, ডাকবাংলোর সিঁড়িতে বসে মিলি গাইছিল-

মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে,
বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে।
আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।

রাজীব বসেছে কাঠের সিঁড়ির ধাপে হেলান দিয়ে । ওর কোলের ওপর একটা কালো রঙের ইয়ামাহা এক্যুয়েস্টিক গিটার। গানের সঙ্গে রিদম বাজিয়ে যাচ্ছিল ও। চাঁদের আলোর শুভ্র প্রতিফলন পড়েছে ওর গিটারের ওপর । কালো প্যান্ট আর লাল রঙের পুলোভার পরেছে রাজীব; রংটং অবশ্য অত বোঝা যাচ্ছে না। অল্প অল্প শিশির পড়ছিল। শীত সত্ত্বেও মিলি আর রাজীব ঠান্ডা শিশিরপাত অগ্রাহ্য করছিল। অন্যরা বসেছে ঈষৎ আবছা অংশে-ডাকবাংলোর বারান্দায় কার্পেট পাতা মেঝের ওপর। শামস আর আফসানা সিগারেট ধরিয়েছিল। রিফাইন্ড তামাকের হালকা গন্ধ ভাসছিল ডাকবাংলোর বাতাসে। ওরা দুজন কাজিন। ছোটবেলা থেকেই লালখান বাজারে ওরা একসঙ্গে বড় হয়েছে-সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুর মতন। তুই তোকারি করে। রিয়া বসেছে একেবারে সিঁড়ির প্রান্তে, মিলির একটু পিছনে। মিলির গলা চমৎকার। মুগ্ধ হয়ে শুনছিল রিয়া। মিলির গার্টস আছে। গভীর মাসসিন আঘাত সহ্য করেও গান গাইছে মিলি; ওর কোনও অনুযোগ নেই। তবে মিলি থানচি আসতে চায়নি। ডিপরেসড। রিয়াই তখন বলেছিল, থানচি চল। ভালো লাগবে। থানচি উপজেলার এই আদিবাসী গ্রামটির নাম: ‘পাঙখুঙ’। জায়গাটা রুমা থেকে অনেকটাই দক্ষিণ-পুবে এবং প্রায় মায়ানমার সীমান্তসংলগ্ন । ডাকবাংলোটির সামনে নীলাভ জলের বিস্তীর্ণ একটি হ্রদ। সে হ্রদের নাম লালমতি। হ্রদের অনেক ওপরে পাঙখুঙ গ্রাম। এলাকাটি বিশেষ করে ম্রো অধ্যুষিত। শামস এর এক পরিচিত লোক ‘ট্রাইবাল মুন’ - এ চাকরি করে; চট্টগ্রাম-বেইজড এই ট্যুরিস্ট কোম্পানিটি বেশ ক্রিয়েটিভ - ডাকবাংলোটি ওদেরই। ডাকবাংলোটির নামও লালমতি। ডাকবাংলোটি সম্পূর্নত কাঠের এবং এর অবস্থান একটি পাহাড়ি জলস্রোতের ওপর । কেয়ারটেকার একজন মারমা। কেয়ারটেকারটি বেশ বুড়ো, নাম: লুঙদি। তামাটে বর্ণের দীর্ঘদেহী বুড়োটির মাথায় সাদা শনের মতন পাকা চুল ও ঘোলাটে চোখ। বেশ ভালো বাংলা জানে। বুড়োর একটি পোষা হাতি আছে। হাতির নাম আদম। কথাটা শুনে আফসানা চিৎকার করে উঠেছিল। আশ্চর্য! বান্দরবানের গহীন অরণ্যের হাতির নাম আদম!
হতে পারে। মাথা নেড়ে শামস বলেছিল তখন।
আজই বিকেলে এসে ওরা ডাকবাংলোয় উঠেছে। তখনও দিনের আলো ছির। তারপর বিশ্রাম নিয়ে ডিনার শেষে এসে বারান্দায় বসেছে। মিলির গান শুনবে। রবীন্দ্রসংগীতে মিলি কিন্নরকন্ঠী। তবে গিটারে রাজীবের হাতও ভালো। রবীন্দ্রসংগীতের আগে রাজীব পাগানিনি বাজিয়ে শোনাল।
এরপর ‘আনন্দলোকে’ গানটা ধরে মিলি। কে বলবে মিলিকে ভীষণ এক কষ্ট কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ভাবতেই রিয়ার কেমন যেন করে। ২ বছর আগে যেভাবে বিধবা হল মিলি- লাইফ এত ফানি! নৈলে জামিল ভাই আজ এখানে থাকত। তবুও মিলি গাইছে: “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।” ইস্, ওর বাচ্চাটাও যদি বেঁচে থাকত! রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর শীত করে। শালটা গায়ে জড়িয়ে নেয় ও । এবার কি বেশি শীত পড়েছে অন্যান্য বছরের তুলনায়? সময়টা ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। সবে পৌষের শুরু। এরকম সময়ে পাহাড়ে শীত তো পড়বেই। কাল ভোরে থানচির আরও গভীরে যাওয়ার কথা। সেখানে কেমন শীত কে জানে । গান শেষ হতেই রিয়া বলল, রবীন্দ্রনাথের জন্য হলেও অবাঙালিদের বাংলা শেখা উচিত। আমাদের যেমন ইংরেজি শিখতে হয় প্রয়োজনে, ঠিক তেমনি হৃদয়ের টানেই অবাঙালিদের বাংলা শেখা উচিত। রবীন্দ্রনাথের গান আত্মার ভাষা। অন্তরের ভাষা।
রাজীব জাপানে থাকে। ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ করছে। ও বলল, হ্যাঁ। জাপানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেক দিন ধরে ভীষন আগ্রহ । ওখানে অনেকে বাংলা জানে। অবশ্য বেশির ভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
না। আমি বলছি সাধারন মানুষের কথা। রিয়া বলল।
রাজীব বলল, হ্যাঁ, বুঝেছি। সাধারন বিদেশিদের বাংলা শেখা উচিত। অন্তত রবীন্দ্রনাথের গান বোঝার জন্যই।
তবে একেক কালচার একেকরকম -তারা কীভাবে নেবে ব্যাপারটা। শামসের কন্ঠে সংশয় ফুটে ওঠে।
আফসানা বলল, আমার মাথায় একটা আইডিয়া এল।
কী আইডিয়া?
আফসানা বলল, আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে গানটা বিশ্বসংগীত করলে কেমন হয়?
রিয়া জিজ্ঞেস করল, বিশ্বসংগীত? মানে?
আফসানা বলল, বিশ্বসংগীত মানে বিশ্বসংগীত । যেমন প্রত্যেক দেশে জাতীয় সংগীত আছে। বিশেষ সময়ে গাওয়া হয়। তেমনি আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে গানটা হবে জাতিসংঘের সংগীত। বিশ্বসংগীত। যে কোনও আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে সবাই সব জাতি গাইবে।
রাজীব শিস দিয়ে উঠে বলল, আইডিয়া মন্দ না।
আফসানা বলল, থ্যাঙ্কস। আফসানা পরেছে ধূসর রঙের কোট। পকেট থেকে চকলেট বের করে বিলাতে লাগল। শামস বলল, আইডিয়া ভালো। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল প্রস্তাবটি জাতিসংঘ মেনে নেবে কিনা।
রিয়া বলল, মেনে নেওয়ার জন্য আমরা ... মানে বাঙালিরা বিশ্বজুড়ে ক্যাম্পেইন করব। মানববন্ধন করব। সংশ্লিস্ট মহলে চিঠি দেব।
রাজীব বলল, হ্যাঁ। এমন একটি মহৎ উদ্যেগের জন্য ক্যাম্পেইন করাই যায়।
শামস বলল, হ্যাঁ। রবীন্দ্রনাথের আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে গানটা বিশ্বসংগীত হওয়াই উচিৎ। কোপেনহেনে বিশ্ব জলবায়ূ সম্মেলন হয়ে গেল। সেখানে গানটা গাওয়া উচিত ছিল। কল্পনা কর, ওবামা আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে গানটা গাইছেন।
শামস চকলেট মুখে ভরে বলল। নাম্বার ওয়ান, আমরা অবিলম্বে একটি ওয়েব সাইট খুলব। নাম্বার টু, ইংরেজিসহ প্রতিটি ভাষায় গানটা ট্রান্সলেইট করব। নাম্বার থ্রি, তারপর ওয়াল্ড ওয়াইড প্রচারে নামব।
রাজীব বলল, দ্যাটস ফাইন্যাল।
সিগারেট ধরিয়ে আফসানা বলল, ভীষন জোশ পাচ্ছি মিলি। গানটা তুই পুরোটা আরেকবার গা।
রাজীব গিটার তুলে নেয়। মিলি এতক্ষণ মন দিয়ে ওদের কথা শুনছিল। বিষাদ কেটে যাচ্ছিল। এবার গানটা গাইতে লাগল।


আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।
মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে,
বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে।
গ্রহতারক চন্দ্রতপন ব্যাকুল দ্রুত বেগে
করিছে পান, করিছে স্নান, অক্ষয় কিরণে।
ধরণী’পর ঝরে নির্ঝর, মোহন মধু শোভা
ফুলপল্লব-গীতগন্ধ-সুন্দর-বরনে।
বহে জীবন রজনীদিন চিরনূতনধারা,
করুণা তব অবিশ্রাম জনমে মরণে।
স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি কোমল করে প্রাণ,
কত সান্ত্বন করো বর্ষণ সন্তাপহরণে।
জগতে তব কী মহোৎসব, বন্দন করে বিশ্ব
শ্রীসম্পদ ভূমাস্পদ নির্ভয়শরণে।

গান শেষ হলে গভীর নীরবতা নেমে আসে। গানের কথাগুলি রিয়ার ভিতরে আশ্চর্য এক অদৃশ্য তরঙ্গ তুলতে থাকে। রিয়া ভাবে: কেমন আদিম স্পর্শ গানের শরীরে; গান তো নয় যেন সংগীত। আদিম অরণ্যের প্রাচীন পুরোহিতের প্রার্থনাসংগীত। এমন মহান বাণী, এমন ভাবগম্ভীর সুর - কেন বুঝবে না অবাঙালিরা। অসহ্য এক অনুভূতি গুমরে ওঠে রিয়ার মনে। বিশ্ববাসী গানটি গ্রহন করলে বাঙালির সুমহান কীর্তি যেন উপলব্দি করতে পারবে- উপলব্দি করতে পারবে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি সাধকের অনুভূতির গভীরতা।
শামস গম্ভীর কন্ঠে বলল, গানটা অতি অবশ্য সভ্যতার বিশ্বসংগীত হওয়া উচিৎ। কেবলি গডের প্রশস্তি নেই। মায়ামমতার কথাও রয়েছে। এ গান সম্বন্ধে বিশ্বের প্রতিটি জাতির স্পস্ট ধারণা থাকা উচিত। গানটি সবারই গাওয়া উচিত । আমি সিডনি ফিরেই প্রবাসী বাঙালিদের মিটিং ডাকছি।
রাজীব বলল, সবই ঠিক আছে। কিন্তু, এখন প্রশ্ন হল অন্য কালচারের লোকজন প্রস্তাবটি মেনে নেবে কি না।
রিয়া বলল, সহজে মানবে না। ওয়াল্ড ওয়াইড হেভি ক্যাম্পেইন করতে হবে। কলকাতায় অনীশ আর দীপাবলীকে কালই ফোন করব।
এখনই কর না, রাত বেশি হয় নি। মাত্র সাড়ে দশটা বাজে। রাজীব বলল।
নেট ওয়ার্ক নেই রে। আর আমার মোবাইল চার্যে। রিয়া বলল। ও শান্তিনিকেতনে পড়ত। তখনই
টালীগঞ্জের অনীশ আর দীপাবলীর সঙ্গে ঘনিষ্টতা। নেটের কল্যাণে সম্পর্কটা এখনও টিকে আছে। আফসানা বলল, ফেসবুকে গ্রুপ খুলতে হবে। আফসানা নেটওয়ার্কিং নিয়ে কাজ করছে সিডনিতে।
এতক্ষণে মিলি বলল, তোমাদের প্রস্তাব ভালো লাগছে। মিলি চট্টগ্রামে একটা স্কুলে পড়ায়। মায়ের সঙ্গে থাকে কাজিরদেউরী। আগে মুরাদপুর থাকত। সে ঘর দু’বছর হল ভেঙ্গে গেছে।
ঘড়ির দিকে চেয়ে শামস চিৎকার করে উঠল। ওরে বাবা। এত রাত হয়ে গেছে। কাল আবার ভোরে উঠতে হবে। রিয়াও ঘড়ি দেখল। কাল সকালে হাতির পিঠে চেপে অরণ্যের আরও গভীরে যাওয়ার কথা। মারমা বুড়ো লুঙদির সঙ্গে কথা হয়েছে।
ঘরে ঢোকার আগে আফসানা বলল, রাজীব এর প্রপোজালটা নিয়ে একটু ভাবিস মিলি।
আমি কী ভাবব? মিলি হিসহিস করে ওঠে।
কি ভাবছি মানে! আফসানা চাপা গলায় বলে, তোর জীবনের কথা ভাববি।
মিলি শ্বাস টানে। মাথা টলছে ওর।
আফসানা এবার নরম সুরে বলে, মঞ্জুরুল ভাই ভালো একটা মানুষ। তোর কথা জানে। সব মেনে নিয়েছে। ঘরোয়া মেয়ে চায়। আর জাপান কী সুন্দর দেশ মিলি! না গেলে বিশ্বাস করবি না। আমারও প্রথম প্রথম ওদেশ ভলো লাগেনি। এখন ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছি।
আফসানা আরও কি কি সব বলল । মিলি ঘরে চলে আসে। মিলি একা থাকবে। রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বাঁচবে। ও জানে কেবল রবীন্দ্রনাথের গান নিয়েই একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়।
ঘরটায় আবছা অন্ধকার আর অ্যারোসেলের গন্ধ। জানালায় পূর্ণিমা রাতের রুপালি ধারা। মিলির ঘুম আসছিল না। দু’বছর ধরে ঘুম হয়ও না তেমন। লেপ সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়ে ও। তারপর স্লিপার পরে নেয়। শীত করছে। চাদরটা চেয়ারের ওপর রাখা । তুলে নেয়। ধীরে দরজা খোলে। করিডোরে অন্ধকার। অ্যারোসেলের গন্ধ ছড়ানো। দুপাশে বন্ধ দরজা। রিয়া আর শামসের ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। দরজায় কান পাতে না। আরেকটা ঘরের ভিতরে আফসানা রাজীবকে আঁকড়ে ধরে আছে। ও দিকে আর গেল না মিলি। বরং বারান্দায় চলে আসে। জামিল জামিল। তুমি কোথায়? বারান্দায় এসে দাঁড়াল মিলি। সাদা শঙ্খের রঙের মতন নিঝুম রাতের আলো । চাঁদের আলো আর শীত। বাতাস থমকে আছে। রাজীবকে আঁকড়ে ধরে ঘুমুচ্ছে আফসানা । আমি বেঁচে থাকব কেন? ঐ নিচের হ্রদে ঝাঁপিয়ে পড়িনা কেন? ভাবতেই রাতের ফুলের মিষ্টি সুবাস পেল মিলি। সিঁড়ি ভেঙ্গে বাগানে নামল ও। ঠিক তখনই আকাশপথে চি চি চি চি করে কী এক পাখি উড়ে গেল আরও গভীর পাহাড় অরণ্যে দিকে। মিলি ম্লান হাসে। ঈশ্বর এখন কলকাঠি নাড়তে শুরু করেছেন। ফুলের গন্ধ শোঁকালেন। রাতচরা পাখি পাঠালেন। আরও কত কী করবেন তিনি! বাগান পেরিয়ে গেলেই নীলাভ জলের বিস্তীর্ণ হ্রদটি । কিনারে একটা দীর্ঘ ইউক্যালিপটাস গাছ। মিলি ও দিকে যেতে থাকে। হ্রদটি নিঝুম হয়ে আছে। আকাশে তখনও কুয়াশার পুরু চাদর, তাতে শুভ্র আলোর ঢল আটকে রাখতে পারছে না। রাত এখন কত? চরাচর শুনশান হয়ে আছে। হ্রদের জলে টলটলে পূর্ণিমার ধারা। জলে পরিপূর্ন বৃত্তাকার চাঁদের প্রতিফলন।
কে যেন ওপাশে দাঁড়িয়ে।
কে?
ওহ! ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার; মারমা বুড়ো লুঙদি। দিনের আলোয় দেখেছে মিলি বুড়োকে। তামাটে বর্ণের দীর্ঘদেহী বুড়োটির মাথায় সাদা শনের মতন পাকা চুল; চোখ দুটি ঘোলাটে । মিলি এগিয়ে যায়। মিলিকে দেখতে পেয়েও মারমা বুড়ো লুঙদি চমকে ওঠে না। ওরা পাশাপাশি দাঁড়ায়। দুজনের ছায়া পড়েছে শিশিরভেজা ঘাসের ওপর। মারমা বুড়ো লুঙদি এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? লোকটারও কি আমার মতো রাতে ঘুম আসে না? কেন? কি দুঃখ তার? সে কি নিঃসঙ্গ? আমার মত কাউকে হারিয়েছে লুঙদি? লুঙদি কি তার সুখদুঃখের কথা বলবে? তা কি করে হয়? লুঙদি তো কেবল প্রয়োজনীয় কথাগুলিই বাংলায় বলতে পারে। তার সুখদুঃখের কথাগুলি মনে হয় মারমা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় বলতে পারে । মিলি তো মারমা ভাষা জানে না। তা হলে? মিলি ওর একান্ত দুঃখ-কষ্টের কথাটি মারমা বুড়ো লুঙদি কে বলতে চায়। বাংলায়। মিলির সুখদুঃখের কথাগুলি আর ওর মা আর বন্ধুরা শুনতে চায় না। ওরা কেবল বলে: ভুলে যা মিলি, ভুলে যা। নতুন করে জীবন শুরু কর। জামিল মিলির প্রতি উদাসী হলে মিলি ঠিকই জামিলকে ভুলে যেত। কিন্তু জামিলের পুরুষসত্ত্বায় কী এক অলৌকিক কারণে মিশে ছিল আশ্চর্য এক নারীহৃদয়। মিলিকে সে গভীরভাবে বুঝতে পারত। রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চার কারণেই কি না কে জানে-যৌন সম্পর্কে কিশোরী বয়েস থেকেই ভয় পেত মিলি-জামিল সে ভয় ভেঙ্গে দিয়েছিল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়ের সঙ্গে বিছানায় শুয়ে যে যা-খুশি-তাই করা যায় না-জামিল কীভাবে যেন সেটা জানত। যৌনসম্ভোগের আগে ও পরে, শীৎকারের সময় আশ্চর্য সংযত ছিল জামিল। ভালোবাসত রবীন্দ্রনাথের গান। আরও অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ে জামিল ছিল অন্য অনেক পুরুষের চেয়ে অনেকই অন্যরকম। মিলি যত ওর পরিচিত মেয়েদের কাছ থেকে বিবাহিত জীবনের ভয়ানক সব রিপোর্ট পাচ্ছিল, তত জামিলকে বেশি ভালো লাগছিল ওর । সেই জামিল হারিয়ে গেল। হায়। প্রিয়তমের ভ্রুন ধারণ করেছিল গর্ভে। প্রবল শোকের দহনে গর্ভপাত হয়ে গিয়েছিল। হায়। মিলি লুঙদির দিকে তাকাল। সুপ্রাচীন এক নির্বাক মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে হ্রদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বৃদ্ধ। কী যেন খুঁজছে। কি খুঁজছে লুঙদি? মারমা বৃদ্ধটির চোখ দুটি বোঝা না গেলেও বৃদ্ধের চৌকো মুখখানি চাঁদের আলোয় অনেকখানিই স্পস্ট। মিলি শ্বাস টানে। ডিসিসন নেয়। মিলি লুঙদি কে বলবে (বাংলায়) ২ বছর আগে ঠিক কি হয়েছিল । জানেন, জামিল একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে চাকরি করত; একবার, দু-বছর আগে। ব্যাঙ্কার্স ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হবে। ওও খেলবে। তখনও বুঝিনি। ওর খেলাটা ঠিক হয়নি। ফিল্ডিং করার সময় বাউন্ডারির দিকে দৌড়ে যাবার সময় মাঠের ওপর ঢলে পড়ল। জীবন এমন ফানি। জামিল খুব সিগারেট খেত। মাঠের ওপর পড়ে রইল আমার স্বামী। আমি গ্যালারিতে বসে। তখনও বুঝিনি। মাঝে মাঝে ফান করত জামিল। আমি ভাবলাম সেরকম। পরে অ্যাম্বুলেন্স এল ...
লুঙদি চুপ করে থাকে। হাত বাড়ায়। মিলির মাথায় চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। যেন আপন কন্যাকে আদর করছে। মিলি কাঁদে। কাঁদতেই থাকে । লুঙদি চুপ করে থাকে।
আকাশপথে চি চি চি চি করে কী এক পাখি উড়ে যায় আরও গভীর পাহাড় অরণ্যে দিকে।
জ্যোস্নারা গাঢ় হয়ে ওঠে।
এইসব পার্বত্য নিথর প্রকৃতি
যেন দুলে ওঠে
ক্ষণিকের
জন্য।
অনেকক্ষণ পর মিলি কেঁদে কেঁদে শান্ত হল। কেঁদে কেঁদে বুকের ভার নামাল। ও জানে আর ওকে দুঃখ স্পর্শ করবে না। ও জানে ও আর মর্মাহত হবে না। এক আদিবাসী বৃদ্ধর স্পর্শ পেয়েছে। আদিম স্পর্শ। এখন ওর নতুন জীবন শুরু হবে। মঞ্জুরুল। রাজীবের কলিগ। মঞ্জুরুলও ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ করছে । দারুন দাবারু নাকি মঞ্জুরুলও আর বেশ রসিক। আফসানা বলে, তোর জীবন সুখে আর হাসিতে ভরিয়ে রাখবে মঞ্জুরুল ভাই। দেখিস। তুই এত সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গাস মিলি। মঞ্জুরুল ভাই আবার রবীন্দ্রসংগীতের ভীষণ পোকা। বলে হি হি করে হেসে উঠেছিল আফসানা। মিলির ভয় কাটে না। আসলে মঞ্জুরুল লোকটা কেমন কে জানে? জামিলের মতো কি? সে কি সম্ভব? কী এক অলৌকিক জামিলের পুরুষসত্ত্বায় মিশে ছিল আশ্চর্য এক নারীহৃদয়। মঞ্জুরুল জামিলের মতো কি? মঞ্জুরুল রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত; কিন্তু, রবীন্দ্রভক্তিই যে সব না। শিরিন আপার বর নাজমূল দুলাভাইও তো রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত; শিরিন আপা সুইসাইড করার আগ পর্যন্ত নাজমূল দুলাভাই নিয়মিত রেপ করত শিরিন আপাকে ...
আকাশপথে চি চি চি চি করে কী এক পাখি উড়ে যায় আরও গভীর পাহাড় অরণ্যে দিকে।
থানচি উপজেলার নিভৃত পাহাড়ি পল্লীতে পৌষ-রাতের চাঁদের আলো আরও গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠতে থাকে। লুঙদির মারমার বুকে মাথা রাখে মিলি। যেন লুঙদি মারমা এক পরম শান্তিদাতা। আদিপিতা। যেন লুঙদি মারমা এক দূর্গা মা: যে তার সান্ত্বনার সমস্ত রকম নীরব ভাষা নিয়ে অরণ্য পাহাড়ের মর্মমূলে মিলির অপেক্ষায় ছিল । মিলি আদিম স্পর্শ পায়। এবং ফিসফিস করে বলে, আমিও আদিবাসী, পিতা। আমিও শ্বাশত। এবং শেষাবধি তুমি আর আমি রয়ে যাব।
লুঙদি কিছু বুঝল কি? নৈলে সে মাথা নাড়বে কেন? তার চোখে জল কেন? সম্ভবত লুঙদির এক পুত্র ছিল । সেই পুত্রের নাম ছিল তাঙদেঙ। এবং লালমতি হ্রদে বহুকাল আগে নিমজ্জ্বিত হয়েছিল তাঙদেঙ । হয়তো বা বালক তাঙদেঙ এরকম পৌষের জোছনারাতে উঠে আসে। নাঃ, আজ আর তাঙদেঙ উঠে এল না। কিংবা নবরুপে তাঙদেঙ ফিরে এসেছে। লুঙদির জীবনের সময় ফুরিয়ে এল। মাস দুয়ের ধরে এক ধরনের ঘড়ঘড়ে কাশি হচ্ছে তার। আগামী বছর অবধি বেঁচে থাকবে কি না কে জানে। এ জন্য লুঙদির বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। সে এক উজ্জ্বল কন্যাকে পেয়ে গেছে। যে কন্যা দূরের এক সমৃদ্ধশালী নগরে বাস করে । যে কন্যাটি নগরে বাস করেও গভীর সংবেদী ও নির্মল রয়ে গেছে।
সে তার এই কন্যার নাম দিল লালমতি।
তারপর সময় আরও গড়ালে লালমতি গাইতে থাকে-

মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে,
বিশ্বজগত মণিভূষণ বেষ্টিত চরণে।
আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।

মারমা বুড়ো লুঙদি শব্দহীন এই রাতের আলোয় খুব কাছ থেকে কান পেতে শুনতে থাকে সে অপার্থিব সংগীত। কেমন এক আদিম স্পর্শ জড়িয়ে থাকা গানটির রচয়িতা যা যা বলতে চেয়েছেন সে সব কথা আপন কন্যার ভাষায় যেন সে ঠিকই বুঝে নিতে পারে ...
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×