somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নজরুলের একটি কৃষ্ণবাদী গান

৩০ শে জুন, ২০১০ সকাল ৯:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


জীবদ্দশায় কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা সম্পন্ন একজন আলোকিত সুন্দর মানুষ, যে কারণে তার পক্ষে মথুরা-বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে কাওয়ালী ঢংয়ে গান কম্পোজ করা সম্ভব হয়েছে। সেই আশ্চর্য গতিশীল গানটি আমরা অনেকেই শুনেছি ... ‘এল নন্দের নন্দন নবঘনশ্যাম/ এল যশোদা নয়নমনি নয়নাভিরাম / প্রেম রাধার মন নব বঙ্কিম ঠাম/ চির রাখাল গোকূলে এল ... কৃষ্ণজী কৃষ্ণজী কৃষ্ণজী কৃষ্ণজী ’ ...এবং এই ‘ কৃষ্ণজী’, ‘ কৃষ্ণজী’-এই কোরসটি অনেকটা কাওয়ালী ঢংয়ের। ইসলামের নবীকে নিয়ে নজরুল যেমন কাওয়ালী ঢংয়ে গেয়েছেন, ‘সে যে আমার কামলিওয়ালা, কামলিওয়ালা’ ... সেই রকমই কৃষ্ণকে নিয়ে গেয়েছেন: ‘কৃষ্ণজী’, ‘কৃষ্ণজী’, ‘কৃষ্ণজী’, ‘কৃষ্ণজী’ এবং নজরুলের কৃষ্ণবাদী এ আবেগ আরোপিত নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ত ও সত্য। কেননা নজরুলের স্পর্শকাতর মানস বহু বর্ণিল ভারতীয় ঐতিহ্যে লালিত। হাজার বছর ধরে ভারতীয় সংস্কৃতি মূলত বহুস্রোতে বহমান। জীবনভর তাঁর গানে, তাঁর কবিতায় নজরুল এই বহুমাত্রিক বিচিত্র জীবনধারাকে মেলানোর সাধনা করেছেন । গানেও নজরুল সে প্রমাণই দিয়েছেন। যেমন, কাওয়ালী মূলত মুসলমানী সংগীত রীতির একটি ধারা, সেই কাওয়ালী ঢংয়ে মথুরা-বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে নজরুল গান বেঁধেছেন: শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে গভীর আবেগ ব্যক্ত করেছেন এবং এভাবে রেখে গেছেন অসাম্প্রদায়িক পথে হাঁটবার ইঙ্গিত ...

কৃষ্ণকে নিয়ে রচিত গানকে সাধারনত শ্যামাসংগীত বলে। কেননা, শ্যাম=শ্যামা। কৃষ্ণর গাত্রবর্ণ মহাকালের রং (কৃষ্ণ)। যা হোক। আমরা এ কালে শ্যামাসংগীত কে কৃষ্ণবাদী গান বলেও চিহ্নিত করতে পারি।

আলোচ্য গানটির কথা:

তিমির-বিদারী অলখ-বিহারী
কৃষ্ণ মুরারী আগত ঐ
টুটিল আগল, নিখিল পাগল
সর্বসহা আজি সর্বজয়ী।
বহিছে উজান অশ্রু-যমুনায়
হৃদি-বৃন্দাবনে আনন্দ ডাকে, ‘আয়,’
বসুধা যশোদার স্নেহধার উথলায়
কাল্-রাখাল নাচে থৈ-তা-থৈ।।
বিশ্ব ভরি’ ওঠে স্তব নমো নমঃ
অরির পুরী-মাঝে এলো অরিন্দম।
ঘিরিয়া দ্বার বৃথা জাগে প্রহরী জন
কারার মাঝে এলো বন্ধ-বিমোচন,
ধরি’ অজানা রূপ আসিল অনাগত
জাগিয়া ব্যথাহত ডাকে, মাভৈঃ।।


প্রথমেই কৃষ্ণর সংজ্ঞা নির্ধারন করেছেন। কৃষ্ণ, যিনি অন্ধকার দূর করেন, অদৃশ্যে বিচরণ করেন। তবে তাঁর হাতে একটি বাঁশী রয়েছে। নজরুলও বাঁশী বাজাতেন। যিনি অন্ধকার দূর করেন এবং অদৃশ্যে বিচরণ করেন তার সঙ্গে সাধারন মানুষের দূরত্ব তৈরি হতে পারে; তবে, তাঁর হাতে একটি বাঁশী কাছাকাছি চলে আসেন। কৃষ্ণকে নজরুল বলেছেন, কালো রাখাল। যা হোক। যিনি অন্ধকার দূর করেন, যিনি অদৃশ্যে বিচরণ করেন-সেই ‘কৃষ্ণ-মুরারী’ আসছেন। তাতে কি হবে। তাতে, অর্গল টুটে যাবে। এ জন্যই ‘নিখিল’ বিশ্ব পাগল হয়ে অপেক্ষায় রয়েছে।


তিমির-বিদারী অলখ-বিহারী
কৃষ্ণ মুরারী আগত ঐ
টুটিল আগল, নিখিল পাগল
সর্বসহা আজি সর্বজয়ী।

সর্বসহা আজি সর্বজয়ী। যারা সহ্য করে তারা সর্বজয়ী হবে। কবি কৃষ্ণর জীবনের ভবিষ্যৎবানী করছেন। কৃষ্ণ, বিষ্ণুর অস্টম অবতাররুপে উত্তরভারতের মথুরা দেবকী-বসুদেবের ঘরে জন্মাবেন। মথুরার রাজা কংস মূতিমার্ন স্বৈরাচারী। স্বীয় পিতা উগ্রসেনকে কারাগারে আটক করে রেখেছেন। কংস সম্পর্কে কৃষ্ণর মাতুল। কংস জানতে পারে ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ সুতরাং কংস মথুরা শিশুহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়।শিশু কৃষ্ণকে তখন গোকুলে নন্দ-যশোদার ঘরে রেখে আসেন। ছোট্ট এক শিশুর কত বিড়ম্বনা! যে কারণে নজরুল লিখেছেন: ‘ সর্বসহা আজি সর্বজয়ী।’

এবার নন্দ-যশোদার ঘরে ও গোকুলে কৃষ্ণর জন্ম ও বেড়ে ওঠা প্রসঙ্গে নজরুল:

বহিছে উজান অশ্রু-যমুনায়
হৃদি-বৃন্দাবনে আনন্দ ডাকে, ‘আয়,’
বসুধা যশোদার স্নেহধার উথলায়
কাল্-রাখাল নাচে থৈ-তা-থৈ।।

‘বহিছে উজান অশ্রু-যমুনায়’ অসম্ভব সুন্দর একটি রুপকাশ্রয়ী চরণ। কিন্তু ‘ অশ্রু-যমুনায়’ কেন? শ্রীকৃষ্ণের জন্ম যমুনাপাড়ের মথুরায়। তারই জন্মসংবাদে যমুনায় উজানে আনন্দের অশ্র“ বইছে। এবং-

হৃদি-বৃন্দাবনে আনন্দ ডাকে, ‘আয়,’

কৃষ্ণর পালক-মাতা যশোদা। যশোদা শব্দের আগে ‘বসুধা’ শব্দটির প্রয়োগ লক্ষনীয়। বসুধা মানে পৃথিবী। কবি কি যশোদাকে পৃথিবী বলছেন? মাতৃস্নেহে কৃষ্ণকে লালন করেছিলেন বলে? তাহলে কৃষ্ণ =মানবতা বা মানবকূল। সেই মা-পৃথিবী গোপাল (বালক কৃষ্ণ) কে লালন করেছেন। সেই চরণটি স্মরণ করি: ‘সর্বসহা আজি সর্বজয়ী।’ সর্বসহা মা-পৃথিবী যশোদা বালক কৃষ্ণ কে লালন করে সর্বজয়ী হয়েছেন। কিংবা আমাদের প্রতি এটি নজরুলের উপদেশ। যারা সহ্য করে তারা সর্বজয়ী হবে।
যাক। যমুনাপাড়ের গোকুলে বালক কৃষ্ণ গোপাল গরু নিয়ে মাঠে যেত। দিনভর নেচে গেয়ে খেলে বেড়াত। সেই অভূতপূর্ব দৃশ্যের বর্ননায় নজরুল লিখেছেন একটি মনোরম চরণ:

কাল্-রাখাল নাচে থৈ-তা-থৈ।।

কাল্-রাখাল=কালো রাখাল। কৃষ্ণকে কালো রাখাল বলা একমাত্র নজরুলের পক্ষেই সম্ভব। কালো রাখাল বলায় কৃষ্ণ আরও প্রাণের কাছাকাছি চলে এল এরপর নজরুল বলছেন:

বিশ্ব ভরি’ ওঠে স্তব নমো নমঃ
অরির পুরী-মাঝে এলো অরিন্দম।

এমন বিরাটের আগমনে বিশ্ব ভরে উঠছে স্তবে, বন্দনায়।

অরির পুরী-মাঝে এলো অরিন্দম। (এই লাইনটির মানে বোঝা গেল না! অর্থ কিন্তু বোঝা গেল ...অন্ধকার রাজ্যে সুন্দর আলোকিত মানুষ এসেছেন ...)

স্বৈরাচারী মথুরারাজ কংসের কারাগারে কৃষ্ণের মাতা-পিতা দেবকী-বসুদেবকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সে প্রসঙ্গে নজরুল লিখেছেন:

ঘিরিয়া দ্বার বৃথা জাগে প্রহরী জন
কারার মাঝে এলো বন্ধ-বিমোচন,
ধরি’ অজানা রূপ আসিল অনাগত
জাগিয়া ব্যথাহত ডাকে, মাভৈঃ।।

কৃষ্ণ আসলে মুক্তির প্রতীক। মানবতার প্রতীক। এবং মানবতার মুক্তি অনিবার্য। নজরুলের এই কৃষ্ণবাদী গান সে কথাই যেন ফুটে উঠেছে। মানবতার সেই অনিবার্য মুক্তি অর্জনের পথে নজরুল একটি যাদুবাক্য আমাদের মনে রাখতে হবে : ‘সর্বসহা আজি সর্বজয়ী ...



তিমির-বিদারী অলখ-বিহারী গানটির ডাউনলোড লিঙ্ক ...

http://www.mediafire.com/?5lzqiu2fzjl
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুন, ২০১০ সকাল ৯:৫১
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×