somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিচেন ইটজা: মায়া সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
ইউরোপীয়দের আগমনের পূর্বে দক্ষিণ আমেরিকায় মায়া সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল । সভ্যতাটি প্রায় ২০০০ বছর ধরে মেক্সিকো, গুয়েতেমালা, বেলিজ, এল সালভাদর এবং পশ্চিম হন্ডুরাসে গড়ে উঠেছিল। মায়া সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পাথরের পিরামিড, উপাসনালয়, ভাস্কর্য, লিখন পদ্ধতি বা হায়ারোগ্লিফিক । এ ছাড়া গণিত এবং জ্যোর্তিবিজ্ঞানে মায়ারা অনেক উন্নত ছিল। তবে মায়ারা কখনোই একটি অখন্ড সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। কতগুলি স্বাধীন নগররাষ্ট্র নিয়ে মায়া সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। অবশ্য এইসব নগররাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ট যোগাযোগ ও গভীর ঐক্য বিদ্যমান ছিল। এবং এই ঐক্যের ভিত্তি ছিল ধর্ম। আমাদের মনে রাখতে হবে, মায়া নগরমাত্রই ছিল ধর্ম-নগর। কেননা, মায়ারা গভীরভাবে নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করে এবং সেই নকশা অনুযায়ী নগরী স্থাপন করত। পালানকুয়ে, উক্সমাল, তিকাল এবং কোপান ইত্যাদি নগরগুলির নির্মাণ নাক্ষত্রিক নকশা অনুযায়ী হয়েছিল। চিচেন ইটজা ছিল মায়া সভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র ।




মেক্সিকোর মানচিত্রে চিচেন ইটজার অবস্থান। মেক্সিকোর দক্ষিণে ইউকাটন উপসাগরে। মায়ারা আজও সেখানে বাস করে। বর্তমানে এদের সংখ্যা প্রায় ষাট লক্ষের মত। এরা বিভিন্ন মায়া উপভাষায় কথা বলে। মায়া নগরে খনন কার্য চালানো হয়েছে। এখনও খনন কাজ চলছে।


গবেষকদের মতে, অস্টম শতকে মেক্সিকোর ইউকাটন উপসাগরে সমুদ্র পথে একটি গোত্রের আগমন ঘটেছিল। এরা ছিল মায়াদের ইটজা গোত্র। এ প্রসঙ্গে একজন ঐতিহাসিক লিখেছেন, It is believed that "Itza" derives from the Maya itz, meaning "magic," and (h)á, meaning "water;" Itzá means: "Water Magicians.ইটজারা ছিল মূলত merchant warriors বা বণিক যোদ্ধা। এরাই ইউকাটন উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলে চিচেন ইটজার ভিত গড়ে তুলেছিল।




চিচেন ইটজার মানচিত্র।


মেক্সিকোর ওই দক্ষিণ অঞ্চলটি বরাবরই ছিল শুস্ক। তবে মেক্সিকোর ওই দক্ষিণ অঞ্চলটি তে ছিল ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক খাল। খালের মুখকে cenote বলে। পানি ব্যতীত সভ্যতা গড়ে ওঠা সম্ভব নয় বলেই দুটি প্রাকৃতিক কুয়ার মুখের মাঝখানে গড়ে উঠেছিল চিচেন ইটজা। আর একারণেই চিচেন ইটজার অর্থ ‘ইটজা কুয়ার মুখ’। কুয়াকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল (ইটজা ) মায়াদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবন।



ভূগর্ভস্থ খালের মুখ বা cenote ... মায়াদের বৃষ্টির দেবতা ছিল চাক। দেবতা চাক- এর উদ্দেশ্যে মায়ারা মানুষসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপকরণ কুয়ায় নিক্ষেপ করত। প্রত্নতাত্ত্বিকগণ কুয়ার ভিতর থেকে মৃৎপাত্র, স্বর্ণ ও রৌপ্যের তৈজষপত্র ও কঙ্কাল আবিস্কার করেছে।



ভূগর্ভস্থ কুয়া হল পাতালের প্রবেশ মুখ- মায়ারা এমনই মনে করত; তারা ভাবত দেবতা চাক- এর আর্শীবাদ পেলেই তবে পাতালে যাওয়া সম্ভব।


অস্টম শতকে যাত্রা শুরু করে প্রায় ৩ স্কয়ার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা চিচেন ইটজার অগ্রগতি অব্যাহত ছিল ১২০০ শতক অবধি। আজ অবশ্য অঞ্চলটিতে ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছুই নেই। আজও দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা মধ্যযুগীয় মায়া সভ্যতার পিরামিড, ধর্মীয় মঠ, পবিত্র কুয়া, টেম্পল অভ দি ওয়ারিয়রস, কারাকল বা গোল স্তম্ভ দেখে অভিভূত হয়ে পড়ে ।



কুকুলকান পিরামিড। সম্ভবত এটিই চিচেন ইটজা সবচে আকর্ষণীয় কাঠামো। এটি El Castillo নামেও পরিচিত। El Castillo মানে দূর্গ। মায়াদের কুকুলকান পিরামিড কে স্প্যানিশরা দূর্গ ভেবেছিল। ভুল ভেবেছিল। আসলে এটি মায়াদের উপাসনালয়।



২০০৭ সালের ৭ জুলাই El Castillo কে পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি বলে চিহ্নিত করা হয়।


কুকুলকান হল ডানাওয়ালা সরীসৃপ। এটি ইটজা গোত্রের সর্পদেবতা। কুকুলকান উপাসনা ছিল (ইটজা ) মায়াদের রাষ্ট্রধর্ম। রাজনৈতিক ও বানিজ্যিক স্থিতিশীলতার উদ্দেশ্য মায়ারা কুকুলকান কে কেন্দ্র করে ঐকবদ্ধ হয়েছিল। এতে করে মায়াসমাজের শ্রেণিগত ভারসাম্যটিও রক্ষা পেয়েছিল।



কুকুলকান পিরামিড এর সিঁড়ির গোড়ায় ইটজা গোত্রের সর্পদেবতা কুকুলকান। মায়ারা কুকুলকান কে মনে করত রাজা এবং দেবতার দূত।


সর্পদেবতা কুকুলকান - এর উপাসনার জন্য মায়ারা নবম ও দ্বাদশ শতকের মাঝামাঝি এক একর জায়গার ওপর ১০০ ফুট উচ্চতার পিরামিডসদৃশ একটি উপাসনালয় নির্মাণ করে। পিরামিডের চার দিকে ৯১ ধাপের সিঁড়ি। আর ওপরে ওঠার জন্য আরও একটি ধাপ । সব মিলিয়ে ৩৬৫!



বসন্ত কালে (অর্থাৎ, সূর্যের বিষুবরেখা অতিক্রমের কালে) যখন দিন ও রাত্রি সমান হয় তখন সূর্যের আলো পিরামিডের ওপর পড়ে যে ছায়ার সৃষ্টি হয় তাতে মনে হয় যে পিরামিডের সিঁড়ি বেয়ে একটি সরীসৃপ নামছে।




বল খেলার মাঠ বা বল কোর্ট।


খেলাধুলা ছিল মায়াসমাজের ধর্মীয় কৃত্যের অন্তর্গত। তবুও এটি ছিল অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম । মায়ারা, বিশেষ করে, বল খেলত। চিচেন ইটজায় এরকম একটি বলকোর্ট আবিস্কৃত হয়েছে। বলের মাঠ বা বলকোর্ট-এর অবস্থান ৩০ ফুট পুরু এবং ২৭৪ ফুট দীর্ঘ দুটি সমান্তরাল দেওয়ালের মাঝখানে । আর দুটি দেয়ালের মধ্য দূরত্ব ১২০ ফুট । মাঝখানে একটি পাথরের রিং। খেলার সময় রিংয়ের ভিতর দিয়ে বল গলাতে হত।



বল খেলা দেখতেন স্বয়ং মায়া রাজা।


খেলার শেষে পরাজিত দলের দলনায়ক বিজিত দলের অধিপতির শিরচ্ছেদ করত। বিষয়টি আমাদের কাছে অদ্ভুত মনে হলেও মায়াসমাজে এটি ছিল অতি সম্মানজনক। কারণ? বিজয়ী দলের অধিপতি সরাসরি স্বর্গে যাবে। এমনি তে স্বর্গে যাওয়া অত সহজ নয়। গুনে গুনে ১৩টি দুঃসাধ্য ধাপ পেরুতে হত।



টেম্পল অভ দ্য ওয়ারিওরস ।

চিচেন ইটজায় টেম্পল অভ দ্য ওয়ারিওরসটি বিশাল চারটে প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্মিত। প্ল্যাটফর্মের ওপরে রয়েছে সারিবদ্ধ ২০০টি গোলাকার ও চতুস্কোন স্তম্ভ।



চাক মুল।


এই ভাস্কর্যটি রয়েছে টেম্পল অভ দ্য ওয়ারিওরস এর সামনে। চিচেন ইটজায় এ রকম বারোটি ভাস্কর্য রয়েছে। তবে চাক মুল কে মায়াদের বৃষ্টির দেবতা চাক এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না।




কারাকোল। এটি মায়াদের মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। এটি ১০৫০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। আমরা জানি গণিত এবং জ্যোর্তিবিজ্ঞানে মায়ারা অনেক উন্নত ছিল।


১২০০ শতকের দিকে প্রতিপক্ষের আক্রমনে চিচেন ইটজা থেকে ইটজা মায়ারা উৎখাত হয়ে যায়। ইটজারা গুয়েতেমালায় চলে যায়। সেখানে কিছুকাল তারা পুরনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছিল। অবশ্য তাদের স্প্যানিশ আক্রমনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল । মায়ারা বিদেশি আক্রম প্রতিহত করেছিল। যেহেতু মায়াসমাজে নরবলির প্রচলন ছিল, অনেক স্প্যানিশ সৈন্য ও ধর্মযাজক নির্মম ভাবে প্রাণ হারায়। অবশেষে ১৬৯৭ সালে মায়ারা স্প্যানিয় শাসকদের কাছে আত্মসমপর্ন করে।



মেক্সিকোর মানচিত্রে প্লায়া দেল কামমেন- এর অবস্থান। চিচেন ইটজায় যেতে হলে প্রথমে প্লায়া দেল কামমেন-এ পৌঁছতে হবে। মেক্সিকোর এই শহরটি ক্যারেবিও সাগরের পাড়ে ...

(এই পোস্টে চিচেন ইটজা সম্বন্ধে সবটুকু বলা গেল না। পরবর্তী পর্বে আরও কিছু তথ্য ও ছবি সংযুক্ত করার ইচ্ছে রইল।)

ছবি: ইন্টারনেট।

তথ্য:

Click This Link
Click This Link
Click This Link
Click This Link
http://chichenitzafacts.com/


উৎসর্গ: রেজওয়ান মাহবুব তানিম
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:২৪
২৯টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×