somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সীরাত প্রবন্ধ : আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবদান।

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ১:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সীরাত প্রবন্ধ : আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবদান।
--বি.এইচ.মাহিনী
আদর্শ উত্তম চরিত্র ও মহানুভবতার এক মহা সমুদ্রের নাম রাসুলে আকরাম হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ সুরা আল কালাম, ৪। আমরা তাঁর ২৩ বছরের নবুওয়াতী জীবন সম্পর্কে যতই অধ্যায়ন করি ততই মনে হয় যেন আরো অনেক কিছুই অজানা রয়েছে। মানব জীবনের এমন কোন শাখা-প্রশাখা নেই যেখানে রাসুলে আকরাম সা. এর পদচারণা নেই। মহান আল্লাহ তা'আলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ সুরা আহযাব, ২১।
প্রায় দেড় হাজার বছর আগে জাহিলিয়্যাতের চরম সন্ধিক্ষণে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. পবিত্র মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তখন হত্যা, সন্ত্রাস, হিংসা-বিদ্বেষ, শোষণ-নির্যাতন, চুরি-ডাকাতি, যিনা-ব্যভিচার, সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি ইত্যাদি ছিল সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সামান্য কারণে তারা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হতো। সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত নিগৃহীত অধিকারবঞ্চিত ছিল নারীরা। দাস-দাসীর মৌলিক অধিকার ছিল না। অধিকাংশ লোকই মূর্তিপূজারী ছিল। রাসুলে আকরাম সা. চারিত্রিক মাধুর্য ও সৎকর্মের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তৎকালীন সমাজের অধঃপতিত মানুষদেরকে সোনার মানুষে পরিণত করেন। মানুষের বহুদিনের হাহাকার-আর্তনাদ এর অবলুপ্তি ঘটে। নারী-পুরুষ ফিরে পায় তাদের সত্যিকারের মানবিক মর্যাদা। চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় মানুষে-মানুষে দ্বন্দ্ব-কলহ, হত্যা, লুন্ঠন, ব্যাভিচার এবং একে অপরকে নির্মূল করার সকল জিঘাংসা। তিনি হলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, মানবসমাজের আদর্শ ন্যায়ের পথিকৃৎ এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রত্যক্ষ প্রতীক। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে তথা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি স্তরে তার আদর্শই একমাত্র আদর্শ। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা, রাজা-প্রজা, বাদশাহ-ফকির, মালিক-শ্রমিক সকল শ্রেণির মানুষের জন্য তিনি উত্তম আদর্শ। তাইতো বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক বার্টান্ড রাসেল ও মাইকেল এইচ হার্টসহ বিশ্বসেরা মনীষীগণ রাসুলে আকরাম সা. কে বিশ্ব মানবতার একমাত্র দিশারী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। রাসুলে আকরাম স. এর মহান আদর্শের পরিপূর্ণ অনুসরণ-অনুকরণ ব্যতীত হিদায়াতের আশা সুদূরপরাহত।
আদর্শ সমাজ :
আদর্শ সমাজ বলতে আমরা এককথায় ইসলামী সমাজকেই বুঝি। কেননা, ইসলামই আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। সূরা মায়েদা, ৩। মহান আল্লাহ তায়ালা ইসলামকে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মহানবী সা.কে রিসালাতের দায়িত্ব অর্পণ করেন। সুরা আস সফ, ৯। তাঁর আনুগত্য অবিকল আল্লাহর আনুগত্য। আলে-ইমরানের ৩১। প্রকৃত পক্ষে, রাসুলে আকরাম সা. এর নেতৃত্বে ইসলামের অভ্যুদয় ঘটে। ফলে জন্মলাভ করে মুসলিম সমাজের। মানুষের চরিত্র গঠন, সুবিচার প্রতিষ্ঠা, ইনসাফপূর্ণ একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিলো রাসুলে আকরাম সা. এর সুমহান লক্ষ্য। রাসুলে আকরাম সা. এর সময়ে মর্তের বুকে একটি স্বর্গীয় সোনালী সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়। খাদিজা আকতার রেজায়ী অনুদিত, আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী, আর রাহীকুল মাখতুম পৃষ্ঠা-১৫।
রাসুলে আকরাম সা. :
নৈতিকতা বিবর্জিত পাপ ও অপসংস্কৃতিতে জর্জরিত মানবসমাজে শান্তি ও মুক্তির বাণী নিয়ে ঐতিহাসিক হস্তি বাহিনীর ঘটনা সংঘঠিত হওয়ার বছর ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে ২০ এপ্রিল মোতাবেক ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুব্হে সাদিকের সময় আরবের হিজাজ অঞ্চলে বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন মানবতার মহান শিক্ষক হযরত মুহাম্মদ সা.। আকরাম ফারুক অনূদিত মানবতার বন্ধু মুহাম্মদ সা. (শতাব্দি প্র. ১৯৯৮) পৃষ্ঠা ৫৪৭।
জন্মের সাতদিন পর তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিব ‘আকিকা সম্পাদন করেন এবং নাম রাখেন মুহাম্মদ। শিবলী নোমানী সিরাতুন্নবী স. পৃ-৬৩। জন্মের অষ্টম দিন থেকে রাসুলে আকরাম সা. হযরত হালিমা সা’দিয়াহ রা. এর কোলে প্রতিপালিত হতে থাকেন। আকরাম ফারুক অনূদিত সিরাত ইবনে হিশাম পৃষ্ঠা ৪০। শিশু মুহাম্মাদের সা. পিতার নাম আব্দুল্লাহ, মাতার নাম আমিনা এবং দাদার নাম আব্দুল মুত্তালিব। জন্মের পূর্বেই পিতাকে হারান এবং শৈশবে মাতা ও দাদাকে হারানোর পর চাচা আবু তালিবের উপর শিশু মুহাম্মাদেও সা. লালন-পালনের দায়িত্বভার অর্পিত হয়। প্রাগুক্ত।
রাসূলে আকরাম সা. এর আগমনের সমসাময়িককালে আরবের অধিবাসীরা সামাজিক রাজনৈতিক ধর্মীয় অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক ও নৈতিক দিক দিয়ে পশ্চাদপদতা ও পঙ্কিলতা পূর্ণ ছিল। এ সময়কে আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগ বলা হয়। গোত্র কলহের ভয়াবহ অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ ২০ বছর বয়সে ‘হিলফুল ফুজুল’ নামক একটি শান্তি সংঘ গঠন করেন। রশিদুল আলম অনুদিত দা স্প্রিট অফ ইসলাম, পৃ- ৭৭।
২৫ বছর বয়সে হযরত খাদিজা রা. এর সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। ৩৫ বছর বয়সে কাবা গৃহের দেয়ালে ‘হাযরে আসওয়াদ’ স্থাপন করে আরব গোত্রসমূহকে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করেন বিশ্বনবী সা.। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে হেরা গুহায় আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হয়ে অর্থাৎ নবুওয়াত লাভ করে নবুওয়াতের চতুর্থ বছওে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। রাসূলে আকরাম সা. যে আদর্শের প্রচার শুরু করেন তা ছিল তৎকালীন সমাজের চলমান বংশানুক্রমিক পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ স্বরূপ; ফলে মক্কার অভিজাত ও প্রতিষ্ঠিত শ্রেণীর লোকেরা মহানবীর বিরোধিতায় লিপ্ত হন এমনকি তারা বনি হাশিম ও বনি মুত্তালিব গোত্রদ্বয়কে বয়কট করে শিয়াবে আবু তালিব নামক পর্বতে রাসুলে আকরাম সা. ও তাঁর পরিবারকে তিন বছর আটক করে রাখে। আকরাম ফারুক অনূদিত সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃ- ৮৯ থেকে ১০০।
নবুওয়াতের দশম বছরে চাচা আবু তালিব এবং উম্মুল মু'মিনীন হযরত খাদিজা ইন্তেকালের পর নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বছরে মদিনার ৭৩ জন পুরুষ ও মহিলা রাসুলে আকরাম সা. এর নিকট বায়’আত গ্রহণ করেন এবং তাঁকে মদিনা হিজরতের জন্য আমন্ত্রণ জানান। প্রাগুক্ত। অবশেষে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে ১৩ সেপ্টেম্বর মক্কা থেকে ৩০০ মাইল উত্তরে ইয়াসরিবে হিজরত করেন। ডঃ সৈয়দ মাহমুদুল হাসান, মসজিদের ইতিহাস, ইফাবা, পৃ-১২১।
আদর্শ সমাজ ও ইসলামী রাষ্ট্র গঠন রাসূলে আকরাম সা. :
রাসুলে আকরাম সা. মানব সমাজে আদর্শ ও উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্য প্রেরিত হয়ে ঘোষণা করেন, ‘আমি তো প্রেরিত হয়েছি উত্তম চরিত্রে পূর্ণতা বিধানের জন্য।’ কানযুল উম্মাহ দ্বিতীয় খ-, পৃষ্ঠা-৫। মানব জীবনের সকল কাজের সঙ্গে ইবাদতের সম্পর্ক বিদ্যমান তাই তিনি মদিনায় পৌঁছে মসজিদে নববীর ভিত্তি স্থাপন করেন। আর রাহীকুল মাখতুম পৃ-১৮৪। এ মসজিদ যেমন ছিল সালাতের জায়গা তেমনি ছিল রাষ্ট্রীয় সামাজিক কার্যক্রমের সদরদপ্তর। মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের আধ্যাত্মিক উন্নতি ও জাগতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রস্থল হিসেবে একে ব্যবহার করা। নবগঠিত মদিনা রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মকা- এখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। এখান থেকেই সব ধরনের ঝগড়া-বিবাদ মামলা-মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করা হতো। নবনির্মিত মসজিদ ছিল মুসলিম জনতার মিলনকেন্দ্র।সীরাত বিশ্বকোষ, পঞ্চম খন্ড, ৩৬৯।
যুবকেরা মসজিদ চত্বরে সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ তীরন্দাজের প্রশিক্ষণ ও খেলাধুলা করত মসজিদে নববীর একপ্রান্তে যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হতো। আর রাহীকুল মাখতুম, পৃ-৩১৮। সহিহ আল বুখারি, সালাত অধ্যায়, বাবুল আসহাবিল হিরাবি ফীল মাসজিদ, হাদিস নং- ৪৫৪। এ মাসজিদ ছিল মুসলমানদের শিক্ষাকেন্দ্র বা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর প্রথম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মসজিদে নববীতে। যেখানে ব্যক্তি পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় মূলনীতি শিক্ষা দেয়া হতো। এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাই সর্বোত্তম জ্ঞানী, ফকীহ, মুফাসসির, ’আবিদ, সুদক্ষ সেনাপতি ও শাসনকর্তারূপে সারাবিশ্বে সর্বজন স্বীকৃত। ড. আবু আইয়ুব মো. ইব্রাহীম সংকলিত, সীরাতুন্নবী সা. সংকলন, ১ম খ-, পৃ-১২৫।
নবগঠিত মদিনা রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সুদৃঢ়করণে রাসুলে আকরাম সা. ঐতিহাসিক এবং যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মুহাজিব ও মদীনার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে বিস্তারিত আলোচনার ভিত্তিতে একটি লিখিত দলিল সম্পাদন করেন যা ‘মদীনা সনদ’ নামে পরিচিত। ৫৪ টি ধারা সম্বলিত এ সনদই পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান।১৯ উন্নত নৈতিক চরিত্র গঠন সাম্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। সিরাতুন্নবী সা. ১ম খন্ড, পৃ-১২৬, ইসলামী অর্থনীতি নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ২০।
মদীনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর রাসুলে আকরাম বদর ওহুদ খন্দক অসংখ্য কাজও সম্পন্ন করে মদিনা রাষ্ট্রকে সুসংহত করেন। এরপর অষ্টম হিজরীতে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। সীরাতে ইবনে হিশাম, পৃ- ১৬৩-১৭২। মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের সুমহান আদর্শ ও দাওয়াত দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে এরপর দশম হিজরীতে বিদায় হজ আদায় করেন আরাফা ময়দানে এর উপস্থিতিতে লক্ষাধিক সাহাবী গ্রামের উপস্থিতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদান করেন। রাসূলে আকরাম সা. এর জীবনের সর্বশেষ হজ্বের সময় জাবালে আরাফাতে দাঁড়িয়ে তিনি যে ভাষণ প্রদান করেন সেটি বিদায় হজ্বেও ভাষণ নামে পরিচিত। আকরাম ফারুক অনূদিত সিরাত ইবনে হিশাম, পৃ-১৫২। ইসলামের ইতিহাসে এ ভাষণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও শাশ্বত দলিল। মূলতঃ এটি ছিল মহানবী কর্তৃক প্রদত্ত বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের হৃদয়গ্রাহী আহ্বান। এ ভাষণের প্রশংসায় ঐতিহাসিক আমির আলী বলেন, ‘ঐরং (গড়যধসসধফ) ষরভব রং ঃযব হড়নষবংঃ ৎবপড়ৎফ ড়ভ ধ ড়িৎশ হড়নষু ধহফ ভধরঃযভঁষষু ঢ়বৎভড়ৎসবফ. সৈয়দ আমীর আলী, দি স্পিরিট অফ ইসলাম, পৃ-১১২।
বিদায় হজ্বের ভাষণ মহানবী’র (সা.) আদর্শ সমাজের প্রতিচ্ছবি :
জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যেসব অধিকার সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, যে অধিকার ছাড়া মানুষ পৃথিবীতে মর্যাদাসহ বাঁচতে পারে না। এমনকি স্বাভাবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে পারে না। আধুনিক যুগে সেসব মৌল অধিকার মানবাধিকার নামে স্বীকৃত। রাসূলে আকরাম সা. সেসকল অধিকারকে সমুন্নত রাখতে বলেন, তোমরা প্রত্যেকে ভাই ভাই এবং সকলেই এক পিতা-মাতা থেকে সৃষ্ট। তোমাদের মধ্যে কেউই একে অপরের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী নয়; কোন আরববাসী অনারবের তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়, তেমনি কোন অনারব লোকও আরবের তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়। সকল মানুষই আল্লাহর সৃষ্ট এবং একই বংশোদ্ভূত। আকরাম ফারুক অনূদিত, সিরাত ইবনে হিশাম, পৃ- ৩৩০ ৩৩৭।
তিনি আরো বলেন, স্মরণ রেখো দুনিয়ার প্রত্যেকটি কাজের জন্য তোমাদেরকে একদিন আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং কখনো তোমরা সত্য পথভ্রষ্ট হবে না। প্রাগুক্ত। নারী জাতির মর্যাদা সম্পর্কে তিনি বলেন, নারীর উপর যেভাবে পুরুষের অধিকার আছে তেমনিভাবে পুরুষের প্রতিও নারীর অধিকার আছে। কাজেই নারীর সাথে সদয়রব্যবহার কর। র্আ-রাহীকুল মাখতুম, পৃ-৪৬০।
তিনি বলেন, তোমরা দাস দাসীদের সাথে সদয় ব্যবহার করবে। তোমরা যেরূপ আহার করবে, যে বস্ত্র পরিধান করবে, তাদেরকে অনুরূপ খাদ্য ও বস্ত্র দান করবে। স্মরণ রেখো, তারাও আল্লাহর সৃষ্টি এবং তোমাদের মতই মানুষ। দি স্পিরিট অব ইসলাম, পৃ- ১১৪। অন্যায়ভাবে রক্তপাত প্রাণসংহার সম্মানহানি ও পরস্পর সম্পদহরণ পর সম্পদ হরণ তিনি হারাম ঘোষণা করেন। এ ভাষণে রাসূলে আকরাম সা. নরহত্যা ও ব্যভিচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আর রাহীকুল মাখতুম ৪৬২।
ভাষণের পরিশেষে মহান রাব্বুল আলামিন ইসলামকে পূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ঘোষণা করে বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীন পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নি’য়ামত পূর্ণ করলাম আর তোমাদের জন্য ইসলামকে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম। সূরা আল মায়েদা : ৩।
রাসূলে আকরাম সা. এর শিক্ষানীতি :
মানুষ সৃষ্টির সেরা হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো মানুষকে জ্ঞান দান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়া’লা বলেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে; যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ সূরা আলাক : ১-২। আল্লাহ তায়া’লা বলেন, তিনি দয়াময় আল্লাহ, যিনি কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন; তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাষা। সুরা আর-রহমান : ১-৪।
রাসূলে আকরাম বলেন, জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরজ। সুনানু ইবনে মাজাহ, বাব : ফাদলুল ওলামা ওয়াল হাচ্ছু.., ১ম খ-, পৃ-৮১। আসলে আকরাম সা. বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে নিজে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়। সহিহ আল-বুখারি, কিতাব : ফাদায়িলুল কুরআন, ষষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা-১৯২। জ্ঞান অর্জন ও গবেষণা জিহাদ তুল্য। রাসূলে আকরাম সা. বলেন, ‘তোমরা জ্ঞান অর্জন করো। কারণ জ্ঞান অর্জন করা হলো আল্লাহ ভীতি; জ্ঞানের অন্বেষণ করা হলো ইবাদাত; পঠন-পাঠন হল তাসবীহ পাঠ; গবেষণা হল জিহাদ; যে জানেনা তাকে শিক্ষাদান হল সাদকা। সীরাতুননবী সা. সংকলন, ১ম খ-, পৃ-৭১।
মূলত রাসূলে আকরাম সা. এর পবিত্র সত্তাই ছিল চলমান শিক্ষা কেন্দ্র। যার সুবহে সাদিক থেকে পরবর্তী সুবহে সাদিক পুরোটাই জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমাদৃত ছিল। রাসূলে আকরামের সা. যুগে প্রতিটি মসজিদই ছিল শিক্ষা কেন্দ্র। তাঁর হাতেই মসজিদে আবু বকর; ফাতিমা বিনতে খাত্তাব এর শিক্ষা কেন্দ্র; দারুল আরকাম শিক্ষা কেন্দ;্র মসজিদে কুবা; সাদ ইবনে যুরারা এর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা; মসজিদে নববী কেন্দ্রীয় মাদরাসা; আসহাবে সুফফা মাদরাসাসাসহ শিশু-কিশোর বৃদ্ধদের জন্য বিশেষ শিক্ষা এবং পারিবারিক শিক্ষালয় গড়ে ওঠে। মহিলা সাহাবীদেও (রা.) জন্য আলাদা শিক্ষালয় গড়ে তোলেন বিশ্বনবী সা.। সিরাতুন্নবী সা. ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৭৫ থেকে ৮০।
রাসূলে আকরাম সা. এর শিক্ষাদান পদ্ধতি : প্রশ্নোত্তর ও পারিবারিক আলোচনা, পারস্পরিক আলোচনা, প্রশ্ন ছাড়াই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা, জিজ্ঞাসিত বিষয় থেকে বেশি শিক্ষাদান, নিজের সামনে সংঘটিত বিষয়ে চুপ থেকে শিক্ষাদান, কৌতুক ও রসিকতার মাধ্যমে শিক্ষাদান, কসম বা শপথ এর মাধ্যমে বিষয়বস্তু, পারস্পরিক সংলাপের মাধ্যমে শিক্ষাদান, অতীত ঘটনা ও কাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে শিক্ষাদান, এছাড়া রাসূলে আকরাম সা. যে সকল পদ্ধতিতে মানুষদেরকে শিক্ষা দিতেন তার মধ্যে সর্বোত্তম সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল বাস্তব কাজের মাধ্যমে, চমৎকার স্বভাব-চরিত্রের মাধ্যমে শিক্ষাদান। সিরাতুন্নবী সা. ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৮০-৮৪। ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেছেন, রাসূলে আকরাম সা. ওমানের বাদশাহর দরবারে ইসলামের দাওয়াত দানের জন্য আমর ইবনুল আস রা. কে পাঠান। তিনি বাদশার দরবারে উপস্থিত হয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেন তার কিছু অংশ নিম্নরূপ : তিনি বলেন, ‘এই উম্মী নবী কে আমি চিনেছি তার এই বৈশিষ্ট্যগুলো দেখে, তিনি যে ভাল কাজের আদেশ করেন তার প্রথম বাস্তবায়নকারী হন নিজেই। যে কোন খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার কথা বললে তিনি হন সেই কাজের প্রথম বর্জনকারী, তিনি বিজয়ী হন কিন্তু গর্ব অহংকার করেন না, পরাজিত হন কিন্তু তখন কোন বাজে কথা বলেন না, তিনি অঙ্গীকার পূরণ করেন, প্রতিশ্রুতি পালন করেন। (এ দেখে) আমি সাক্ষ্য দেই তিনি অবশ্যই একজন নবী।’ আল-আসকালানী, আল-ইসাবা ফী তাময়িযিস সাহাবা, (বৈরুত) ১ম খন্ড পৃ-৬৩৭।
রাসূলে আকরামের সা. শিক্ষানীতি সম্পর্কে পাশ্চাত্যের খ্যাতনামা দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল বলেন, ‘ঞযব পড়হঃৎরনঁঃরড়হং ড়ভ গঁযধসসধফধহং ধং ঃৎধহংসরঃঃবৎ ড়ভ শহড়ষিবফমব ভৎড়স ধহপরবহঃ ঃড় সড়ফবৎহ বঁৎড়ঢ়বধহ পরারষরুধঃরড়হ সঁংঃ হড়ঃ নব ঁহফবৎৎধঃবফ.’ অর্থাৎ-প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার জ্ঞানের হস্তান্তরকারী হিসেবে মুসলমানদের অবদান অত্যন্ত গৌররোজ্জ্বল। ইবৎঃৎধহফ জঁংংবষ, ঞযব ঐরংঃড়ৎু ড়ভ বিংঃবৎহ ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু, (টক ১৯৪৬, িি.িমড়ড়ফৎবধফবৎং.পড়স)
ব্যবসায় লেনদেন ও অর্থনীতিতে রাসূলে আকরাম সা. এর অবদান :
আদর্শ সমাজের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো অর্থনৈতিক লেনদেন। মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে রাসূলে আকরাম সা. ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উপহার দিয়েছেন। তাঁর অর্থনীতি ও লেনদেনের মূল ভিত্তি হলো আল কুরআন ও সুন্নাহ। নির্ভুল সময়োপযোগী বাস্তবসম্মত এবং মানব জাতির জন্য কল্যাণকর একটি গতিশীল জীবন দর্শন হিসেবে ইসলামী অর্থনীতি মানুষের উন্নতি অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির সাথে জড়িত। মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, ইসলামী অর্থনীতি, খায়রুন প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৯।
অর্থ উপার্জন ও বন্টনে রাসূলে আকরাম সা.এর আদর্শ : ইসলামী অর্থনীতির একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উৎপাদন ও বন্টন। হালালকে গ্রহণ ও হারামকে বর্জন করা। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, অতএব আল্লাহ তোমাদেরকে যেসব হালাল ও পবিত্র বস্তু দিয়েছেন তা তোমরা আহার কর এবং আল্লাহর অনুগ্রহের জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। সূরা নহল :১১৪। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, কেবল তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। সূরা নিসা ২৯ ।
যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার প্রবর্তক রাসূলে আকরাম সা. : যাকাত প্রদান ইসলামী সমাজের বিত্তশালী মানুষের শর’য়ী দায়িত্ব এবং সাধারন জনগনের প্রাপ্তির অধিকার। রাসূলে আকরাম তার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা চালু করেন। যাকাতের সম্পদ হলো গরিব মিসকিন বিধবা অসহায় মানুষের জনকল্যাণ বা সাহায্য ফান্ড এটা স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ইসলামী বীমা ব্যবস্থা। ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ, ১০০। মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত প্রদান কর।’ সূরা আল বাকারা ১১০।
ইসলামী অর্থনীতিতে ধন সম্পদ ব্যয়-বণ্টনের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন ও মিতব্যয়ী হওয়ার জন্য বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, এবং তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হযয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী। সূরা আল-ফুরকার : ৬৭। ‘তুমি একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ হইওনা এবং একেবারে মুক্তহস্ত হইওনা; তাহলে তুমি তিরস্কৃত নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে। বনী-ইসরাঈল ২৯। সম্পদ মজুদে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখেন এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদের কঠোর আযাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। সূরা তাওবাহ ৩৪। মহানবী সা. বলেন, পণ্যদ্রব্য আটক রেখে অধিক মূল্যে বিক্রয়কারী অবশ্যই পাপী। সহিহ মুসলিম, (দেওবন্দ, মাতবাউ আসাহ-হিল মাতাবি,) ২য় খন্ড পৃ-৩১।
সুদ প্রথা নিষিদ্ধকরণে রাসূলে আকরাম সা. : রাসূলে আকরাম সা. আল্লাহর নির্দেশে সমাজ থেকে সুদ প্রথা চিরতরে নিষিদ্ধ করেন। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল (বৈধ) করেছেন এবং সুদকে হারাম (অবৈধ) করেছেন। সূরা বাকারা : ২৭৫। আল্লাহ তা'আলা আরও বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ খেয়ো না।’ আল ইমরান :১৩০।
রাসূলে আকরাম সা. ব্যবসা বাণিজ্য এবং লেনদেনে কালোবাজারি চোরাচালানি দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি নিষিদ্ধ করেছেন। প্রতারণাসহ সকল প্রকার অবৈধ উপার্জন ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসূলে আকরাম সা. বলেন, ‘যে আমাদের মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করে সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’সহীহ মুসলিম, ১ম খন্ড, হাদিস নং ১৬৪। আদল ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় রাসূলে আকরাম সা. তাগিদ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা আদল (ন্যায়বিচার) প্রতিষ্ঠা কর, এটা তাকওয়ার অতি নিকটবর্তী। সূরা মায়িদা : ৮। ইহসান সম্পর্কে আল্লাহ তায়া’লা বলেন, ‘আর তোমরা ইহসান করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ ইহসানকারীদেরকে ভালবাসেন। সূরা বাকারা : ১৯৫।
দারিদ্র দূরীকরণ রাসূলে আকরাম সা. : যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা চালু করার ফলে দারিদ্র চিরতরে দূরীভূত হয়। দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলাম যে অবদান রেখেছে ইতিহাসে তার দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। অসহায় অক্ষম দুর্বল মানুষদের স্বাবলম্বী করার ক্ষেত্রে ইসলাম এক অনন্য দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে। মাও. মু. আব্দুর রহীম অনূদিত ফিকহুয যাকাত, ১ম খন্ড, ইফাবা, পৃÑ ৫৯।
মানবসম্পদ উন্নয়নে রাসূলে আকরাম সা. : রাসূলে আকরাম সা. এর জীবন হলো আল কুরআনের জীবন্ত দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তায়া’লা বলেছেন, ‘তিনি কখনো নিজের থেকে কোন কথা বলেন না বরং তা হচ্ছে তার কাছে পাঠানো প্রত্যাদেশ। সূরা নজম :৩-৪। তিনি রিসালাতের দায়িত্ব লাভের পর যত কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন তন্মধ্যে মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রসঙ্গটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এব্যাপারে তার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ ছিল বহুমূখী। মূলত তাঁর নবুওয়াত লাভর পর গোটা সময়কাল ছিল মানবতার সর্বাধিক উন্নয়নে নিবেদিত। সিরাতুন্নবী স. ১ম খন্ড, পৃ- ৪৫।
ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, ভাষা ও বর্ণের ন্যায় বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত বহুধাবিভক্ত গোত্র নির্ভর জাতিকে এক মজবুত সীসা ঢালা প্রাচীরের মত জীবনাচরণে প্রশিক্ষিত করেছিলেন রাসূলে আকরাম সা.। তিনি বলেন, ‘তিন দিনের বেশি কোন মুসলিমের সাথে কথা বন্ধ রাখা যাবে না।৫ সহিহ বুখারী, ৫৭২৭। ‘তোমরা চেনা-অচেনা সকলের সাথে সালাম বিনিময় করো। সহিহ বুখারী, ১২। ‘তোমরা নিজের জন্য যা পছন্দ করো তা তোমার অপর ভাইয়ের জন্য পছন্দ করো। সহিহ মুসলিম, ৫৪। ‘এমনকি মনের মধ্যেও কারো প্রতি বিদ্বেষ রাখবে না।’ সহিহ বুখারি, ৬০৬৫।
সার্বজনীন শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনাচরণে রাসূলে আকরাম সা. : শিক্ষাকে সার্বজনীন করে তিনি ঘোষণা করেছিলেন ‘জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক নর নারীর জন্য ফরজ; এমনকি জ্ঞানীর ঘুম জাহেলের ইবাদত থেকে উত্তম।’ রাসূলে আকরাম সা. তাঁর জনগোষ্ঠির দৈনন্দিন জীবনকে পরিমার্জন করাকে অন্যতম কাজ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। দৈনন্দিন জীবনে হালাল-হারাম; ক্রয়-বিক্রয়; লেনদেন; দেহ-মনের পবিত্রতা; পরিবেশের পরিষ্কার-পরিছন্নতা; খাদ্যভ্যাস; কথাবার্তা; উঠাবসা; শুভেচ্ছা বিনিময়; খাবার গ্রহণ; হাত ধোয়া; অজু-গোসল; মেসওয়াক; এমনকি টয়লেটে যাওয়া ও আসার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। সীরাতুননবী সা. ১ম খ-, পৃ-৪৭। আয়েশা রা. বলেন, রাসূলে আকরাম তার সকল কাজেই জুতা পরা, চুল আঁচড়ানো এবং পবিত্রতা অর্জনে ডান দিক থেকে শুরু করতে ভালোবাসতেন। সহিহ মুসলিম, পবিত্রতা অধ্যায়, হাদিস নং-৫১০।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনিই মহান সত্তা যিনি নবীদের মধ্যে তাদেরই একজন করে পাঠিয়েছেন যিনি তাদেরকে তার আয়াত শোনান, তাদের জীবনকে সজ্জিত ও সুন্দর করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয় অথচ ইতিপূর্বে তার স্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল। সূরা জুমুয়াহ : ২। রাসূলে আকরাম সা. শ্রম নির্ভর জীবন যাপন করতেন এবং বলেছেন শ্রমিকদের গায়ের ঘাম শুকাবার পূর্বেই তাদের মজুরি দিয়ে দাও।
সমাজসেবায় রাসূলে আকরাম সা. : সমাজ সেবা ও সমাজ কল্যাণে রাসূলে আকরাম সা. অভূতপূর্ব অবদান রেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হে লোকসকল সালামের প্রসার ঘটাতে থাকো, খাবার খাওয়া ও আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো, রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন সালাত আদায় করো, জান্নাতে নিরাপদে প্রবেশ করবে। সুনানু দারেমী, কিতাবুস সালাত, হাদিস নং ১৪২৪। রাসূলে আকরাম যুবক বয়সে হিলফুল ফুজুল নামক সমিতি গঠনের মাধ্যমে সমাজ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি হাজরে আসওয়াদ স্থাপন যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত প্রদান করে তৎকালীন আরবের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষেও অবসান ঘটান। সমাজসেবা প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে আল্লামা সাঈদ হাবি বলেন, ‘মুসলমানের কর্তব্য হলো তার অপর ভাইকে সাহায্য ও সহযোগিতা করা তার দোষ ত্রুটি গোপন করা তার সুবিধাও কষ্ট দূর করা প্রয়োজন পূর্ণ করা বড়দের সম্মান করা ছোটদের স্নেহ করা এবং তার অনুপস্থিতিতে তার স্বার্থ সংরক্ষণ করা। সায়িদ হাবি, আল ইসলাম, কায়রো, আল মাক্তাবা, ১ম সংস্করণ, ২য় খন্ড, পৃ- ৮৪।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরাই হলে সর্বোত্তম জাতি মানবজাতির কল্যানের জন্যেই তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দান করবে ও অন্যায় কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে। সূরা আল-ইমরান : ১১০। রাসূলে আকরাম সা. বলেন, ‘তোমাদের মধ্যকার কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের জন্য পছন্দ করা জিনিস অপর ভাইয়ের জন্য পছন্দ না করবে। সহিহ বুখারী, কিতাবুল ঈমান, হাদিস নম্বর ১২।
পরিবেশ সংরক্ষণে রাসূলে আকরাম সা. : পরিবেশ সংরক্ষণ ও সবুজায়নে বিশ্বনবী সা. বলেন, ‘যে কোন মুসলমান ফলবান গাছ রোপণ করে অথবা কোন ফসল চাষাবাদ করে আর তা থেকে পাশে পাখি কিংবা মানুষ বাঁচার জন্য খায় সেটি তার পক্ষ থেকে সাটকা বলে গণ্য হবে। সহিহ বুখারী, নবম খন্ড, হাদিস নাম্বারঃ ২১৫২। তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি ফুল বা ফল দানকারী কোন গাছ কাটবে আল্লাহ তায়া’লা তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (আহমদ ইবনে হুসাইন ইবনে আলী, সুনানুল কুবরা, ৩য় খন্ড) । রাসূলে আকরাম সা. বলেন, ‘যারা সৃষ্টির প্রতি দয়া করে আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি দয়া করেন।আবু সায়ীদ উসমান ইবনে সাঈদ ইবনে খালিদ, নাকছুল ঈমান, ১ম খ-, পৃ-৫১২।
পরিবেশ দূষণ রোধে রাসূলে আকরাম সা. : বিশ্বনবী সা. বলেন, ‘দুই অভিসম্পাতের কারণ হতে বেঁচে থাকবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন হে আল্লাহর রাসূল অভিসম্পাত এর কারণ কি? বললেন, যে ব্যক্তি মানুষের চলার পথে অথবা ছায়ার স্থলে মলত্যাগ করে। সহিহ মুসলিম ১ম খ-, পৃ- ২২৬। পানি দূষণ রোধে রাসূল সা. বলেন, ‘তোমাদের কেউ যেন বদ্ধ পানিতে প্রস্রাব না করে।সহিহ বুখারী, ১ম খ-, পৃষ্ঠা ৬৪। অপচয় রোধে রাসূল সা. বলেন, ‘রাতে ঘুমানোর আগে বাতি নিভিয়ে দাও, ঘরের দরজা বন্ধ করো, পাত্র ঢেকে রাখো এবং খাদ্য ও পানির পাত্রের মুখ ঢেকে রাখো।(সহীহুল বুখারী ও সহীহ মুসলিম।)
নৈতিক অবক্ষয় রোধে ইসলাম : খারাপ চরিত্র আমল ও প্রবৃত্তি হতে আশ্রয় প্রার্থনা করে রাসুলে আকরাম সা. বলেন, হে আল্লাহ আমি তোমার নিকট খারাপ চরিত্র আমল ও প্রবৃত্তি হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। রাসূলে আকরাম সা. খোদাভীতি কে অধিক গুরুত্ব দিতেন। কেননা পবিত্র কোরআন মুত্তাকীদের জন্য পথ প্রদর্শনকারী। সূরা আল বাকারা : ২।
রাসূলে আকরাম সা. শত বিপদে ধৈর্য ধারণ করেছেন এবং অন্যকে ধৈর্য ধারণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তায়া’লা বলেন, ‘হে আমার প্রিয় বৎস সালাত কায়েম কর; সৎকাজে আদেশ দাও; অসৎ কাজে নিষেধ করো এবং তোমার উপর যে বিপদে ধৈর্য ধারণ করো। সূরা লুকমান : ১৭। নৈতিক অবক্ষয় রোধে আখেরাতের চেতনা জাগ্রত করেছেন রাসূলে আকরাম সা.। দুনিয়ার জীবনের শেষ জীবন নয় বরং মৃত্যুর পর মানুষকে আখিরাতের অনন্ত জীবনে প্রবেশ করতে হবে। রাসূলে আকরাম দুনিয়ার জীবনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছেন, ‘দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা স্বরূপ আর কাফেরদের জন্য স্বর্গ।সহিহ মুসলিম, ২য় খ-, পৃ- ৪০৭। আল্লাহ তা'আলা বলেন, ‘বরং তোমরা দুনিয়ার জীবনকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে অথচ আখেরাত অনেক ভালো এবং চিরস্থায়ী। সূরা আল আলা ১৬-১৭।
আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে উত্তম উপদেশ ও শিক্ষা : রাসূলে আকরাম সা. বলেন, ‘পিতা নিজের সন্তানকে যা কিছু প্রদান করে তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম হলো ভালো শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। তাবারানী, মুজামুল কাবীর , দ্বিতীয় সংস্করণ খন্ড, হাদিস নাম্বারঃ ১৩২৩৪।

পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, রাসূলে আকরাম সা. আদর্শ সমাজ বিনির্মানে যা যা করণীয় তার সবটুকুই আমাদের দেখিয়ে গেছেন। যার ফলশ্রুতিতে তাঁর সাহাবায়ে কেরামগণ খোলাফায়ে রাশেদার সময় সোনালী সমাজ বিনির্মান করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা অর্থ পৃথিবী শাসন করেছিলেন। মহান আল্লাহ রব্বুল আ’লামিন আমাদেরকে রাসূলে আকরাম সা. এর আদর্শ তথা সুন্নাহ’র আলোকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
--সমাপ্ত--
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৯ দুপুর ১:০৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×