somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রক্তস্নাত ইতিহাস ; ১৪ ফেব্রুয়ারি

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৪ ফেব্রুয়ারি নিয়ে সমসাময়ীক তরুণ-যুবক সমাজে যথেষ্ট উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা বিরাজ করে থাকে । উদ্গ্রীব অপেক্ষায় অপেক্ষমান থেকে তরুণ সমাজ কত শত স্বপ্নের জাল বুনে, হাজারো পরিকল্পনা এটে রাখে এ দিনটিকে ঘিরে । রঙিন সব পোষাক, সাজসজ্জা, ফুল, নানা রকম উপহারে মাখা থাকে দিনটি । ফুলের রাজধানী বলে পরিচিত যশোরের পদখালী এলাকায় ফুলের বাগানে মৃদু বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে মাথা দুলে নিজেকে উত্সর্গের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে রক্ত রঙ্গা গ্লাডিওলাস । শেষবার শিশির স্নানের জন্য হাজারো গোলাপ কলি পাপড়ি মেলে। দেড়হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় দেড়শত কোটি টাকার ফুলের চাষ হয়েছে এবার, লক্ষ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস । প্রায় পনেরশত বছরেরও বেশি পুরনো অজাচিত ইতিহাসকে বরণ করে নেওয়ার জন্য এই তোরজোড় । অথচ মাত্র তিন দশক আগের রক্ত বর্ষণের গৌরবউজ্জ্বল ইতিহাস ঢাকা পরছে গোলাপ পাপড়ির অতলে ।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে অমাবস্যাময় অথচ রক্তঝরা দিন। গণতন্ত্রের বুকে বর্শা নিক্ষেপ করে উঠে আসা স্বৈর শাসক এরশাদের মনোনীত শিক্ষামন্ত্রী ডঃ অব্দুল মজিদ খানের প্রণীত কুশিক্ষা নীতি প্রত্যাহার, বন্দী মুক্তি ও গণতন্ত্র অধিকারের দাবি এবং বিজ্ঞান ও অ-সম্প্রদায়িক শিক্ষা নীতির দাবিতে ছাত্র জমায়েত ডাকা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ থেকে । শিক্ষার্থীদের বিরোধিতা করা সেই শিক্ষা নীতিতে প্রথম শ্রেণী থেকেই আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল । তবে সবচাইতে বিতর্কিত প্রস্তাবটি ছিল উচ্চ শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে । ফলাফল খারাপ হলেও ৫০% শিক্ষা ব্যয় ভার বহন করার সামর্থ থাকলে তাদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হয় এ প্রস্তাবে ।
পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে শিক্ষার্থীরা একত্রিত হতে থাকে ক্যাম্পাসে । এতে যোগ দিয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, তৎকালীন জগন্নাথ কলেজসহ ঢাকার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা । স্লোগানের খই ফুটছিলো শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে; প্রকম্পিত হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আসেপাশের এলাকা । একপর্যায়ে কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রীর একটি মিছিল সচিবালয়ের দিকে এগিয়ে যায় স্মারকলিপি নিয়ে । হাইকোর্ট মোড়ে মিছিল পৌঁছালে পূর্বে অবস্থান নেয়া পুলিশ মিছিলে হামলা করে । প্রতিবাদী সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের মিছিলে এরশাদ সরকারের পাচাটা পুলিশ বাহিনী গুলি বর্ষণ করে বৃষ্টির ন্যায় । নিহত হয় জাফর, জয়নাল, দীপালী সাহা, আইয়ুব, ফারুক, কাঞ্চন প্রমুখ এবং আহত হয় কয়েক শত শিক্ষার্থী । এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১৭ ফেব্রুয়ারি এরশাদ সরকার ছাত্রদের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয় ; মুক্তি দেয় গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের ।
প্রকৃতপক্ষে ফেব্রুয়ারির এই ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনই ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম গণ আন্দোলন । যার ফলাফল ছিল ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী এরশাদের পতন । এর পর থেকেই ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ ‘‘স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র প্রতিরোধ’’ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে । কিন্তু গৌরবউজ্জ্বল এই দিবসটি অতি সম্প্রতি ঢাকা পরছে পশ্চিম থেকে ধার করা পুজিবাদ মুখোপেক্ষী স্পষ্ট ইতিহাসহীন এক অপসংস্কৃতি দ্বারা । যার ইতিহাস নিয়ে রয়েছে হাজারো বিতর্ক । এমনকি কোথাও কোথাও ধর্মের ঘোড়ামির কথাও বলা হয় ।
ভালোবাসা দিবস নিয়ে প্রচলিত মতামতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশ আলোচিত মতটি হচ্ছে খ্রীষ্টান ধর্ম যাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের । ধর্ম যাজক ভ্যালেন্টাইন ছিলেন খ্রীষ্ট ধর্মের প্রচারক । রোমান সম্রাট ক্লাডিওয়াস দেব দেবীর পূজা করতে বললে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন তা অস্বীকার করায় তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। সম্রাটের খ্রীষ্ট ধর্ম ত্যাগের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রীয় আদেশ অমান্য করার অভিযোগে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয় । সেই থেকে খ্রীস্টধর্মানুযায়ী একে ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের দিন হিসেবে পালন করা হয় । উইকিপিডিয়ায় ভালোবাসা দিবসের ইতিহাস উল্লেখ আছে এভাবে- ২৬৯ সালে ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স নামে একজন খ্রীষ্টান পাদ্রী ও চিকিৎসক ছিলন । ধর্ম প্রচার অভিযোগে তৎকালীন রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস তাকে বন্দী করেন। কারণ তখন রোমান সম্রাজ্যে খ্রীষ্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ ছিল । বন্দী অবস্থায় তিনি জনৈক কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন । এতে ভ্যালেন্টাইনের জনপ্রিয়তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে রাজা তাকে মৃত্যু দন্ড দেন; আর সেই দিন ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি । অতঃপর এর ২০০ বছর পরে ৪৯৬ খ্রীষ্টাব্দে পোপ সেন্ট জেলাসিউ ও ১ম জুলিয়াস ভ্যালেন্টাইন স্মরণে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস ঘোষনা করেন । খ্রীষ্টান সমাজে পাদ্রী-সাধুদের স্মরণ ও কর্মের জন্য এ ধরণের অনেক দিবসই প্রচলিত আছে । যেমনঃ- ২৩ এপ্রিল সেন্ট জজ ডে, ১১ নভেম্বর সেন্ট মারটিন ডে, ১ নভেম্বর আল সেইন্টম ডে ইত্যাদি ।
খ্রীষ্টিয় ইতিহাস মতে, ২৬৯ খ্রীষ্টাব্দে সাম্রাজ্যবাদী রোমান সম্রাটের রাজ্যে সেনাবাহিনীর সংকট দেখা দেয়। এ সংকট মোকাবেলায় সম্রাট যুবকদের বিবাহের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন, যাতে তারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ না করে । যুবক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের এক ধর্মযাজক সম্রাটের নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে পারেন নি । প্রথমে তিনি সেন্ট মারিয়াসকে বিয়ে করে সম্রাটের আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন এবং গির্জায় গোপনে বিয়ে পরানোর কাজও করতে থাকেন । এ খবর সম্রাট গ্লাডিয়াসের কানে পৌছালে ২৭০ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তাকে হত্যা করা হয় । এভাবেই প্রবর্তিত হয় ভালোবাসা দিবস; যার সাথে বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতির নেই কোন সংযোগ ।
যে ১৪ফেব্রুয়ারিতে দেখাযেতো প্রভাতফেরী, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো এবং নতুন করে সব ধরণের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে দীপ্ত শপথ গ্রহণের দৃশ্য ; সেখানে আজ দেখা যায় প্রেমিক প্রেমিকাদের জুটি বদ্ধ হয়ে ভ্যালেন্টাইনস ডে পালন । সংস্কৃতি ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনশীল, কিন্তু ইতিহাস নয় । ইতিহাস মন্দ-ভালো যাই হউক না কেন তা অক্ষত থাকে । ইতিহাসকে অস্বীকার করা যায় না । আর তা যদি হয় রক্তস্নাত চির বিপ্লবী চেতনার ইতিহাস; তবে তা অস্বীকার করা মানে জাতীয় সংগ্রামী চেতনার কপালে কলংকের টীকা একে দেয়া । আর ১৪ ফেব্রুয়ারি তেমনি এক রক্তস্নাত ইতিহাস; গান-বাজনা, হুরোহুরি, সেবলামো করার দিন এটি নয় ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৪০
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×