somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সংখ্যালঘুত্বের গুরুভার

০৩ রা অক্টোবর, ২০১২ বিকাল ৪:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম পর্ব

১৯৯৬ সালে আমি বিদেশ সফরে যাই। সেটাই ছিল আমার প্রথম বিদেশ সফর। যদিও সেটাকে বিদেশ সফর বলা যায় কি না এ নিয়ে একটা বিতর্ক হতে পারে। কারণ আমি গিয়েছিলাম, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতায় [কলকাতা তখনো কোলকাতা ছিল, কলকাতা হয়ে ওঠেনি]। কোলকাতাকে গিয়ে পরবাসে বাস করার কোন সুখ (দুঃখ) পাওয়া যায় না, ভবন থেকে শুরু করে মানুষগুলোর চেহারা, সংস্কৃতি, ভাষা, খাবার কোনটার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
কিন্তু পার্থক্য যে একটা আছে তা টের পেতে দেরি হল না।
পকেট তেমন ভারি ছিল না, তাই রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেটে ঘুরে বেড়াই।

অনেকে পোষাক দেখে ঠাউরে নেয়, আমি ওপার বাংলা থেকে এসেছি।

আলাপ জুড়তে বেশী সময় লাগে না।

আমাকে দেখে অনেকে স্মৃতিতাড়িত হয়ে পড়েন। মুন্সিগঞ্জ কিংবা চাঁদপুর মহাকুমা কেমন আছে তার খোঁজ নেন। তাদের জানাই এ দুটি আর মহকুমা নেই, জেলে হয়ে গেছে। আনন্দে তাদের চোখও ভরে ওঠে।

আবার কোন কোন দোকান থেকে ইশারা করে। নাম জানার পর প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে হিন্দু না মুসলমান। এর পরের প্রশ্নটি থাকে এ রকম, মুসলমানের নাম কি ভাবে বিজয় হয়।
শঙ্কা কাটলে দেখা যায়, ভাব হতে খুব একটা দেরী হয় না। আলাপচারিতায় প্রথম টের পেলাম, এই দুটি বাংলার অবস্থানের ভিন্নতা কোথায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ আর সংখ্যালঘিষ্ঠতা।

একজন আমাকে বললেন, এদেশের মুসলমানদের দেশপ্রেম ছিনতাই হয়ে গেছে। যখন কোন সন্ত্রাসী বোমা মারে, যেহেতু সে নামে মুসলমান, তখন ভারতবর্ষের একটা অংশ আমাদের এই মুসলমান সম্প্রদায়ের দিকে এমন ভাবে তাকায়, যেন সে নয়, আমি এবং আমার ভাই বোমা মেরেছি। আর ভারতবর্ষের বাকী অংশ তখন নির্লিপ্ত থাকে, যে অংশটা এই ধরণের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে, তারাও আমার মত সংখ্যালঘু।
এই রকম ঘটনার পর একদল আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকায়, যেন আমরা হয় পাকিস্তান, নয়তো ওপারের গুপ্তচর।


ফেসবুকে আমার বন্ধু সংখ্যার তালিকাটি বেশ দীর্ঘ। এর মধ্যে একজন আমাকে বার্তা পাঠালো, যার ভাষাটা হচ্ছে এ রকম, ভাই, ‘আপনি কি মালাউন, যদি মালাউন হন, তাহলে আমি আপনাকে ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে ছাঁটাই করে দেব’।

আমার কাছে এর একটা উত্তর আছে, যদিও তাকে সেটা আর প্রদান করা হয়নি। তাকে বলা হয়নি যে আমি তার জন্য প্রার্থনা করছি, পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা যেন আপনাকে একজন প্রকৃত মুমিন মুসলমানে পরিণত করেন, যার জিহ্বা এবং তরবারির থেকে সকল নিরপরাধ ব্যক্তি নিরাপদ।



বন্ধুত্বের তালিকায় থেকে একজন ভারতীয় আমাকে একদিন প্রশ্ন করল, শুনেছি তোমাদের দেশে নাকি হিন্দুদের উপর নির্যাতন করা হয়।

আমি বললাম তুমি ভুল শুনেছে, নিপীড়ন হয় বটে, তবে হিন্দুদের উপর নয়, সংখ্যালঘুদের উপর, আর সে সংখ্যালঘু, হিন্দু বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান যে কেউ হতে পারে। আর তার মূল কারণ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক, যদিও তা করা হয় ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে। এই কাজটি তোমাদের দেশেও করা হয়। ধর্মের নামে উপাসনালয় ভাঙ্গা হয়, মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়। আর এই কাজটি করা হয় তাদের বিরুদ্ধে, যারা সেখানে সংখ্যালঘু।

ভারতের যে সমস্ত মুসলমান, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকদের জন্য বানানো পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতে থেকে গেছে, তারা একদিকে যেমন খাঁটি মুসলমান, অন্যদিকে তেমন খাঁটি ভারতীয়।

বাংলাদেশের হিন্দু, তারা কোন ভাবে এদেশ ছেড়ে যাবার বিষয়ে ভাবেনি, কারণ ভারতের জন্ম হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে নয়, সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে। যার ফলে যারা নানান টানাপোড়নের মাঝেও মাতৃভূমির টানে, এদেশে থেকে গেছে, তাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন অবকাশ থাকে না। কিন্তু তবুও প্রশ্ন ওঠে। কারণ?

ওই একটাই। তারা সংখ্যালঘু। এই কারণে তাদের কণ্ঠস্বর হতে হবে দুর্বল। তাদের রাষ্ট্রের দয়ায় কিংবা বৃহত্তর সম্প্রদায়ের উদারতার ছায়ায় বাস করতে হবে।

পর্ব দুই
লোভের আগুনে সব পুড়ে হয় ছাই!
আমার ভারতীয় বন্ধুটি প্রশ্ন করলেন, তুমি বলছ সংখ্যালঘু নিপীড়ন হয়? তুমি বলছ, বিশ্ব জুড়ে এই দৃশ্য বিদ্যমান। এর কারণ কি?

আমি উত্তর করলাম, লোভ, যার থেকে এ সবের উৎপত্তি, যে কিনা ধর্মকে হাতিয়ার করে স্ফুলিং তৈরি করে।
এর একটু ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করা যাক।
ধর্ম যার বাস মানুষের অন্তরে, তার প্রতি মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা, সেই ধর্মকে হাতিয়ার করে মানুষ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়।

যদিও ধর্মের সাথে ভোটের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন সম্পর্ক নেই। তবু ভোটের সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা একে অপরকে অধার্মিক এবং নিজেদের ঠিক তার বিপরীতটা প্রমাণে উঠে পড়ে লেগে যায়।

কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ

আর যখন প্রতিবারই এই ধরনের হামলার ঘটনা ঘটে তাতে একদল লোক সর্বশান্ত হয়, আরেক দল ফুলে ফেপে ওঠে। হিসেবটা খুব সহজ।

লুটপাট চলবে, কেউ কেউ ভীত হবে, আগামীতে এই দাঙ্গার ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে কেউ কেউ নিরাপত্তা ভাতা আদায় করবে, কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবে, আবার কেউ জীবনের মায়ায় খুব কম দামে সহায় সম্বল বেঁচে, নিরাপদ আশ্রয়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমাবে।

তখন কে বলবে, যে এ সব ঘটনা খারাপ। তখন একদল বলবে দাঙ্গা বড়ই পয়মন্ত।


বোঝা গেল কি হিসেবটা?

যখন এই রকম সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটে, তখন সেই পক্ষের অসহায় হয়ে মার খাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না, কারণ ঐ একটাই, তারা সংখ্যালঘু। প্রতিরোধ করার চিন্তা ভাবনা তাদের লুপ্ত হয়, কারণ নিজেদের একজন মারা গেলেও চোখের নোনা জলে তাঁর জন্য কাদা যায়, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ একজনের লাশ পড়ে গেলে যে সবাই ছাই হয়ে যাবে। কাঁদার জন্য যে আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।

সংখ্যালঘিষ্ঠের ভয়ের হিসেবটা পরিষ্কার। কিন্তু যারা আগুন দেয়, তাদের হিসেব কি?

সেই হিসেব অনেক জটিল, সেখানে যেমন ভূমি আছে, টাকা আছে, লুটপাটের হিসেব আছে, আছে আগুনের ছাই থেকে রাজনৈতিক সার উৎপাদনের ধান্ধা।

এই হিসেবে, সাদা কালো, ডান বাম সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসে, তা হচ্ছে পোড়া ছাই থেকে কে কত স্বর্ণ বের করতে পারে।

ইসালম এবং সংখ্যালঘু
৪০ বছর বয়সে নবুয়ত প্রাপ্তির পর মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সঃ) যখন মক্কায় ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন মুষ্টিমেয় কয়েকজন মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে এবং সে সময় তারা ছিলেন সংখ্যালঘু। আর এ কারণে সংখ্যালঘুদের উপর যে সমস্ত নির্মম আচরণ করা হয়, প্রায় তার সবকটি তাদের উপর প্রয়োগ করা হয়েছিল। শুরুতে যারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ক্ষেত্রে হত্যা (ইসলাম গ্রহণের কারণে (সুমাইয়া বিনতে খাবাবকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হয়, , ভয়, নির্যাতন (ইসলাম গ্রহণের কারণে হজরত বেলালের বুকে পাথর চেপে ধরা হয়) , ধর্ম পালনে বাঁধা দেওয়া (হজরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের আগে কেউ প্রকাশ্যে কোরআন তেলাওয়াত করতে পারত না), এমনকি জীবন বাঁচাতে দেশ ত্যাগে বাধ্য হবার মত নিষ্ঠুর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন।

এ কারণে নবীজী ইসলাম ধর্মের নাগরিকদের কোন বিষয়ে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে গেছেন।

আর কোরআনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।
‘বনি ইসরাইলের সন্তানদের প্রতি নির্দেশ থাকল, যদি কোন ব্যক্তি নিরাপরাধ এক ব্যক্তিকে হত্যা করল, তাহলে সে সমগ্র মানব জাতিকে হত্যা করল, আর যদি কেউ একটি জীবন রক্ষা করল, তাহলে যেন রেখ সে যেন সমগ্র মানব জাতিকে রক্ষা করল,- সূরা আল মায়েদাহ (৫:৩২) ।
সেই সব সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের থেকে ইসলাম কত দূরে?
..............................................................................................................................

যে কোন কারণে কেউ যদি সংখ্যালঘু হয়ে যায়, তাহলে তার উপর এক গুরুভার এসে চাপে। তা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের দয়ায় জীবন যাপন করে চলা।

আর তখন সংখ্যালঘুর কোন স্বর থাকে না, কেবল থাকে শঙ্কা।
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×