somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প ; 'একটি যুদ্ধ এবং আরেকটি প্রশ্ন'

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




শহরটাকে তিনি আর চিনতে পারছেন না।

না পরারই কথা।

সময় পাল্টে গেছে। শহরটা এখন অনেক বড় হয়েছে। যেন সে তার যৌবনে উপনীত হয়েছে।

উপমাটা তাকে চিন্তিত করল। তিনি নিজে কি বৃদ্ধ হচ্ছেন। কারণ এক সময় হাতের উল্টো পিঠের মত এই এলাকাকে চিনতেন। তার সাথে এখানকার মানুষদের।



সময় সময়ের তালে এগিয়েছে।

শহরটাকে এক সময় নিজের মনে হত। এখন আর মনে হচ্ছে না। এখন যারা তাকে চেনে, তারা এই শহরের, কিন্তু সেই শহরের নয়, যে শহরটা তার স্মৃতিতে গেঁথে আছে। তাদের কাছে তিনি কর্ণেল হাসান*। কিন্তু সেই শহরের মানুষদের কাছে? মনে হল তারা বোধহয় রুপকথার নগরীতে চলে গেছে।



সভা ঠিক সময়ে শুরু হল। সভাপতি দেরীতে আসার কারনে সভার সময় পেছানোর কোন কারণ ঘটল না। কারণ তিনিই সভাপতি। আলোচনার বিষয়, নিজের দায়িত্ব। তিনি একটা অরাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। যে প্রতিষ্ঠান দেশ এবং নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে কথা বলে।



তিনি জানেন এ সব শুনে আড়ালে বেশির ভাগ মানুষ হাসে। কিন্তু বরাবরই তিনি জেদি। তিনি বিশ্বাস করেন, কেউ একজন শুরু করলে অনেকেই এগিয়ে আসবে। তাই তিনি ছুটে চলেছেন শহর থেকে শহরে। পরিবারে লোকজন বলে বয়স হয়েছে, “থামো”। তিনি জানেন থেমে যাওয়া মানেই মৃত্যু।





লোক কম হলেও আলোচনা হল ভালো। দুপরে খিদে জানান দিল যে বেশ লম্বা সময় ধরে আলোচনা হয়েছে। দলের স্থানীয় সঙ্গীরা বলল, “স্যার, এখানকার বাজারে একটা ভালো হোটেল আছে, চলুন সেটাতে যাই।



হোটেলে পা দিয়ে তিনি বুঝলেন, চালু হোটেল।

মাঝবয়সী মালিক তাকে দেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। বুঝলেন, মালিক ব্যবসা বুঝে। পরনে লুঙ্গি আর একটা খয়েরি রঙের পাঞ্জাবী। মাথায় একটা টুপি। মুখে দাড়ি। কাঁধের এক পাশে একাট গামছা ঝুলছে।

মফস্বল শহরের খাবারের হোটেল যত বড় হয়, মালিকগুলোর স্বাস্থ্য সেই অনুপাতে কৃশ হয়ে থাকে। এই হোটেলের মালিকও তাই।

হালকা গড়নের লোকট, অনেকটা জোরালো গলায় হাঁক দিয়ে বলল, এই মনোয়ার স্যারকে বসতে দে।



হোটেলে ভীড় প্রচণ্ড। সিট খালি নেই প্রায়। কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে, কখন টেবিল খালি হবে। তরুণ মনোয়ার এর মধ্যে একটা টেবিল ফাঁকা করে তাদের বসার ব্যবস্থা করে ফেলেছে।



হোটেলের রান্না আসলেই ভালো। ক্ষুধার্থ ছিলেন। খেলেন প্রচুর।
সঙ্গীরাও খেতে কার্পন্য করল না। তবে খাওয়ার ফাঁকে মনে হল হোটেল মালিক তাকে খুব ভালো করে খেয়াল করছে।



খাওয়া শেষ। বিল দেবার পালা। সবাইকে আগে জানিয়েছিলেন, খাবারের বিল তিনি দেবেন।



মনোয়ার এল। তিনি বললেন, বিল নিয়ে এস।



“বিল হয় নাই”, মনোয়ারের দ্রুত উত্তর।



কর্ণেল হাসান একটা ধাক্কা খেলেন



মনোয়ারকে সেই বিস্মিত কন্ঠে শুধালেন, “মানে”!



মনোয়ার বলল, স্যার, বিল নিতে মালিকের নিষেধ আছে।



এবার তিনি দুর থেকে আরো ভালো করে মালিকের দিকে তাকালেন, কোন ভাবেই তিনি তাকে চিনতে পারলেন না। তার মনে পড়ল না যে হালকা পাতলা, মুখভর্তি দাঁড়ি, এমন একজনকে তিনি চেনেন, যার হোটেলের খাওয়া তার জন্য ফ্রি।



খানিকটা মিলিটারি মেজাজে তিনি বললেন, “ডাক মালিককে”।



বিনীত ভঙ্গিতে মালিক সামনে এসে দাঁড়ালে, যেন তাকে খাইয়ে এবং বিল না নিলে সে কৃতার্থ হবে।



মালিক যেন জানত, তিনি কি বলবেন?



তিনি কিছু বলার আগেই মালিক বলে উঠল, স্যার আমাকে চিনতে পারন নাই? আমি জয়নাল*।



তিনি তার স্মৃতিকে সর্বোচ্চ অতীতে নিয়ে গেলেন।

বয়স হয়েছে ঢের। অজস্র স্মৃতি হাতড়েও তিনি গিয়ে এই রকম চেহারা কোন জয়নালের কথা মনে করতে পারলেন না।



স্যার আমি জয়নাল... ওই যে ওই এলাকার জয়নাল।



স্মৃতি তাকে দারুণ বিপদে ফেলে দিল...

জয়নাল যেন বুঝতে পারল। সে খানিকটা ইতস্তত করে বলে উঠল, “স্যার, আমি সেই চোর জয়নাল”।



বলার সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া হল মারাত্মক।



সবাইকে বিস্মিত করে কর্ণেল হাসান চোর জয়নালকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।



................................................................................................



১৯৭১ সালে ক্যাপ্টেন হাসান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তার অসুস্থ মাকে দেখতে এসে আরেক মায়ের টানে এক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন।



বর্ষা শেষ হয়ে গেছে, শরতের আগমন ঘটেছে। কাদাপানিতে পাক সেনাদের নাকানি চুবানি খাইয়ে মুক্তিযোদ্ধার এখন সীমান্তে ঘাঁটি গেড়েছে।

এ রকম এক সীমান্ত তাঁর ক্যাম্প। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের দাপট তীব্র। যার ফলে আশে পাশের গ্রামগুলোতে পাকিস্তানী সেনাদের অত্যাচারও ভয়ানক। গ্রামগুলোতে মাঝে মাঝে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখা যায়। সেই আগুন তার বুকে জ্বলে।



এখন আরো বেশী বেশী মানুষ যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য এগিয়ে আসছে। তাদের জন্য খোলা হয়েছে এক ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে এক শরতের সকালে তিনি আর মেজর রাঠোর বসে আগামী হামলার পরিকল্পনা করছিলেন।



এমন সময় একটা আওয়াজ তার কানে এল। মনে হল অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে। যুদ্ধের সময় স্বাভাবিক বলে কিছু থাকে না। তাই সদা সতর্ক থাকতে হয়, কিন্তু এটা ঠিক যুদ্ধের সঙ্কেত নয়, অনেকটা হট্টগোলের আওয়াজ।



তিনি দ্রুত উঠে সামনে এগিয়ে যেতে চাইলেন, কিন্তু তার আর প্রয়োজন পড়ল না। আওয়াজটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

..................



জহুরুলকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার?







“স্যার এই যে এ ক্যাম্পের আশেপাশে ঘুর ঘুর করছিল”। বলে জহুরুল একটা যুদ্ধ জয়ের হাসি দিল। “স্যার কিছু করার আগে তাকে ধরে ফেলেছি”।



যুদ্ধকালিন সময়ে অনেক কিছু ঘটতে পারে, সেই জন্য সবাই সতর্ক থাকে। তবে জহুরুলের মুখের হাসি ভিন্ন কিছু বলছে।



তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? কি চাও?



উত্তর দিল জহুরুল, স্যার এ একটা চোর। শুধু এ চোর না এর গুষ্ঠি শুদ্ধ চোর।



জহুরুল ধৃত প্রানীটির ঘাড় শক্ত করে ধরে আছে যেন ছেড়ে দিলে সে চুরি করতে শুরু করে দেবে।



তিনি উক্ত চোরের দিকে তাকালেন।



তার চোখে মুখে কোন গ্লানি নেই। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার কোন চেষ্টা নেই, তার বদলে আছে আছে এক আগুন।



কিন্তু ক্ষোভটা কোথায়, তাকে চোর বলায়?



ক্যাপ্টেন হাসান শুধালেন, তুমি কি চোর?



উত্তরে দুবার মাথা নাড়ল?



তার মানে স্বীকার করে নিচ্ছে।



তার মানে তোমার বাবাও চোর? ক্যাপ্টেন হাসান আবার শুধালেন



উত্তরটা এলো জহুরুলের কাছ থেকে। “এর সার, বাপ, দাদা, সবাই চোর, এদের সার কাজই চুরি করা”।



এর কোন প্রতিবাদ এলো না।



ক্যাপ্টেন হাসান শুধালেন, “ক্যাম্পের আশে পাশে ঘুর ঘুর করছিলে কেন? এখানে তো চুরি করার কিছু নেই”।





উত্তর এল, “সার, আমি চোর ঠিকই, কিন্তু সার আমি এখানে চুরি করতে আসেনি।

তাহলে তুমি কি চাও?

উত্তর এল “আমি সার যুদ্ধে যোগ দিতে চাই”।



ক্যাপ্টেন হাসানের মুখে হালকা একটা হাসির রেখা দেখা দিল।



এই হাসি একই সঙ্গে দুটি অর্থ তৈরি করে,



এই উত্তরে তিনি গর্বিত এবং বিস্মিত



কারণ উত্তরদাতার বয়স দশ বছরও হবে কিনা সন্দেহ!



.......................................................................................।



এই কথা শোনার সাথে সাথে জহুরুল এই কিশোরের ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে নিল।



ক্যাপ্টেন হাসান তাকে শুধালেন, “কেন তুমি যুদ্ধ করতে চাও”?



“আমি সার খানদের খুন করতে চাই”!



কেন?



তারা আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। আমাদের গ্রামে আগুন দিয়েছে। আমি এর প্রতিশোধ নিতে চাই।



কথা বলার সময় ছেলেটার চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল।

..................................................................।।



যুদ্ধের আগুন যতই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, লড়াই ততই ভয়ঙ্কর হচ্ছে।



আর এই কিশোরের মধ্যে লড়াইয়ের আগুন যেন তীব্র হচ্ছে।



মাঝে মাঝে আলোচনার ভেতরে সে এসে হাজির হয়। দাবী একটাই, সে যুদ্ধে যেতে চায়।



ক্যাপ্টেন হাসান ভাবেন, যুদ্ধ কি আসলে ছেলেখেলা?



তাকে শুধান, “তুমি যে যুদ্ধ করবে, তুমি তো এখনো অস্র চালাতে শেখনি ?



“তাইলে সার আমাকে এমন কাজ দেন যা আমি করতে পারি”



তুমি বল? তুমি কোন কাজটা ভালো পার?



সার! আমি খুব ভালো চুরি করতে পারি।



এক অট্টহাসিতে সকালটা ভরে গেল!



ক্যাপ্টেন হাসান মজা করার লোভ সামলাতে পারলেন না।



আমোদের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, তাই!



ছেলেটি উত্তর দিল, জি সার! সবাই বলত আমার বাপ নাকি ওস্তাদ চোর ছিল! কিন্তু আমার বাপ আমাকে বলত, একদিন তুই আমাকে ছাড়ায় যাবি!



সার! আমি এই কাজে আমি খুব দক্ষ! আমার কোন ট্রেনিং লাগে নাই।



ইতোমধ্যে মেজর রাঠোর টের পেয়েছেন, একটা মজার আলোচনা চলছে।



তিনি ক্যাপ্টেন হাসানকে শুধালেন, কি আলোচনা হচ্ছে আমিও একটু শুনি (বাত ক্যায়া হ্যায়, হামভি তো শুনে)!



তিনি মেজর রাঠোর কে সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললেন, ছেলেটার দাবী কি!



মেজর রাঠোর বললেন, “কি চুরি করতে চায় সে”? (ক্যায়া চুরানা চাহতা হ্যা ইয়ে?)



ছেলেটা বলল, সে পাকিস্তানী সেনাদের ঘাঁটি চেনে। যদি তাকে সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে সে সেখান থেকে অস্ত্র চুরি করে নিয়ে আসবে!



মেজর রাঠোর সাথে সাথে মাথা নাড়লেন। প্রস্তাব হিসেবে তা মোটেও বাস্তব সম্মত নয়।



কিন্তু ছেলেটা নাছোড়বান্দা।



তার একটাই দাবী। সে পারবে এবং তাকে একটা সুযোগ দেওয়া হোক!



প্রচণ্ড দাবীর মুখে অবশেষে এই কিশোরের জয় হল।



সে দিনের অন্ধকার রাতেই ছেলেটা রওনা দিল পাকিস্তানী সেনা ছাউনির দিকে!



অন্ধকারে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা জোনাকের আলোয় হঠাৎ ক্যাপ্টেন হাসানের মাথায় একটা চিন্তা তীব্র হয়ে দেখা দিল।

তিনি কি ঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন?



কারণ এই অবস্থায় ধরা পড়লে শাস্তি একটাই, আর সেটা হল ‘মৃত্যু’।

..............................................................................।

রাত যত গভীর হতে থাকল ক্যাপ্টেন হাসানের শঙ্কা তীব্র হতে থাকল।



একবার মনে মনে ভাবলেন, তাকে ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু এই অন্ধকারে আরেকজনকে তাহলে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হবে।



ঘুম আর আসবে না। তিনি অন্ধকারে পায়চারী করতে শুরু করলেন।



রাত অন্ধকার। সময়টা তার চেয়ে অন্ধকার। চারিদকে এক বিষণ্ণ নিস্তব্ধতা । অন্য সময় শোনা যেত ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। আজ যেন তারা ডাকতে ভুলে গেছে। জোনাকের আলো জ্বলছে আর নিভছে। ঠিক তার চিন্তার মত।



দুরে বাঁশবনে এক পাল বক হঠাৎ ডানা ঝাপ্টালো। তার শব্দ রাতের ঘুমকে যেন ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে গেল।



ছেলেটা কি পারবে?

সে কি দুশমনের আস্তানা আসলে চেনে?

সেখানে অস্ত্র কোথায় রাখা আছে? তা তো সে জানে না! যদি ভুল করে অন্য জায়গায় ঢুকে পড়ে।



তিনি ক্যাম্প থেকে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলেন। তার সামনে অন্ধকারেও যেন দিগন্ত বিস্তৃত এক বাংলাদেশ ধরা পড়ল।



বাংলাদেশ, এখনো তার জন্ম হয়নি, কিন্তু এই যুদ্ধ যেন পূর্ব বাংলার গর্ভ ধারণ।



মেজর হাসান নিশ্চিত একদিন দেশটি স্বাধীন হবে। তাঁর সামরিক চেতনা তাঁকে জানান দিচ্ছে, এই দেশ স্বাধীন হতে আর বেশী দেরি নেই।



পাকিস্তানী সেনার এখন পিছু হটতে শুরু করে দিয়েছে।



বন্যার সময় মুক্তিযোদ্ধারা কাদা আর পানিতে তাদের নাস্তানাবুদ করেছে।



এখন তারা নিজেদের ক্রমশ সামরিক ঘাঁটিতে আবদ্ধ করে ফেলছে। তারা বুঝতে পারছে না নিজেদের নিরাপত্তার ঘোরটোপে নিজেরাই বন্দী হয়ে যাচ্ছে।



অন্ধকারে আবার সেই কিশোরের মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। শঙ্কার চিন্তাটা ক্রমশ মনের মধ্যে তীব্র হচ্ছে। এমন সময় মনে হল সামনের ঝোপটা নড়ে উঠল। ছেলেটা কি ফিরে এসেছে? এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা না। সতর্ক হলেন। অন্ধকার এখন সয়ে এসেছে। আবছায়া সব কিছু দেখতে পাচ্ছেন, কিন্তু কোন মানুষ নয়, হবে হয়ত কোন শেয়াল!



ক্যাম্পের দিকে আবার হাটতে শুরু করলেন, ক্যাম্পের সেই আম গাছের নীচে আসতে টের পেলেন, আরেক জন লোক সেখানে পায়চারী করছে। তিনি ক্যাপ্টেন রাঠোর।



বুঝতে পারলেন ছেলেটাকে হায়নার গুহায় পাঠিয়ে তিনি নিজে যে অস্থিরতায় পড়ে গেছেন, মেজর রাঠোর সেই একই ভাবনায় বাস করছে।



মেজর হাসান ভাবনাকে পাল্টাতে চাইলেন।



যখন বাংলাদেশ স্বাধীন তখন দেশটা কেমন হবে?



তিনি একটা হাসিখুশী বাংলাদেশের ছবি আঁকার চেষ্টা করলেন। যে বাংলাদেশে কোন অভাব নেই,ক্ষুধা নেই, দারিদ্র নেই।



কিন্তু ঘুরে ফিরে আবার ছেলেটা তাঁর মাথায় চলে এল, সে কি ফিরে আসতে পারবে? স্বাধীন বাংলাদেশে একটি সুন্দর জীবন যাপনের জন্য।



মানুষের চিন্তা কতটা গতিশীল?



সেই মূহূর্তে মেজর হাসানের মাথায় সকল ভাবনা একের পর এক ছবির মত এসে চলে যেতে থাকল, কেবল ছেলেটার মুখ স্থির হয়ে রইল।



মানুষ অনেক সময় ঘোরের মধ্যে চলে যায়। মেজর রাঠোরের এক আওয়াজে তাঁর ঘোর কেটে গেল।

“কর দিখায়া, সাচ মুচ কর দিখায়া” ( কাজ করে দেখিয়েছে, সত্যিকারে সে কাজটা সম্ভব করেছে)। মেজর রাঠোরের উচ্ছ্বাস ক্যাম্পকে জাগিয়ে দিয়েছে।



কিশোরের কাঁধে দুটি রাইফেল, যার ওজনে সে প্রায় মাটির সাথে নুয়ে পড়ার দশা। সাথে লুঙ্গির কোচর ভর্তি গুলি আর কিছু গ্রেনেড।



কিন্তু এত ওজন নিয়েও সে নিঃশব্দে ফিরে এসেছে।



ভোরের আলো ক্যাম্পে তখন উঁকি দিচ্ছে, ঠিক যেমন করে উঁকি দিচ্ছে স্বাধীনতা।



সেই চোর কিশোর তখন জহুরুলের কাঁধে।



সবাই অস্র আর বুলেট সবাই পরীক্ষা করে দেখছিল।



এই কিশোর চোরটি তখন উচ্চতায় সবাইকে ছাড়িয়ে।



তাঁর দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন রাঠোর একটা বিস্ময়ে উচ্চারণ করল,



ইয়ে ল্যাড়কা কামাল কা হ্যায়, তুমলোগ বাহাদুর সিপাহী, লেকিন ইয়ে কামালকা চোর সবসে উঁচা হ্যায়। (এই ছেলে অসাধারণ, তোমরা সবাই সাহসী সেনা, কিন্তু এ তোমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে)।



.................................



খাবারের দোকানের সবাই বিস্মিত হয়েছিল, কারণ কেউ জানত না কর্ণেল হাসান চোর পরিচয়ে যে জয়নালকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল, দেশের জন্য জীবন বাজী রেখে সে আসলে শত্রুর কাছ থেকে দেশের স্বাধীনতা চুরি করে এনেছিল।



সেই জয়নাল এখন আর চুরি করে না। সে এক স্বাধীন ব্যবসায়ী।





কর্ণেল হাসান ফিরে এলেন, কিন্তু সাথে জয়নালের একটা প্রশ্ন নিয়ে ফিরে এলেন। প্রশ্নটা এখনো তাঁর মাথায় ঘুরছে?



ফেরার সময় জয়নাল তাঁকে শুধালো,
“স্যার, আমি ছিলাম চোর, আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ আমাকে একজন সৎ নাগরিকে পরিণত করল। কিন্তু এখন যারা চুরি করে, তারা কারা? তাদের কে সৎ মানুষে পরিণত করতে স্যার আরো কয়টা যুদ্ধ দরকার?”



প্রশ্নটা কর্ণেল হাসানের মাথায় গেঁথে গেছে!



..............................................................................।



[* এটা একটা সত্যি ঘটনা। ১৯৭১ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমি দুঃখিত এই কারণে যে এই গল্পের যারা সত্যিকারে নায়ক তাঁদের প্রকৃত নাম আমার জানা নেই। একজন টিভির একটি টক শোর শোনা গল্প আমাকে শুনিয়েছিল, সেই গল্প কথক বীর মুক্তিযোদ্ধা যিনি ছিলেন, তিনি এখানে উল্লেখিত কর্ণেল হাসান। এ রকম ধারণা পেয়েছিলাম, যে আমার জানা নেই। তাই আমি এই গল্পটাকে নিজের মত সাজিয়ে সেই কিশোর যোদ্ধার খাবারের হোটেল দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর বা তার আশপাশে কোথাও, যদি কেউ আমাকে তাদের নাম জানান, আমি সাথে সাথে এই গল্পের চরিত্রগুলোর নাম পাল্টে ফেলতে বাধ্য ]
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×