কিংকর্তব্যবিমূঢ়.......
ডিপ্রেশনের উচ্চমাত্রায় ব্রেইনের সেল গুলো উঠানামা করছে। কোন ভাবেই শান্ত হওয়া যাচ্ছে না। ব্রেইন প্রতিনিয়তই শীতল রক্ত উঞ্চ করে তুলছে। চোখে দিশা দেখছে না। বিবর্ণ ঠিক ভাবে দাঁড়াতে পারছে না। সামনে এক কদম দিবে সেই শক্তি তার লোপ পাচ্ছে। সে এ মুহুর্তে যা ভাবছে জঘন্যতম একটা কাজ। পথ একটায়, এটাই তাকে করতে হবে। সময় বেশিক্ষণ নাই। খুব শীঘ্রই করতে হবে। ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসতেই মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে, সামনের সব কিছু যেন ঝাপসা মনে হচ্ছে।রিপনের দোকান থেকে এক পেকেট সিগারেট নিয়ে একটা ধরাল , টানতে টানতে পৌঁছাল বাস ষ্টেশনে। পানের দোকানে রিক্সাওয়ালা ছেলেটার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়েছে আজ দুপুরে। স্থান ভালো করে চিনে না আজকাল দোকানের নিচে ঠিকানা ভালো করে লিখা থাকে, খুঁজতে খুব একটা সমস্যা হবে না ।
জানালার পাশে একটা সিটে বিসে গেল।এতে সিগারেট টানটে বেশ সুবিধা। পকেটে থাকা সিগারেট বের করে আবার টান দিচ্ছে। চোখ মুখ লা হয়ে আছে। গত রাত থেকে এখনো ঘুম হয়নি। রাস্তার পাশে দোকানের লাইট গুলো জ্বলছে। কিছু কিছু সুপারস্টোরে ছোট ছোট বাচ্চারা দৌড়ের তালে বিভিন্ন জিনিস পত্র ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে মা-র কাছে চলে যাচ্ছে। এইসব দেখতে আজ বিবর্ণের ভালো লাগছে না।
প্রায় আধ ঘন্টা পরে বাসের হেল্পার ডাক দিল,বিবর্ণের গন্তব্য স্থল এসে গেছে। বাস থেকে নেমে কিছুক্ষণ হাটলেই গন্তব্য। রিক্সাচালক যেমন বলছিল ঠিক তেমন ই দেখতে, চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না এটা সেই জাগা। পকেটে সিগারেট এক পেকেট আছে। আর একটা সিগারেট ধরাল, মনস্থির করল বিবর্ণ। জঘন্যতম জাগায় সেই আজ পা দিবেই।আগে শুধু বই কিংবা টেলিভিশন নিউজে শোনেছিল, আজ সে নিজেই সেই পথের যাত্রি। আজ কোন কিছুর লেহাজ তার নাই। ভুলে গেছে সে ইউনিভারসিটির স্টুডেন্ট। কোন কিছুর কথা মনে পড়ছে না তার। সিগারেট শেষ হতেই ডুকে পড়লো রুমে।
রুমে ডুকতেই ভেতরে থাকা রমণী বলল, কিরে তোরে দেখতে তো হ্যানসাম লাগছে। বড় লোকে পুলা বুঝতেছি। যাগ তাহলে দেরি হলেও আজকে ইনকাম ভালো হবে। বিবর্ণ গম্ভীর গলায় বলল, আপনাকে কত টাকা দিতে হবে। হ... বড় লোকের পুলা টাকার ভাব দেখাইস। আমার পাঁচটা এক-শ টাকার নোট দিলেই হলো। বিবর্ণ গচ করে ম্যানি ব্যাগ খুলে এক-শ টাকার পাঁচটা নোট দিয়ে বলল, এই নিন আপনার টাকা। বাব্বাহ... পুলার দম আছে দেহি। বড় লোকের পুলা টাহার তো অভাব অইবো না।
মেয়েটা উলটা দিকে ফিরে তার শাড়ীর আচল ফেলে দিল নিচে। বিবর্ণ চমকে উঠলো... এই এই কি.. আপনি কি করছেন? ওমা... পুলা তো দেহি লজ্জা পায়। আমার লক্ষি সোনা, দুধের বাচ্চা, কত লজ্জা করে। প্লিজ আপনি শাড়ি খুলবেন না। আপনাকে রিকুয়েস্ট করছি। প্লিজ আপনি শাড়ি খুলবেন না। ওই ব্যাট.. এহানে কি ঢং কিরতে আইসো... এত ঢং করলে আইসো ক্যান? বিবর্ণ বলল.. আপনার সাথে গল্প করব বলে এসেছি। মেয়েটা দুষ্ট হাসি হেসে বলল, আইলা.. এই কি শোনি... এইহানে আইসে গল্প করতে.. শোন মিয়া বড় লোকের হুজুর সাহেব, এহানে দেহ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। এহানে শুধুই দেহ পাওয়া যায়। টাহা দিয়ে দেহের ক্ষিদে মিটায় বুঝলে হুজুর সাহেব। আবার দুষ্টু হাসি হাসলো মেয়েটা।
বিবর্ণ আবার বলল, প্লিজ আপনি আমার কথা বুঝার চেষ্টা করেন। আমি এই সব করতে আসিনি.. আপনার সাথে সময় কাটাতে এসেছি। প্লিজ আমার কথা একটু শোনেন প্লিজ। মেয়েটা বলল, টাহা দিছস, টাহা তো হালাল করতে ওইবো। তাইলে ক তোর কথা শোনি। আপনার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করব। মেয়েটা বলল, আমার কাছে কোন গল্প নাই, আছে শুধু দেহ। সবাই আসে দেহের চাহিদা মিটাতে। বুঝলে লক্ষি ছেলে.. হাহাহা। বিবর্ণ বলল, আমি আজ আত্মহত্যা করব। সুইসাইড করব আমি আজ রাতে, শেষ মুহূর্তে কারো সাথে মন খুলে গল্প করার জন্য এসেছি। পরিচিত কারো সাথে গল্প করলে সুইসাইড করা আর হবে না, তাই অপরিচিত কারো কাছে এসেছি, আমার মৃত্যুতে যার কিছু আসবে যাবে না।
মেয়েটা বলল, তো কি ভাবে সুইসাইড করবি.. গলায় ফাঁস দিয়ে নাকি বিষ খেয়ে.. কোনটা করবি। বিবর্ণ বলল এখান থেকে বের হয়ে বড় কোন ট্রাকের নিচে লাফ দিব। ব্যাটার সাহস আছে দেহি। দেখতে এত হ্যানসাম, বাপের তো টাহা পয়সা আছে, মরতে ইচ্ছে করে ক্যান? ছ্যাকাতেকা খায়লি নাকি। আজ আমার সাত বছরের প্রেমিকা তার স্বামীর সাথে বাসর রাত মানাবে। আর আমি তার ছবি দেখে তার প্রমের সাগরে দিশেহারা মাঝির মত ব্যাকুল হৃদয়ে ধড়ফড় করব। তার চেয়ে ভালো ট্রাকের নিচে লাফ দিয়ে মরে যাওয়া। কেউ বুঝবে না, আমি সুইসাইড করেছি। সবাই ভেবে নিবে আমার এক্সিডেন্ট হয়েছে। পুলিশ এসে ট্রাকটা থানায় নিয়ে যাবে, ট্রাকের নামে মামলা হবে। ট্রাক ড্রাইভার ততক্ষণে অনেক দূরে পালাবে।
কিরে ব্যাটা ছোট বেলায় তোরে তোর মা দুধ না খাওয়ায়া কি মুত খাওয়ায়ছে নাকি? একটা মায়্যার লাইগ্যা জীবনটা শেষ করে দিবি? তোর কি ঘরে মা বোন নাই? জীবন কি এতই সস্তা..?? হুম টাকা যখন দিসস তোরে এখ্যান গল্প শোনাই। একটা মেয়ে.. সবে মাত্র ক্লাস টেনে পড়ে। দুর্ঘটনায় বাবা মারা যায়, ঘরে দুই বোন ছোট ছোট। মা আছে কিন্তু বেকার। কাজ তো করতে না তার উপর হাই ব্লাড প্রেশার। ইদানীং মরণ অসুখে ধরেছে তারে। ডাক্তার বলেছে ওষুধ ঠিক মতন দিতে পারলে বাচবো। মেয়েটা পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করাত, ছোট বোন দুইটা কিছুই করতে পারে না। একজন ক্লাস ওয়ানে পড়ে। টিউশনিতে যে টাকা পায় তাতে কোন রকম খেতে পারলেও মা -র ওষুধের টাকা হয় না। পাড়ার একজন বিত্তবান লোক, তাকে পছন্দ করতো। কিন্তু মেয়েটা তার প্রতি কোন আকর্ষণ দেখালো না। ওইসব লোক যা ইচ্ছে করে। টাকার লোভ দেখায় প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্যাবহার করে কিছু দিন পরে স্বাদ মিটে গেলে লাথ্যি মেরে ঘর থেকে বের করে দেয়।
একদিন মানুষটা এসে মেয়েটাকে এক বান্ডেল টাকা মুখে ছোড়ে মেরে বলল,
তোর মায়ের ওষুধের জন্য কত টাকা লাগে নেয়। তোই শুধু বল আমার সাথে একটি রাত কাটাবি। বিয়ে করতে চাইলেও আমার আপত্তি নায়। তোর মতন এত্ত সুন্দর মায়্যার লগে থাকতে পারলে নিজে তো ধন্য হয়ে যাব। মেয়েটা রেগে থাকতে না পেরে পায়ের জুতা খুলেই মানুষটা মুখে ছোড়ে মারল। মানুষটা শুধু বলল, দেখ্.... আমার সাথে বিয়াদবি করেছিস.. আমি তোরে দেখ্যা নিব। মনে রাখবি কিন্তু। একদিন টিউশনি থেকে আসার সময়, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল, রাস্তায় তেমন কেউ নাই বললেই চলে। হঠাৎ দুই দিন জন মানুষ এসে মেয়েটাকে জোর করে ধরে নিয়ে বাঁশ ঝাড়ের পিছনে। এর পরে যা হলো তা অবর্ণনীয়। যাওয়ার সময় তিনটা এক-শ টাকার নোট ছোড়ে মেরে বলল, ধর নেয়।তোর মায়ের ওষুধ খরচ অইবো।
মেয়েটা তখন ভেবে নিল, জগতে ভালোভাবে বাসতে চাইলে, গরিবের কোন ঠাই নাই। মাস শেষে টিউশনির দেড় হাজার টাকায় কিছুই হয় না। মা-র চিকিৎসকা করাতে হবে। মাকে বাচতে হবে। ছোট বোন দুইটাকে পড়াশোনা করাতে হবে। মাসের শেষ তারিখের অপেক্ষা না করে এক দেড় ঘন্টায় যদি তিন-শ টাকা কামা যায় মন্দ কি। মার চিকিৎসা ও হবে। মাও বাচবে... আমি না হয় ঘৃণিত হলাম। সম্ভ্রমহীন নারীর আর কিই বা আছে। হয়ে গেলাম পতিতালয়ের বাসিন্দা, নতুন নাম হয়েছে বিউটি। শোনেছিস গল্প? বিবর্ণ এর শরীর অনেকটা শীতল হয়ে এসেছে। মানুষ এত কিছুর পরেও বেচে আছে আর আমি একটা মেয়ের জন্য আমার জীবনকে শেষ করে দিচ্ছি। যে জীবন সৃষ্টিকর্তার আমানত। ঠিক এই মুহূর্তে এশারের আজান ভেসে আসছে মসজিদের মিনার থেকে। বিবর্ণের মাথা থেকে চলে যেতে লাগলো আত্মহত্যার চিন্তা। মনে পড়েছে তার ছোট একটা বোন আছে। তাকে ভাইয়া বলে ডাকে। তার জন্য অপেক্ষা করে ভাইয়া আমার জন্য খেলনা আনবে, চকলেট আনবে, আমাকে নিয়ে শিশু পার্কে যাবে। মেয়েটা বলল, শোন বড় লোকের ছ্যাকা খাওয়া পুলা, একটা মায়্যার লাইগ্যা জগতটা ছেড়ে যাইস না। মায়্যা তো আইব যাইবো। জীবন গেলে কি আর পাবি? ঘরে যা, তাওবা করে মায়ের পা ধরে সালাম দিয়া নতুন জীবন শুরু কর। মায়ের পদ তলে কিন্তু জান্নাত.... আমার এখনো মনে আছে মকতবের পড়া। বিবর্ণের মনে পড়েছে আত্মহত্যার জঘন্য শাস্তির কথা।
সেই হাদীস পাঠে পড়েছিল.. রাসূল (সাঃ) এর বাণী .....
(১) যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের উপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে সর্বদা নিজেকে সেই ভাবে নিক্ষেপ করতে থাকবে।
(২) যে ব্যক্তি বিষ পান করে আত্মহত্যা করবে, সেও জাহান্নামে সর্বদা নিজ হাতে বিষ পান করতে থাকবে। বিবর্ণের মাথা থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা নেমে যায়। মেয়েটাকে বলল আপনাকে ধন্যবাদ।মেয়েটা বলল টাহা নিয়ে যা, হালাল হবে না। তোই আমার শরীর স্পর্শ করিস নাই। কেন হবে না হালাল। আত্মহত্যা থেকে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছন আপনি, রেখে দিন টাকা গুলো। বিবর্ণ বের হয়ে গেলো নতুন জীবনের সন্ধানে।
লেখাঃ বিন কাউসার
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:১০