somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সরদারের সঙ্গে আলাপ

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



প্রচলিত রীতির সাক্ষাৎকার দিতে সরদার ফজলুল করিম গররাজি ছিলেন। ফলে তার নিজের জীবনীতে কোনো কথা আদায় করা কঠিন। নানা সময়ের বিক্ষিপ্ত সংলাপগুলো এখানে সূত্রবদ্ধ করছেন শাহীন রহমান


সরদার ফজলুল করিম এ উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, লেখক ও মনীষী। প্রগতিশীল ও সাম্যবাদী আন্দোলনের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। নানা অর্থে বহুমুখী বর্ণালী এক অসামান্য চরিত্র। সব সময়ই মগ্ন ছিলেন সাম্যবাদী জ্ঞান চর্চায়। যুগপৎ সহজ ও গভীর ব্যাখ্যায় সাম্যবাদের স্বপ্ন- সঞ্চারি, যিনি অসংখ্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন সে স্বপ্ন পূরণের সাধনায়। নিজেকে 'কৃষকের পোলা' ভাবলেও চিন্তা-ভাবনা-চেতনায় ছিলেন এ জনগোষ্ঠীর এক অসাধারণ সত্যান্বেষী মনীষী। বিশ্ব জ্ঞান-দর্শন-মনীষার সঙ্গে বাঙালি মননের অন্যতম যোগসূত্র স্থাপনকারী। ১ মে ১৯২৫ সালে বরিশালের অাঁটিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছিলেন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অসাধারণ কৃতী ছাত্র। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে তিনি ১৯৪২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। অনার্স ও এমএ উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠকালে সাম্যবাদী আদর্শে দীক্ষা লাভ করেন। স্কুলজীবনে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পথের দাবি পড়েই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অধ্যয়নকালে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৪২-৪৬) অধ্যয়ন সমাপ্ত করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে, বিলাতে স্কলারশিপের আমন্ত্রণ ছিঁড়ে ফেলে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তার কিছুদিন পর নরসিংহদীর চালাকচরে আত্মগোপন করেন। পাকিস্তান আমল থেকে চার দফায় প্রায় ১১ বছর কারাজীবন ভোগ করেন। কারাবন্দিদের প্রতি অমানবিক আচরণের প্রতিবাদে ৫৮ দিনের অনশনে অংশগ্রহণ করেন এবং কারাগারে থাকাকালীন অবস্থাতেই পাকিস্তান কনস্টিটুয়েন্ট এসেমবিস্নর সদস্য নির্বাচিত হন। কারামুক্তির পর এক পর্যায়ে বাংলা একাডেমির অনুবাদ বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের উদ্যোগে অধ্যাপক হিসেবে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন এবং সেখান থেকে অবসর নেন। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনারারি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। অধ্যাপনায় ফিরে আসার পর জ্ঞান সাধনার পাশাপাশি দেশের অসংখ্য নবীন-প্রবীণ নর-নারীকে সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করে গেছেন। অন্তরালবর্তী থাকতে চাইলেও সব প্রগতিশীল নেতাকর্মী নানা সঙ্কটে তাঁর কাছেই দিশা পেতে ছুটে গেছে বার বার। তিনি আসলে এ দেশের প্রগতিশীল ও সাম্যবাদী চিন্তা ও তৎপরতার বাতিঘর। ২০১১ সালে তাঁকে জাতীয় অধ্যাপকের সম্মানে ভূষিত করা হয়।


প্রকাশিত গ্রন্থবলি : দর্শনকোষ, নূহের কিশ্তি ও অন্যান্য প্রবন্ধ, গল্পের গল্প, নানা কথা, নানা কথার পরের কথা, রুমীর আম্মা, সেই সে কাল : কিছু স্মৃতি কিছু কথা, চলি্লশের দশকের ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের আলাপচারিতা, আবক্ষ, আর এক যুগে এক যুগোসস্নাভিয়ায়, অনশনে আত্মদান ইত্যাদি। অনূদিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ : প্লেটোর সংলাপ, প্লেটোর রিপাবলিক, এ্যারিস্টটলের পলিটিকস্, রুশোর সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট, এঙ্গেলসের এ্যান্টিডুরিং, আমি রুশো বলছি, ম্যাকিয়াভ্যালির দি প্রিন্স।





প্রচলিত রীতিতে সাক্ষাৎকার প্রদানে অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের ছিল প্রবল অনীহা। নিজেকে জ্ঞান করতেন সামান্য মানুষ হিসেবে। এ সাধারণ হওয়ার সাধনাই তাঁকে অসাধারণ করেছে। তাঁকে দিয়ে স্ব-জবানীতে নিজের কথা আদায় করা ছিল প্রায় অসম্ভব। অথচ অন্যদের খুঁচিয়ে তোলেন তাদের ভেতরের মানুষটিকে তুলে ধরার জন্য। নিজে লিখতেও চান নি তেমন। গুরু সক্রেটিসের মতো তর্ক-বিতর্ক-ডায়লগের মাধ্যমে জীবন ও সত্য অন্বেষণে প্রয়াসী ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গে নানা সংলাপের মাধ্যমে তাঁকে তুলে ধরার এই প্রচেষ্টা।





সরদার ফজলুল করিম : এসো আমরা তর্কাতর্কি করি। আমি কিছু বলি। তোমার ভালো না লাগলে, তুমি পাল্টা বলো। আমার যুক্তিকে খ-ন করো। এর আদর্শ দৃষ্টান্ত হচ্ছে প্লেটোর সংলাপ। তার একটি নমুনা শোনাই... সক্রেটিস তাঁর শিষ্যদের প্রশ্ন করলেন : ন্যায় কাকে বলে? শিষ্যদের একজন বলল : এ আর এমন কি কঠিন প্রশ্ন? ন্যায় হচ্ছে যার যা প্রাপ্য তাকে তাই দেয়া। সক্রেটিস বললেন : বেশ, তাহলে চিন্তা করো এমন একটা অবস্থার কথা যেখানে এক ব্যক্তি সুস্থ অবস্থায় আমার কাছে একটি অস্ত্র জমা রেখেছিল। এখন সে অসুস্থ। কিন্তু অস্ত্রটি এমন অবস্থাতেও সে ফেরত চাচ্ছে। এটি তার প্রাপ্য, এখন আমি কী করব? আমি কি অস্ত্রটি তাকে ফেরত দেব? ফেরত দিলে এ ফেরতদানের ফলে অস্ত্রের মালিকের দ্বারা নানা মারাত্মক অঘটন ঘটতে পারে। বলো, এমন অবস্থায় আমি কী করব? জবাবে শিষ্যরা বলল : না, এমন অবস্থায় তুমি অস্ত্র ফেরত দেবে না। সক্রেটিস বললেন : তাহলে দাঁড়াল- ন্যায়ের সংজ্ঞা হিসেবে যার যা প্রাপ্য তাকে তা দেয়া বলে আমরা স্থির করতে পারিনে। আসলে সংলাপই আমাদের নিত্য মুহূর্তের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম : পিতামাতার সংলাপ, ভাই-বোনের সংলাপ, চায়ের টেবিলে বন্ধুতে-বন্ধুতে সংলাপ। কথা-প্রতিকথা, প্রশ্ন-জবাব, আবার প্রশ্ন, আবার জবাব : এরই মধ্য দিয়ে আমরা সত্যে পেঁৗছার চেষ্টা করি। সেদিক থেকে লেখাই বলো আর বক্তৃতাই বলো, তা হচ্ছে কৃত্রিম। সংলাপ স্বাভাবিক। সংলাপে আমাদের হৃদয় উন্মুক্ত। লেখায় আর বক্তৃতাতে আমরা চতুর। যত না প্রকাশ করি, তার অধিক গোপন করি। কিন্তু তাই বলে তোমাদের শিক্ষাদানের জন্য আমি কথাটা তুলছিনে। আমি শিক্ষা পাওয়ার জন্য বলছি। তোমরা নতুন প্রজন্মের প্রতীক। আমি পুরনো বাসি দিনের স্মারক। তোমাদের সঙ্গে তর্ক বাদে তোমাদের নাগাল পাওয়ার আমার উপায় কী?


শাহীন রহমান : ঠিক আছে আমরা সেভাবেই শুরু করছি। আপনি প্রায়ই বলেন মানুষের জীবনটা একটা বিরাট বই... জীবন আসলে কী...


স. ফ. ক : আমি মনে করি প্রত্যেকটা মানুষ একটা বই। দেশ ১৩ কোটি মানুষকে নিয়ে-আমরা ঘাবড়াই কেন! ১৩ কোটি বই থাকা একটা সাংঘাতিক ব্যাপার। আমাদের ১৩ কোটি বই আছে। দরকার শুধু পাঠ করা। যে বই মানুষ পড়ে না সে বই তো বই না। বইটা আমাদের পড়তে হবে, তার সূচিপত্র, নির্ঘণ্টটিও দেখতে হবে। এভাবেই পাঠ করতে হয়। কিন্তু আমাদের ছেলেমেয়েরা মানুষ নামক এ বই পাঠ করতে চায় না। তাহলে একটা গল্প শোনো-একজন ছাত্র আমাকে বলল, 'স্যার, আপনি তো ক্লাসে ভালো ভালো কথা বলেন, এমন একটা বইয়ের নাম বলেন, যে বইয়ে সব আছে।' তখন আমি বললাম, কাগজ-কলম নাও, লেখো, জীবন। সে বলল, 'স্যার, এ বইয়ের লেখকের নাম কি?' আমি বললাম, লেখো, জীবন দত্ত। তুমিও সেই ছাত্রটির মতোই প্রশ্ন করেছ। জীবন, জীবন। জীবনের সহজ কোনো সংজ্ঞা নেই। তুমি এমন কোনো অভিধান পাইবা না, যাতে জীবনের সহজ অর্থ আছে। তুমি জীবনের এত সহজ অর্থ খোঁজ করো কেন? জীবনের অর্থই জীবন। জীবন জীবিত থাকে আর মৃত্যু হলো যারা চলে যায়। ...এ মারা যাওয়াটা একজন ব্যাক্তির Extinction, এটা মানুষের Extinction নয়। এ রকম ভাবনা নিয়ে আমি বেঁচে আছি। তাই মৃত্যুর জিগির করি না। জীবন প্রবহমান। জীবন জয়ী হবে। মৃত্যু পরাজিত হবে।


শা. র : যদি জিজ্ঞেস করি কেমন আছেন...


স. ফ. ক : তুমি কেমনের 'ম'টা বাদ দিয়া জিগাও। বলো, কেন আছেন? মানুষ আমাকে ভালোবাসে বলেই বেঁচে আছি। আর অন্যভাবে আমি তো এসব ব্যাখ্যা করতে পারব না। আমার আর বেঁচে থাকা না থাকা সমান। আমি জানি আমি একদিন থাকব না, তোমরা থাকবে। মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জন্মকে চেনা যায়। আমার তো এখনও জন্মই হয়নি। কারণ আমি তো এখনও মরিনি। চিন্তার দিক থেকে বলতে গেলে, মানুষ এখনও সব আবিষ্কার করতে পারেনি। কিন্তু মানুষ ধীরে ধীরে অনেক কিছু আবিষ্কার করবে। এসব যখন ভাবি তখন আমার ভালো লাগে। জীবন সম্পর্কে আশাবাদী হয়ে উঠি। 'জীবন মানেই যন্ত্রণা' আমি এ তত্ত্বে বিশ্বাস করি না। যা অনেক কিছু দিতে পারে এবং নিতে পারে তাই জীবন। একই সঙ্গে আত্মত্যাগ ও উপভোগই জীবন। আসলে আমরা মানুষ হওয়ার জন্য বেঁচে আছি। মানবিক সভ্যতা তৈরির জন্য বেঁচে আছি। আমি তো জন্মগ্রহণ করিনি, আমাকে জন্ম দেয়া হয়েছে। তাই নিজেকে মারতে পারি না- ইউ হ্যাভ নো রাইট টু ডাই।


শা. র : আপনি প্রায়ই ফিলোসফি, দর্শন, জীবনদর্শন এসব কথা বলেন, কেন? এত বিষয় থাকতে বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়তে গেলেন কেন?


স. ফ. ক : অধ্যাপক হরিদাস ভট্টাচার্যের জন্য... তিনি ক্লাস নিতেন আমি ক্লাসের পাশ দিয়ে যেতাম। তখন সত্য-মিথ্যা সম্পর্কে বলতেন। ফিলোসফির ক্লাসে ঢুকে আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। সেজন্য ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েও ফিলোসফিতে এসেছিলাম। ...সহজ ভাষায় দর্শন বলতে বুঝি, যে যেমন দেখে সেটাই দর্শন। সাধারণ অর্থে ফিলোসফি বলতে বুঝায় দেখা- এ তুমি যা দেখো, আমি যা দেখি এবং যেভাবে দেখি, সেইটাই ফিলোসফি। দর্শন হচ্ছে সব কিছুকে টোটালি দেখা। যুক্তির মধ্যে দিয়ে দেখা। বিবেকানন্দের জীবন দর্শনও একটা বিশেষ দর্শন। দর্শন বাদে মানুষ নাই। আবার খারাপ দর্শনও আছে। দর্শন যে শুধু মহৎ ব্যাপার তা তো না। যারা মারছে তাদের দর্শন আছে না? আমি সক্রেটিসের দর্শনকে ভালোবাসি। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসফি ডিপার্টমেন্টের কোনো ফিলোসফি নাই। দেখো, যে ফিলোসফি মানুষকে মানুষ বানায় না, সেই ফিলোসফি দিয়ে তোমার আমার লাভ কী? ফিলোসফির ডিগ্রি হচ্ছে; কিন্তু ফিলোসফির ছাত্র কমে যাচ্ছে। কারণ এখন আর কেউ ফিলোসফি নিয়ে চিন্তা করে না, এটা গভীর ভাবনার বিষয়।


শা. র : সক্রেটিস প্লেটো এসব পড়তে পড়তে কমিউনিস্ট হলেন কেমন করে?


স. ফ. ক : ৪৩ সালে খুব বড় একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। বাংলা পঞ্চাশের মন্বন্তর বলে ওটাকে। আমি তখন সক্রেটিস, প্লেটো, হেগেল ইত্যাদি নিয়ে পড়াশোনা করছি। একদিন এক কমরেড এসে বলল, এই, তুমি এত কী লেখাপড়া কর, অাঁ? হেগেল তোমাকে কোন স্বর্গে নিয়ে যাবে? তোমার মা-বোনেরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে, আর তুমি হেগেল পড়ে কী করবে? ওরা আমাকে বলল, তুমি নয়াবাজার গিয়ে লঙ্গরখানায় ডিউটি করো। দ্যাখো গিয়ে সেখানে তোমার মা-বোনেরা এসে হাজির হয়েছে। আমি তো আর হেগেলের কাছে থাকতে পারলাাম না। পরদিন সিরাজউদ্দৌলা পার্কে গেলাম রিলিফের কাজ করতে। ...কমিউনিস্টই মানুষ, মানুষই কমিউনিস্ট। পৃথিবীতে যত সৎ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ আছে, মানুষের জন্য যার বুকে ভালোবাসা আছে আমি তাকেই কমিউনিস্ট বলি। তাই ভাবলাম কমিউনিস্ট হতে হবে।


শা. র : আপনি কথায় কথায় মার্কস-এঙ্গেলসের পাশাপাশি গৌতম বুদ্ধের কথা বলেন। গৌতম বুদ্ধ আপনাকে কেন আকর্ষণ করে?


স. ফ. ক : ইতিহাস তাঁকে প্রিয় ব্যক্তি বানিয়েছে। তিনি নিজেই স্ত্রী-পুত্র ত্যাগ করে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন, মানুষের জন্য কাজ করেছেন। এজন্য তিনি মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। তিনি মানুষ হওয়ার জন্য কতগুলো উপায়ের কথা বলেছেন, সৎ কর্ম, সৎ কাজ, মিথ্যে কথা না বলা ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর কথা এবং কাজ দুই-ই তাঁকে স্মরণীয় আর মহৎ করে তুলেছে। তবে কার্ল মার্কস এবং এঙ্গেলসের নাম বিশেষভাবে বলতে হয়। তাঁরা দুজনই খুব বড় মাপের দার্শনিক ছিলেন।


শা. র : আপনি বার বার বলেন, মানুষ মানুষ হতে আরও দেরি আছে...


স. ফ. ক : ...তুমি ভালো কথা বলেছ। তাহলে একটা গল্প বলি, শোন। হবস বলতেন, মানুষ জন্মগতভাবে স্বার্থপর। যেমন ধরো, একজন মহিলা গোসল করতে যাবে, তবু তার চাবির গোছা ছেলেমেয়েদের কাছে না দিয়ে নিজের অাঁচলে বেঁধে রাখে। সেজন্য তিনি বলতেন, মানুষ এখনও মানুষ হয়নি-মানুষকে মানুষ হতে আরও দেরি আছে।


আমার নিজের কথাও সেই রকমই। মানুষ এখনও মানুষ হয়নি- তাই এত হানাহানি মারামারি। মানুষকে মানুষ হতে আরও সময় লাগবে। মানুষ মানুষ হয়ে উঠতে পারলেই শান্তি আসবে, তার আগে নয়। মানুষ কেন মানুষের সঙ্গে অসম হবে? এটা তো যুক্তির বাইরে। মানুষ যদি একটি যুক্তিবাদী প্রাণী হয়, তাহলে মানুষরা অসমান হবে কেন? একটা পাখি তো আরেকটা পাখির সঙ্গে বা একটা হাতি তো আরেকটা হাতির সঙ্গে অসমান না। তারা তো অসাম্যের জন্য, বা সাম্যের জন্য লড়াই করে না। দু'পা থাকলেই তো মানুষ হয় না। কাজেই মানুষকে মানুষ হয়ে উঠতে হবে। তাকে যুক্তিবাদী হতে হবে। যুক্তির সঙ্গে আচরণ করতে হবে। মার্কস যেমন বলেছেন, মানুষের জীবনে এমন একদিন আসবে যেদিন রুল অব ম্যান ওভার ম্যান শ্যাল বি সাবসটিটিউটেড বাই রুল অব ম্যান ওভার থিংস। পশু জগতে পশু পশুর ওপর শাসন করে না। যাকে তোমরা পশুর জগৎ বলো, সে জগৎ তোমাদেরই এ অমানবিক মনুষ্য জগতের চেয়ে ঢের ভালো।


শা. র : আপনি তো রিকশায় চড়তে খুব পছন্দ করেন...


স. ফ. ক : ...আমি তখন মগবাজার থাকি। মোতালিব নামে একটা ছেলে সে ভালো কবিতা লিখত। আমাকে সে তার কবিতা পড়ে শুনিয়েছে। ওর কবিতা শুনে আমার মনে হইছে, আমি ওকে বলি, তুমি সিটে বসো, আমি রিকশা চালাই। আমি ওকে পেয়ে এতটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। রিকশা আমাদের ঐতিহ্য। একজন রিকশাচালক জীবনের এত চড়াই-উতরাই পার করেও কবিতা লিখতে পারে, মানুষকে নিয়ে ভাবতে পারে, সেটা আমি কল্পনা করিনি। এরা আমাদের গর্ব, এরা তো আমাদের উত্তরাধিকার। ওদের আমরাই উচ্ছেদ করেছি-ওরা উচ্ছেদ হওয়া কৃষক। এদের কথা ভাবলে ভীষণ কষ্ট পাই।


শা. র : আপনার বিলেতে না যাওয়ার গল্পটা বলুন...


স. ফ. ক : ...আমি কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি খুব কমিটেড ছিলাম। আমার বিলেত যাওয়ার ব্যাপারে একটা আমন্ত্রণ আসল। আমাকে কলকাতার পার্টি অফিস থেকে কার্ড পাঠালো ঢাকায়- 'কাম টু এটেন্ড মিটিং।' ওই মিটিংয়ে ঠিক হবে বিলেত যাওয়ার ব্যাপারটি। এটা এখন চিন্তা করাও যায় না। আমার স্কলারশিপটা ছিল ওভারসিজ স্কলারশিপ, ইংল্যান্ডে যাওয়ার জন্য। আগে যেমন জ্যোতিবসু বিলেত গিয়েছেন। আমি গেলাম ইন্টারভিউ কার্ড নিয়ে কলকাতায়। তখন এ স্কলারশিপটা দেয়া হতো কেবল হিন্দু ছাত্রদের, মুসলমান ছাত্রদের কখনও স্কলারশিপটা দেয়া হতো না। সে যাক, আমি একজন মুসলমান ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সেটা পেয়েছিলাম। আমি কলকাতায় গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে উঠলাম। কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ছিলেন কমরেড মুজফফ্র আহমদ (কাকা বাবু) এবং কমরেড নৃপেন চক্রবর্তী (ত্রিপুরার প্রয়াত প্রখ্যাত বামফ্রন্ট ও সিপিএম নেতা)। আমি তাঁদের কাছে হাসতে হাসতে একটু রসিকতা করার ঢঙে বললাম, দাদা আমি তো বিলেত যাচ্ছি। কার কাছে গেলে পরে আমাকে বিলেত যাওয়ার চান্স দেয়া হবে? তখন দুজনই বললেন, 'আপনি বিলেত যাবেন, আর আমরা এ ভারতবর্ষে বসে কি ভ্যারেন্ডা ভাজব?' 'কাঁথা-কম্বল নিয়া পার্টি অফিসে চলে আসেন।' তাঁরা মূলত স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যাপারটা ইঙ্গিত করেছিলেন। তবে সেদিন ইন্টারভিউ কার্ড ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ঢাকায় চলে এসেছিলাম।


শা. র : আর আপনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগের শিক্ষকতার চাকরি ছাড়ার ব্যাপারটি...


স. ফ. ক : ...আমি তো তখন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংযুক্ত। নেতারা বললেন, 'তুমি তো এভাবে পারবা না। ক্লাসও নিবা আবার পলিটিকসও করবা, তা হবে না। তোমাকে পুলিশ খোঁজ করতাছে।' আমি বললাম, তাহলে আমাকে কী করতে হবে? তারা বললেন, 'তুমি চাকরি ছেড়ে দাও।' আমি তার পরদিনই গেলাম, আমার হেড অব দি ডিপার্টমেন্টের কাছে বললাম, স্যার, কাল থেকে আমি ক্লাস নেবো না। কেন? আমি বললাম যে, না, ডিসিশন হয়ে গেছে। ডিসিশন চেঞ্জ করা যাবে না। তখন এ কে সেন আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'এ রকম পাগল তো আমি আর জীবনে দেখি নাই।' কিন্তু আমার বাবা এসে জড়াইয়া ধরে বলল, 'চল, আজকে আমার সঙ্গে। তুই কী আরম্ভ করছিস?' আমি শুধু অপেক্ষায় রইলাম যে, কখন মাগরিবের নামাজের সময় হয়। যখন সে মসজিদে চলে যাবে, এ ফাঁকে আমি স্নেহের বন্ধন থেকে পালাইয়া যাব। সেদিন অন্ধকারে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলাম, হয়তো বোনের বাসায় বা কোনো বন্ধুর আশ্রয়ে গিয়েছিলাম, তা মনে করতে পারছি না। এ গল্পটা শুনে অনেকে বলে, 'আপনি এটা কী করলেন? আপনি ভীষণ পাষ-!'


আমি একদিক দিয়ে কথার দাস, আর একদিক দিয়ে আমি ভালোবাসার ভৃত্য। তুমি আমাকে ভালোবেসে যা বলবে আমি তাই করব। তুমি যদি বলো, আপনি এখন ঝুলে পড়েন, আমি ঝুলে পড়ব।


শা. র : আপনার আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন...


স. ফ. ক : ...আমাকে সংগঠন পাঠিয়ে দিল নরসিংহদীর চরাঞ্চলে- চালাকচরে। সে সাংঘাতিক জীবন। যেখানে খাবার নাই, কাঁঠালের অাঁটি, মরিচ পোড়া আর শুঁটকিভর্তা ছিল খাবার। থাকতাম গরুর গোয়ালে। সারা রাত মশার কামড়ে ঘুমানো যেত না। পরার কিছু নাই, তো যে কোনো সময় আমি গ্রেফতার হতে পারি। আমাকে যারা রাখছে, তারা আমাকে সরদার ফজলুল করিম নামে চেনে না। তারা আমাকে চেনে 'মজিদ মিয়া' বলে। তারা জানে, সরদার ফজলুল করিম বলে একজন ভালো কমিউনিস্ট আছে; কিন্তু আমিই সেই যে ফজলুল করিম তা তারা জানে না। একবার আখতারুজ্জামান নামে একজন আমাকে বলেছিল, 'আমি ঢাকায় গেলে সরদার ফজলুল করিমের সঙ্গে দেখা করব।' একথা শুনে আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম, যাওয়ার সময় আমার কাছ থেকে একটা চিঠি নিয়ে যেও।


শা. র : আপনি তো আরও একবার কলকাতায় আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়েছিলেন?


স. ফ. ক : ...এটা তো তোমার জানার কথা না। তুমি যখন জানো ভালো কথা। আমি বোধ হয়, বাবা ও বড় ভাইয়ের থেকে ছাড়া পেয়ে সেদিন গোয়ালন্দ হয়ে ট্রেনে করে কলকাতা যাই। গিয়ে কোথায় উঠব? আমি কবি আহসান হাবীবকে চিনতাম। তিনি আমার এক আত্মীয়ের বাসায় ছাত্রাবস্থায় লজিং থাকতেন। আমি তাঁকে হাবীব ভাই বলে ডাকতাম। আমি যেদিন তাঁর বাসায় পেঁৗছেছি সেদিনই রাতে পুলিশ আহসান হাবীবের বাসায় হানা দিল। হাবীব ভাইকে পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, 'এখানে অ্যাব্ সেকন্ড কেউ আছে নাকি?' তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, 'না তো এখানে কোনো অ্যাব্্সকন্ড নেই।' পুলিশ বাসা তল্লাশি করতে চাইল। সেখানে বাইরের লোকের মধ্যে আমি ছিলাম। আমার পাতলা ছোট-খাটো চেহারা দেখে পুলিশ অবজ্ঞা ভরে জানতে চাইলেন, 'তোমার নাম কী?' আমি বললাম, ফজলুল করিম। এবার পুলিশ অফিসার বললেন, 'তুমি কী করো?' আমি বললাম, বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলাম, ফেল করেছি। আবার পরীক্ষা দেব। তখন পুলিশ অফিসার মন্তব্য করলেন, 'নো, নো সরদার ফজলুল করিম ইজ এ বিগগাই।' পুলিশ চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি তখনই হাবীব ভাইয়ের বাসা থেকে বেরিয়ে আরও অন্ধকারে মিশে গেলাম।


শা. র : আপনি প্রথম কখন জেলে গেলেন, কত সালে, কেন আপনাকে ওরা গ্রেফতার করল?


স. ফ. ক : ...১৯৪৮ সালে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাই। ১৯৪৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর আমি প্রথম জেলে গেলাম, বাইর হলাম ১৯৫৫ সালে। তারপর ২১ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে গ্রেফতার হই এবং ১৯৬২ সালে বাইর হলাম। তারপর ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাকে গ্রেফতার করে, আমি ছাড়া পাই ১৬ ডিসেম্বর নট ১৭ ডিসেম্বর। ও রকম কিছু অভিযোগ-টভিযোগ আমার বিরুদ্ধে ছিল না- আবার ছিলও। আমি তো কমিউনিস্ট পার্টি করতাম। তখনকার দিনের কমিউনিস্ট তো এখনকার মতো ছিল না। তখন কমিউনিস্ট নাম শুনলেই পুলিশ ধরে নিয়ে যেত। সন্তোষ গুপ্তের (দৈনিক সংবাদের প্রখ্যাত প্রয়াত সাংবাদিক) বাড়িতে মিটিং করতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে আমিও অ্যারেস্ট হয়েছি। সন্তোষ গুপ্ত নিজের বাড়ি কমিউনিস্ট পার্টির লোকদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। গোপন হেডকোয়ার্টার ছিল সেটা। কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলার অফিস হিসেবে কাজ করতে দিয়েছে। তখন আমি ছিলাম চালাকচরে, খবর পাঠানো হলো। সেখান থেকে আমাকে স্কট করে নিয়ে আসা হলো সন্তোষের বাসায়। এটা যে সন্তোষের বাসা আমি তা জানি না। এখানে যারা আছে, তাদেরও আমি চিনি না। যারা ওখানে ঢুকলো কেউ কারও নামও জানে না। একদিন দুপুর বেলা আমরা খেতে বসেছি, হঠাৎ পুলিশ এসে বাড়িটা ঘিরে ফেলল। তখন পর্যন্ত সবাই জানতো, এটা একটা নিরাপদ আশ্রয়। গোয়েন্দা বিভাগের লোক যে বাড়িটাকে ক্যামোফ্লাঝ্রে মতো করে রেখেছিল, সেটা আমরা কেউ জানতাম না। সন্তোষসহ আমাদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেল। তারপর জেলখানায় পাঠিয়ে দিল। পরদিন সকাল বেলা আমীর হোসেন (ইন্সপ্টের জেনারেল অব প্রিজনস) যখন ভিজিটে গেলেন, আমরা লাইন করে বসা, ওখানে কারা কারা বইসা আছে তা দেখার জন্য। তখন সন্তোষকে দেখে আমীর হোসেন অাঁতকে উঠে বললেন, 'সন্তোষ তুমিও এর মধ্যে!' সেই সময় যারা চাকরি করতেন তারা এ ধরনের লোকদের আশ্রয় দিতে ভয় পেতেন। কিন্তু সন্তোষ নিজের বাড়িতে কমিউনিস্ট ডেন তৈরি করেছিল। এইটা তো অনেক বড় সাহসের ব্যাপার। সন্তোষ তখন বলেছে, 'পার্টি দায়িত্বটা আমাকে দিয়েছিল।' সন্তোষ গুপ্ত জেলখানার ক্লার্ক ছিল। পুলিশের একটা গাড়িতে করে সন্তোষ ও তাঁর মা-সহ কয়েকজনকে তাঁতীবাজার থানায় নিয়ে যায়। তাঁদের চড়-থাপ্পড় মারে, নানা প্রশ্ন করে।


শা. র : আপনি জেলে থেকেই নির্বাচন করে কীভাবে জিতলেন...


স. ফ. ক : ...যুক্তফ্রন্ট হলো। যুক্তফ্রন্ট ওয়াজ দ্য ক্রিয়েশন অব কমিউনিস্ট। ...সিট ছেড়ে দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়ী করানো হয়েছিল! তখন দেশ চলতো জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের মাধ্যমে। ইংরেজিতে বলা হয়, ন্যাশনাল কনস্টুয়েন্সি ও প্রভিন্সিয়াল কনস্টুয়েন্সি। প্রভিন্সিয়াল কনস্টুয়েন্সির সদস্যরা নির্বাচিত হতো জনগণের ভোটে। আর ন্যাশনাল কনস্টুয়েন্সির সদস্য নির্বাচিত হতো প্রভিন্সিয়াল কনস্টুয়েন্সির সদস্যদের দ্বারা। হঠাৎ ন্যাশনাল কনস্টুয়েন্সি ভেঙে দিলেন মুসলিম লীগ নেতা তমিজউদ্দিন। তিনি স্পিকার ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কেস করেছিলেন জাস্টিস মুনীর। তারপর নির্বাচন হলো। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, নিজামী ইসলাম পার্টি অংশ নিলো। ইসলাম নিজামী পার্টির নেতা ছিলেন ফরিদ উদ্দিন আহমদ। এ যে আমাদের ন্যাপ নেতা অধ্যাপক মোজাফ্ফর, তিনি যুক্তফ্রন্টের নেতাদের বললেন, 'আমাদের একজন লোক নিতে হবে।' তাঁরা বললেন, 'নেবো।' তখন সে জেলখানায় গিয়ে বলল, 'এ সরদার, এখানে সই করো।' আমি বললাম, কেন? ও তখন বলল, 'করো, তারপর বলছি।' বলল, 'আমরা এগ্রিমেন্ট করেছি, তুমি আমাদের পক্ষ থেকে ভোটে দাঁড়াবে।' আমি এভাবেই জেলে থেকেই কমিউনিস্ট পার্টি থেকে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হলাম। জেলে থেকেও কনসটুয়েন্সি এ্যাসেম্বিলির সদস্য হিসাবে বিজয়ী হয়ে গেলাম।


শা. র : কনসটুয়েন্সি এ্যাসেম্বিলির অধিবেশনে আপনার বক্তৃতা নাকি খুব প্রশংসা...


স. ফ. ক : ...মারি পাহাড়ের একটা জায়গায় ন্যাশনাল কনস্টুয়েন্সির এ্যাসেম্বিলি হয়েছিল, সেখানে আমি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। আমার বক্তৃতা তখনকার স্পিকার খুব পছন্দ করেছিলেন। দ্বিতীয়বার যখন ন্যাশনাল কনস্টুয়েন্সির এ্যাসেম্বিলিতে যোগ দেবার জন্য যাই, প্লেনে উঠার পরেই একজন পুুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করেন, 'হু ইজ সরদার ফজলুল করিম?' আমি তখন বললাম, 'আই এম সরদার ফজলুল করিম।' আমি বেরিয়ে আসলাম এবং বুঝতে পারলাম ঘটনা ঘটে গেছে। শেখ মুজিব অধিবেশনে যোগ দিয়ে আমার গ্রেফতারের বিষয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন এবং ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। এখানে একটা মজার ব্যাপার ঘটেছিল। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে জানতে চাওয়া হলো পাকিস্তান সরকারের কাছে সরদার ফজলুল করিম একজন কমিউনিস্ট, সে কীভাবে জেলে থেকে নির্বাচিত হলো? আর কীভাবে জেল থেকে ছাড়া পেল? তখন সরকার পড়ে গেল বেকায়দায়। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রাণালয় থেকে বলা হলো, আমরা তো তাঁকে মুক্তি দিইনি। তার একটা ব্যাখ্যা তারা দাঁড় করাল। তারা বলল, 'আমরা রাজশাহী জেলের ফজলুল করিম সরদারকে মুক্তি দিয়েছি। সরদার ফজলুল করিম তার নাম ভাঙিয়ে বেরিয়ে গেছেন।'


শা. র : ৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়কে কীভাবে দেখেন...


স. ফ. ক : ...আমি এই ঘটনাকে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় বলতে নারাজ। এটা একটি বা কতিপয় দেশে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের প্রক্রিয়ার অপ্রত্যাশিত পরিণতি মাত্র। কমিউনিজম টোটাল কনসেপশন। এটা কখনো ভুললে চলবে না যে, এ কমিউনিস্ট ফেইলস বাট কমিউনিজম ডাজ নট ফেইল। পৃথিবীর কেউ যদি কমিউনিস্ট না থাকে, আমি একাই কমিউনিস্ট থাকব। কারণ আমি তো মনে করি পরিবারের মধ্যেই সাম্যবাদ রয়েছে। পরিবারের যে যেমন যোগ্য সে তেমন কাজ করে। অন্য সবাই ভোগ করে। আমি ব্যাপারটাকে এভাবে দেখি। পৃথিবীর আদিতে সাম্যবাদ ছিল, আবার এক সময় সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা হবে। আসলে বর্তমান বাস্তবতায় ক্যাপিট্যালিজমের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে। সংঘাত, যুদ্ধ, ধ্বংস, হত্যা-এসব ছাড়া পুঁজিবাদের এখন দেওয়ার কিছু নেই। মানুষের অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে। কিন্তু আমি হতাশ নই। আমি বিশ্বাস করি মানুষকে মেরে মানবিক সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন ও প্রচেষ্টা ধ্বংস করা যাবে না। মানুষ থাকবেই তার সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের মহৎ ভাবনা ও কর্ম নিয়ে। সভ্যতার এ পর্যায়ে আসতে যদি মানুষের লক্ষ লক্ষ বছর লেগে থাকে, তবে সামনে আরো লক্ষ বছর আছে। তাই কোনো দেশে বিপ্লব ব্যর্থ হলো কি না, কিংবা আমার দেশে বিপ্লব হলো কি না-এটা কোনো ব্যাপার না। আসলেই পুরো বিশ্বটাই, আমরা সকলেই একটা বিপ্লবের প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছি। আমি বিশ্বাস করি মানুষকে অবশ্যই একটু মনুষ্য সমাজ নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু সেটা কি উপায়ে হবে তার কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তবে মানুষ তা করবেই। কেননা ম্যান ইজ দি ক্রিয়েটর।

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৫
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসবে তুমি কবে ?

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪২



আজি আমার আঙিনায়
তোমার দেখা নাই,
কোথায় তোমায় পাই?
বিশ্ব বিবেকের কাছে
প্রশ্ন রেখে যাই।
তুমি থাকো যে দূরে
আমার স্পর্শের বাহিরে,
আমি থাকিগো অপেক্ষায়।
আসবে যে তুমি কবে ?
কবে হবেগো ঠাঁই আমার ?
... ...বাকিটুকু পড়ুন

(রম্য রচনা -৩০কিলো/ঘন্টা মোটরসাইকেলের গতি )

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫০



একজন খুব পরিশ্রম করে খাঁটি শুকনো সবজি( দুষ্টু লোকে যাকে গাঁ*জা বলে ডাকে) খেয়ে পড়াশোনা করে হঠাৎ করে বিসিএস হয়ে গেলো। যথারীতি কষ্ট করে সফলতার গল্প হলো। সবাই খুশি। ক্যাডারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×