লিখতে বসাটা আমার জন্য ভীষণ জরুরি। কিন্তু এই বেজন্মার দেশে নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্যও হিসাব করে সময় বের করতে হয়। তাই লেখালিখির সময় বের করা একটা বিলাসিতা এখানে। লেখার জন্য অবারিত অবসরের দরকার পড়ে। অবারিত অবসরের ভিতর লিখতে লিখতে ব্যস্ত হয়ে উঠলে তবে আমার লেখা বেরোয়। কিন্তু ‘অবসর’ এদেশে একটা চমৎকার সুখস্বপ্ন। মাঝে মাঝে ভেবে অবাক হই, হাতে কোনো কাজ নাই কেন--এই ভেবে বছরখানেক আগেও বোরড্ হয়ে যেতাম!
যা হোক, যা নাই তার জন্য বিলাপ করে করে সময় নষ্ট না করে ‘যা থাকে কপালে’ জপে লিখতে বসে যাওয়াটাই ফরজে আইন। ‘ইনডেসপেনসিবল স্কেডিউল’ পরে মেইনটেন করা যাবে।
বিষয় হিসেবে মাথায় নিয়ে ঘুরছি রকিবুল হাসানকে। হ্যাঁ, ক্রিকেটার রকিবুল। কেন, এত বিষয় থাকতে রকিবুল কেন? সমস্যাটা এখানেই। ‘এত বিষয়’ কথাটা আমার জন্য খাটছে না। লেখার মতো কোনো বিষয়ই পাই না আজকাল। ভাবার যদিও সময় নাই, তারপরও ভাবতে গেলে মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আল্লার দুনিয়ায় বিষয়ের এত টানাটানি পড়ে গেছে! গেছে মনে হয়। বিষয় আসলেই মাথায় আসছে না। অতএব, ক্রিকেটার রকিবুল হাসান।
কী নাটকটাই না মনে মনে সাজিয়ে রেখেছিলেন রকিবুল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনদিনের ম্যাচটাতে সেঞ্চুরি করার পথে প্রতিটি রানের জন্য যখন দৌড়াচ্ছিলেন, কে আঁচ করতে পারবে, মনে মনে তিনি একটা দুর্দান্ত নাটকের খসড়া লিখছেন। এই খেলোয়াড়টি বছর দুয়েক হলো বোধহয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে আছেন। আমি শুরু থেকেই তার খেলায় যথেষ্ট বিরক্ত ছিলাম। তার হিসাবি ব্যাটিং আমার ভালো লাগতো না। মাঝে মাঝে তার মধ্যে জাভেদ ওমরের ছায়াও যেন টের পাওয়া যেত। কিন্তু এই হিসাবি খেলোয়াড়টিও যে ভিতরে ভিতরে এত রহস্যপ্রবণÑএটা ভেবে তার ব্যাপারে আমার আগের সব বিরক্তি মুলতুবি রাখা গেল।
খেলোয়াড় বলতে আমরা একজন বোলার বুঝি, ব্যাটসম্যান বুঝি, উইকেটকিপার বুঝি। এই খেলোয়াড়দের আমরা মাঠের ভিতর দৌড়াতে দেখি, বল তাড়া করতে দেখি, বল পেটাতে দেখি। খেলা শেষে এরা টিভি কমেন্টেটরদের কাছে দু-এক লাইন কথা বলে। মাঝে মাঝে টেলিভিশনে কেউ কেউ ইন্টারভিউ দেয়। বিজ্ঞাপনে তারা অন্যের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে ঠোঁট মেলায়। বিশাল বিলবোর্ডে তাদের হাসিতে উপচে পড়া মুখের ছবি থাকে। আর একটা চমৎকার ব্যাপার হয় খেলোয়াড়দের নিয়ে। সেটা করে আমাদের স্পোর্টস জার্নালিস্টরা। হয়তো পরেরদিন ইন্ডিয়ার সঙ্গে টেস্ট ম্যাচ। আগেরদিন খেলার পাতায় নির্বাচিত কয়েকজনের প্র্যাকটিসের ছবি। নিচে ক্যাপশনÑ‘আত্মবিশ্বাসী মাশরাফি’, কিংবা ‘ফুরফুরে মেজাজে সাকিব’। অথবা খেলার পরের দিনের ছবিÑ‘নিজের পরফরমেন্সে আবারও হতাশ আশরাফুল’। বলতে চাইছি, খেলোয়াড়দের যে ইমেজটা আমাদের সামনে তৈরি করে মিডিয়া সেখানে খেলোয়াড়রা হয় ‘ফুরফুরে’ মেজাজে থাকে অথবা ‘হতাশ’ থাকে। হয় ‘আত্মবিশ্বাসে টগবগ করে’ অথবা ‘ফর্মহীনতায় ভোগে’। কিন্তু এই মানুষগুলো কি কখনও বিষণœ থাকে না, কাতরতায় ভেগে না, অভিমানী কিংবা লোভী হয়ে ওঠে না? এমন কি কখনও হয়েছে যে পত্রিকার পাতায় ছবি আসলো ‘ঈর্ষায় জর্জরিত রকিবুল’, ‘নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন মাহমুদুল্লাহ্’? ভুল বুঝবেন না পাঠক, পত্রিকাকে এই দায়িত্ব আমি নিতে বলছি না! পত্রিকা যে মাঝে সাঝে এই দায়িত্ব নেয় না, তা-ও না। তখন আমরাই এই সিদ্ধান্ত করি, এসব পাপারাজ্জিগিরি। সেটা ভিন্ন ক্ষেত্র। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য খেলোয়াড়দের ইমেজটা একটু বুঝে দেখা, এই আর কি।
পত্রিকায় যে খেলোয়াড়ের ছবি আমি দেখি তা অবশ্যই খণ্ডিত। তারা আমাদের কাছে কেবলই, এবং কেবলই একেকজন আয়রনম্যানের ছায়া। তাই রকিবুল হাসান যখন হঠাৎই একটা দুর্বোধ্য কাজ করে বসলেন, তাকে নিয়ে লেখা রিপোর্টগুলো ইন্টারেসটিং হয়ে উঠল। খেলোয়াড়রা তো এই ধরনের খবর সাধারণত যোগান দেয় না। এই প্রথম একজন খেলোয়াড়কে দেখলাম যার ‘অভিমান’ নিউজ হয়ে উঠল। আসলেই ‘অভিমান’ কি-না তা-ও হলফ করে কেউ বলতে পারছেন না। কেউ বলছেন, অভিমান নির্বাচকদের উপর, কেউ বলছেন সতীর্থ খেলোয়াড়দের উপর। আবার রকিবুল বলেছেন আরেকটা মোক্ষম কথা, তার আর খেলতে ভালো লাগছে না। এটা কি তার অবসন্নতা? অথবা হয়তো অভিমান করেই এ কথা বলেছেন। যাই তিনি বলুন আর সাংবাদিকরা যাই অনুমান করুন, রকিবুলের সরে দাঁড়ানোর কারণটা ঠিক মেলানো যায় না। দুর্বোধ্য লাগে।
...সারছে। এতক্ষণ ধরে অবসরযাপন করলাম! আমাকে আবার শিডিউলে ফিরিতে হইবে। আরেকটা কথা লিখে ক্ষান্ত দিই। গতকালের প্রথম আলোতে দেখলাম, রকিবুল আবার খেলায় ফেরার চিন্তাভাবনা করছেন। তিনি ফিরুন আর নাই ফিরুন, এরপর থেকে স্পোর্টস পাতায় তার ছবির নিচে যে ক্যাপশনই দেওয়া হোক সেটা দেখে আমার একটু আমোদ হবে!
শিকাগো
১৪ মার্চ, ২০১০।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১০ সকাল ৭:৫১