জীবনযাত্রা সম্পর্কে আমার ধ্যান-ধারণা উল্টা-পাল্টা হয়ে গেছে। সাধু-সন্ন্যাসী-দরবেশের মতো জীবনকে যাপন করে যাব। কারও মায়ায় আটকে যাবে না দিনানুদৈনিক জীবনযাত্রা—এই ছিল খায়েশ। কিন্তু পরাণকে বাঁচিয়ে রাখতে, শ্বাস-প্রশ্বাসকে স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে খায়েশ পণ্ড হয়ে গেল।
বরং জটিলতার এক জীবন প্রণালীর মধ্যে খাবি খাইতেছি। যেখানে জটিলতা সহনীয় হলেও কুটিলতা দুর্বিষহ। তারপরও মুখ বুঝে সব মানতে হয়। কেন মানতে হয়, এ প্রশ্নটির জবাব তালাশ করতে গিয়ে কিছুটা নড়েচড়ে বসেছি।
মানুষের সভ্যতার পত্তনির মধ্যে যেসব নিয়মকানুন গড়ে উঠেছে তাতেই রয়েছে এর দুর্দান্ত জবাব। সভ্যতার নিয়মে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি হয়েছে। মানুষ আর মানুষ নেই। কেউ হয়েছে খোদা আর কেউ হয়েছে দাস। নিযুত মানুষ খোদা আর দাসে পরিণত হয়ে গড়ে উঠেছে দুটি শ্রেণী—খোদাদের সমবায়ে শাসক শ্রেণী ও দাসদের সমবায়ে শাসিত শ্রেণী।
এই দুই শ্রেণীর ফারাকের কারণ হচ্ছে শাসক শ্রেণীর হাতে চলে গেছে পরাণ ধারণের খাদ্যবস্তুর দখল। আর এ খাদ্যবস্তুর মাধ্যমে পরাণ ধারণ শাসিত শ্রেণীরও দরকার বলে তারাও শাসকদের দখলে চলে গেছে। অর্থাত্ পরাণ ধারণের জন্য শাসিত শ্রেণী আজ শাসক শ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল।
এই সত্য নতুন নয়, সবাই জানে। আমিও জানতাম। কিন্তু এর মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না।
হ্যাঁ, সেই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। পরাণ ধারণের জন্য আমিও নির্ভরশীল হয়েছি শাসক শ্রেণীর। তাদের ফুট-ফরমায়েশ খেটে পরাণ ধারণের প্রয়োজনীয় খাদ্য সংস্থান করতে হচ্ছে আমাকে।
এই খাটাখাটনির মধ্যে এসে দেখছি শাসক শ্রেণীর চরিত্র ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে একই। তারা শাসিতের প্রাপ্য শ্রমের মজুরিতে কমতি করবেই। এই কমতি চুপচাপ মেনে নিতেই হবে। না মানলে সহজ জবাব কেটে পর।
দেখেন মুশকিলটা কত ভয়ানক! কম মজুরি নিয়ে হলেও খাদ্য সংস্থানের স্বার্থে জুলুম মেনে নিতে হবে। আবার জুলুমের প্রতিবাদ করলে খাদ্য সংস্থানই হাতছাড়া হয়ে যাবে।
তাহলে কি কোনো আসান নেই?
মানুষের ইতিহাস তালাশ করেই জবাব পেলাম। পরাণ বাঁচানোর চেয়েও বড় বাস্তবতা মানুষের সামনে হাজির আছে। তা হচ্ছে মানুষ হিসেবে মানুষের পরাণের যে ইজ্জত ইতিহাসে নির্ধারিত হয়েছে, তার সাথী হচ্ছে গৌরব। দাসত্ব না মানার গৌরব।
এই গৌরবের বলে বলীয়ান হয়ে মানুষ প্রভুদের, শাসক শ্রেণীর তখতে তাউস উল্টে দিতে পারে।
এখন জীবনযাত্রা নিয়ে আমার মুশকিলটা হচ্ছে—‘হে পরাণ বেঁচো থাকো, গৌরবই তোমার সাথী বলে নিজের পরিত্রাণ নিজেই ঘোষণা করতে দ্বিধাগ্রস্ত।
দয়াময় দ্বিধা দূর করো।