.
.
.
পর্ব ১
প্রায় বিশ মিনিট হাটার পর রুসটক ইউনিভার্সিটির হোস্টেলের দেখা পেলাম । অনেক বড় জায়গা নিয়ে করেছে, অনেক গুলো বিল্ডিং । ৬ নাম্বার বিল্ডিং এর কাছাকাছি পৌছতেই পেছন থেকে চিৎকার শুনে সবাই ঘুরে দাড়ালাম । সাইকেলে করে আমাদের জার্মান দোস্ত মিখায়েল আসছে , মিখায়েলের সাথে আমার আগেই পরিচয় আছে । আমাদের হোস্টেলে গিয়েছিলো তিন/চারবার ।
মিখায়েল (জার্মান নাগরিক, ফিজিক্সের ছাত্র, প্রায় ৬ ফিট ২ ইঞ্চি লম্বা, শরীরের গঠন দৈত্যের মতন, মাথার চুল এলোমেলো সোনালী, 'তারছিড়া' বলতে আমরা যা বুঝি মিখায়েল তারও উর্দ্ধে, এককথায় "বিশ্ব তারছিড়া কমিটি"র প্রেসিডেন্ট পদে অনায়াসে নমিনেশন পাবার যোগ্যতা রাখে)
সাইকেল ছুড়ে ফেলে আমাদের বুকে ঝাপিয়ে পড়লো দৈত্যটা । ও নাকি চল্লিশ মিনিট ধরে আমাদের জন্য গোটা এলাকায় টহল দিচ্ছিলো । আমাকে দেখে খুশিতে চপাশ করে আমার গালে চুমু দিয়ে বললো -
- দোস্ত তুমার কথা আমি বিশেষ কইরা কইয়া দিসিলাম । পরে হুনলাম তুমি নাকি ইটালি যাইবা ক্রিসমাসে ! শুইন্না খুব আফসোস করসিলাম । তুমারে আমগো লগে দেখুম কল্পনাও করি নাইক্কা !
আমি গাল মুছতে মুছতে বল্লাম -
- রাখে আল্লাহ মারে কে !!
এর ফাকে সবাই খেয়াল করলো আশকা নেই !! আশকা হাওয়া সেই সাথে মিখায়েলের সাইকেলও হাওয়া !
আশকা সাইকেল সহ ফিরলো ৪/৫ মিনিট পর । সবাই মিলে উপরে উঠলাম ধাপধুপ করে । বলা বাহুল্য , সবচেয়ে বেশী আওয়াজ করলো মিখায়েল , ওকে আমি কখনো আওয়াজ ছাড়া চলাফেরা করতে দেখি নাই । ('পাব' এর ড্যান্স ফ্লোরে মিখায়েল যখন নাচতে নামে তখন ভয়ে সবাই ড্যান্স ফ্লোর ছেড়ে উঠে আসে।)
দোতলায় একটা রুম এবং চারতলায় দুটো রুম আমাদের দল দখলে নিয়ে নিলো । চারতলায় উঠে দেখলাম কিচেনে টমেক , সুসান, ক্যারোলিনা রান্না বান্না করছে । আমাদের গলার আওয়াজ পেয়ে আর্থার ওর রুম থেকে বেরিয়ে এলো,
আর্থার (জার্মান নাগরিক, ফিজিক্সের ছাত্র, লম্বা লিকলিকে শরীর, টেবিল টেনিস চ্যম্পিয়ন)
গাল ভরা হাসি নিয়ে ছুটে এসে আমাদের জড়িয়ে ধরলো । সবাই মিলে বিড়ি ফুকতে ফুকতে গপসপ করলাম ব্যালকনিতে বসে, কি কি করা হবে আজ ! কথায় কথায় জানতে পারলাম, আজকের বিশেষ আয়োজন স্পেশাল ডিশ .. "ক্যাঙারুর মাংসের সাশলিক" । শুনেই আমি প্রমোদ গুনলাম .. না খেয়েই না থাকতে হয় আবার !!
সারারাত জেগে থাকবার প্রস্তুতি হিসেবে আর্থারের বিছানায় গিয়ে একটা ছোট 'ন্যাপ' নিয়ে নিলাম । পয়তাল্লিশ মিনিটের মত শুয়েছিলাম, উঠে দেখলাম সবাই প্রস্তুত হচ্ছে পার্টির জন্য । দোতলায় নেমে শুনলাম , দোতলার রুমটা মেয়েরা তাদের অস্থায়ী 'গ্রীন রূম' হিসেবে ডিক্লেয়ার করেছে । মেয়েরা সাজুগুজু করবে ..এবং শান্তনা পুরষ্কার হিসেবে ছেলেদের চুলের স্টাইল করে দেবে মেয়েরা ফ্রী । ডেমিয়েন , জীলন , পাভেল এবং অবিদিউসের পালা শেষ। আমার বড় কালো চুল পেয়ে তো হাতে ঈদের চাঁদ পেলো যেন দুস্তিরা । পনের বিশ মিনিট পর ওদের হাত থেকে রেহাই পেলাম আমি কিন্তু ততক্ষনে আমার শখের চুলের দফারফা । আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠলাম ।
এরপর রাত আট টায় শুরু হলো পার্টি, প্রায় ১৪/১৫ রকমের খাবার, ৪/৫ পদের জুস , ১০/১২ পদের এ্যলকোহল, বেছে বেছে আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ খাবার গুলো টেস্ট করলাম ... জলপাইয়ের মিষ্টি চাটনি , প্যারোগি (পুলি পিঠার মত দেখতে ভিতরে আলু এবং পনির ভরা খেতে চমৎকার), ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, সেদ্ধ ডিমের একটা আইটেম, টুনা মাছের স্যান্ডউইচ, আনারসের জুস এবং ক্যাঙ্গারুর সাশলিক, (মউলানারা কি বলেন !!! যেহেতু আমি জানি না এটা হালাল নাকি হারাম সুতরাং আমার পাপ হবার কথা না , তাই না ?)... আশেপাশের রুম থেকে জার্মান ছাত্র ছাত্রীরা আমাদের সাথে জয়েন করলো , আমি গুনে দেখলাম জার্মান ছেলেগুলো মোট আট কেস বিয়ার এনেছে, এক এক কেসে ২০ টা করে মোট ১৬০ বোতল বিয়ার । মহীনের ঘোড়াগুলির সেই বিখ্যাত গানের লাইনটা মনে পড়লো .. "বাঙালী করেছে ভগবান রে .... আমি যদি জার্মান হতাম বোতল বোতল বিয়ার খেতাম.. আবার কনসার্টে পিয়ানো শুনতাম দেখতিস আমার মান রে ... বাঙালী করেছে ভগবান রে..." এদের বিয়ার প্রেম আসলেই দেখার মত ।
ব্রোদের আজকের দিনটাকে "পাংখা দিবস" হিসেবে ঘোষনা দিলো (এরা "পাংখা" শব্দটা আমার কাছ থেকে শিখেছে..ওরা জানে এটার মানে হলো ড্রাংক).. আমার পাশে এসে ব্রোদের নিচু গলায় বললো
- দোস্ত আমগো সবারই পাংখা হওয়া উচিত কি কও !! তুমি যুদি আমার লগে ওয়াইন না পান করো তুমারে আমি কক্ষনোই ক্ষমা করুম না।
আমি একটু আসতাসি বলে ফুটলাম ওর সামনে থেকে ।
ক্রমাগত অনেকের সাথে পরিচয় হচ্ছে... মনিকা নামের এক জার্মান মেয়ে বাংলাদেশের নাম শুনে বললো - ও মা ! তুমি ড: ইউনুসের দেশের লোক !! নিজে থেকে কাছে এসে অনেক কথা বললো। আমার চুলের স্টাইলের প্রসংশা করলো।
করিডোরে সবাই বসে হাউকাউ চেচামেচি করছে,আলাপের বিষয় পাকিস্থান, বেশীর ভাগ ছেলেপেলের একই কথা বেনজীর রে যে মারলো এখন পাকিস্তান এর অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাবে।
একপর্যায়ে শুরু হলো জাতিগত পঁচানো,
জার্মান পোলাপান আমাকে ডাকদিয়ে বললো
- এই হালার পোলিশ ডি এ্যালকোহল খাইতে জানে না। ধুমধাম গলায় ঢালবো আর খুব তাড়াতাড়ি টাল হইয়া যাইবো । জোরসে মিউজিক বাজাইবো। আর ষাড়ের মতন চ্যাচাইবো ।
আমার পোলীশ দুস্তরা বললো -
এই জার্মান পুলাপান বালের বিয়ার ছাড়া কিছুই খাইতে জানে না । এক একজন ১৫/১৬ বোতল বিয়ার খাইবো রাণীক্ষেত মুরগির মতন ঝিমাইবো । বড়জোর পপ আর হিপহপ মিউজিক ছাইড়া ঢুলুঢুলু শরীর দুলাইবো ।
অসংখ্য পুলাপানের ভীড়ে আভগেণী নামের এক ইসরাইলী তরুনের সাথে পরিচয় হলো, ২৭ বছর বয়সি মাঝারি উচ্চতার স্বাস্হ্যবান ইহুদী তরুন । চমৎকার শুদ্ধ ইংরেজী উচ্চারন, আমার পরিচয় জেনে খুবই আগ্রহের সাথে আলাপ করলো আমার সাথে...কথায় কথায় বাংলাদেশের কয়েন চেয়ে বসলো ... আমি ওয়ালেট থেকে ২টাকার চকচকে একটা নোট বের করে বল্লাম এটা রাখো .. কয়েন তো আমার পোলীশ দুস্তরা আগেই গাপিস করে ফেলছে । টাকাটা সে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে নিলো । আভগেণী ফিজিক্সের ছাত্র সে আমাকে বোঝালো এখানে অনেক সুযোগ পড়াশোনার কিভাবে এপ্লাই করবো কি কি সুবিধা সব জানিয়ে বললো বন্ধু আর দেরি নয় ... যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার এখানে চলে আসা উচিত। সিডরে আমার ফ্যামিলি আক্রান্ত হয়েছিলো কিনা সেটাও উদ্বিগ্নের সাথে জানতে চাইলো। শেষে একটা কাগজ কলম এনে বললো - এটাতে তোমার ভাষায় তোমার দেশের নাম লিখে দাও । আমি রেখে দিবো ।
ব্রোদের আবার আমার পাশে এসে দাড়ালো , আমার হাতে কোকের গ্লাস দেখে বললো -
সর্বনাশ !! দোস্ত তুমি খালি কোক খাইতাসো !! কোক খাইয়ো না .. এটাতে বাজে ক্যামিকেল এলিমেন্ট আছে, তোমার ক্ষুদ্রান্ত্র বৃহদান্ত্র ফুটা করে ফেলবে । তোমার ভোদকা খাওয়া উচিত । এই নাও গেলাস ।... আমি বোঝালাম দেখো এই জিনিস আমার একদমই সহ্য হয়না , আমি অসুস্থ ফিল করি । আমারে তুমি রেহাই দেও ।
আমার কথা শুনে মাথা ঝাকিয়ে বললো -
দোস্ত তুমার কথা শুইন্না আমি পুরাই হতাশ হইলাম !!!
ইয়েমেনের কিছু মুসলিম ছাত্রের সাথেও পরিচয় হলো .. এদেরকে একটু ছোক ছোক স্বভাবের মনে হলো । একজনের তো কোন সাবজেক্টে পড়ছে সেটা মনে করতেই ৩ মিনিট লেগে গেল ।
তিন ঘন্টার মধ্যে চকচকে করিডোর টা আবর্জনার স্থুপে পরিনত হল ।
পার্টি শেষে সবাই বিদায় নিলে .. রাত পৌনে ১১ টায় আমাদের ১৯ জনের দলটি নতুন বছরকে স্বাগতম জানানোর জন্য বাল্টিক তীরের দিকে রওনা দিলাম.......................
চলবে..................পর্ব ৩