ক্রিসমাস এবং নিউ ইয়ারের ছুটি পেয়েছিলাম মোট ১৩ দিন , প্ল্যান ছিলো মিলান যাবো এবং সেখান থেকে অস্ট্রিয়া ঘুরে আবার ব্যাক টু দা প্যাভিলিয়ন । কপাল গুনে কোন টিকেট পাই নাই । ২১ তারিখে গিয়ে জানলাম ২ জানুয়ারির আগে প্লেনে বা বাসে কোন টিকেট নাই । শুধু মাত্র ট্রেনের টিকেট আছে এবং আমাদের গাবতলী সদরঘাটের মত ৬৫ ইউরো টিকেটের দাম ২০০ ইউরো তাও আবার ওয়ান ওয়ে । এবং সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো ৫ বার ট্রেন চেঞ্জ করতে হবে । এতো কাহিনী দেখে "তাইলে হালার যুদ্ধেই যামু না .." ডিসিশন নিলাম । কুনো ব্যাঙের মত ঘরে বসে ক্রিসমাস কাটলো, পুরো হোস্টেল খালি ।
২৮ তারিখে একে একে পুলাপান ফিরতে শুরু করলো । তখনই জানতে পারলাম দোস্তরা জার্মানীর 'রুসটক' নামক শহরে নিউ ইয়ার পালন করার প্ল্যান করছে । সেখানে জার্মান দোস্তরা আমাদের অপেক্ষায় থাকবে । শহরটা নাকি বাল্টিক সাগরের পাড়ে এবং জার্মানীর অন্যতম সুন্দর শহর । আমি যাবো নাকি জিজ্ঞেস করার ধারও ধারলো না কেউ , সোজা হুকুম "তুই যাবি আমাগো লগে ব্যাস" । ৩০ তারিখে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হলো টমেকের বাসায় । প্রাথমিক ভাবে মোট ২৩ জন যাত্রী । দুটো দল , প্রথম দলটি গাড়িতে যাবে ভোরে , দ্বিতীয় দল ট্রেনে যাবে দুপুরে । ৩১ তারিখ রওনা দিয়ে ১ তারিখ ওখানে থেকে ২ তারিখ সন্ধ্যার ট্রেনে আবার ফেরৎ ।
প্রথম দলটিতে আছে :
টমেক (সোশলজির ছাত্র, প্রায় ৬ফিট ৩ইঞ্চি লম্বা, পিঠ পর্যন্ত লম্বা সোনালী চুল, সবসময় হাসি খুশী, বেশীরভাগ সময় ঠোঁটে দেয়াশলাই কাঠি কামড়ে থাকে অথচ নন স্মোকার)
সুসান (টমেকের বউ , একই সাবজেক্টে পড়ে, বাচ্চাটে স্বভাব, প্রচন্ড আহ্লাদী, চমৎকার রান্না করতে পারে)
জীলন (টেলিকমিউনিকেশনের ছাত্র, হলিউডের নায়কদের মত দেখতে, পোশাকের ব্যাপারে সব সময় ফিটফাট)
ক্যারোলীনা (জীলনের বান্ধবী, মেডিকেলের ছাত্রী, পুতুলের মত দেখতে, কঠিন ধার্মিক ক্যাথলীক, গত পরীক্ষায় এক সাবজেক্টে খারাপ করে নাকি একদিন টানা চার্চে পড়েছিলো)
এ্যনা (বায়োলজির ছাত্রী, ইদানিং মন খারাপ..বয় ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে)
আগ্নিয়েস্কা (মেডিকেলের ছাত্রী, বন্ধুরা আদর করে ডাকে জলহস্তি)
ম্যারেখ (টেলিকমিউনিকেশনের ছাত্র, তুখোর মেধাবী)
জিবি (টেলিকমিউনিকেশনের ছাত্র, মাথা কামানো থাকে সবসময়, বিশাল বড়লোক বাপের একমাত্র পোলা, শালার ২০০৬ মডেলের একটা "অডি" আছে)
অবিদিউস (টেলিকমিউনিকেশনের ছাত্র, লিথুনিয়ান নাগরিক, চমৎকার গিটার বাজায়, অসম্ভব মেধাবী)
এই দলের কাজ হলো খাবার দাবার এবং পানীয় নিয়ে চলে যাবে ।
দ্বিতীয় দলটিতে আছে :
ডেমিয়েন (জিওগ্রাফীতে মাস্টার্স করে এখন ইন্টার্নশীপে আছে, একটু তাড়ছিড়া স্বভাবের, মনটা সমুদ্রের মত বিশাল)
ব্রোদের (রাশান লিটারেচারের ছাত্র, আমি এর নাম রেখেছি 'নিরব ঘাতক', মুখভর্তি দাড়ি, চুপচাপ স্বভাবের, জীবনের একটাই টার্গেট 'ফিলোপিনো' মেয়ে বিয়ে করবে)
পাভেল (সোশলজির ছাত্র, বান্দর টাইপ পোলা, সারাক্ষন মিচকা হাসি থাকে মুখে)
হেলেনা (টেলিকমিউনিকেশনের ছাত্রী, কার্লি চুল, ছেলেদের মত ধুমচুর গালাগালি করতে পারে)
কামিলা (মেডিকেলের ছাত্রী, চুল ছেলেদের মত ছাটা, গলার স্বর ফাটা বাঁশ, চেইন স্মোকার)
আশকা (মেডিকেলের ছাত্রী, মুটি টাইপ, মাথায় ছিট আছে অল্প)
এবং
আমি
এই দলের কাজ হলো বাকি যারা বাসা থেকে এখনো হোস্টেলে পৌছায়নি তাদের জন্য ১০ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ।
৩১ তারিখ সকাল থেকে অপেক্ষার পর কামিলা, আশকা এবং ব্রোদের এই তিন জন শুধু হাজির হলো । সাড়ে দশ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে স্টেশনে রওনা হলাম আমরা সাত জন । স্টেশনে ঢুকেই বিড়ি খোরেরা পকেট ভর্তি করে বিড়ি কিনে প্ল্যাটফর্মের দিকে হাটা দিলাম , ঠিক তখনই তিনজন পুলিশ এবং দুটো জার্মান শেফার্ড আমাকে ঘিড়ে দাড়ালো । একজন মামু রীতিমত স্যালুট ঠুকে বিনয়ের সাথে আমার আইডি কার্ড দেখতে চাইলো , দিলাম তার হাতে আমার আইডি । ওয়াকিটকিতে কিসব আলাপ আলোচনা করে ব্যাটা শিউর হলো যে আমি কোন অবৈধ আগন্তুক নই । দুঃখ প্রকাশ করে মামুরা চলে যেতেই আমার দুস্তরা এটা নিয়ে মশকরা শুরু করলো আমার সাথে । ওদের কে বল্লাম -
"তোগো সবাইরে থুইয়া খালি আমারে যে স্যালুট মারলো এটা দেখছোস !!!"
এগারোটা চল্লিশে লালটু রঙের ট্রেন হাজির হলো আমাদের নিতে । সবাই হৈ হৈ করে ট্রেনে উঠে পড়লাম । ট্রেন ছাড়লো ১২টায় , ট্রেনে মাত্র তিনটা বগি এবং মোটামুটি ফাঁকা , দুস্তরা যার যার ব্যাগের ভেতর থেকে বিয়ারের ক্যান বের করে বসলো । আর দুস্তিরা মাশাল্লাহ দুনিয়ার যত সাজু গুজু করার মালমশলা আছে একে একে সব বের করে সাজতে বসলো । একেক জনের নেইলপলিশের সংখ্যাই হবে ১২/১৩ রকমের । ব্রোদের আব্দার করলো ওর নখে রং লাগাবে , ব্যাস আর যায় কোথায় !! দুস্তিরা সব হামলে পড়লো ব্রোদের এর নখে রং লাগাতে । আশকা নেইলপলিশ দিতে দিতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমার দেশের মেয়েরা
নেইলপলিশ ব্যাবহার করে কিনা ?? বল্লাম হ্যাঁ
কানে দুল পড়ে কিনা ?? বল্লাম হ্যাঁ
কপালে টিপ দেয় কিনা ?? বল্লাম হ্যাঁ
শাড়ি পড়ে কিনা ইন্ডিয়ান মেয়েদের মত ?? বল্লাম হ্যাঁ
এরপর বল্লো
ট্যাটু আঁকে কিনা !! ভুরু / নাভি / থুতনি ইত্যাদি ইত্যাদি ফুটো করে অর্নামেন্ট পড়ে কিনা ??
বল্লাম - কেউ কেউ ইদানিং শুরু করছে এগুলা, কিন্তু এদের সংখ্যা খুবই কম । ও বললো
- এদের সংখ্যা খুবই কম কেন !! তোরা চাসনা এগুলো ওরা করুক নাকি ওরাই চায় না !!
এই পাগলিটাকে আরো কোন বেফাস প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে বিড়ি টানার উসিলায় পালালাম ।
ট্রেনের টয়লেটে গিয়ে দেখি পাভেল আগে থেকেই ভিতরে মনের সুখে বিড়ি টানছে । আমাকে দেখে বললো
- কি রে ! বিড়ি টানবি !! আয় আয় ভিতরে হান্দা । চেকার হালায় টের পাইলে খবর আছে !!
বিড়ি টেনে ফিরে এসে বসতে না বসতেই আব্দার আসলো তোর ঐ গান টা শোনা .... "নীলা তুমি কি চাও না ... হারাতে ঐ নিলীমায়"
চিল্লা ফাল্লা .. হাসাহাসি .. গান বাজনা এসবের মধ্যে চার ঘন্টার যাত্রা শেষ হলো , মাঝে 'গুসট্রো' নামের এক জায়গায় ট্রেন চেঞ্জ করতে হয়েছিলো । গুসট্রো তে জীবনের প্রথম সামনা সামনি 'গে' দেখলাম, প্ল্যাটফর্মে একজন আরেকজন কে বিদায় দিতে এসেছে , চুড়ান্ত বিদায় হলো প্রায় ৩০ সেকেন্ড ধরে 'ফরাসি চুম্বনের' মাধ্যমে । সন্ধ্যা চারটায় আমরা 'রুসটক' পৌছলাম । এখন গন্তব্য রুসটক ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট হোস্টেলের ছয় নাম্বার বিল্ডিং । আমাদের দলের কেউ চেনে না জায়গাটা কোথায় । পোলাপান যাকে পাচ্ছে তাকেই ধরে ধরে জিজ্ঞেস করছে আর হেটে হেটে এগুচ্ছে । দুস্তিদের এক একজনের ব্যাগের ওজন ১২/১৩ কেজি হবে, তারা নিজেদের ব্যাগ সুকৌশলে ছেলেদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো । প্রচন্ড শীতের মধ্যে আমরা হাটছি । ডেমিয়েন আমার পাশে হাটতে হাটতে বল্লো - "ভেরী ক্রেজী সিচুয়েশন !!".....................
চলবে...............পর্ব ২
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০০৯ রাত ১১:২৬