somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফেলুদার তোপসে
নিষ্পত্তি কি সব সময়ে জয়-পরাজয়ে? ময়দানি ধুলোয় তার বাইরেই যে পড়ে থাকে খেলার আসল-নকল গল্পগুলো৷ ময়দানের ঘাস-ধুলো যাঁর প্রিয়তম বন্ধু, তাঁর কলমে অভিজ্ঞতার দস্তাবেজ৷

বেঁচে থাকার মার্কশিট হয় কখোনো?

২৭ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ১০:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি সেনাদের ‘কমফর্ট’-এর জন্য, লক্ষ লক্ষ কোরিয়ান মেয়েকে যৌন দাসী করে পাঠানো হয়েছিল। জাপান ক্ষমা চাইল এই সে দিন।


আমার তখন কতই বা বয়স হবে, সতেরো-আঠারো। আমায় বলেছিল কাজ দেবে। তখন আমাদের চার দিকে বড্ড অভাব। রোজ ঠিক করে খেতেও পাই না। সেনাদের ছাউনিতে কাজ। ওদের জামাকাপড় কাচা, রান্না করে দেওয়া, সেলাই করা, ছাউনি পরিষ্কার রাখা। আমার মতো আরও অনেকে নাকি করতে যাচ্ছে। আমরাও গিয়েছিলাম। ওই সব কাজ করেওছিলাম। তবে আসল কাজ ছিল জাপানি সৈনিকদের কাছে ধর্ষিত হওয়া। কপাল ভাল থাকলে দিনে পাঁচ বার, আর খারাপ থাকলে দিনে কুড়ি বার। ওরা একেবারে ক্ষুধার্ত বন্য কুকুরের মতো হয়ে থাকত। সকাল থেকে হয়তো কুড়ি জন এসে পর পর ধর্ষণ করত। করেই যেত। কী যে কষ্ট হত, কী যে কষ্ট, বাপ রে! মনে পড়লে মনে হয় এখুনি আবার দম আটকে যাবে। আমার যোনি সব সময় ছেঁড়া ছেঁড়াই থাকত। হাঁটতে পারতাম না ঠিক করে। গা বমি দিত সারাক্ষণ। গর্ভপাত হয়েছে আমার দু-তিন বার। আর কুড়ির কোঠা পেরোতে না পেরোতে জরায়ু বাদ হয়ে গিয়েছে। আমি আর মা হতে পারিনি।’
— এ বয়ান কিমিকো কানেদা-র, এক কোরিয়ান মহিলার। বা অনেক কোরিয়ান মহিলার। যাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের সেনা-ছাউনিতে ছিলেন ‘কমফর্ট উইমেন’ বা আরামদাত্রী হিসেবে। জাপান তার নিজের সেনাদের যুদ্ধক্ষেত্রে অবধি আরামের কথা, মানে যৌনতার চাহিদার কথা খেয়াল রেখেছে! ওয়াহ্!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এশিয়ায় জাপান তখন অক্ষশক্তির টেক্কা। হিটলারের প্রিয় দোসর। দখল করেছে চিন, কোরিয়া, ফিলিপিন্‌স, এমন নানা দেশের অনেকখানি, তার সেনারা ঘাঁটি গেড়েছে সে সব দেশে, বোমা-কামান-গোলা-গুলি দিয়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে প্রতিপক্ষকে। কিন্তু দিনের শেষে সেনা ছাউনিতে ফিরেও তো ছিঁড়ে খাওয়ার কাউকে চাই। তো, জাপান এ ব্যাপারে বেশ উদার ছিল। সে দেশে যৌনবৃত্তি আইনসম্মত। আর তাই যুদ্ধের সময় জাপানের যৌনকর্মীরা বিদেশে যে সব জায়গায় জাপানের সেনারা রয়েছে, সেখানে গিয়ে সেনাদের পরিতৃপ্ত করত। দলে দলে ‘কমফর্ট উইমেন’ হিসেবে রওনা দিত সেনাদের ‘কমফর্ট স্টেশন’-এ।
কিন্তু এক সময় জাপানের মনে হল, এত মেয়ে ট্রাভেল ভিসা নিয়ে কমফর্ট উইমেন হিসেবে নানা দেশে যাচ্ছে, এতে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ছি ছি, বাকি বিশ্ব কী বলবে? জাপান যৌনকর্মী পাঠাচ্ছে? আরেরেরেরে! উদার তো কী! ও সব ভাই নিজের কুঠুরিতে ভাল, বাকি বিশ্ব তো আর জাপানের আধুনিকতা বুঝবে না। অতএব যেখানে যেখানে ঘাঁটি গেড়েছ, সেখান থেকেই মেয়ের ব্যবস্থা করো। তাই লোকাল মেয়েদের চাহিদা বাড়ল, আর তাই দালাল জুটল, আর তাই যৌনক্রীতদাসী হয়ে গেল দখল-নেওয়া দেশগুলোর বছর বারো-তেরোর মেয়েরাও। বিশেষ করে কোরিয়া আর চিনের হাজার হাজার পরিবার থেকে বারো বছর থেকে শুরু করে যৌবনবতীরা পাচার হয়ে গেল আরামদাত্রী হিসেবে। বেশির ভাগ মেয়েকেই লোভ দেখানো হয়েছিল, কাজ দেওয়া হবে। যুদ্ধের বাজার। গরিব দেশ। বাড়ির মেয়েরা ফাঁদে পা দিয়েছিল। আবার অনেককে জাস্ট তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ইসলামিক স্টেট-এর দৌলতে যৌন-ক্রীতদাসী কথাটা ইদানীং খুব চলছে বটে, কিন্তু এ ট্র্যাডিশন চলছে প্রাচীন ইতিহাসের যুগ থেকেই। জাপানও এ জিনিস চালিয়েছে, পা‌ইকারি হারে।
ফিলিপিন্‌স-এর মারিয়া রোজা হেনসন বলেছেন, তাঁর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে অসহ্য ক্লান্তিটা। ‘এতটুকু বিশ্রাম পেতাম না। হয়তো বারো জন ধর্ষণ করল, তার সামান্য পরেই আবার বারো জন ধর্ষণ করল। ওরা বোধহয় প্রত্যেক মিনিটেই যৌনতা চাইত।’ তাইওয়ানের এক নারী জানিয়েছেন, ‘সকালটায় সৈনিকদের জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে হত, তার পর ওদের জামাকাপড় কাচতাম আর সেলাই-ফোঁড়াই করতাম। সেটা সহজ ছিল। কিন্তু রাত্রে আমাদের একটা ঘরে ডেকে নেওয়া হত... আমি সারা ক্ষণ কাঁদতাম।... রাত্রে আমি মরে যেতাম। প্রত্যেক রাত্রে আমি মরতাম। পালানোর কথা ভাবতাম, কিন্তু সৈন্যরা গেট পাহারা দিত। ... এত ছোট ছিলাম, কিছু বুঝতাম না। কখন প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়েছি, বুঝতেই পারিনি। যখন বমি করছি, এক মহিলা আমায় বোঝালেন। দু’মাসের মধ্যে মিসক্যারেজ হয়ে গেল।... যুদ্ধের পর আমার প্রেমিক ফিরে এল, আমরা বিয়ে করলাম। কোনও দিনই ওকে এ সব বলতে পারিনি। কী করে বলব? পঞ্চাশ বছর পর, যখন এই অভিজ্ঞতাগুলো বলা হচ্ছে, আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। স্বামীকে প্রথমে সব বললাম। ভেবেছিলাম, ও আমাকে ক্ষমা করবে না। কিন্তু ও অবাক হয়ে গেল। বলল, যুদ্ধে আমরা অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছি, কিন্তু তোমার যন্ত্রণা, তোমাদের যন্ত্রণা তো তার চেয়ে অনেক বেশি!’
তবে জাপান সবচেয়ে বেশি এই অত্যাচার চালিয়েছে কোরিয়ান মেয়েদের ওপরেই। কত মেয়ে কোরিয়া থেকে জাপানি সেনাদের যৌন ক্রীতদাসী হয়েছে, কোনও হিসেবই নেই— কুড়ি হাজার থেকে শুরু করে তিন-চার লাখও হতে পারে। ১৯১০ থেকে ১৯৪৫ অবধি জাপান টানা কোরিয়াকে শাসন করেছে। আর তাই ওখান থেকেই সবচেয়ে বেশি মেয়ে আরামদাত্রী হিসেবে অত্যাচারিত হয়েছে ভয়ঙ্কর, মর্মান্তিক ভাবে। চটকে, পিষে, থেঁতলে গিয়েছে শরীর। একটা সময় পচা কমলালেবুর মতো থ্যাপ করে পড়ে গিয়ে ছেতরে গেছে। তার পর সত্যি পচে গিয়ে মরে গেছে।
অসুখ হত যে। সেনা ব্যারাক বা ছাউনিতে তো বিশেষ কোনও ওষুধ থাকত না। শুধু মারকিউরোক্রোম আর সেনাদের যাতে যৌন-রোগ না হয় তার কিছু ওষুধপত্র। কিন্তু তাতে কি আর সব রকম অসুখ সামাল দেওয়া যায়? বেশি অসুখ হত ট্রেঞ্চগুলোতে।


সোল-এর জাপানি দূতাবাসের উলটো দিকে কোরিয়ান বালিকার
এই স্ট্যাচু নিয়েই দুই দেশের চাপান-উতোর।


সৈন্যরা স্থানীয় লোকদের দিয়ে কিছু খড় বিছিয়ে নিত সেই সব ট্রেঞ্চে। সেখানে সাপ্লাই হত বারো-তেরোর বছরের মেয়েরা। তাদের যোনি তখনও ঠিক মতো তৈরি হয়নি। কিন্তু তাতে যে ধর্ষণ আটকায় না, সে তো আমাদের দেশের শিশুকন্যারাই রোজই প্রমাণ দিয়ে চলেছে। ছয়, পাঁচ, চার কিংবা এক বছরের মেয়ের, এমনকী ২৮ দিনের মেয়ের যোনি ছিন্নভিন্ন হয়েছে। আর জাপানি সেনাদের তো ধর্ষণের সরকারি লাইসেন্স ছিল। তারা দমে থাকবে কেন? সেই সব বাচ্চা মেয়েরা রাতে কাঁদত জোরে। ‘মা গো আমার বড্ড জ্বালা করছে, মা গো আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।’ কিমিকো কানেদা বলেছিলেন, ‘আমরা ওদের কান্না শুনতে পেতাম, কিন্তু ওখানে গিয়ে খাবার দেওয়ার সাহস হয়নি। আমার ভয় করত, যদি খাবার দিতে যাই আর আমাকেও ট্রেঞ্চের মধ্যে টেনে নেয়?’ ওখানে অনেকের টিবি হত। যেই কোনও মেয়ে মারা যেত, সঙ্গে সঙ্গে অসুখ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে ট্রেঞ্চের বাকি সবাইকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হত। আর ওই ট্রেঞ্চটা বুজিয়ে আবার একটা ট্রেঞ্চ কাটা হত, আবার সেখানে ফুটফুটে মেয়েরা তাদের অস্ফুট যোনি নিয়ে উপস্থিত হয়ে যেত। আর এই অপরিসীম অত্যাচারে বেশির ভাগ ‘কমফর্ট উইমেন’ মরে গিয়েছে। তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ মেয়ের বেশির ভাগকে নিকেশ করতে হলে অত্যাচার কতটা তীব্র হতে হয়?
কিন্তু এ সব হেজেমজে যাওয়া মেয়েদের নিয়ে এখন এত কচকচি কেন? আসলে কথা শুরু হয়েছে বহু আগে থেকেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে ১৯৪৫ সালে। তখন থেকেই কোরিয়া তার মৃত ও জীবিত, ক্ষতবিক্ষত মেয়েদের জন্য ন্যায় দাবি করে এসেছে জাপানের কাছে। বলেছে, নিঃশর্ত ক্ষমা চাও। বলো, অন্যায় করেছ। ক্ষমতার জোরে এতগুলো মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছ, তার প্রতিদান দাও। স্বীকার করো, যা করেছ তা মানবিকতার অপমান।
তো, জাপান কোরিয়ার সঙ্গে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিয়েছিল ১৯৬৫ সালে। দু’দেশের চুক্তি হয়েছিল কূটনৈতিক সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার জন্যে। জাপান প্রচুর সাহায্য করেছিল কোরিয়াকে তার অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যে। এ কথা পাবলিক জানে। কিন্তু পাবলিক যেটা বহু দিন জানত না, কোরিয়া ওই ‘আরামদাত্রীদের ক্ষতিপূরণ’ নিয়ে, সেই টাকা দিয়ে বানিয়েছিল স্টিল প্লান্ট, রাস্তা, আরও নানা জিনিস। কিন্তু কমফর্ট উইমেনদের ডিসকমফর্ট বিন্দুমাত্র কমানোর চেষ্টা করেনি। এই মহান চুক্তির বিশদ বিবরণ জানা যায় চল্লিশ বছর পরে, ২০০৫ সালে, যখন চুক্তির নথিপত্র প্রকাশ হয়।
অবশ্য নব্বই দশকের গোড়া থেকেই এই ব্যাপারটা নিয়ে দুনিয়া সরগরম হয়ে উঠছিল। কিছু সাংবাদিকের লাগাতার রিপোর্ট আর কিছু আরামদাত্রীর আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের অভিজ্ঞতা লোকসমাজে জানানোয় ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যায়। পথে নেমে বিক্ষোভ, আন্দোলন, ক্ষমা চাওয়ার আর্জি জানানোর জন্য লাগাতার লড়াই চলে। আন্তর্জাতিক মহলে জাপানের নাম খারাপ হতে শুরু করে। জাপানের পক্ষে হাত গুটিয়ে আর বসে থাকা সম্ভব ছিল না। ১৯৯৪ সালে জাপান সরকার সে দেশের বেসরকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যৌথ ভাবে একটা ফান্ড তৈরি করে, এশিয়ান উইমেন’স ফান্ড। সেই তহবিল থেকে দক্ষিণ কোরিয়া সহ নানা দেশে জাপানিদের দ্বারা অত্যাচারিত মানুষদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু কোরিয়ার বহু আরামদাত্রী সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন, কারণ তাঁদের বক্তব্য, এই ক্ষতিপূরণ জাপানের সরকার দিচ্ছে না, তার মানে রাষ্ট্র হিসেবে জাপান তার দায় স্বীকার করছে না। কিছু মেয়ে অবশ্য পরে ক্ষতিপূরণ নিয়েছিলেন।
আর ক্ষমা? এক বার এই ক্ষমা চাওয়া হয়, এক বার আবার তা ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ১৯৯২ থেকে বার বার নানা উপলক্ষে জাপানের বিদেশমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, ন্যাশনাল পার্লামেন্ট দোষ স্বীকার করে, কিন্তু জাপানের কট্টরপন্থীরা, যারা মনে করে ‘আমাদের দেশ’ কখনও কোনও ভুল করতে পারে না, এই সব ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারে সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আবার, ২০০৭ সালে তখনকার (এবং এখনকারও) প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বলেন, জাপানি সেনারা যে আদৌ কোনও যৌন ক্রীতদাসী রেখেছিল, তার কোনও প্রমাণই নেই। ২০১৪ সালে জাপান সরকারের এক কর্তা বলেন, সরকার এই মার্জনা ভিক্ষার ব্যাপারটা ফের খতিয়ে দেখবে। মানে, বিভ্রান্তি, ধোঁয়াশা, এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা।
কিন্তু হঠাৎই, ২০১৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর, জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে একটা চুক্তি হয়ে গেল। জাপানের বিদেশমন্ত্রী আর তার পর প্রধানমন্ত্রী কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে ক্ষমা চাইলেন। শুধু তাই নয়, জাপান সরকারি তহবিল থেকে ৮৩ লক্ষ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে চাইল। সেই টাকায় এখনও বেঁচে থাকা ৪৬ জন কমফর্ট উইমেনকে সাহায্য করা হবে। বদলে, দক্ষিণ কোরিয়া এই কমফর্ট উইমেনদের ব্যাপারটা ‘চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয় ভাবে’ মিটিয়ে নিল, কথা দিল যে, এ বিষয়ে আর তারা জাপানের কোনও সমালোচনা করবে না। জাপান অবশ্য আরও একটি জিনিস চেয়েছে, এবং সে চাহিদা যাতে পূর্ণ হয় তার জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে।
সোল-এ জাপানি দূতাবাসের উলটো দিকে যে ছোট্ট মেয়েটার মূর্তি রয়েছে, সেটাকে হটিয়ে দিতে চায় জাপান।
কী মূর্তি? ২০১১ সালে, এক নাগরিক সংগঠনের উদ্যোগে, দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সোল শহরে জাপানি দূতাবাসের সামনে একটি কোরিয়ান বালিকার মূর্তি বসানো হয়। কোলের ওপর হাত দুটো রাখা, আর বিষণ্ণ মুখ। জাপানি দূতাবাস থেকে বেরনোর সময় প্রত্যেকে যেন ওই মূর্তিটি দেখে মনে রাখে, কোরিয়ান মেয়েদের প্রতি কী সাংঘাতিক অন্যায় হয়েছে, এবং তার কোনও রকম প্রতিকার হয়নি। জাপানের দাবি, ওই স্ট্যাচুটা সরাতে হবে। আসলে বক্তব্য হল, অপরাধের চিহ্ন মুছে দাও। কিছু টাকা তো দিচ্ছি। আর কেন বাপু? কিন্তু কমফর্ট উইমেনরা অনেকেই এই ক্ষমায় রাজি নন।
তাঁরা বলছেন, জাপান অবশেষে ক্ষমা চাইছে বটে, কিন্তু এটা কেন স্বীকার করছে না, যে কাণ্ড তারা করেছে, সেটা নৃশংস ‘যুদ্ধাপরাধ’? ওয়ার-ক্রাইম? কেন বলছে না, এটা ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ? এই কথা স্পষ্ট স্বীকার করুক। আর ক্ষমা তো সর্বসমক্ষে চাইতে হবে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী কোরিয়ান প্রেসিডেন্টের কাছে বন্ধ দরজার পিছনে বা টেলিফোনে ক্ষমা চাইলে তো হবে না। তাঁরা বলছেন, ‘আমরা টাকার জন্য লালায়িত নই, হৃত সম্মানের জন্য আমাদের লড়াই।’ তাঁরা চাইছেন, জাপানি ইতিহাসের টেক্সট-বইতেও লেখা হোক এই পৈশাচিক বিবরণ।
আর ওই স্ট্যাচুটা? কোরিয়ার বহু মানুষ এবং কমফর্ট উইমেনরা মনে করেন, ওটা কোনও ভাবেই সরানো উচিত নয়। কারণ ওটাই তো বার বার মনে করিয়ে দেবে যে, জাপান কী জঘন্য অপরাধটা করেছিল। সেই বৃদ্ধারা বলতে চাইছেন, আমরা এক বার মরেছিলাম যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলাম, এখন দয়া দেখিয়ে, পোশাকি ক্ষমা প্রার্থনা করে আর আমাদের অপমান কোরো না। তাঁরা যে আরও এক বার মরেছিলেন সে কথা তো তাঁরা অনেক দিন জানতেনই না! ১৯৬৫ সালে কোরিয়া সরকার তাঁদের নাম করে টাকা নিয়ে যে অন্য কাজে ব্যয় করেছে, এ তো আরও একটা মৃত্যুর সমান!
সবই তো হল, কিন্তু ২০১৪-য় জাপান সরকার বলেছিল তারা ক্ষমার ব্যাপারটা ভেবে দেখবে, আর পরের বছরেই ক্ষমা চাওয়া হয়ে গেল, চুক্তি হয়ে গেল, এত তড়িঘড়ি সব ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়ার পিছনে কোন রহস্য? আরে, এখনও তো আসল দাদাকে মঞ্চে আনিনি। আমেরিকা দাদা। আমেরিকা ইদানীং এ পা়ড়ায় একটু কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। চিন তরতর করে উঠছে, ও-দিকে উত্তর কোরিয়া বন্ধ দরজার আড়ালে কী ফাঁদছে ভগবান জানে, হঠাৎ করে তারা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করে বসল, তার পর আবার নাকি হাইড্রোজেন বোমা। অতএব এ পাড়ায় দাদাগিরি কায়েম রাখতে হলে জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়াকে রেডি স্টেডি রাখা চাই। ওয়াশিংটন থেকে বার্তা গেল দু’দেশের কাছে, তোমরা বাপু ক্ষমাটমা চেয়ে ভেতরকার ঝামেলা মিটিয়ে নাও। অতএব শিনজো আবে এবং পার্ক গুয়েন-হি ক্ষমার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে উঠলেন।
অ মা! এত ক্ষণ কি ভেবেছেন, কমফর্ট উইমেনদের দুঃখ সইতে না পেরে এ সব কাণ্ড হয়ে আসছে, সেই তবে থেকে? আশ্চর্য সরল তো! রাষ্ট্র থাকতে মেয়ে? রাষ্ট্র যখন যুদ্ধ করল, তখন মেয়েদের বলি দেওয়া হল। অত্যাচারী রাষ্ট্র যখন অত্যাচারিত রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করল, তখন সেই মেয়েদের প্রতারণা করা হল, তাদের নাম করে টাকা নিয়ে রাষ্ট্র অন্য কাজে ব্যবহার করল। আর আজ এই যে মেয়েদের নাম করে লোক-দেখানো ক্ষমা চাওয়া হচ্ছে ও কিছু ইয়েন-টিয়েন ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে, তারও মূল কারণ মেয়েরা নয়, রাষ্ট্রগুলোর মিটমাট করার রাজনৈতিক দায়। যদি চিন এত বড় শক্তি না হত, আমেরিকা তাতে ভয় না পেত, আজ হঠাৎ কমফর্ট উইমেনদের এই হইচই-ই হয়তো হত না। স্বয়ং কোরিয়াই হয়তো তার অপমানিতা মেয়েদের জন্য এত জোরে সওয়াল করত না। মেয়ে, সে যতই নিপীড়িতা হোক, যত অসহ্য কষ্টের মধ্যে দিয়েই যাক, রাষ্ট্র তাদের বোড়ে বই মানুষ হিসেবে গণ্যই করে না কখনও। যেমন কমফর্ট উইমেনদের করেনি। না জাপান, না কোরিয়া। আর আমরা বোকারা ভাবছি এত আন্দোলন, এত ক্ষমা-চাওয়াচাওয়ি, তাদেরই জন্য।
এ সবের পরেও মেয়েরা বেঁচে থাকে। ক্ষত যোনি, ছিন্নভিন্ন আত্মা, ব্যাঁকা শিরদাঁড়া, পেটের খিদে, চোখের জল— সব নিয়ে ‘দিব্য’ থাকে তো! ওই যে বলে না, মেয়েদের প্রাণ, কইমাছের জান— এ কথাটা কিন্তু বার বার বহু রকম ভাবে প্রমাণ করেছে গণধর্ষণ, অত্যাচার, প্রতারণা, অপমান। কী টেনাসিটি মেয়েদের, না?
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৬ রাত ১:৪২
১৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×