ভূতুড়ে কণা নিউট্রিনো
হঠাত করে ফলাও করে একটা খবর প্রকাশিত হতে লাগলো।আলোর চেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন কণার আবিষ্কার।পুরো বিশ্ব কাঁপানো খবর।পদার্থবিজ্ঞানীরা নড়েচড়ে বসলেন।যারা এই অদ্ভুত আবিষ্কার করেছেন তারা নিজেরাই অবাক।এটি কিভাবে সম্ভব?তাহলে কি আইনস্টাইন ভুল?আর সেই বিখ্যাত কণাটির নাম নিউট্রিনো।যদিও পরে এই তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
শুনি পৃথিবী কাঁপানো নিউট্রিনোর গল্প-
নিউট্রিনো আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে চলতে পারে - এই তথ্য দিয়ে সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের হতবাক করে দিয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম বড় ল্যাবরেটরি স্যার্নের বিজ্ঞানীরা৷ কিন্তু তাদেরই আরেক পরীক্ষায় দেখা গেল আগের তথ্যটি ঠিক নয়৷
বিশ্বখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী জার্মানির অ্যালবার্ট আইনস্টাইন৷ তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ E=MC²৷ ‘থিওরি অব স্পেশাল রিলেটিভিটি' বা বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সমীকরণ এটি৷ এই তত্ত্বের মূল কথা, আলোর চেয়ে দ্রুতগতির আর কিছু নেই৷ আজ থেকে প্রায় ১০৬ বছর আগে আইনস্টাইন এই কথা বলেছিলেন৷ পরবর্তীতে অনেকবার পরীক্ষা করা হলেও আইনস্টাইনের কথাটাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়৷ বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের উপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে পদার্থবিজ্ঞানের অন্যান্য অনেক তত্ত্ব৷
কিন্তু গত বছর সেপ্টেম্বরে একদল ইউরোপীয় বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের তত্ত্বকে ভুল বলে ধারণা দিয়েছিলেন৷ একটি পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা দেখিয়েছিলেন আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে চলতে পারে নিউট্রিনো৷ তাঁদের এই তথ্য সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে রীতিমত হৈচৈ ফেলে দেয়৷ কেননা আইনস্টাইনের তত্ত্ব ভুল, এটা কেউই ঠিক কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না৷ তাই নতুন এই তথ্য কতটা সত্যি সেটা নিয়ে শুরু হয় গবেষণা৷ অবশেষে অ্যামেরিকার বিখ্যাত জার্নাল ‘সায়েন্স ইনসাইডার'এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷ তাতে স্যার্ন তথা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সম্ভাব্য দুটি ত্রুটির কথা উল্লেখ করা হয়৷ এর একটি ‘লুজ' অর্থাৎ ঢিলা অপটিক্যাল ফাইবার কানেকশন - যে কারণে সময় গণনায় ভুল হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ আর আরেকটি ত্রুটি হতে পারে ‘অসিলেটর'এ৷
আইনস্টাইন
এটাও সময় গণনার একটি যন্ত্র৷ এরপর স্যার্নের পক্ষ থেকেও তাঁদের ভুলের কথা স্বীকার করে নেওয়া হয় এবং বলা হয় আবার নতুন করে পরীক্ষা করে দেখা হবে৷
যে কথা সেই কাজ৷ ফলে নতুনভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গেল আগে যেটা বলা হয়েছিল সেটা ভুল৷ মানে নিউট্রিনো আলোর চেয়ে বেশি গতিতে নয়, সমান গতিতে চলে৷ নতুন এই পরীক্ষাটা চালান স্যার্নেরই আরেক দল বিজ্ঞানী৷ এই তথ্য প্রকাশের পর স্যার্নের গবেষণা পরিচালক সার্গিও বার্তোলুচ্চি বলছেন, আগের পরীক্ষায় যে পরিমাপগত ভুল ছিল নতুন তথ্য সেদিকেই ইঙ্গিত করছে৷ তবে পুরো বিষয়টা নিশ্চিত হতে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে বলেও জানান তিনি৷ আগামী মে মাসে ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে আবারও পরীক্ষা করা হবে বলে জানান স্যার্নের ঐ কর্মকর্তা৷
প্রথম গবেষণা প্রকাশের পর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের কণা-পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জেফ ফোরশাও বলেছিলেন, গবেষণার ফল যদি সত্যি হয়, অর্থাৎ নিউট্রিনো যদি সত্যিই আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে চলতে পারে, তাহলে আজকের তথ্য পাঠিয়ে দেয়া যাবে অতীতে৷ অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, ‘‘আমরা কল্পবিজ্ঞানে হরহামেশাই যে ‘টাইম ট্রাভেল'এর কথা পড়ি সেটা সত্যি হবে৷''
স্যার্নের এক বিজ্ঞানীর মতে, নিউট্রিনো সাধারণত পরমাণু চুল্লিতে তৈরি হয়৷ ১৯৩৪ সালে প্রথমবারের মতো নিউট্রিনোর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটা শুধু বিজ্ঞানীদের অবাকই করে যাচ্ছে৷ নিউট্রিনোকে এরপরেও অনেকে যে ‘ভুতুড়ে কণা' বলে ডাকে, সেটা কী ভুল? মোটেও নয়! নিউট্রিনো আসলেই একটি ভুতুড়ে কণা!
নিউট্রিনো কি?
নিউট্রিনো (ইংরেজি: Neutrino, ইংরেজি উচ্চারণ: ইতালীয় উচ্চারণ: [neuˈtriːno]) হচ্ছে বৈদ্যুতিক চার্জবিহীন, দুর্বল সক্রিয় ক্ষুদ্র পারমাণবিক কণা। ধারণা করা হয়, এই ক্ষুদ্র কণা অশূন্য ভরের কণা। পর্দাথের মধ্য দিয়ে এই কণা প্রায় অবিকৃতভাবে চলাচল করতে পারে। নিউট্রিনো অর্থ হচ্ছে 'ক্ষুদ্র নিরপেক্ষ কণা'। গ্রীক বর্ণ নিউ (ν) দিয়ে একে প্রকাশ করা হয়।
সেপ্টেম্বর ২০১১-তে গবেষকরা ঘোষণা করেন, নিউট্রিনো আলোক কণা থেকে দ্রুত বেগসম্পন্ন।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো আদর্শ মডেল নামের একটি তত্ত্ব। এই মডেল অনুসারে মৌলিক কণাগুলো তিন প্রকার—কোয়ার্ক, বোসন, লেপটন। এর মধ্যে লেপটন দুই প্রকার—ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো। নিউট্রিনোর ধারণা প্রথম বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন পরমাণুর বেটা ক্ষয়ের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে। বেটা ক্ষয়ের মাধ্যমে পর্যায় সারণির একটি পদার্থের পরমাণুর কেন্দ্র থেকে ইলেকট্রন নির্গত হয় এবং পরমাণুটি পর্যায় সারণির পরবর্তী পদার্থে পরিণত হয়। বিজ্ঞানী পাউলি দেখলেন যে ভরবেগ, শক্তি, কৌণিক ভরবেগ ইত্যাদির নিত্যতা বজায় রাখার জন্য ইলেকট্রনের সঙ্গে আরেকটি খুবই হালকা, আধানহীন এবং প্রায় অদৃশ্য কণার উপস্থিতি প্রয়োজন—এই কণাটিরই নাম দেওয়া হয় নিউট্রিনো। নিউট্রিনো এবং ইলেকট্রন প্রকৃতিতে দুই ভাইয়ের মতো। তিন ধরনের ইলেকট্রন আছে—ইলেকট্রন ইলেকট্রন (অথবা শুধুই ইলেকট্রন), মিউ ইলেকট্রন (মিউয়ন), টাউ ইলেকট্রন (টাউয়ন); এর প্রতিটির সঙ্গে আছে একটি করে নিউট্রিনো—ইলেকট্রন নিউট্রিনো, মিউ নিউট্রিনো, টাউ নিউট্রিনো। নিউট্রিনোর উপস্থিতি টের পাওয়া খুবই কঠিন। কারণ, এর ভর অতি সামান্য, কোনো আধান নেই এবং অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে এর বিক্রিয়াও খুবই ক্ষীণ। এমনকি ঠিক এ মুহূর্তে আপনার শরীর ভেদ করে হাজার কোটিরও বেশিসংখ্যক নিউট্রিনো যাচ্ছে, কিন্তু আপনি বুঝতেও পারছেন না। পৃথিবীতে আগত নিউট্রিনোর মূল উৎস সূর্যের অভ্যন্তরে ফিউশন বিক্রিয়া। নিউট্রিনোর ভর এখনো সুনির্দিষ্ট নয়, এখন পর্যন্ত আমরা যতটুকু জানি তা হলো, এই তিন ধরনের নিউট্রিনোর ভর যথাক্রমে সংশ্লিষ্ট ইলেকট্রনের ভরের দুই লাখ ভাগের এক ভাগ, ৬০০ ভাগের এক ভাগ, ১১০ ভাগের এক ভাগ হতেও কম। তবে অনেকের মতে নিউট্রিনোর আসলে কোনো ভরই নেই, অর্থাৎ আলোর মতো ভরহীন।
নিউট্রিনোর গতি-
নিউট্রিনো যদি আসলেই ভরহীন হয়, তাহলে আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী তার গতি হবে আলোর গতির সমান, আর যদি ভর থাকে, তাহলে গতি হবে আলোর গতির চেয়ে কম। কিন্তু অপেরা পরীক্ষণের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে নিউট্রিনোর গতি হলো আলোর গতির ১.০০০০২৫ গুণ (০.০০২৫ শতাংশ বেশি)। স্বাভাবিকভাবেই এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এ ধরনের আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীদের প্রথম করণীয় হলো, আবিষ্কারে নির্ভুলতা যাচাই করা এবং আবিষ্কারটি ব্যাখ্যা করা যায়—এমন গাণিতিক তত্ত্ব হাজির করা।
প্রজেক্ট অপেরা-
এই পরীক্ষাটির প্রথম ধাপে সুইজারল্যান্ডের সিনক্রোটোন নামের একটি ভূগর্ভস্থ যন্ত্রে প্রোটন কণা তৈরি করে গ্রাফাইটের ওপর নিক্ষেপ করা হয়। এতে প্রোটন কণাগুলা ভেঙে কিছু অন্তর্বর্তীকালীন জটিল কণা তৈরি হয়, যেগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষয় হয়ে মিউয়ন এবং মিউ নিউট্রিনো তৈরি করে। এই কণাগুলোকে তখন লোহার ওপর নিক্ষেপ করা হয়। এতে মিউয়ন নিউট্রিনো বাদে অন্য সব কণা প্রতিফলিত বা শোষিত হয়, কিন্তু নিউট্রিনোগুলো লোহা ভেদ করে চলে যেতে পারে। এই নিউট্রিনোগুলো তারপর পৃথিবীর মাটি-পাথর ভেদ করে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার দূরে ইতালিতে পৌঁছায়, যেখানে বিজ্ঞানীরা এই বিশেষ নিউট্রিনোর আগমন সময় লিপিবদ্ধ করেন। সূর্য থেকে আগত বিপুলসংখ্যক নিউট্রিনোর সঙ্গে এই নিউট্রিনোর পার্থক্য করা সহজ। কারণ, সূর্যের নিউট্রিনোগুলো হলো ইলেকট্রন নিউট্রিনো, যার ভর এই মিউয়ন নিউট্রিনোগুলোর ১০ হাজার ভাগের এক ভাগ। ভূগর্ভের বিভিন্ন ধরনের পদার্থ ভেদ করে আসার সময় এই নিউট্রিনো বা তার গতির কোনোই পরিবর্তন হয় না। বিজ্ঞানীরা সহজে এই বিশেষ পর্যটকের গতি নির্ধারণ করেন।
পরীক্ষণের নির্ভুলতা-
প্রথমত আসে পরিমাপের নির্ভুলতার কথা। নিউট্রনগুলো আলোর গতিতে ভ্রমণ করলে সুইজারল্যান্ড থেকে ইতালিতে আসতে যে সময় লাগত, প্রকৃত পরীক্ষায় তার চেয়ে মাত্র ৬০ ন্যানোসেকেন্ড (১ ন্যানোসেকেন্ড = ১ সেকেন্ডের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ) আগে পৌঁছেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এই প্রায় কল্পনাতীত ক্ষুদ্র পার্থক্য কি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে? উত্তর, হ্যাঁ। অপেরা পরীক্ষার অংশ হিসেবে করা বিভিন্ন পরিমাপ এতটাই নিখুঁত যে ২০০৯ সালে সংঘটিত একটি ভূমিকম্পের ফলে সুইজারল্যান্ড ও ইতালির মধ্যবর্তী দূরত্বে যে পরিবর্তন হয়েছে, তাও হিসাবে নেওয়া হয়েছে। ইন্টারনেটে প্রকাশিত তথ্যগুলোতে ঠিক ভূমিকম্পের সময় নিউট্রিনগুলোর যাত্রাকালে বড় ধরনের পরিবর্তন ধরা পড়ে, যার কারণ হলো ভূমিকম্পের ফলে মাটি সরে যাওয়ায় দূরত্বের পরিবর্তন।
যেকোনো বিজ্ঞান পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার পর প্রথম কাজই হলো, পরীক্ষাটির ভুলত্রুটি দূর করা। এ ধরনের সমস্যা দূর করার জন্য বিজ্ঞানীরা যা করেন তা হলো, একই পরীক্ষা বারবার করা। বিভিন্ন কারণে পরীক্ষার ফলাফল সব সময় একই আসে না, তখন ফলাফলের গড় করা হয় এবং ভুলের আশঙ্কা হিসাব করা হয়। অপেরা পরীক্ষায় নিউট্রিনোর গতি পরিমাপ করা হয়েছে কয়েক বছর সময় নিয়ে প্রায় ১৬ হাজার বার এবং তারপর গড় যে ফলাফল পাওয়া গেছে, ভুলের আশঙ্কা গণ্য করার পরও তার গতি আলোর গতির চেয়ে বেশি!
এখন বাকি থাকল আসলে পরীক্ষাটিতেই অন্তর্নিহিত কোনো ভুল আছে কি না তা যাচাই করা। বিভিন্ন কারণে পরীক্ষার ডিজাইনের মধ্যেই ভুল থেকে যেতে পারে। যেমন, একটি থার্মোমিটার দিয়ে শিশুর জ্বর মাপার সময় যদি মায়ের নিজের আঙুলই থার্মোমিটারে অগ্রভাগকে স্পর্শ করে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সঠিক জ্বর পাওয়া যাবে না। এটি হলো পরীক্ষার ডিজাইনের একটি ভুল। যেকোনো পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণের সময় বিজ্ঞানীদেরও এ ধরনের ভুলের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হয়। অপেরা পরীক্ষাটিতে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো ভুল পাওয়া যায়নি। পরীক্ষকেরা তাই তাঁদের সব তথ্য ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।
আরেকটি ধাপ হলো, সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো পরীক্ষায় একই ফলাফল পাওয়া যায় কি না, তা যাচাই করা। শুধু একটি পরীক্ষার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা খুব বেশি উৎসাহী নন। এ ক্ষেত্রে একটি সুখবর হলো, কয়েক বছর আগেই শিকাগোর ফার্মিল্যাবে নিউট্রিনো-সংক্রান্ত আরও কিছু পরীক্ষা করা হয়েছিল। এখন সেই পরীক্ষায় পাওয়া তথ্যগুলো পুনরায় বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
সম্ভাবনা
যোগাযোগ ব্যবস্থায় পৃথিবীকে দিন দিন ছোট করে ফেলাই যেন পৃথিবীর বিজ্ঞানী-প্রকৌশলীদের অন্যতম লক্ষ। সেকেন্ডের ভেতরেই তথ্য আদান প্রদান করা চাই। যেহেতু নিউট্রিনো এমন বাধাহীনভাবে চলে তাই এই নিউট্রিনোর মাঝে তথ্য দিয়ে তাকে প্রেরণ করা যেতে পারে না? ধরা যাক পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে কোনো বার্তা অপর প্রান্তে পাঠানো লাগবে, তাঁর জন্য যেটা করতে হবে সেটা হল স্যাটেলাইটের সাহায্য নেয়া, কিংবা তারের/সাবমেরিন ক্যাবলের সাহায্য নেয়া। মোটামুটি বেশি সময় না লাগলেও ভালই সময় লাগে তাতে। এখানে যদি নিউট্রিনো দিয়ে কাজটা করা যায় তবে কতই না সহজ হয়ে যায়। নিউট্রিনো মাটি ভেদ করে যেতে পারবে সেকেন্ডের লক্ষ ভাগের এক ভাগে। লাগবে না কোনো তাঁর। উপযোগী একটা ট্রান্সমিটার আর রিসিভার হলেই হল।ট্রান্সমিটার হতে তথ্য প্রেরণ করা হবে আর গ্রাহকের কাছে রিসিভারে সে তথ্য গ্রহণ করা হবে। আমরা যে টেলিফোন, মোবাইল ব্যাবহার করি সেখানেও তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের বদলে ব্যবহার করা যেতে পারে এই নিউট্রিনো প্রযুক্তি।
কিন্তু ওই যে বিজ্ঞানীদের নাকানি চুবানি খাওয়ানো কণা সে কি আর সহজে ধরা দিবে? এখানেও আছে ঝামেলা। নিউট্রিনো সে অনায়াসেই ভেদ করে যাবে রিসিভার। রিসিভারকে সাড়াই দিবে না। স্বয়ং পৃথিবীকে ভেদ করে চলে যায় আর এটা তো একটা রিসিভার মাত্র! কোনো একটা হিসেবে এমন সংখ্যাও দেখেছিলাম নিউট্রিনোর গতিকে থামাতে হলে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল [তিন লক্ষ কিলোমিটার] লম্বা নিরেট ধাতব পাত দরকার! সামান্য একটা কণাকে ধরতে এত বিশাল আঁকারের ডিটেক্টর তৈরি করতে হয় যে সে ডিটেক্টরকেও মোটামুটি এক ভৌতিক কারখানা বলে মনে হয়।
চিত্র: নিউট্রিনোকে ধরার জন্য তৈরি করা বিশাল ডিটেক্টর।
তবে আমরা আশা করতেই পারি এবং এর জন্য অপেক্ষা করতেই পারি, একসময় সহজলভ্য এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হবে যা দিয়ে খুব সহজেই নিউট্রিনোকে বাগে আনা যাবে। এবং তার সাথে সাথে এটি দিয়ে জগতকেই পাল্টে ফেলা যাবে, মানুষের জীবনযাত্রার সহজতর হয়ে যাবে। যদি আমরা দৃশ্যমান আলোকের বিকিরণের বদলে নিউট্রিনোর বিকিরণে দেখি তাহলে রাতের অন্ধকারেও পৃথিবীকে দিনের মতই দেখা যাবে। সে জন্য দরকার উপযুক্ত প্রযুক্তি। সত্যি কথা বলতে কি নিউট্রিনোকে ব্যবহার করে যে কি পরিমাণ সুবিধা পাওয়া যেতে পারে সেটা আমরা ভাবতেই পারি না।অনেক অনেক সম্ভাবনাময় একটা জিনিস এই নিউট্রিনো।
তত্ত্ব-
অপেরার ফলাফল যদি সত্যি প্রমাণিত হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে তা পদার্থবিজ্ঞানে একটি বিপ্লব সৃষ্টি করবে। এ ঘটনা এবং সার্নের বিশাল হ্যাড্রন সংঘর্ষক নামক যন্ত্রের উচ্চশক্তি পরীক্ষাগুলোর প্রতিক্রিয়া গত শতাব্দীর শুরুর দিকে পদার্থবিজ্ঞানের যে নবযুগ সৃষ্টি হয়েছিল, তাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে অনেকের ধারণা। এ ঘটনার ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন নতুন-পুরোনো তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। নিউট্রিনোর এই আপাত গতি আইনস্টাইনের তত্ত্বের পরিপন্থী। তবে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের অত্যন্ত গভীরে নিমজ্জিত এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ সফল (অন্য কোনো তত্ত্বের এ ধরনের সাফল্যের রেকর্ড নেই) হওয়ায় বিজ্ঞানীরা প্রাথমিকভাবে একে রক্ষা করেই নতুন তত্ত্বের প্রবর্তনের চেষ্টা করছেন।
একটি সম্ভাব্য তত্ত্ব হলো, স্ট্রিং থিওরি। স্ট্রিং থিওরি প্রস্তাব করে যে মহাবিশ্বে আমাদের দৃষ্টিগোচর স্থান-কাল ছাড়াও আরও অনেকগুলো মাত্রা আছে। কোনো কোনো উচ্চ শক্তিবিশিষ্ট কণা (যেমন, অপেরার মিউ নিউট্রিনোগুলো) এই বাড়তি মাত্রাগুলোকে স্থান-কালের মধ্যে বিচরণের জন্য চোরাগলি বা শর্টকাট হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। সে ক্ষেত্রে আমাদের কাছে (আমাদের পর্যবেক্ষণ স্থান-কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ) কণাটির গতি প্রকৃত গতির চেয়ে বেশি মনে হবে। এ ব্যাখ্যা আইনস্টাইনের তত্ত্বকে রক্ষা করেই নিউট্রিনোর আপাত গতি ব্যাখ্যা করতে পারে।
আরেকটি সম্ভাব্য তত্ত্ব হলো, সিমেট্রি ব্রেকিং (সুষমতা ভঙ্গ)। মহাবিশ্বের কিছু সিমেট্রি (সুষমতা) আছে। এই সুষমতাগুলোই মহাবিশ্বের সব নিয়মের মূল। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্বের মূল হলো ‘লরেঞ্জের সুষমতা’-এর আবিষ্কর্তা বিজ্ঞানী লরেঞ্জের সম্মানে নামকৃত। লরেঞ্জের সুষমতার মূলনীতি হলো, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মগুলো পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ। মহাবিশ্বের অন্য সুষমতাগুলো কিছু বিশেষ প্রক্রিয়ায় ভঙ্গ হতে পারে; তবে লরেঞ্জের সুষমতা ভঙ্গের কোনো দৃষ্টান্ত এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে যদি কোনো ক্ষেত্রে লরেঞ্জের সুষমতা ভঙ্গ হয়, তাহলে সেখানে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রযোজ্য হবে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে বস্তুর গতি আলোর গতির বেশি সেটা যা-ই হোক, বিজ্ঞানের চমৎকারিত্ব যে নতুন নতুন দিকে সব সময় ডানা মেলছে সার্নের এ পরীক্ষা হলো তার বড়ো প্রমাণ।
কাজে তত্ত্বের বেড়াজাল ডিঙিয়ে শেষ পর্যন্ত জয় হবে বিজ্ঞানের, মানুষের কৌতুহলের ও মহাবিশ্বকে জানার দারুণ আগ্রহের।
সর্বশেষ কিছু কথা-
নিউট্রিনো তিন প্রকার। হিসাবের মাঝে তিন প্রকার নিউট্রিনোর দরকার পড়ে তিন প্রকার ইলেকট্রনের জন্য।
১. ইলেকট্রন-ইলেকট্রন। যাকে বলে “ইলেকট্রন” (সত্যিকারের ‘আসল’ ইলেকট্রন)
২. মিউ-ইলেকট্রন। যাকে বলে “মিউওন”
৩. টাউ-ইলেকট্রন। যাকে বলে “টাউওন” বা “টাউ”
এই প্রতিটি কণার সাথে আছে একটি করে নিউট্রিনো।
১. ইলেকট্রন নিউট্রিনো
২. মিউ নিউট্রিনো
৩. টাউ নিউট্রিনো
এক পলকে নিউট্রিনোর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
১৯৩১- বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি নিউট্রিনোর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা করেন ও ভবিষ্যদ্বাণী করেন। ইলেকট্রনের ভর, শক্তি, ভরবেগ ইত্যাদির হিসাব মিলাতে গিয়ে তিনি এটি লক্ষ করেন।
১৯৩২- এনরিকো ফার্মি এর নাম দেন নিউট্রিনো।
১৯৩৪- এনরিকো ফারমি নিউট্রিনোকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি তত্ত্ব দাড় করান।
১৯৫৬- পরীক্ষার মাধ্যমে সর্বপ্রথম নিউট্রিনো আবিষ্কার করা হয়।
১৯৬২- নিউট্রিনোর অন্য একটি প্রকারভেদ ‘মিউ নিউট্রিনো’ আবিষ্কার।
১৯৬৮- সূর্য থেকে আগত নিউট্রিনো খুঁজে পেতে বিজ্ঞানীরা প্রথম কোনো পরীক্ষা চালায়।
১৯৭৮- স্ট্যানফোর্ড লিনিয়ার এসিলারেটরে টাউ লেপটন আবিষ্কৃত হয়। তাতে টাউ নিউট্রিনোর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা করা হয়। এবং তাতে সে কণার ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়।
১৯৮৫- নিউট্রিনোর ভর শূন্য নয় এমন ফলাফল প্রকাশ করা হয়। গবেষণায় ছিল আই.বি.এম. ও রাশিয়ান টিম।
১৯৮৭- ক্যামিওক্যান্ড ও রাশিয়ান টিম সুপারনোভা থেকে আগত নিউট্রিনো শনাক্ত করে।
৯৮৮- ৬২ সালের নিউট্রিনোর একটি প্রকারভেদ আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীদের নোবেল পুরস্কার প্রদান।
১৯৮৯- ক্যামিওক্যান্ড আরেকটি গবেষণায় সূর্য থেকে আগত নিউট্রিনো পরিমাপ করে এবং দেখতে পায় সূর্য থেকে যে পরিমাণ নিউট্রিনো ছুটে আসার কথা সে পরিমাণ আসে না। কম আসে। তিন ভাগের এক ভাগ।
১৯৯০- আই.বি.এম. সূর্যের আগত তিন ভাগের এক ভাগ নিউট্রিনো বিষয়ক সমস্যার সঠিক কারণ খুঁজে পায়।
১৯৯৮- এই সময়ে বিজ্ঞানীরা একেবারে নিশ্চিত হয়ে ঘোষণা করলেন যে নিউট্রিনোর ভর আছে।
২০০০- ভবিষ্যদ্বাণী করা টাউ নিওট্রিনোকে খুঁজে পাওয়া যায়।
২০০২- সূর্যের নিউট্রিনো সমস্যার সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীদের নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয়।