আমাদের অনেকেই এক কাপ কফিতে চুমুক না দিয়ে দিনের কাজ শুরু করতেই পারিনা। নানারকম ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় আমাদের স্বাস্থ্যকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে- সম্প্রতি এক নতুন গবেষণায় লম্বা জীবনকালের সাথে কফির যোগসূত্র পাওয়া গিয়েছে। যেখানে, অনেক শক্তিবর্ধক পানীয়তে আশ্চর্যজনকভাবে অত্যধিক মাত্রায় সুগার থাকে।
ক্যাফেইন নিজেই একটি উত্তেজক যার কিছু ভালো এবং খারাপ প্রভাব রয়েছে। এটা আমাদেরকে সতর্ক, সজাগ, এবং মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিপর্যয় ঘটতে পারে। এটা আমাদের দেহের বিভিন্ন প্রক্রিয়া যেমন, ডাইজেশন, মেটাবলিজম, দৃষ্টিশক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। এক কাপ ক্যাফেইনেটেড কফি খাওয়ার পর আমাদের দেহে কি ঘটে সেটা নিয়েই আজকে আমাদের আলোচনা।
ক্যাফেইন পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশী ব্যাবহৃত একটি সাইকোএকটিভ ড্রাগ:
ক্যাফেইন সম্পর্কে একটা বিষয় খুব কমই আলোচনায় আসে যে, এটা একটা ড্রাগ। ইন ফ্যাক্ট, এটা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ব্যাবহৃত একট সাইকোএকটিভ ড্রাগ। হয়তো এই কারণেই আমরা এটাকে ড্রাগ মনে করিনা।
ক্যাফেইনের চিত্তপ্রভাবক ভুমিকা রয়েছে। এটা আমাদের চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা এবং মেলামেশার ধারা পরিবর্তন করে দেয়। তারপরেও আমাদের কতোজনই ক্যাফেইনেটেড কফি ছাড়া একটা দিনও কাটাতে পারিনা।
হার্ভার্ড নিউরোসাইন্টিস্ট চার্লস যাইসলার ধারণা করেন যে, ক্যাফেইন এবং ইলেক্ট্রিসিটির সমন্বয়, মানুষেকে সূর্যের চক্র থেকে মুক্ত করে মানুষের ঘুমানো এবং জেগে উঠার স্বাভাবিক প্যাটার্ন পরিবর্তন করে দিতে পারে। তিনি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে লিখেন, "এই পরিবর্তন ফার্ম থেকে ফ্যাক্টরীতে মানুষের অর্থনৈতিক প্রচেষ্টার অসাধারণ ট্রান্সফরমেশনকে সম্ভব করেছে।"
ক্যাফেইন আমাদের এলার্ট করে:
দিন গড়ানোর সাথে সাথে আমরা ক্লান্ত হতে থাকি, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের ব্রেইন আমরা জেগে উঠা থেকে শুরু করে ঘুমানো পর্যন্ত প্রাকৃতিকভাবে এডিনোসিন নামে একটি পদার্থ উৎপাদন করতে থাকে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এটাই আমাদেরকে রাতে বিছানায় টেনে নিয়ে যায়।
ক্যাফেইন ব্রেইনে এডিনোসিনকে নকল করে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে হাইজ্যাক করে। এটা এডিনোসিন রিসেপ্টরের সাথে লেগে, এদেরকে তাড়িয়ে দেয়। ফলে, আমরা আরো সজাগ এবং সতর্ক হতে পারি।
শেষমেশ, এডিনোসিন আরো নতুন রিসেপ্টর তৈরী করে আমাদের চোখে ঘুম এনে দেয়।
এজন্যই আমাদের সকালের এক কাপ কফি কখনো দুই কাপ হয়ে যায়। কারণ, যতো বেশি এডিনোসিন রিসেপ্টর থাকবে, ততো ক্যাফেইন লাগবে।
ক্যাফেইন মুড বুষ্ট করে:
সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম উত্তেজক হিসেবে ক্যাফেইন শুধু এলার্টনেস বাড়ায় না, বরং মানসিক অবস্থারও উন্নতি করে। এটা ঐ এডিনোসিন ব্লকিং ইফেক্টের কারণেই হয়, যা আমাদের সতর্ক করে। এডিনোসিন রিলাক্সিং ইফেক্ট ব্লক করার মাধ্যমে ক্যাফেইন ডোপামিন এবং গ্লুটামিনকে (ব্রেনের তৈরী দুটি প্রাকৃতিক স্টিমুল্যান্ট) ক্ষিপ্ত করে তোলে। যা আমাদেরকে আরো সতর্ক, কম বোরড করে তোলে এবং মানসিক অবস্থার উন্নতি করে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, কয়েকটি স্টাডিতে কফি হিসেবে ক্যাফেইন গ্রহণ এবং ডিপ্রেশনের রিস্ক কমে যাওয়ার মধ্যে সম্পর্ক পাওয়া গেছে। গবেষণা বলছে, ক্যাফেইন পুরুষের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঝুকি কমায়। এদের মধ্যে একটা স্টাডিতে শুধুমাত্র ক্যাফেইনেটেড কফির সাথে এরকম সম্পর্ক পাওয়া গেছে। তবে বাকি সব গবেষণায়ই কফি এবং চা এর ক্ষেত্রেও একই প্রভাব লক্ষিত হয়েছে।
ক্যাফেইন স্মৃতিশক্তি বাড়ায়:
কিছু গবেষণায় আমাদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে ক্যাফেইনের ভুমিকা পাওয়া গেছে। শব্দের তালিকা মুখস্থ এবং সহজ তথ্য মনে রাখায় এর অবদান লক্ষ্যণীয়।
একটি সাম্প্রতিক গবেষণা নির্দেশ করে যে, ক্যাফেইনের এই প্রভাব ইন্ট্রোভার্টদের থেকে এক্সট্রোভার্টদের ক্ষেত্রে বেশি কাজ করে। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এটা বেশি প্রভাব ফেলতে পারে। The science and lore of alcohol and caffeine এর লেখক স্টিফেন ব্রাউন ব্যাখ্যা করেন যে, ইন্ডিভিজুয়ালের ক্ষেত্রে ক্যাফেইনের প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। যখন একজন মানুষ উচ্চ মাত্রার ক্যাফেইনে অনেক বেশি কাজ করার শক্তি লাভ করে, তখন হয়তো এটা অন্যজনকে কাজ করতে অক্ষম করে ফেলে।
ক্যাফেইন ঔষধের কার্যক্ষমতা বাড়ায়:
যদি আপনার কখনো মাইগ্রেনের ব্যাথা হয়ে থাকে, আপনি হয়তো এক্সেড্রিন এর মতো ব্যাথানাশক ট্রাই করে থাকবেন। ট্র্যাডিশনাল পেইন রিলিভিং ইনগ্রেডিয়েন্টস ইবুপ্রফেন, এসিটামিনোফেন এর মতো এক্সেড্রিনেও ক্যাফেইন থাকে।
এটা এজন্য কারণ কিছু প্রমান রয়েছে যে, ক্যাফেইন এসিটামিনোফেন, এসপিরিনের মতো ঔষধকে দ্রুত, দীর্ঘসময় এবং আরো ইফেক্টিভলি কাজ করতে সাহায্য করে।
২০০৭ সালে ২৪ জন মানুষকে নিয়ে একটা পরিক্ষা চালানো হয়। এতে কয়েকজনকে ক্যাফেইনযুক্ত এবং কয়েকজনকে ক্যাফেইন ছাড়া এসিটামিনোফেন খেতে দেওয়া হয়। দেখা যায় যে, ক্যাফেইনযুক্ত ব্যাথানাশক দ্রুত ব্যাথা সারায় এবং দীর্ঘক্ষণ কার্যক্ষম থাকে।
ক্যাফেইন মনোযোগ বাড়ায়:
ক্যাফেইনেটেড কফি পান করার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে এটা কোনো কাজে ফোকাস করতে সাহায্য করে। এটা কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, ক্যাফেইনের একটি মানসিক প্রভাবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফোকাসিং এবিলিটি বাড়ানো।
গবেষণায় দেখা গেছে, কমার্শিয়াল ড্রাইভার যারা লং ডিস্টেন্স গাড়ি ড্রাইভ করে, তারা যদি কফি, চা, বড়ি, এনার্জি ড্রিংকস বা অন্য কোনো উপায়ে ক্যাফেইন পান করে তাহলে এক্সিডেন্ট করার সম্ভাবনা কম থাকে।
নিয়মিত কফিপান দীর্ঘস্থায়ী জীবনের সাথে সম্পর্কিত:
দুটি সাম্প্রতিক বড় গবেষণায় দেখা যায় যে, যারা অনেক বেশি কফি পান করে, তাদের আর্লি ডেথ কম হয়।
গবেষকরা যারা সহস্র মানুষের ডায়েট এবং স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করেছেন, বলেছেন যে, যারা খুব বেশি কফি পান করে, তারা হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস ইত্যাদী কারণে কম মারা যায়।
ক্যাফেইন কিছু সসময়ের জন্য ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে পারে:
এক কাপ কফি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে। কিন্তু, এরকম কোনো প্রমাণ নেই যে, নিয়মিত কফি পানের অভ্যাস ওজন কমানোয় সাহায্য করবে।
এ বিষয়ে অনেক স্টাডি হয়েছে, তবে বাস্তবিক প্রমাণের অভাবে এগুলো গ্রহণযোগ্য হয়নি।
কিছু গবেষক মনে করেন যে,ক্যাফেইনের অনুভুত বেনিফিট গুলো আসলে কোনো উপকারই নয়। ক্যাফেইনের সকল ইতিবাচক প্রভাব যেমন- স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি ইত্যাদী ক্যাফেইন ডোজের ফল যা টেম্পোরারিলি আমাদের দেহে একটি প্রভাব বিস্তার করে। তবে, যারা অতিমাত্রায় কফি আসক্ত, তারা যদি হঠাৎ করে কফিপান বন্ধ করে দেয়, তাহলে তারা ক্লান্ত বোধ করে এবং অমনোযোগী হয়ে উঠে। যখন তারা আবার পান করা শুরু করে, তাদের পারফরমেন্স আবার বৃদ্ধি পায় কারণ, তাদের ব্রেইন এবং বডি ক্যাফেইনের প্রতি ইতোমধ্যে আসক্ত হয়ে উঠেছে।
(বিদেশী জার্নাল থেকে অনুদিত)