তখন ২০১৫ সাল, মাত্র বউ নিয়ে ডেনমার্কে এসেছি পিএইচডি করতে। পিএইচডি করে যে দেশ ও জাতির খুব উন্নয়ন করব সেরকম কোন খায়েশ ছিল না! মূলত উন্নত জীবন-যাপন এবং বিদেশী দিনার দিয়ে পকেট ভারি করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল । ইউনিভার্সিটি থেকে তিন মাসের জন্য একটি বাসা দিয়েছে, নিয়ম অনুসারে তিন মাস পার হলে খোজ দ্যা সার্চ করে নিজের বাসা খুঁজে নিতে হবে। ডেনমার্কে বাসা পাওয়া যুদ্ধ জয় করার সামিল, সেই গল্প আরেকদিন বলা যাবে।
ডেনমার্কে এসেই ওয়ারকিং-ডেতে অফিসে গিয়ে প্রফেসরের সাথে মোলাকাত করলাম। ভদ্রলোক উচা-লম্বা, শক্ত-পোক্ত চেহারার তবে দেখতে কাঠ বডি। স্বভাব অনেকটা রাফ এন্ড টার্ফ টাইপের। তিনি অফিসিয়াল কাজ যেমন, আইডি কার্ড, ইনস্যুরেন্স ইত্যাদি শেষ করে আস্তে-ধীরে আসল কাজে মনোযোগ দিতে বললেন।
আমাদের তখন প্রথম সন্তান হবে তার উপর নতুন একটি দেশে এসেছি তাই আনন্দ এবং উচ্ছ্বাসে দিনগুলি কাটছিল। তবে পোড়া কপাল আমার, পিএইচডির শুরুতেই একটি ধাক্কা খেলাম। আমার পিএইচডি সুপারভাইজার ভদ্রলোক আমাকে যেই প্রজেক্টে এনেছিল সেই প্রজেক্টটি আস্তে-আস্তে পরিবর্তন হয়ে গেল। পিএইচডির তিন মাসেই সুপারভাইজার আমাকে জানিয়ে দিল ‘তোমাকে যেই প্রজেক্টে আনা হয়েছে সেটা কিছুটা পরিবর্তন হয়ে গেছে তবে সমস্যা নেই, তুমি নতুন প্রজেক্টে মানিয়ে নিতে পারবে’।
সময় ভালই চলছিল, সপ্তাহ দুয়েক পর হঠাৎ সুপারভাইজার আমাকে জানিয়ে দিল, ‘ইয়ে মানে প্রজেক্ট এখন পুরাই পরিবর্তন হয়েছে, তোমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে ঠিক যায় না, তুমি তোমার রাস্তা দেখতে পার!’ কথাটা শুনার পর বাংলা সিনেমার মত আমার মাথায় যেন বজ্রপাত পরল, বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল আকাশে-বাতাসে সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডে সিনেমার করুন বেহালার সুর বেজে উঠল । নিজেকে কোন মত সামলে আমি তাকে বললাম ‘প্রজেক্ট পরিবর্তন হলেও আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারব, দরকার পরে আরও বেশী পড়াশুনা করে নিজেকে এই প্রজেক্টের সাথে মানিয়ে নিব’। তিনি নাছোড় বান্ধা, আমাকে আর তার গ্রুপে রাখবেন না, তিনি হয়ত ভাবছেন একে নতুন করে সময় দেবার চেয়ে আমি দূত সময়ে এই বিষয়ে এক্সপার্ট আরেকজনকে নিয়ে আসব! আমি অনেক অনুনয় বিনয় করে তাকে বললাম ‘আমাকে এক সপ্তাহর সময় দাও পড়ার তারপর আমার পরীক্ষা নিও, যদি না পারি তাহলে আমি হাসি মুখে চলে যাব’!
দেশে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি, পিছে ফিরে যাবার আর পথ খোলা নেই। দেশে নতুন চাকরি একটা জোগাড় করা অনেক সময় সাপেক্ষ তার উপর আমাদের প্রথম সন্তান হবে, এই মুহূত্যে চাকরি হারা হয়ে বেকার থাকা যাবে না। তার উপর ব্যাংকে মাল পানি নাই, এমনিতেই দেশে ব্যাংক লোণ নিয়ে বাড়ি করেছি, এমতাবস্থায় বেকার হয়ে চিত হয়ে বিছানায় পরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নহে! এক সপ্তাহ কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশুনা করলাম। তারপর সুপারভাইজারের রুমে পরীক্ষা দিতে গেলাম, গিয়ে দেখি তিনি পিএইচডি স্কুলের প্রধানকেও ডেকেছেন। তিনি আমাকে আর রাখবেন না এটা মনস্থির করে ফেলেছেন, এই পরীক্ষা যে শুধু আমাকে সান্ত্বনা দেয়া সেটা ভালভাবেই বুঝে গেলাম। তারপরও লাইভ পরীক্ষা দিলাম, তিনি যেই যেই বিষয়ের উপর পড়তে বলেছিলেন তার সবই ভালভাবে পড়ে এসেছিলাম। অনেকক্ষণ আমার ভাইবা নিলেন, সাথে কিছু অংক করতে দিলেন হোয়াইট বোর্ডে। সবকিছুই পারলাম, কিন্তু তিনি এক পর্যায় বিষয়বহির্ভূত প্রশ্নও করাও শুরু করলেন, তিনি মনে মনে হয়ত বলছেন ‘বাছাধন তোমাকে দরকার পরে ছাই দিয়ে ধরব আজকে’! পরীক্ষা শেষে বললেন কাল সকালে এস।
পরের দিন সকালে তার অফিসে গেলাম। তিনি আমাকে তার রুমে ডেকে পাঠালেন এবং জোর করেই রেজিগ্নেশোনে সাইন করিয়ে নিলেন। তখন আমার মনের অবস্থা কি হয়েছিল তা বলে বুঝানো যাবে না! যেহেতু আমার আর ফিরে যাবার উপায় নেই দেশে তাই বউয়ের রিটার্ন টিকিট করে ফেললাম। আমার উদ্দেশ্য আমি নিজে যেভাবেই হোক এখানে থেকে যাব, কোন না কোন ব্যবস্থা হবেই! পরের স্টেপ কি করা যায় ভাবতে লাগলাম।
পরের দিন ইউনিভার্সিটি থেকে এক ইমেইল পেলাম, যারা চাকরি ছেড়ে দেয় তাদের মেইল করে জানতে চায় কেন ছেড়েছে? আমি সুযোগ পেয়ে জানিয়ে দিলাম ‘আমার জোর করে রেসিগ্নেশন নেয়া হয়েছে।‘ যেই ভদ্রলোক মেইল দিয়েছিল তিনি তার অফিসে ডাকলেন। আমি গিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। তিনি আমাকে বললেন ‘তুমি চিন্তা করনা, তোমার কোন দোষ নাই, আমি তোমার হয়ে লড়ব, আমাকে তুমি তোমার উকিল ভাবতে পার, লিগ্যাল ব্যাপারগুলো আমি দেখি’। ভদ্রলোক অমায়িক এক মানুষ, আমাকে যেন খাদের কিনার থেকে টেনে তুললেন, একটু একটু আশার আলো দেখতে পেলাম। তিনি নিজেও একজন প্রফেসর ডিপার্টমেন্টের। তিনি পুরো ইউনিভার্সিটির অথরিটিকে ব্যাপারটা জানালেন। আমাকে তিনি বললেন ‘তোমার সাথে তোমার সুপারভাইজারের এই পর্যন্ত যত মেইল চালাচালি হয়েছে, সমস্ত কিছুর রেকর্ড নিয়ে আসবে। পুরো ইউনিভার্সিটির সামনে কি কি ঘটছে, খুলে বলবে। প্রজেক্ট পরিবর্তন হলেতো আর তোমার দোষ নেই! তোমাকে তাহলে প্রজেক্ট কনফার্ম না করে এনেছে কেন’!
আমি তাই করলাম, প্রজেক্টটা প্রথমে কি ছিল এবং পরে কিভাবে পরিবর্তন হয়েছিল সবকিছুর প্রমাণ হিসেবে আগের মেইলগুলো নিয়ে একটি পিডিএফ তৈরি করলাম এবং সেটা প্রিন্ট করে নিলাম। তারপর ইউনিভার্সিটির অথরিটিদের ইমেইল করে পিডিএফটা পাঠিয়ে দিলাম। ব্যাপারটা পুরো ইউনিভার্সিটিতে ছড়িয়ে পরল, তারা আমাকে এবং সবাইকে নিয়ে একটি মিটিং কল করলেন। আমি মিটিং-এ গিয়ে যা বলব সব কিছু লিখে ফেললাম এবং আমাকে পরীক্ষার নামে-যে বিষয়বহিভূত প্রশ্নও করা হয়েছিল সেগুলোও লিখে ফেললাম এবং বাসায় প্যাক্টিস করলাম কিভাবে বলব ।
মিটিং এর দিন আমি আর আমার সেই দয়ালু প্রফেসর মিটিং-এ গেলাম, আমার পিএইচডি সুপারভাইজারও এসেছে। উদ্বোধনী ভাষণে আমি পুরো ঘটনা তুলে ধরলাম। আমার সুপারভাইজার এবার কিছুটা নমনীয় হয়ে বক্তব্য রাখল এবং আত্মপক্ষ সমর্থন করল। সত্যি বলতে তার উপর কোন বিদ্বেষ বা অনুযোগ নেই আমার, তবে তিনি জোর করে যে রেসিগ্নেশোন সাইন করিয়েছিলেন সেটার উপর সামান্য ক্ষোভ ছিল! এখন অবশ্য সেই ক্ষোভটুকুও নেই! ইউনিভার্সিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে আমাকে বলল ‘তুমি কি পিএইচডি করতে চাও? তুমি চাইলে তোমাকে এর বদলে মাল পানি বা কোন চাকরি দিয়েও সাহায্য করতে পারি!’ আমি দাঁড়িয়ে দ্যার্থহীন ভাসায় বললাম ‘আমি পিএইচডি করতে এসেছি, আমি এখান থেকে পিএইচডি করেই দেশে ফিরতে চাই। অন্য কোন কিছুর আমার দরকার নেই’।
সিদ্ধান্ত অনুসারে আমাকে পিএইচডি শেষ করতে মূল সময়ের সাথে আরও ৬-৯ মাসের এক্সটা ফান্ড দেয়া হল যেহেতু প্রজেক্টটা আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে যায় না। আমি ডিপার্টমেন্টের হেডকে বললাম ‘আমাকে অন্য কোন গ্রুপে দিন, এখানে আমি থাকতে চাইনা কারন আমার সুপারভাইজার আমার উপরযে কোন প্রতিশোষ নিবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই’! হেড বললেন, ‘একটি পজিশন ওপেন আছে যেটা তোমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে যায়! তবে আমরা তোমাকে সরাসরি কোন গ্রুপে দিতে পারব না কিন্তু তুমি এপ্লাই করতে পার। আবার ইন্টার্ভিউ দিয়ে যদি চান্স পাও তাহলে আমাদের কোন আপত্তি নেই! তবে নতুন পজিশন পাবার আগ পর্যন্ত তুমি এখানেই কন্টিনিউ কর।‘ আমি নতুন গ্রুপে এপ্লাই করলাম এবং ইন্টার্ভিউ-এর জন্য ডাক পেলাম। বলে রাখা ভাল ডেনমার্কে পিএইচডিতে প্রাথমিক সিলেকশনে ডাক পাওয়াও অনেক কঠিন ব্যাপার। প্রথম যখন আমি এপ্লাই করেছিলাম ডেনমার্কে আসার জন্য, পজিশনটার জন্য প্রায় ৫১ এপ্লাই করেছিল সেখান থেকে চান্স পেয়েছিলাম। যাইহোক আবারো ইন্টার্ভিউ দিলাম। নতুন প্রফেসর জানালো আরও অনেকেরই ইন্টার্ভিউ সে নিচ্ছে, পরে আমাকে জানাবে। দু-সপ্তাহ পর জানতে পেলাম নতুন গ্রুপে আমার পিএইচডি পজিশনটা হয়ে গেছে।
আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। নতুন গ্রুপে এক বছর সফলতার সাথে পার করলাম, নিয়ম অনুসারে ওয়ান-ইয়ার ইন্টার্ভিউতে আবার পিএইচডির স্কুলের প্রধানের সাথে দেখা হল। তিনি আমার প্রগ্রেস দেখে বললেন ‘তোমার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব এবং লেগে থাকার মানসিকতা দেখে আমি অবাক, তুমি সফল হবে। ভদ্রলোক অনেক খুশী হলেন’।
গত বছর নভেম্বরে সফলতার সাথে পিএইচডি শেষ করলাম। একটি জার্নি, একটি যুদ্ধ শেষ করলাম। এক দিকে তৃপ্তির ঢেকুর গিলছি অন্যদিকে আবার জব হারা হলাম! খুশী হওয়া উচিৎ নাকি দুখী হওয়া উচিৎ ঠিক বুঝতে পারলাম না! এ এক মিশ্র অনুভূতি! ডিফেন্স দেবার আগ থেকেই আবারোই খোজ দ্যা সার্চ শুরু করলাম। গত বছর নভেম্বরে পিএইচডি ডিফেন্স দিলাম এবং তার পরের সপ্তাহেই দেশে চলে গেলাম। যখন দেশে আসি তখনও জানি না নতুন আবার কথায় যাব! কোন চাকরি বাকরির ঠিক হয়নি তখনো। তবে মনে বিশ্বাস ছিল, রাখে আল্লায় মারে কে, যা দিবার আমারে দে! একটানা একটা ব্যবস্থা হবেই।
দেশে যাবার এক সপ্তাহ পরে আমেরিকাতে থেকে পোস্টডক্টরাল রিসার্চার পজিশোনে ডাক পেলাম। দেশের এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতেও অবশ্য এসিস্টটেন্ট প্রফেসর হিসেবে অফার ছিল। যাইহোক সব কাগজপত্র ঠিক করতে করতে এ মাসে চলে এলাম আমেরিকায়। নতুন এই পজিশনে হয়ত অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, আবার হয়ত মুখ থুবরে পরব তবে এগুলো আর আমাকে ভাবায় না! এখনকার এই সময় সময়-গুলো উপভোগ করতে চাই।
গত বছরটা নতুন চাকরি খোজা, পিএইচডির শেষের পেপার, জার্নালের কাজ, থিসিস লেখা এবং ডিফেন্স ইত্যাদি নিয়েই কেটে গিয়েছে। পুরো বছরটাই গিয়েছে এক রকম অনিশ্চয়তায়, সত্যি বলতে মন ছিল অশান্ত তাই ব্লগে সময় দিতে পারিনি, এখন থেকে আবার ব্লগে নিয়মিত হব।
সবার দোয়া প্রার্থী।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ভোর ৫:৪৩