ক্রিমিনাল সাইকোলজিতে একটি কথা রয়েছে। কোন একজন খুনী যখন কোন খুন করে, তখন সে খুন করার পর সারা জীবনের জন্যে সে খুন করার স্থান থেকে হারিয়ে যায় না। বাকী জীবনের সবগুলো দিনের একটি দিনের জন্যে হলেও সে খুন করার স্থানটিতে ফিরে আসে.... এ ফিরে আসার পেছনে তেমন কোন উপলক্ষ নেই... তারা সে স্থানে ফেরে শুধুমাত্র নস্টালজিক হবার জন্যে...
আজ থেকে প্রায় সাড়ে ৫ বছর আগের কথা। কুড়িল বিশ্বরোডের ফ্লাইওভারটি তখনও সচল হয়নি। নির্মানাধীন অবস্থায় রয়েছে। দিনের আলোতে অনেকেই সেখানে আড্ডা দিতে উঠলেও রাত ৯ টার পর থেকেই সেখানে লোকসংখ্যা কমে যেত। কোন এক রাতে ঠিক এমনই একটা সময়ে সে ফ্লাইওভারের রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসেছিলাম। কিছুক্ষণ পরপর নির্মানাধীন ফ্লাইওভারটির নিচ দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে তীব্র আলো নিয়ে। যখনই একটি ট্রেন আসতে দেখা যাচ্ছিলো, ট্রেনের সামনের আলোটা ততবার চোখের উপড় চোখ ধাধিয়ে যাবার মত করে পড়ছিল। আর প্রতিবারই মনে হচ্ছিলো "এই ট্রেনের আলোটাই হয়তো আমার জীবনের দেখা শেষ আলো"।
সুইসাইডটা শেষমেষ সেদিন আর করা হয়ে ওঠেনি। বাসায় ফিরে সেদিন অন্য আর দশটা দিনের মতই স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছি। পরিবারের একটা সদস্য সেদিন ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি, যে সেদিন আমার বাসায় ফিরে ভাত খেয়ে ঘুমুনোর কথা ছিল না... একটা দূর্ঘটনা ঘটানোর কথা ছিল...
শেষমেষ এই দূর্ঘটনাটি ঘটানো থেকে ফিরে আসাটি সাহসের অভাবের জন্যে যে হয়েছে তা নয়। একটি বেশ সাদামাটা বাক্য আমাকে বেশ শক্তভাবেই সেখান থেকে ফিরিয়ে এনেছে। ভাবনায় আসা সে বাক্যটি হচ্ছে "বাকী জীবনে এমন কোন না কোন দিন আমার জীবনে আসবে, যেদিন আমি আজকের দিনের করতে চাওয়া বোকামীর জন্য হাসবো"।
গতকাল তিনজন স্টুডেন্টকে হোটেল রেডিসনের সামনে বাসে চাপা দিয়ে পিষে মেরে ফেলা হয়েছে। আজকে মিরপুর থেকে শুরু করে টঙ্গী রোডের গাড়ি চলাচল দুপুর থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরোপুরি বন্ধ ছিল। গতদিন কয়েকজন ছাত্রকে বাস চাপা দিয়ে পিষে মারার ক্ষোভে স্কুল ছাত্ররা মিলে
বলতে গেলে পুরো ঢাকা শহরকে আজ স্থবির করে দিয়েছে। বিকেলের দিকে অফিস ছুটির পর বের হবার পর রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িগুলোর অবস্থা দেখে বুঝতে সমস্যা হলো না যে আজ হেটে বাড়ি ফেরা ছাড়া গতি নেই।
তাই হেটে রওনা দিয়েছি। বাসের ভেঙ্গে যাওয়া কাঁচের টুকরোয় ছড়ানো রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে একটা সময়ে সেই কুড়িল ফ্লাইওভারের উপড় চলে এলাম। আরো কিছুদূর আগানোর পর ফ্লাইওভারের রেলিং এর সেই অংশটা চোখে পড়লো, যেখানে আর থেকে প্রায় সাড়ে ৫ বছর আগে বসেছিলাম...
আজকের সেই সময়টা সেই সাড়ে ৫ বছর আগের রাতের মত নির্জন ছিল না।সে জায়গা আজ বাস প্রাইভেটকার আর মানুষের ভীড়ে প্রচন্ড পরিমানে ব্যস্ত। এরকম সীমাহিন বিরক্তিকর পরিস্থিতির মাঝেও প্রায় মিনিট দশেকের মত আমি রেলিংটার কাছে দাঁড়িয়ে থেকেছি।
রেলিং এর পাশে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে,দূর থেকে ট্রেন আসছে....
ক্রিমিনাল সাইকোলজির সে বাক্যটিতে হয়তো কিছুটা সংযোজন করা উচিৎ। শুধু অন্যকে খুন করা মানুষগুলোই শুধু নয়, নিজেকে খুন করতে চাওয়া মানুষগুলোও কখনো কখনো নস্টালজিক হতে খুন করার সেই স্থানটিতে জীবনের কোননা কোন সময়ে চলে আসে...
কখনো সেটি নিজ ইচ্ছায়... আবার কখনও বা ভাগ্যের ফেরে...
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ১০:২৭