হোয়াট'স গোয়িং অন ইয়র কান্ট্রি?
আগের রাতে ওভারটাইম কাজ করে বাসায় যখন ফিরি তখন রাত আড়াইটা। ঘুমুতে ঘুমুতে সাড়ে তিনটা। তাই সকালে আবার কাজে যেতে খুব আলসেমী লাগছিলো। তবুও যেতে হবে। নয়টা বাজার তিন মিনিট পূর্বে লগ ইন করতে পেরে বেশ খুশীই লাগছিলো। লগ ইন করে স্টাফ রুমের দরজায় পা রেখে গুড মর্নিং বলার সাথে সাথে দেখি সবার হাতে মেট্রো পত্রিকা এবং একসাথে সবাই আমাকে জিঞ্জেস করলো, ''হোয়াট'স গোয়িং অন ইয়র কান্ট্রি''??
তোমারা কি অসভ্য জাতি?
লন্ডন মেট্রো London metro নামে একটি পত্রিকা প্রতিদিন সকালে লন্ডনের রাস্তায় ও টিউব স্টেশনের সামনে বিনামূল্যে বিতরন করা হয়। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই পত্রিকাটি সকাল বেলা টিউব ও বাসের প্রায় সকল যাত্রীর হাতে হাতে থাকে, কাজে যেতে যেতে নজর বুলিয়ে নেন তারা। উয়িন্ডি সেই পত্রিকার একটা পাতা বের করে আমাকে দেখিয়ে বললো, তোমরা কি সভ্য জাতি?? মানুষ কখনো এমন একটা নিষ্পাপ শিশুকে এমন নির্দয় ভাবে মারতে পারে? পাশে বসা রুটা সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলছে ব্রুটাস!! গোসা, আরভিন, আলমা, শ্যারন বেনজামিন, ডেক্সটার সবাই জিঞ্জেস করছে তোমাদের দেশের সরকার এমন কেনো?? পুলিশ নির্দয় ভাবে একটা শিশুকে পেটাচ্ছে এ দৃশ্য পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে ঘটতে পারেনা। তোমাদের দেশে কি মানবতাবোধ টুকুও নেই? এসব পুলিশ কি জানেনা কি ভাবে একটা শিশুর (অপরাধী হলেও) সঙ্গে আচরন করতে হয়। আমি তাকিয়ে আছি ছবিটার দিকে। একটা ১০/১২ বছরের শিশু কি অশায় আতংকগ্রস্থ তার চাহনী। তবুও নির্দয় পুলিশ তাকে বেদম প্রহার করছে। এভাবেই পুলিশ বাংলাদেশের পোষাক শিল্পের অস্থিরতা দূর করার জন্য মাঠে নেমেছে। আমি কি বলবো বা বলা উচিত? নিরুত্তর বসে বসে ভাবছি আর নিউজটা পড়ে শেষ করলাম। নিউজটা এরকম তারা মাসিক ১৫ পাউন্ড বেতন পায়, সে বেতন বাড়ানোর জন্য তারা আন্দোলন করছে। আর এমন অমানবিক(!), অসাংবিধানিক(!), মানবতাবিরোধী(!), ধর্ম বিরোধী(!) কর্মকান্ডের জন্য পুলিশ তাদের উপর চড়াও হয়েছে। সেসব সৎ(!), সুযোগ্য(!), দ্বায়িত্বশীল(!) মহান (!) পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেনা ইনোসেন্ট শিশুরাও। চিন্তা করেন কোথায় জন্ম আমাদের, কোথায় বসবাস আমাদের!!
ইয়াসেক বিশ্বাস করো বন্ধু
ইয়াসেক পোলিশ বংশদ্ভুত এক বন্ধু, কলিগ। বাংলাদেশের ভালো মন্দ জানতে চায়, বাংলাদেশের কৃষ্টি, কালচার বুঝতে চায়। আমার মনে হয়েছে ইয়াসেক শুধু আমারই বন্ধু নয়, সে বাংলাদেশেরও বন্ধু। ইয়াসেক সকাল আটটায় কাজ শুরু করে একটি আউটডোর কলে গিয়েছিলো। ১২টার দিকে ফিরেই সোজা আমার রুমে হাতে মেট্রো'র সেই পাতা, আমাকে ছবিটা দেখিয়ে বললো ''ডোন্ট ইউ পিপল হেভ হিউম্যানিটি''?? আমি কিভাবে ইয়াসেক কে বলি উই হেভ?
মনটা খারাপ থেকে খারাপতর হতে লাগলো। কাজে মনযোগ দেয়ার চেস্টা করছি। কিন্তু মাথার মধ্যে বিভিন্ন কালচার, বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন মানুষের আমর দেশকে নিয়ে করা প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্চে। কাজ শেষে ইয়াসেক, বেনজামিন, মারেক ও আমি একটা মোড়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। বাংলাদেশ নিয়ে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে হিটলারের উদাহরন দিয়ে বললো, ''তোমাদের জন্য এডলফ খুব সাধারন একজন ব্যাক্তি বা ঘটনা মনে হতে পারে, কিন্তু একজন পোলিশ এর কাছে সে এক ভয়ংকর নির্যাতনের ইতিহাস''। সে জানালো এখনো প্রত্যেক পোলিশ মানুষেরা এডলফকে ইভেন জার্মান জাতিকে ঘৃনা করে। আজ তোমাদের দেশের পুলিশি নির্যাতন দেখে আমাদের দেশের বহু কথা মনে পড়ছে।(মেট্রো এক শিরোনামের ভেতর একসংগে দুটি খবর দিয়ে ছিলো, একটা গার্মেন্টস নিয়ে আরেকটা বাংলাদেশের প্রধান ইসলামিক দলের তিন নেতা গ্রেফতার বিষয়ক )। আমি তখন ভাবছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার ফিল্ডওয়ার্ক (ইন্টার্ন) ছিলো অপরাজেয় বাংলাদেশ নামে একটি পথশিশু বিষয়ক এনজিও'তে। আমার মনে পড়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন থানায় আমরা যেতাম। শিশু ও কিশোর অপরাধীদের সাথে পুলিশ আচরন কেমন হওয়া উচিত এ ব্যাপারে বিভিন্ন লিফলেট, পোস্টার বিলি করতাম থানায় থানায়। ঢাকা শহরের প্রত্যেক থানার সদর দরজার পাশে একটি পোষ্টার বাঁধিয়ে সাটানো আছে যে একজন শিশু বা কিশোরের সাথে পুলিশের কেমন আচরন করতে হবে। আজ মনে হচ্ছে এগুলো আসলে কি পন্ডশ্রম ছিলো? আজ বিদেশে কেনো আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বলতে পারছিনা, আমরা বাংলাদেশী? বলতে পারছিনা ইয়াসেক বিশ্বাস করো বন্ধু, আমরা অসভ্য জাতি নই।
শেখ মুজিব ভক্ত মাইকেল
মাইকেল আমার প্রতিবেশী। মাইকেল জানে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের প্রসব বেদনা কতটা কষ্টের ছিলো। মাইকেল বংগবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের একনিষ্ট ভক্ত। তার বিশ্বাস বংগবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মই হতোনা। মাইকেল তার পরিচিত বাংলাদেশীদের শেখ মুজিব নামেই ডাকতে পছন্দ করে। এটা শেখ মুজিবের প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশ বলে মনে করি। বাসার পার্শ্ববর্তী একটি রেস্টুরেন্টের নিয়মিত কাস্টমার সে। সেখানে আমিও যাই মাঝে মাঝে কিছু সুখ দুঃখের আলাপ করি। কাজে থাকার সময় থেকেই আজ মনটা খারাপ, তাই একটু গল্প করার জন্য রেস্টুরেন্টে গল্প করছি। তাছাড়া নিজামী, মুজাহিদ, সাইদী গ্রেফতার এমন একটা টপ নিউজ নিয়ে কথা বলতেও ইচ্ছা হচ্ছিলো। এমন সময় মাইকেলের প্রবেশ। না সে কোন কিছু খেতে আসেনি। এসেছে হাতে মেট্রো নিয়ে। এসেই হাঁক ছাড়লো, হ্যালো শেখ মুজিব, তোমাদের দেশে এসব কি হচ্ছে?? তোমরা ইনোসেন্ট শিশুদের মারছো?? ইসলামিক দলের নেতারদের গ্রেফতার করছো ইসলাম অবমাননার জন্য?? হায় শেখ মুজিব, তোমরা কি ফ্যাসিস্ট হয়ে গেলে?? রেস্টুরেন্টের মালিক আওয়ামী পন্থী হওয়ায় তার কাছে পত্রিকাটা দেয়ার অনুরুধ জানালো একজনকে। এবং তার প্রশ্নটাও পৌছাতে অনুরোধ করলো। মাইকেল বিশ্বাস করে আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের একতি গনতান্ত্রিক এবং প্রোগ্রেসিভ রাজনৈতিক দল। শেখ মুজিব পৃথিবীর অন্যতম সেরা একজন নেতা। আমাকে সে তিরস্কার করে বলতো, শেখের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা আরো বেশী হওয়া উচিত, যেহেতু তুমি পড়াশুনা করো। সেই মাইকেল। আমি আর কি বলবো, সে মাইকেলরাই আমাদের বলতেছে ফ্যাসিস্ট! আজ মাইকেলরাই আমাদের বলতেছে মানবতাবিরোধী!
সভ্যতার মাপকাটি
আজ ইসরেল কতৃক ফিলিস্তিনের শিশু হত্যা হলে, মুক্তিকামী মানুষকে নির্যাতন করলে আমরা বলি ইসরেল একটা অসভ্য জাতির দেশ। আজ আফগানিস্তান, ইরাকের শিশু হত্যা হলে বলি কি বর্বোরোচিত আচরন, ব্রিটিশ আমেরিকার সৈন্যদের বলি অসভ্য। পাকিস্তানে একের পর এক বোমা হামলা হলে অসভ্য বর্বরদের দেশ। রাস্ট্রীয় মদদে গোজরাটে মুসলিম গনহত্যা হলে ভারতীয়দের সভ্যতার খোলশ বেরিয়ে পরে আর আমরা তাদের গালি দিয়ে বলি অসভ্য। আর নিজের দেশের আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহীনী কতৃক নারী শিশুর উপর নির্যাতন দেখে এবং ভিন্নমত দমনের লক্ষ্যে বিরোধী দলের প্রধান সহযোগী আরেক বিরোধী দলের তিন নেতাকে ন্যাক্কারজনক গ্রেফতার দেখে আমাদেরকে অন্যদেশের মানুষেরা বলছে, অসভ্য, বর্বর, মানবতাবিরোধী, ফ্যাসিস্ট। এডলফ হিটলারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সরকারের এমন আচরনে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছিনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আমাকে শুনতে পাচ্ছেন কি???
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:০৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





