All the Prime Minister's Men নামের প্রতিবেদনটিকে প্রত্যাখ্যান করে আল-জাজিরার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়ার কথা ভাবছে বাংলাদেশ সরকার। ভেরি ওয়েল। মিথ্যার পরাজয় এবং সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। প্রতিবেদনে যা কিছু দেখিয়েছে এবং বলেছে তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে যদি দেশের জন্য মানহানিকর কিছু থাকে তবে অবশ্যই আইনের পথে হাঁটবে সরকার। আমরাও অপেক্ষায় থাকব সমুদ্র জয়ের পর মরুভূমি জয় উদযাপন করার জন্য। ইন শা আল্লাহ।
হয়তো আন্তর্জাতিক কোনও আদালতে অভিযোগ দায়ের হবে। আন্তর্জাতিক কোনও আইনি প্রতিষ্ঠান কেইস লড়বে। তার বিরাট লটবহর থাকবে। সরকারেরও নিজস্ব জনবল নিয়োজিত থাকবে। কম করে হলেও ৫-১০ কোটি টাকা চোখের নিমিষেই খরচ হয়ে যাবে বিচারের ফলাফল জানার আগেই। কতদিন ধরে চলবে লড়াই কেউ জানে না; অর্থ, আরো খরচ। রায় যদি সরকারের বিপক্ষে যায় আমরা তা জানতে পারবো না ঠিক একই কারণে, যে কারণে সংবাদমাধ্যম All the Prime Minister's Men সম্পর্কে টু শব্দটিও করতে পারছে না গ্যা গো করা ছাড়া।
এই টাকাটা আসবে কোথা থেকে? সরকার তো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান না। সে কোথা থেকে খরচের টাকা পায়? ফ্রি ভ্যাকসিনের যে কথা হচ্ছে তা আসলেই কি ফ্রি?
সরকারের অধিকাংশ আয়ের উৎস বিভিন্ন প্রকার ট্যাক্স, যেমন, ব্যক্তিগত আয়ের উপর কর, কর্পোরেট কর, রেভনিউ, বন্ড, আমদানি-রপ্তানি কর, ভ্যাট, সুরা, সাকি ইত্যাদি। এর পাশাপাশি বৈদেশিক ও দেশীয় উৎস থেকেও সরকার ঋণ নিয়ে থাকে। এই ঋণের বোঝা আপনাকেও টানতে হয়। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২০২০ এর তথ্য অনুযায়ী দেশের প্রতিটি মানুষের মাথাপিছু ঋণের বোঝা ৭৯ হাজার টাকা।
এর মানে দাঁড়ালো, আপনার, আমার ট্যাক্সের ১০ কোটি টাকা (নূন্যতম) আমাদের অনুমতি না নিয়েই আইনি লড়াইয়ের নামে জলে ঢেলে দিল সরকার। এতে আমাদের ঋণের বোঝাটাই স্ফীত হলো শুধু।
আল-জাজিরার All the Prime Minister's Men প্রতিবেদনে ঘটনা প্রবাহের যে বর্ননা দেয়া হয়েছে এর তিনটি ভাগ আছে। প্রথম ভাগে আছে তথ্য বা ইনফরমেশন। দ্বিতীয় ভাগে ডিসপ্লেইড(displayed) ডক্যুমেন্টস অ্যায প্রুফ(as proof), তৃতীয় ভাগে স্টিং অপারেশনের মাধ্যমে তথ্য ও proof এর সমন্বয় করা হয়েছে। মিডিয়া বায়াস(bias) সম্পর্কে যতটা জ্ঞান রাখি এতে All the Prime Minister's Men একটি পুর্নাঙ্গ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য বলে মনে করি। সত্য না মিথ্যা, তদন্তের বিষয়।
এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে হলে আল-জাজিরার তথ্য, ডক্যুমেন্টস, ও স্টিং অপারেশনে কৃত অভিযোগ সমূহ মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে হবে। যে প্রশ্নগুলো আল-জাজিরা ইথারে ছুঁড়ে দিয়েছে সেগুলোকে গওহর রিজভী বা সালমান রহমানের কৌশলে কুপোকাত করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সত্যটা কী, তা প্রমানের দ্বায়িত্ব এখন সরকারের। 'অপপ্রচার', 'চক্রান্ত', 'বানোয়াট', 'কুচক্রী মহল', 'কুৎসা রটনা', 'মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি' - এই শব্দবাজিতে সত্য প্রমানিত হবে না।
অ্যামেরিকার সিএনএন, ইংল্যান্ডের বিবিসি কে টেক্কা দিয়ে প্রথম সারির ইংরেজি নিউজ এজেন্সি হিসেবে সারা বিশ্বে কাতারের আল-জাজিরা সমাদৃত এবং প্রশংসিত। খুব অল্প সময়ে সংস্থাটি বিশ্বের গণমাধ্যমের আস্থা অর্জন করেছে মুসলিম বিশ্বের মিডিয়া বাতিঘর হয়ে। আল-জাজিরার রিপোর্টের পর সরকারের পতন হয়েছে, সুবিচার প্রাপ্তি ঘটেছে, ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এমন ঘটনা প্রচুর।
বাংলাদেশের 'প্রধানমন্ত্রীর লোকেরা' বলছেন যে আল-জাজিরা অনেক দেশে banned. কেন নিষিদ্ধ তা বলছেন না। জানেন না বলেই হয়তো বলতে পারছেন না। ইট'স ওকে। জানার তো শেষ নেই। আল-জাজিরা নিষিদ্ধ তার রিপোর্টের নিচুমানের জন্য না, আল-জাজিরা নিষিদ্ধ কারণ তার রিপোর্টের গভীরতায় অনেক শাসকের গদি নড়ে গিয়েছিল, যার মধ্যে মিশর অন্যতম।
নিজেকে কিছু প্রশ্ন করুন। স্বাভাবিক সাংবাদিকতার বাইরে বাংলাদেশ নিয়ে কাতার বা আল-জাজিরার মাথাব্যাথা থাকবে কেন? আমি যুক্তিসঙ্গত উত্তর পাই না। কাতার তো অ্যামেরিকা না, চায়না না, ক্যানাডাও না? কাতার তো ইন্ডিয়াও না যে আওয়ামি সরকারের পতন হলে আবার নতুন করে সব সেট করতে হবে। বাংলাদেশে তার স্বার্থটা কী? কাতার কোনো আঞ্চলিক শক্তিও না। আবার বাংলাদেশও সিঙ্গাপুর বা তাইওয়ান না। তাহলে কি তারেক রহমান বা নিজামি, গোলাম আজমের প্রেতাত্মারা আল জাজিরাকে ভয় দেখালো? কিনে ফেললো?
এটা কিন্তু বিরাট কাতুকুতু দেয়া কথা হয়ে গেল। রাবিশই না, স্টুপিড ও।
আল-জাজিরার মত একটি বৈশ্বিক নিউজ সার্ভিস তথ্য, ডক্যুমেন্টস, ও স্টিং অপারেশনের সমন্বয় ঘটিয়ে, একটি চক্রান্ত মূলক 'সম্পুর্ণ রঙিন' প্রতিবেদন তৈরি করেছে কোনও কায়েমি স্বার্থে, এমন ভাবনা কেবল রাজনৈতিক স্বমেহনের আনন্দ দিতে পারে। উত্তর দিতে না পারলে ব্যক্তিগত আক্রমণ বা গালাগাল করে বসা কোনো সুস্থ মস্তিকের কাজ না। ভুলে গেলে চলবে না, আল-জাজিরা, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা(বাসস) না।
আল-জাজিরা কি তাহলে পক্ষপাতমূলক রিপোর্ট করে না?
অবশ্যই করে। যে কারো চোখেই এটা ধরা পড়বে। মুসলিমদের প্রতি দূর্বলতা নিয়ে রিপোর্ট করতে দেখি। ইয়েমেনের নির্যাতিত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নিয়ে রিপোর্ট করে। পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবেশের উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর জীবন নিয়ে রিপোর্ট করে। রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমারের অত্যাচার নিয়ে রিপোর্ট করে। ইন্ডিয়া ও শ্রিলংকার ক্রিকেটে 'পিচ ফিক্সিং' নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করতে দেখেছি। এগুলো যদি কারো খারাপ লাগে, স্যরি।
আল-জাজিরার বিরুদ্ধে অভিযোগ মূলত মুসলিম আরব বিশ্বের কিছু দেশের, বিশেষ করে সৌদি আরবের। সৌদির গাত্রদাহ ইরানকে কেন্দ্র করে। এর শুরু ২০১৭ সালে যখন কাতারের আমির তামিম বিন হামাদ ইরানকে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে বিবৃতি দেন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইরান নীতির নিন্দা করেন। ইজরেইল এর বন্ধু, ইরানের শত্রু সৌদি আরবের তা ভালো লাগবে কেন? বাহরাইন এবং আরব আমিরাতের নতুন বন্ধু ইজরেইলের চক্ষুশূল আল-জাজিরা তো ইহুদি নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া সাম্রাজ্যের বুকে একটি শক্তিশালী বজ্রপাত।
সরকারের লোকেরা লড়াই করতে ইচ্ছা পোষণ করে জেহাদি বক্তব্য দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। আমি ভাবছি, সরকারের কি উচিত হবে এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে লড়াই করা?
আফ্রিকান আলকাতরা বালকের গল্পে এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে।
এক বনে এক শেয়াল ছোট্ট এক ডানপিটে খরগোশের দুরন্তপনায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠে তাকে শাস্তি দেবে বলে ঠিক করে। অনেক চিন্তা করে একদিন আলকাতরা/পিচ দিয়ে একটা মানুষ বানিয়ে খরগোশটার চলাচলের পথে রেখে দিল। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুম সেরে খরগোশ মনের আনন্দে বাসা থেকে বের হতেই দেখে একটা বালক কেমন একা রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে ও জিজ্ঞেস করলো, 'Jambo!' কোনো উত্তর নেই। 'জাম্বো'! এবারও উত্তর নেই। 'বেয়াদব'! রেগে গিয়ে খরগোশটি বালকের উপর হামলে পড়লো। 'আমি তোকে জিজ্ঞেস করি আর তুই আমাকে পাত্তা দিস না', বলেই মারলো ডানহাতে অ্যায়সা এক ঘুষি। 'তুই জানিস আমি কে', বলে বাম পা দিয়ে লাথি। 'আজকে তোর একদিন কী আমার দুইদিন', বাম হাতে মারলো এক প্রকান্ড থাপ্পর। 'তুই বোবা নাকি রে', বলে ডানপায়ে কষে লাগালো পেটের মধ্যে। উন্মাদনা কাজ করছে খরগোশের মধ্যে। আরও মারতে হবে কিন্তু মুশকিল হয়ে গেল হাত টেনে বের করা যাচ্ছে না। ডান হাত টানলে বাম হাত ঢুকে যাচ্ছে, এক পা টেনে ধরলে আরেক পা আরও গভীরে চলে যাচ্ছে। ফাইট করা যাচ্ছে না! রাগে ও ভয় পেয়ে ছুটোছুটি করে যতই বের হতে চাচ্ছে আলকাতরাময় হয়ে ততই আরো আটকে যাচ্ছে ওর পুরো শরীর আলকাতরা বালকের গায়ে।
সত্যিটা, সরকারের চাইতে ভালো আর কেউ জানে না।
বিঃদ্রঃ সোয়াহিলি ভাষায় জাম্বো অর্থ হ্যালো।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সকাল ১০:১০