ছবি ১: ট্রেকিং এর সরল রুট ম্যাপ। লাল কালি চিহ্নিত রুটে আমরা ট্রেকিং করেছিলাম।
৬৫ লিটারের একটা ব্যাগ আমার ছিল, কিনলাম হাত মোজা, ৩ জোড়া মোজা আর ছোট ভাইয়ের জ্যাকেট ধার করলাম। পিয়াস দরকারি সব ঔষধ কিনল। সকল টিকেটের ব্যবস্থাও পিয়াস করেছে।
১৬/১০/১৩ & ১৭/১০/১৩
গরু কোপাকুপির পর রাত ১২ টায় গরিব উল্লাহ শাহ মাজারের সামনে থেকে গ্রিন লাইন বাসে করে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করলাম দুই বন্ধু। রাস্তা ফাকা থাকাতে ভোরে ঢাকা পৌঁছে গেলাম। ঢাকা থেকে কাঠমুন্ডুর ফ্লাইট ৩:৫০ এ। সারাদিন ঘুমিয়ে, খাওয়া দাওয়া শেষ করে ৩ টায় এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেলাম। আনুসাঙ্গিক কাজ শেষ করে প্লেন এ উঠলাম, ৪ টায় ছাড়ল ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ এর বিমান। এই প্লেন এর সিটের চেয়ে গ্রিন লাইন বাসের সিট ভাল ছিল। ৫:১০ এ কাঠমুন্ডু ত্রিভুবন এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেলাম। ল্যান্ড করার আগ মুহূর্তে ডানে মাউন্ট এভারেস্ট দেখা গেল। নেপাল এ পোঁছে টুরিস্ট ভিসা পাওয়া যায়। SAARC ভুক্ত দেশের জন্য বছরে ১ বার ফ্রী টুরিস্ট দেয় নেপাল সরকার। অবশ্যই ৫/৬ কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি সাথে রাখবেন। এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি ঠিক করতে গিয়ে দেখি ক্যাচাল। থামেল পর্যন্ত ভাড়া চায় ৬৫০ রুপি। সোজা এয়ারপোর্ট এর একদম বাইরে চলে এলাম, দরাদরি করে ট্যাক্সি পেলাম ৩০০ রুপিতে। থামেলে পৌঁছে Bright Star নামের হোটেলে উঠি। সিঙ্গেল রুমের ভাড়া নিয়েছিল ৮০০ রুপি। বলে রাখা ভাল এয়ারপোর্ট থেকে না পারতে ডলার ভাঙ্গাবেন না। আমরা ৫০ ডলার ভাঙ্গিয়ে ছিলাম। ৯৩ রুপি/ডলার দিয়েছিল। থামেলে পেয়েছিলাম ৯৬/৯৭ রুপি/ ডলার। হোটেল থেকে ম্যানেজার আগামিকাল পোখারা যাবার বাসের টিকেট কেটে দেন। ট্যুরিস্ট বাসে ভাড়া ৬৫০ রুপি/ প্রতিজন।
হোটেল ঠিক করার পর বেরিয়ে পরলাম থামেল দেখতে। মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার ভাঙ্গালাম। সিম কার্ড কিনলাম। ডিনার শেষে দেখা হল আওয়াল এর সাথে, ও গতকাল ট্রেকিং (Langtang valley) থেকে ফিরেছে। ওর গ্রুপের সবার সাথে আড্ডা দিলাম। ফয়সাল ভাই আমাদেরে প্লান শুনে, অন্নপূর্ণা বেইস ক্যাম্প ট্রেকিং করে আসতে বুদ্ধি দেন। উনি নিজের অন্নপূর্ণা বেইস ক্যাম্প ট্রেকিং এর গল্প শুনান আর সহজে কিভাবে ট্রেকিংটা শেষ করা যায় তার টিপস দেন। তো আমরাও আমাদের প্ল্যান পালটিয়ে ফেলি। রুমে ফিরে ABC (Annaprna Base Camp) ট্রেকিং এর কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি।
১৮/১০/১৩
হোটেল থেকে ১০ মিনিট হাঁটার দূরত্ব বাস স্ট্যান্ড। ৭:১৫ এ বাস। ৭ বাজে বাস স্ট্যান্ড পৌঁছে গেলাম। চা আর পিঠা দিয়ে নাস্তা সারলাম। ট্যুরিস্ট বাস গুলোতে ট্যুরিস্ট ছাড়া সচ্ছল নেপালিরা যাতায়াত করে। যথা সময়ে বাস ছাড়ল।
ছবি ২,৩: কাঠমুন্ডু থেকে পোখারা যাবার রাস্তা। ত্রিশূলী নদীর ধার ঘেঁষে দারুন দেখতে।
পথিমধ্যে ২ বার বিরতি ছিল। মাঝে ভেজি-রাইস এত ভাল লেগেছিল যে ইচ্ছা মত খেয়েছি।
ছবি ৪: যাত্রা বিরতিতে রেস্টুরেন্ট।
বিকাল ৩ টা নাগাদ পোখারা পোঁছে গেলাম। বাস স্ট্যান্ড থেকে বের হয়ে ছুটলাম পারমিটের জন্য। অন্নপূর্ণা সার্কিট এ যেকোনো ট্রেকিং করতে ACAP (Annapurna Conservation Area Project) & TIMS (Trekker Information Management System) পারমিট অবশ্যই নিতে হবে। বাস স্ট্যান্ড থেকে সরকারী ট্যুরিজ্ম বোর্ড অফিস ১০ মিনিট হাঁটার পথ। যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলে দেখিয়ে দেয়। সার্ক ভুক্ত দেশের জন্য ACAP চার্জ ২০০ নেপালি রুপি, TIMS চার্জ ৬ ডলার। TIMS নিতে পারলাম না কি কারনে জানি অফিস বন্ধ। কিন্তু ACAP বলে দিল যে আমরা ওটা চেকিং অফিস(Bire Thati) থেকে নিতে পারব, তাই চিন্তার কিছু নাই। এরপর চলে গেলাম লেক সাইড এলাকাতে, পর্যটকরা সাধারানত এইদিকে থাকে। প্রচুর পর্যটক এর আনাগোনা, পিক সিজন হওয়াতে নাকি এই অবস্থা। কয়েকটা হোটেল দেখে, বাজেটের মধ্যে KIWI Guest House এ উঠলাম। সিঙ্গেল রুম, দুই বেডের ভাড়া পড়েছিল ১০০০ রুপি। হোটেল থেকে বের হয়ে গেলাম ফেওআ লেক, আকাশে মেঘের ঘনগটা। থেকে মাউন্ট ফিশ টেইল (Machhapuchere) এর ভাল ভিউ পাওয়া যায়, কিন্তু আবহাওয়ার কল্যাণে কিছুই দেখতে পারলাম না। লেকের ধারে কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটির পর বাজারে গেলাম, কিছু ডলার ভাঙ্গালাম। প্রথমে কিনলাম ABC ট্রেকিং ম্যাপ(এইটা বিশদ ম্যাপ, রুট, হোটেল/ লজ পজিশন সহ ) , এরপর কিনলাম প্রচুর চকলেট ( অবশ্যই SLICKERS কিনবেন), বাদাম, কিসমিস, বিস্কুট, কান টুপি, ওয়াকিং পোল (প্রতিটি ৪০০ রুপি)। সন্ধ্যা বেলাতে শুরু হল বৃষ্টি। কাল সকালে যাব ট্র্যাকিং এ, আর আজ কে তুমুল বৃষ্টি। রাত ৯ টার দিকে বৃষ্টি একটু ধরে আসলে রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে আসি। ট্র্যাকিং ম্যাপ ঘাঁটাঘাঁটি করলাম আর চিন্তা করছিলাম সকালে এই রকম বৃষ্টি থাকলে রওনা দিব কেমনে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
১৯/১০/১৩
৬:৩০ এ ঘুম থেকে উঠে দেখি বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে, কিন্তু আকাশে অনেক মেঘ। পিয়াস কে বললাম রওনা দেয়া যাক, দেখি কত টুকু যেতে পারি। গেস্ট হাউস এ বেশকিছু কাপড়, স্যান্ডেল রেখে ব্যাগ হালকা করলাম। তারপর বেরিয়ে পড়লাম।
হোটেল থেকে বের হয়ে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম যেটা যাত্রী আনতে নয়াপুল যাচ্ছে। অনেক দরাদরির পর সে আমাদের ১০০০ রুপিতে (নরমালি ১৮০০/২০০০ রুপি ভাড়া) নিয়ে যেতে রাজি হল। ৮:৩০ নাগাদ নয়াপুল চলে গেলাম। হালকা কিছু নাস্তা খেলাম। যেহেতু আমাদের সময় কম তাই প্রথম দিন যত বেশি রাস্তা যাওয়া যায় সেই দিকে আগলাম। নয়াপুল(Nayapul) থেকে খিমছে (Chimche) পর্যন্ত জীপ পাওয়া যায়। খিমছে থেকে গ্রান্দ্রুক (Grandruk) ১ ঘণ্টার হাঁটার রাস্তা। আমি জানতাম শাওলি বাজার (Syauli Bazar) পর্যন্ত পাওয়া যায়। যা হোক ভাল এ হল। জীপ ভাড়া ৩০০ রুপি/প্রতিজন। পথিমধ্যে ভিরেথাতিতে (Bire Thati) আমাদের ACAP, TIMS চেকিং হল। TIMS না থাকাতে ১২০০ রুপির বিনিময়ে আমাদের দুটি TIMS কার্ড দিলেন। ১০ টায় খিমছে পৌঁছে গেলাম। এরপর শুরু হল আমাদের ম্যারাথন হাঁটা। ম্যাক্সিমাম রাস্তা গুলো পাথরের তৈরি।
ছবি ৫,৬: শুরু হল ট্রেকিং।
শুরুতে একপাল গাধার সাথে ক্রসিং হল। গাধা এখানে প্রধান মালবাহী পশু। সমতল থেকে ম্যাক্সিমাম জিনিস এই গাধা গুলোর পিঠে করে উপরে পৌঁছে।
ছবি ৭: খাড়া পথ দিয়ে উঠছি আর উঠছি।
এইখানে পথ হারাবার ভয় নেই। কোথাও সন্দেহ দেখা দিলে, অপেক্ষা করলে মানুষের দেখা মিলে আর যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলে পথ দেখিয়ে দিবে। পথে পরল ঝর্ণা, কোথাও বা ব্রিজ।
ছবি ৮: এই ট্র্যাক এ এই রকম ঝর্ণার অভাব নাই।
এতক্ষণ আবহাওয়া ভালই ছিল, হঠাৎ করে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়া শুরু করলো। ১১:৩০ এ গ্রান্দ্রুক(Grandruk) পৌঁছালাম। শেরপা নামের রেস্টুরেন্ট এ গরম লাল চা খেলাম। বৃষ্টি জোরেশোরে পড়া শুরু হয়েছে। নাই রেইন কোট, ছাতা তাই লোকাল চিকিৎসা হিসাবে বড় একটা পলিথিন কিনলাম। পলিথিনের একপাশ কেটে মাথালের মত ব্যবহার করলাম।
ছবি ৯, ১০: লোকাল রেইন কোট, গ্রান্দ্রুক এর ঘর বাড়ি।
গ্রান্দ্রুক ভ্যালীটা অনেক সুন্দর কিন্তু বৃষ্টির কারনে ভাল ভাবে দেখতে পারিনি। ম্যাপ দেখে ঠিক করলাম পরের গন্তব্য কম্রং(Komrong)। এই রাস্তা আগের চেয়ে একটু খাড়া, তার উপর বৃষ্টি তাই চলতে সময় লাগছিল। ১:৩০ এ কম্রং পৌঁছালাম। এইখানে খেলাম রসুনের সূপ (Garlic soup হিসাবে চিনে), খুব একটা স্বাদের কিছু না কিন্তু দ্রুত শক্তি যোগায়। সেই সাথে নুডুলস, বিস্কুট খেলাম।
ছবি ১১: গরম গারলিক সূপ।
পরবর্তী যাত্রা কিম্রং (Kimrong) এর উদ্দেশে। এই সময় বৃষ্টি থেমে গেছে। কম্রং থেকে কিম্রং এর রাস্তাটা নিচের দিকে। এই রাস্তাতে তেমন একটা ট্যুরিস্ট দেখিনি। পাহাড়ের ঢাল দিয়ে একদম নিছে কম্রং নদীতে নামতে হবে। নামছি আর নামছি, পথে ৩ ইন্ডিয়ান এর সাথে দেখা, ওদের মতে আজকে সন্ধ্যায় চম্রং পৌঁছা সম্ভব না। ৪টা বাজে কিম্রং পৌঁছালাম। নদীর পাশের দোকানে চা খেলাম আর কিছুক্ষন বিশ্রাম নিলাম।
ছবি ১২: কিম্রং খোলা নদী। ( নেপালি ভাষাতে "খোলা" মানে নদী)
এরপর দিনের শেষ গন্তব্য চম্রং (Chhomrong) এর উদ্দেশে যাত্রা করলাম। অনেকটা খাড়া পথ। কিছুটা উঠি আর বিশ্রাম। পাহাড়ের উপর সুন্দর একটা ভ্যালি। আবার হাঁটা আর হাঁটা। ৬:১৫ নাগাদ হাঁটার পর পাহাড়ের ঢালে “Way to Chhomrong” সাইন বোর্ড দেখে ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলাম।
ছবি ১৩: আশা জাগানো সাইন বোর্ড।
তার একটু পরেই একটা বাড়ি চোখে পড়ল, সোজা ওই বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। দেখলাম এই বাড়িতে গেস্ট থাকার ব্যবস্থা আছে। রাতে ভাত, ডাল, সবজির আসাধারন ডিনার। এইদিকে সব বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি আছে। খাওয়া দাওয়া শেষে মাসল রিলাক্স এর ঔষধ খেলাম। তারপর সোজা ঘুম।
ছবি ১৪: সকালের নাস্তা করছে পিয়াস, এটি পরদিন তোলা।
অন্নপূর্ণা বেইস ক্যাম্প ট্রেকিং এর গল্প – ২
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:২১