২০/১০/১৩
ঘুম থেকে উঠে দেখি চমৎকার সকাল। আকাশের এক কোনে এক টুকরো মেঘ। নুডুলস, রসুনের সূপ আর চা দিয়ে ঝটপট নাস্তা সেরে নিলাম।রাতের খাওয়া, গরম পানি, থাকা, সকালের নাস্তা বাবদ দুজনের বিল হয়েছিল ১৯০০ রুপি। ৭:১৫ তে বেরিয়ে পড়লাম। একটা পাহাড় ঘুরতেই চোখে পড়ল মাউন্ট ফিশ টেইল (Machhapuchere)। ভ্যালীর উপরে ফিশ টেইল আর অন্নপূর্ণা সাউথ এর দৃশ্যটা ছবির মত।
ছবি ১: ছবির মত শাফালু ভ্যালীর সামনে পিয়াস।
সামনের গেস্ট হাউস এ পৌঁছে বুজলাম, আমরা চম্রং এর মেইন ভ্যালী থেকে ৩০ মিনিট পিছনে আছি। আমারা যেখানে রাত্রে ছিলাম ওটা হচ্ছে শাফালু। গেস্ট হাউস এ আবার লাল চা খেলাম। ৪০ রুপি/প্রতি কাপ। পথে দেখা হল এক ডাচ তরুনের সাথে, ও একাই ABC ট্র্যাক করে ফিরছে।
ছবি ২: ট্রেকিং ম্যাপ যা প্রতিটি ভ্যালীতে পাবেন।
ছবি ৩,৪: চম্রং এর পথে।
কিছুটা খাড়া পথ উঠতে হল। ৯:১৫ তে চম্রং পৌঁছে গেলাম। দারুন সুন্দর একটা ভ্যালী। এইখান থেকে ফিশ টেইল আর অন্নপূর্ণা সাউথ এর ভিউ অসাধারন। এই ভালীতে প্রচুর লজ, হোটেল, বাড়ি। অনেকে এই পর্যন্ত ট্র্যাক করতে আসেন।
ছবি ৫: চম্রং এর বিখ্যাত সিঁড়ি, প্রায় সাড়ে তিন হাজার স্টেপ আছে, উঠার সময় খবর হয়েছিল।
ছবি ৬: চম্রং খোলা নদীর উপর ব্রিজ।
এইখানে বিদ্যুতের লাইন ও আছে। চম্রং ভ্যালিটা অনেক উঁচুতে। এইখানে দেরি করলাম না। এইবার ডাউনে যেতে হল বেশ খানি। পরের গন্তব্য সিনুয়া। চম্রং খোলা নদীটা ব্রিজ দিয়ে পার হলাম। এখান থেকে দেখা পেলাম প্রচুর পর্যটকের। আসলে যেই পথেই হাঁটা শুরু করেন যেতে হলে চম্রং থেকে উপরে সোজা উঠতে হবে। ম্যাপ দেখলে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে। চম্রং খোলা নদীটা পার হয়ে শুরু হল খাড়া পথ। ৪০ মিনিট উঠার পর পৌঁছালাম লোয়ার সিনুয়াতে (Sinuwa)। কথা হল মালয়সিয়া, অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড থেকে আসা ট্র্যাকারদের সাথে।
ছবি ৭: সিনুয়া (Sinuwa) থেকে চম্রং ভ্যালি।
কিছুক্ষন পর পর রেস্ট নিচ্ছি, চকলেট খাচ্ছি, পানি খাচ্ছি। লোয়ার থেকে আপার সিনুয়াতে উঠতে বেশ বেগ পেতে হল। পথিমধ্যে দেখা হল কলকাতার এক ট্র্যাকার পরিবারের( এক মাত্র বাঙালি পরিবার) সাথে। ভদ্রলোকের নাম প্রণব বেনার্জি। বাংলাদেশ থেকে শুনে জানতে চাইলেন কোন জেলা থেকে এসেছি। চট্টগ্রাম শুনে বললেন, লোকাল বাংলা বললে কিছু তো বুজবনা। আমরা হাসলাম।
ছবি ৮: মি: এবং মিসেস প্রণব বেনার্জি।
ছবি ৯: সিনুয়া (Sinuwa) থেকে বাম্বু(Bamboo) এর পথে।
আপার সিনুয়াতে পিয়াস আরও কিছু কাপড় রেখে দিল। এইখানে লেবুর সরবত খেলাম। ৫০ রুপি/ প্রতি কাপ । আমাদের পরের টার্গেট বাম্বু(Bamboo)। হাঁটা আর হাঁটা। রাস্তা একবার আপ, একবার ডাউন। ২:৩০ টায় বাম্বু পৌঁছালাম। এই জায়গাতে এত বাঁশ যে বলার মত না। এলাকার নাম করন সার্থক বলা যায়। এইখানে ভাত আর নুডুলস দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম।
ছবি ১০: বাম্বুতে দুপুরের খাবার।
যেতে হবে বহু পথ। ঠিক করলাম রাতে হিমালায়াতে (Himalaya) থাকব। মাঝে আর একটা স্টেশন দোভান(Doban)।
বাম্বু থেকে দোভান এর রাস্তাতে বেশ ঘন জঙ্গল, দিনের আলোতেও অন্ধকার।দেড় ঘণ্টাতে দোভান পৌঁছালাম।
ছবি ১১: বাম্বু(Bamboo) থেকে দোভান(Doban) এর পথে।
কিছুদূর যাবার পর বেশ বড় ঝর্ণা চোখে পড়ল। এইখানে বেশ খানিকটা রেস্ট নিলাম, পানি আর চকলেট চলল সেই সাথে।
ছবি ১২: দোভান(Doban) থেকে হিমালায়া (Himalaya) এর পথে।
৫:০০ এ এখানে অন্ধকার নামে। পিয়াস এর কাছে থাকা টর্চ লাইট খুবই কাজ দিল। শেষ বেলাতে দেখি দারুন খাড়া এক পাহাড়। গড়ির সময় অনুযায়ী শেষ স্টেশনটা নিকটে হবারই কথা। অনেক কষ্ট করে পাহারটাতে উঠার পর গ্রামের আলো দেখতে পেলাম, দেহে প্রান ফিরে আসলো। হিমালায়াতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ৬:৩০ বেজে গেল। গিয়ে শুনি কোন গেস্ট হাউস এ কোন রুম খালি নাই। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি। শেষ পর্যন্ত একটা গেস্ট হাউস এ ডাইনিং রুম এ থাকার ব্যবস্থা হল। গেস্ট হাউস এ ঢুকে গরম কাপড় পরার পর শান্তি। রাতে ডাইনিং রুমে কত রকম ভাষার কথা যে শুনছি, বলে শেষ করা যাবে না। ইউরোপিয়ান প্রায় সব দেশের মানুষের এইদিকে আনাগোনা। সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, চেক রিপাবলিক, রাশিয়া, জার্মানি, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, এমন কি এক ইসরাইলিকে ও দেখলাম। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে, মাসল রিলাক্সেসিং, সর্দির ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
২১/১০/১৩
ঘুম থেকে উঠে দেখি দারুন আবহাওয়া। নুডুলস দিয়ে নাস্তা সারলাম, চা খেয়ে বেরিয়ে পরলাম। নেক্সট টার্গেট দেউরেলি(Deurali, ৩২০০ মি)। হিমালায়া থেকে দেউরেলি যাবার রাস্তাটা দারুন, ধিরে ধিরে উপরে উঠছি। যত ই উঠছি অন্নপূর্ণা আর মাছেপুছেরে ( ফিশ টেইল) প্রকট হয়ে উঠছে। পথে দেখা হল জাপানি এক পরিবারের সাথে। ৫০ ঊর্ধ্ব লোকজন যেভাবে হাতছে, ঈর্ষাবোধ হল। দেউরেলি পৌঁছানোর শেষ ২৫ মিনিট বেশ খাড়া।
ছবি ১৩: দূরে দেউরেলি(Deurali) এর গেস্ট হাউস।
ছবি ১৪: আক্ষরিক নয়, এইটা যেন আসলেই মাছের লেজ!
দেউরেলি পৌঁছে গেলাম ১০:৩০ নাগাদ। লাল চা খেলাম, কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে আবার যাত্রা শুরু MBC (Machhapuchere Base Camp) উদ্দেশে। এই রাস্তাটা অস্থির, শুধু এতটুকু বলব। নদীর ধার ঘেঁষে চলে যাওয়া পথ।
ছবি ১৫,১৬,১৭,১৮: দেউরেলি(Deurali) থেকে MBC এর পথে।
১ টা বাজে MBC(৩৭০০ মি) পৌঁছে গেলাম। অনেকে এইখানে রাত্রে থেকে ভোরে যান, তারপর আবার ফিরে আসেন। আমদের প্লান হল ABCতে রাতে থাকা, যেহেতু সময় হাতে আছে তাই এখানে থাকতে চাই না। পজিশনটা জোস, যদিও মেঘের জন্য পাহার গুলো ঢাকা পড়ে যাচ্ছিল বারবার।
ছবি ১৯: “হিমালায়ান থর” নামে পরিচিত, MBC থেকে তোলা।
এইখানের কয়েকজন নেপানির সাথে আলাপ হয়। ভাত, ডাল, শিমের তরকারি দিয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে রওনা দিতে দিতে ২:৩০ বেজে গেল। MBC তে বেশ কিছু গেস্ট হাউস আছে। রাস্তাটা খুব খাড়া না, কিন্তু এত উচ্চতাতে হাটতে খবর হয়ে যাচ্ছে। একটু পর পর রেস্ট নিচ্ছি, পানি আর চকলেট খাচ্ছি। বাতাস থাকাতে বেশ শীত লাগছিল। অন্নপূর্ণা দক্ষিন কিছুটা সময় মেঘমুক্ত ছিল, আবার মেঘে ধেকে গেল। বেশ খানিকটা পথ হাঁটার পর বড় একটা পাথরে লেখা দেখতে পেলাম ১ ঘণ্টার দূরত্ব। ফিশ টেইল পিছনে ফেলে এসেছি। বিকালের শেষ আলো ফিশ টেইলের চুড়ায় পড়াতে দারুন লাগছে।
ছবি ২০: বিকালের শেষ আলো এসে পড়েছে মাউন্ট ফিশ টেইল (Machhapuchere) এর চূড়াতে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আরও কিছুক্ষন পর ABC এর আলো দেখতে পেলাম। মনে হচ্ছে কাছে, কিন্তু পৌছাতে পৌছাতে আরও ৩০ মিনিট লাগল। যখন পৌঁছালাম, তখন ঘড়িতে ৫:৪৫। পুরা ট্র্যাক এ এই শেষ আধা ঘণ্টা পিয়াস আমার আগে ছিল। আমার মাথা ধরে ছিল। গেস্ট হাউস এ পৌঁছে ঝিম মেরে বসে ছিলাম বেশ খানিকক্ষন। রাতের খাওয়া (পিজা,নুডুলস সহ কয়েক আইটেম নিয়েছিলাম) খেতে পারলাম না, শুধু ভাজা আলু খেয়েছিলাম। ৫ জনের এক ইতালিয়ান গ্রুপের সাথে কথা হল। এদের একজন মি. ক্লদিও একবার নাকি নোয়াখালী এসেছিলেন, তার ফ্যাক্টরির একজনের বিয়ের নিমন্ত্রনে। উনি চট্রগ্রাম, ঢাকা ভালই চেনেন।
ছবি ২১:মি. ক্লদিও ( ও তার গ্রুপ), যিনি “ আমি এক যাযাবর, আমার নাই ঠিকানা ঘর...” গান শুনিয়ে আমাদের টাসকি খাইয়ে দিয়েছিলেন।
ভাবলাম যা কিছু হোক বেইস ক্যাম্প পর্যন্ততো পৌঁছে গেছি। খারাপ লাগছিল তাই ঔষধ খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।
ছবি ২২: আমরা দুই বন্ধু অন্নপূর্ণা বেইস ক্যাম্প এর সামনে ( এইটা পরদিন তোলা)
অন্নপূর্ণা বেইস ক্যাম্প ট্রেকিং এর গল্প – ৩(শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৩ সকাল ১০:২৫