আমি কি তোমার হাতটা ধরতে পারি ?
অবশেষে বলেই ফেললাম মুখফুটে ।
হাতে মেহেদীর আলপনা , চুড়ি , বিশেষত এই এনগেজমেন্ট রিং কেমন যেন অচেনা লাগছে পাখিকে । ঠোঁটে এমন লিপস্টিক । আচ্ছা এই লিপস্টিক না দিলে হয়না । কেমন রাজকন্যার মত দেখাচ্ছে । আমার চেনা টি লাগছেনা । সেই চেনা জনকে খুঁজে পেতে কি যে লাগছে আমি আসলে বুঝাতে পারবোনা ।
হাত ধরে সেই পুরাতন স্পর্শ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল আমি । আমি একটু চাপা স্বভাবের । এত কথা বলার মত অত শব্দ ভান্ডার ও আমার নেই ।
পাখি আমার দিকে তাকাল । কাজল টানা ঘন নেত্রপল্লবের ভিতরদিয়ে ও আমাকে পুরোটা পড়েই ফেলল । সে পরম মমতায় আমার হাত তার হাতে রাখলো । সুবাসিত এক অনুভব । আমি যেন প্রাণ পেলাম । পুরাতন ওকে ফিরে পেলাম ।
তারপর ই সে নানা প্রকারের গল্প শুরু করলো । আমি মুগ্ধ ভাবে শুনে যাচ্ছি । ওর চোখের ই আলাদা ভাষা আছে । চোখগুলো যেন হাসে । এত সুন্দর চোখ কি কোন মেয়ের হয় ?
আমাদের ম্যারেজ মিডিয়া আমাদের হাতে কতগুলো বই ধরিয়ে দিয়েছে । তাদের ধারনা আমরা প্রিপারেশন ছাড়াই বিয়ে করে ফেলি। অথচ যেই বিষয়টা সারা জীবনের ব্যাপার সেখানে ভাল একটা প্রিপারেশনের দরকার । এই প্রিপারেশন নাই বলেই বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি ।
আমার বাসার সবাই ,পড়ালেখা করছে । আম্মা পড়ছে “ ভাল শাশুড়ির গুনাবলী । “
রিমু পড়ছে “ আদর্শ ননদের গুনাবলী । “
বাবার জন্য ভাল শশুরের গুনাবলী নামের কোন বই পাওয়া যায় নি । আম্মার বই এ নাকি লেখা আছে , “ ছেলের বউ কে নিজের মেয়ের মত মনে করবেন “ ।
আম্মা বলছে নিজের মেয়ের মত মনে করলে খবর আছে । মেয়ে কোন দোষ করলে বকা দেয়া যায় । কিছু ছেলের বউ দোষ করলে বকা দিলে কি ঘটে বলা যায় না ।
আমিও পড়ছি , সুখী পরিবার ও পারিবারিক জীবন । ওয়াইফ সম্পর্কে কুরান আর হাদীস সম্বলিত বই । খুব ইন্টারেস্টিং । খুব আগ্রহ পাচ্ছি ।
পাখি তার ঘন কালো চুলগুলো হাত দিয়ে বিলি কেটে বলল , “ আমিও একটা বই পড়ছি । মিস হেনরি ল্যম্ব এর অনুবাদ বই , পুরুষকে বুঝার ১০১ উপায় ।“
আমি আর্তনাদ করে উঠলাম , “ হায় আল্লাহ ! তাহলে তো আমার ভিতর বাহির কোন কিছুই তোমার আর বুঝার বাকি থাকবেনা ।‘
পাখি শুভ্রদাঁতের হাসির ঝিলিক মেখে বলল , “ দুঃশ্চিন্তা নিওনা , ওখানে লেখা আছে আগের ১০০টি উপায় আপনি শুধু শুধু পড়েছেন কারণ পুরুষকে বোঝা আসলে কিছুতেই সম্ভব না । কারণ এদেরকে কোন সূত্রেই ফেলা যায় না । “
- পুরুষ প্রজাতিরে অপমান করছে মনে হইতাছে
- আচ্ছা ? বিয়ের পর আমরা কিন্তু ঝট করে বাচ্চা নিয়ে নিব বুঝলে ?
- হু , তাড়াতাড়ি নিয়ে নেয়াই ভাল ।
-তারপর বাচ্চা বড় হবে । তাকে বিয়ে দেব । তার আবার বাচ্চা হবে ।
স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে আমরা গ্র্যান্ড মা আর গ্র্যান্ডপা হয়ে গেলাম । কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগছে ।
- মেয়ে হলেই ভাল ,কি বল ? ভাইয়ার মেয়ে টুনটুন কে এত আদর লাগে । সারাদিন এক প্রশ্ন , এটা কি ? এটা কি ?
আমরা ও বিরতীহীন ভাবে তার উত্তর দিয়ে যাই ।
- তার এখন ভাষা শিক্ষার টাইম ।
-আর বলোনা আব্বা তাকে কি ভাষা শিক্ষা দিচ্ছে কাউয়া , কুত্তা , মুরগা
- নিজেদের আঞ্চলিক ভাষাওজানা দরকার । হাহাহা ।
- আচ্ছা চুল গুলো কিন্তু বড় বড় রাখবো । টুনটুনের চুল ভাবী হাফ ইঞ্চি হলেই নেড়া করে দয় । এত মন খারাপ লাগে । কি বলবো ।
দুজন স্বপ্নের ভেলা ভাষাই । পাখি , রবিন আর একটা ছোট্ট পরীর বাচ্চা । বাচ্চার নাম ও ঠিক করে ফেলেছি আমরা । বাচ্চার নাম হবে রিমঝিম । পাখি , রবিন আর রিমঝিম ।
আমি আগে থেকে কেয়ারিং মনোভাবসম্পন্ন । এনগেজমেন্ট হয়ে যাওয়ার পর নিজেকে আরো দায়িত্ববান মনে হয় । নিজেকে একেবারেই একলা লাগেনা । স্বপ্নের উপর স্বপ্ন দিয়ে আমি আর পাখি বাবুই পাখির বাসা বুনে চলি ।
আমি আর পাখি পূর্বপরিচিত ছিলাম না । ম্যারেজ মিডিয়ার মাধ্যমে পারিবারিক ভাবেই ঠিক হয়েছে বিয়ে । আমার এত দিন মনে হত বিশাল সমুদ্রে একা এক নাবিক । আজ যেন সে নোংগর ফেলেছি এখানেই বাসা বাঁধব ।
আজ আমাদের বিয়ের দিন । আমি সমুদ্রের ব্লকের উপর বসে আছি । ঢেউ গুনছি । আমাদের পরিবারের এত স্বপ্ন হঠাত করে কাঁচের মত ভেংগে গুড়া গুড়া হয়ে গেছে । গায়ে হলুদে দেয়া হাতের মেহেদীর রং আমার সাথে যেন উপহাস করছে । জানি আমাকে সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছে । পাখি হাসপাতালে । আমি পালিয়ে গেছি । আমি ওকে দেখতে যেতে পারিনি । পারবোনা ।
আমার পালিয়ে যাওয়াকে সবাই স্বাভাবিক হিসেবেই নিবে । বিয়ের আগের দিন রাতে মেয়ের যদি এত ভয়াবহ অসুখ ধরা পড়ে তাহলে সেই বিয়ে হবেনা এটাই স্বাভাবিক ।
খুব সম্ভব তার ওভারিতে টিউমার । আর আমাদের যাবতীয় স্বপ্ন এখানেই শেষ । আমার রিমঝিম , তার বড় বড় চুলের ঝুটি , তারও মায়ের মত উজ্জ্বল চোখ সব নিমিষেই কোথায় হারিয়ে গেল । বাচ্চা হবার জন্য মেয়েদের ওভারি খুব দরকার । । টিউমার ফেলতে গিয়ে ওভারির যদি ক্ষতি হয় তাহলে আড় কখনোই বাচ্চা হবেনা পাখির ।
এই কদিনে যেন আমার বয়স অনেক বেড়ে গেছে । আচ্ছা সবারই কি জিতে যেতে হবে ? অন্য মানুষের বেঁধে দেয়া সাফল্যের সংগায় নিজেকে সংগায়িত করতে হবে ?
নাহ !শুধু তোমাকে ঘিরে থাকতে পারাই আমার জিতে যাওয়া ।
আমি চলে যাব দূরে । উল্টেপাল্টে কাটাব এক জীবন । যে জীবন সবুজের । ফড়িং এর । তোমাকে যেতে হবে আমার সাথে । তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে উঠ । আমি মনে মনে বললাম । পাখিকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । আমি প্রার্থনা করলাম পরম দয়াময় আল্লাহর কাছে । আল্লাহ তুমি পাখিকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিও না ।
পাখি র উজ্জ্বল চোখে রাত জেগে থাকার কষ্ট । কিন্তু তার হাসিটা সেই অমলিন ।
সে আমাকে বলল , দেখ রিমিঝিমের জন্য আমি এত কষ্ট করি ।অথচ ও সবার আগে বাবা বলে ডাকলো । দুনিয়ার বাচ্চারা মা বলে ডাকে । বাচ্চারা সবার আগে মা বলবে এটাই তো স্বাভাবিক । এই বাচ্চা সবার আগে বাবা বলছে কেন বলত ?
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৪ রাত ৮:৫৬