(১)
“ পাখিকে কে খুঁজে পাচ্ছিনা কেন , যাকে আমি ভালবাসিনা ...বরং ঘৃণা করি ? “
রায়হান , জানি আকুল হয়ে তুমি আমাকেই খুঁজছ । প্রতিটি মানুষের ই দুই ধরনের মানুষকে দেখার জন্য থাকে উদগ্রীব । এক যাকে খুব ভালবাসে আর যাকে ঘৃণা করে ।কপাল দোষে আমি তোমার ভালবাসা পাইনি কিন্তু ঘৃনা যেহেতু পেয়েছি , তাই আমি না বরং তুমিই মরেছ । তুমি আর আমাকে ভুলতে পারবেনা ।
তোমার সব প্রোগ্রামে আমার জন্য অজান্তে ঘৃণাভরে একটা চেয়ার বরাদ্ধ রাখবে আর আমাকে খুঁজবে । রায়হান , তুমি অনেক কিছুই জাননা । তাই আমাকে ভালবাসতে চেয়েছিলে আর আমার শীতলতায় এখন ঘৃনাও কর ।
আজ তোমাকে অনেক কথা বলবো । প্রথমেই তোমাকে জামিলের কথা বলি ,শুন । জামিল হল সেই মানুষ , যার কন্ঠ আমার রক্তে জোয়ারের ঢেউ আছড়ে পড়ে । মাথাও একটু ঝিম ঝিম করতে থাকে । আমি তাকে খুব ভালবাসি । ও নিজেও কেয়ারিং টাইপের । আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রায় সব মেয়েরা ওর জন্য পাগল । কিভাবে যেন ওর সাথে আমারই এফেয়ার হয়ে গেলো । তাও বেশিদিন হয়নি আমাদের রিলেশনের , মাস খানিক হবে ।
আহ , আমার ফোন টা বেজেই যাচ্ছে । জামিল করেছে আমি জানি । আমি ফোন রিসিভ করে আসি ।
>হ্যালো জামিল
> পাখি , আমার জান , কি কর তুমি ? চলনা বেরিয়ে পড়ি
> কোথায় ?
> যেদিকে দুচোখ যায়
> চল ।
>আই লাভ ইউ পাখি ।
> কিন্তু আমার ম্যাথ পরীক্ষা টার কি হবে ?
> আমার সংগে চল , তোমাকে ডেমো দিয়ে দেব । আরে এই ম্যাথ দিয়েতো আমিও পাশ করেছি নাকি ?
আমরা ঘন্টা দুয়েকের জন্য আশুলিয়ায় নৌকা ভাড়া করেছি । বর্ষার অথৈ জল , জামিলের কবিতা ।আমার খোপায় লাগানো কদম । কি বলব , সব কিছু কি রকম পারফেক্ট ম্যাচিং । এই অথৈ পানির মধ্যে হাউজিং কোম্পানীর বড় সাইনবোর্ড লাগানো ।
>আচ্ছা , জামিল এই জায়গাগুলো যদি ভরাট করে ফেলে হাউজিং কোম্পানী তাহলে বর্ষার এত্ত পানি কোথায় যাবে ?
> অন্য এলাকা ডুবে যাবে তখন । পাখি ত দূরে বসে আছ কেন ? আরেকটু কাছে এস ।
আমি একটু এগিয়ে আসতে গিয়েই নৌকার মধ্যে রাখা একটা কিছু দেখে অবাক হয়ে গেলাম ।
> এটা কি কনডম ? এখানে কেন ? এখানে তাহলে এই হয় ? নৌকার ছৈ এ রাখাছিল বস্তুটি ।
> দেখ দূরে যতগুলি নৌকা বাঁধা । ওখানে সব কাপল রা আছে । আজকাল ননভেজ প্রেম কি আজকাল আছে ? এস আমরা এটাকে কাজে লাগাই ।
আমি চুপ করে জামিলের কাহিনী দেখছি । ধুর কি থেকে কি হয়ে গেলো । এই প্যাকেটটাই যত নষ্টের গোড়া । আমার গাঁইগুঁই দেখে জামিল বলল ,
> পাখি তুমি কি আমাকে ভালবাসনা ? দেখ আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নেব না হয় । আল্লাহ খুব দয়ালু । আমাদের মাফ করে দিবেন । প্লিজ আমাকে আদর করতে দাও । তোমাকে এত সুন্দর লাগছে । নীল জলরাশির মধ্যে নীল জলদেবী । এত সুন্দরের পূজা যদি না করি সেটাই আমার আজকের সবচেয়ে বড় পাপ হবে ।
আচ্ছা গতকাল ও আমরা রিকশায় যা করেছি অতটুকুই করবো এর বেশিনা প্রমিস ।
প্রমিস কথাটার মর্যাদা জামিল রাখতে পারছেনা । আমি বাঁধা দিয়ে বললাম , জামিল আমরাতো বিয়ে করিনি এখনো ।
> আচ্ছা , বিয়ে মানে কি ?গুছিয়ে রাখার মত একটা বাড়তি কাগজ । আচ্ছা তোমার কাছে কি একটা কাগজের মূল্য এতই বড় হয়ে গেলো । সেই একটাকা দেন মোহরের একটা কাগজ । তার জন্য এই সময় টাকে বৃথা যেতে দিওনা । ভালবাসা হবে উদার , নিঃস্বার্থ , নিঃশর্ত ।
আসলে , আমাকে পাবার জন্য ওর মধ্যকার এগ্রেসিভ ভাবটা আমার খুব ভাল লেগেছে । আমি আমাকে উপহার দিলাম । আর ও জানে কিভাবে কদর করতে হয় ।কিভাবে সেবা করতে হয় । কিভাবে আদর করে ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হয় । ও একটা শিল্পী ।
দিনে দিনে ওকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যকুলতায় আমি মরে যাচ্ছি । আমি আসলে ওর ছোঁয়াগুলো , আদরগুলোর জন্য হেবিচুয়াল হয়ে গেছি ।মন যেখানে হারিয়ে গেছে শরীর আর কি । ওর কথা আমার সমস্ত স্বত্বা জুড়ে । ঘোরের মত দিন গুলো যাচ্ছে । সত্যি কথা বলতে কি ফিজিকেল রিলেশন হবার আগ পর্যন্ত ও এমন লাগত না । প্রথম দিন একটু বেশি জড়তার কারনে আমি আসলে সব কিছু বুঝে উঠতে পারিনি । এরপর একটু একটু করে ও আবার শরীর মনের দখল নিয়েছে । জামিল সবসময় বলে , “ বুঝছ পাখি শরীরের কোন পাপ নাই । পাপ পূণ্য সব মনের ব্যপার । “
আমরা একটা ফ্ল্যাটে উঠলাম । ফ্ল্যাট সাব্বির ভাই নামের ওর বিসনেস পার্টনারের
জামিল একদিন আমাকে বলল , সামনেই রোজা , তুমি কি রোজা রাখবে ? তাহলে তোমার সামনে সিগারেট খাব না ।আমি ও রোজা রাখতাম কিন্তু অন্তর থেকে ধর্ম ব্যাপারটায় সাড়া পাইনা , বুঝছ? আমি তিন দিন একনাগাড়ে না খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু এই রোজা অসহ্য লাগে ।
আচ্ছা ধর্মে বিয়ের ব্যাপারটা ধর । এই যে মোহরানা ব্যাপারটা । তোমার কি মনে হয় না মোহরানা একধরেনের প্রস্টিটুটের মত একটা ব্যপার । আমি টাকা দিয়ে কিনে নিলাম এমন একটা ঘৃণ্যব্যাপার চলে আসে কিন্তু ।
জামিলের কথাটাতে কিন্তু বেশ যুক্তি আছে ।
এরই মধ্যে সাব্বির ভাই একদিন আমাদের ফ্ল্যাটে এলেন । জামিল বলল , “ সাব্বির ভাই তোমার সাথে একটু পরিচিত হতে চায় । ওনার বউ আছে , কিন্তু খ্যাত টাইপের । ওনার কথা বলার মানুষটাও নাই । এই তোমার সাথে কথা টথা বলবে ।এর বেশি না । বেচারা অসহায় কিন্তু ভাল লোক । আমাদেরকে এই ফ্ল্যাটে থাকতে দিচ্ছে । টাকা দিয়েও হেলপ করতে চায় আমাদের । মাঝে মাঝে এসে তোমার সাথে একটু ক্লোজ হয়ে গল্প টল্প করে যাবে । এ যুগে এরকম মানুষ হয়না । আমার ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলেই আমরা এখান থেকে চলে যাব ।
(২)
আমি এবরশন করিয়ে আসলাম । সাত সপ্তহের বাচ্চা । আসলে বাচ্চাটা কার আমি জানিনা । এটা কি জামিলের নাকি সাব্বিরের নাকি প্রণবের ? এর আমি জানিনা । আমি হোস্টেলে থাকবো রেস্টে এই কটা দিন । প্রচন্ড গতিতে ছুটে চলা আমি যেন একটু থেমেছি । হঠাত করে বিশ্রাম পেয়ে আমি ভাববার মত সময় পেয়েছি । আমি আমার বাচ্চা নষ্ট করে এলাম । আহা একটা বাচ্চার জন্য কত স্বপ্ন ছিল । এবরশনের পরে আমি ডিপ্রেশনে ডুবে যাচ্ছি ।
আমি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম , বাচ্চাটা ছেলে না মেয়ে বুঝা যাচ্ছে ? একটা পিতৃপরিচয়হীন বাচ্চা পৃথিবীতে থাকবেনা এটাই ত বাস্তবতা । কিন্তু বাচ্চাটাত আমার ও ছিল । জামিল কি বাচ্চাটার দায়িত্ব নিয়ে আমার পাশে থাকতে পারতোনা ?
সে বলেছে , পাখি আমাদের টাকার দরকার । প্রেগনেন্ট মহিলার সংগে কি কেউ সময় কাটাবে বল ? প্রমিস , আমরা আরেকটু গুছিয়ে নিয়েই নিজেদের বাচ্চা নেব । আই লাভ ইউ জান ।
আমার রুমমেটের টেবিলে পুরাতন খবরের কাগজ ।আমি চমকেউঠলাম , কলেজ ভার্সিটির মেয়েরা যৌন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে । আচ্ছা আমার নাম নাই তো আবার ? আমি আর জামিল এই ব্যবসাই তো করছি এখন , একথা ভেবে আমি লজ্জায় ডুবে গেলাম ।
আমি পিছন ফিরে তাকাতেও ভয় পাচ্ছি । আমি আসলে কোথায় ? মানব সমাজের কোন স্তরে আমি এখন বাস করছি । আমার গর্বিত পদচারণা আমার স্কুলে । আমার প্রধান শিক্ষক , যিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন , আমি গ্রামের নাম উজ্জ্বল করবো । আমার বাবা , মা কোথায় ?আজ আমার নিজের কোন আত্মবিশ্বাস নাই । আমি হেরে যাওয়া কলের পুতুল । আমি হারিয়ে ফেলছি নিজের আত্মসম্মান । সোজা কথায় বলতে গেলে আমি ত এক প্রস্টিটিউট হয়ে গেছি । ও আল্লাহ !! আমি কি করব ? সুইসাইড ? নাকি আরেকবার বাচার চেষ্টা করবো । আমি আব্বুকে ফোন করবো আব্বুকে কি বলব ঠিক করে ফেলেছি ।
আব্বু , আমার এক্সাম শেষ । তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চল । এই ইট কাঠ পাথরের শহর আমার ভাল লাগছেনা । আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । আমি কি মরার আগে আরেকবার বেঁচে উঠার চেষ্টা করা উচিত তো আমার । আব্বু , আমার জীবণ চলার পথে পা পিছলে গেছি । আমি তলিয়ে যাচ্ছি চোরাবালিতে ।
আব্বুকে সবকিছু গুছিয়ে বলেছিলাম , নাকি কি বলেছিলাম আজ আমার ঠিক মনে নেই ।নাহ , সব বলতে পারিনি । আমি আব্বুকে কষ্ট দিতে পারিনি । আর আব্বুর চোখে আমার জন্য করুণা তাও দেখার মত শক্তি আমার নাই ।
আমি যা কিছু পছন্দ করতাম না , তা কিভাবে করে ফেললাম । ঝড়ের মত যে এফেয়ার এ আমি জড়িয়েছিলাম তা ঝড়ের মতই মন থেকে শরীর থেকে হারিয়ে গেল কিন্তু আমার সবই তো হারিয়ে গেল । এখন আমি নিজের কাছেই এক অচেনা আমি , কিভাবে আমার সব কিছু আমি হারিয়েছি ।
রায়হান , আমি জানি এর পর তুমি আর আমাকে ভালবাসবেনা , আবার ঘৃণাও করতে পারবেনা । ভালবাসা আর ঘৃনা করূণা দিয়ে রিপ্লেস হয়ে যাবে । তুমি আমাকে করুণা করবে । তবু ও তুমি জানবেনা আমি তোমাকে একা একা এক তরফা ভালবাসার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে যাচ্ছি । তুমি আমাকে করুণা করলে , আবার ও সেই আমি না তুমিই বেঁচে যাবে । কারণ এক তরফা ভালবাসা আর মরে যাওয়া সেই একই ।
তবুও জানো ,মাঝে মাঝে কি ইচ্ছে করে ? মাঝে মাঝে স্বপ্নে বসবাস করতে ইচ্ছে করে অথবা এই নীল আকাশ টার থোকা থোকা মেঘে !!! হয়না , কে যেন সাথে সাথে মনে করিয়ে দেয় সবাই কে সব কিছু মানায় না ।
আমি জানিনা , আমি প্রায়শ্চিত্ব কি পৃথিবীতেই শেষ হবে ? রক্তে এইডস ধরা পড়েছে আমার ।
সমাপ্ত
উতসর্গ -
ব্লগের অন্যতম সুন্দর মনের মানুষ
ব্লগার সায়েদা সোহেলী আপুকে
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:৩২