somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প - মা ( লক্ষীপুরের আঞ্চলিক ভাষায় )

২০ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৪:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ডাক্তার নাড়ী টিপে গম্ভীর মুখে বললেন ,” অবস্থা খারাপ । ডায়রিয়া । শরীর থেকে সব হানি বাহির হই গেছে । যত পানি খাওয়াবি আর ও হানি বাহির হই যাইবো । হানি খাবানি বন্ধ কর , রোগী বাঁচাইতে চাইলে ।“
কথাটা শুনেই রহীম ঘর থেকে ছুটে দৌড় দিল ।এত পথ দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে স্কুল ঘরের জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিল ।তারপরই ক্লাসের ভিতরে থাকা রফিককে খুজে বের করল এতগুলো ছাত্রের মাঝখান থেকে । জানালার কাছের বেঞ্চেই তাকে পাওয়া গেছে ।

জব্বার মাস্টর সুর করে ছাত্রদের ১২ ঘরের নামতা পড়াচ্ছিলেন ।

জানালার বাহিরে থেকেই রহিম বলল , “ ইরে রফিক্যা , তোর মা মরি যায়ের , তুই বাইত দিগে আয় ।“
রফিক অবাক হয়ে রহীমের দিকে তাকাল । রহীমের চেহারায় কি ছিল রফিকের বুক ধ্বক করে উঠল ।

ছুটতে ছুটতে বাড়ির পথে রওনা দিল । বৃষ্টি , কাদা । কয়েক যায়গায় রাস্তা পানির নীচে ডুবে গেছে ।
মা কেমনে মরি যায় । আঁই মারে ভালা রাখি আইলাম । গতকাল ঢেঁইত বারা বাইন্ধলাম মাইজ্যা ভাই , আঁই আর মা । আইজ মা বেনে হানি ভাত গুন আঁরে খাবাই দিসে । নিজে খায়নো । কইছে শরীল ভালা লাগেনা । আঁই তো জিজ্ঞাইনো কি হইছে । আঁর চুলে সইশ্যার তেল দি , চুল আঁচুড়ি দি মা কইছে বালা মত হড়া লেয়া করিছ বাপ ।
মা গো , আংগোরে হালাই যাইয়েন না । আংগোরে হালাই যাইয়েন না মা ।

ঘন গাছ পালায় জড়ানো মাটির স্যাঁতে স্যাঁতে শেওলাপড়া ভিজা রাস্তা । সুপারি , আম গাছ , মান্দার গাছ নারিকেল গাছ , কলাগাছ , বাঁশ ঝাড়ের ভিতর দিয়ে ভুতুড়ে রাস্তা । একটানা বৃষ্টিতে জংলাগাছ বেশ বড় বড় হয়ে গেছে । বৃষ্টি আবারো নেমে গেছে ঝিরঝির করে । রাস্তায় কেউ নাই । অন্ধকার বর্ষার দিন । ব্যাঙ ডেকে যাচ্ছে । কিশোর কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে চলেছে । বই গুলো চিতি পড়া পলিস্টার শার্টের ভিতর ।   বুক বরাবর আকড়ে ধরে রাখা । তার সংগে সংগে ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে আরেক কিশোর রহীম । দুজনের পরনেই লুংগি । রহীম খালি গায়ে । আর দুজন ই নগ্ন পায়ে ।

বুবুর শ্বশুর বাড়ি পাশের গ্রামে । বুবুরে খবর দিতে গিয়েছিল রফিক । বুবু কান্না করছে ,।“ রফিক , আঁই অন কিত্যাম ? ঘরে বেজ্ঞুন ছোড ছোড হোলাহাইন । ইগুনরে ডায়রিয়া ধরি যাইবো , ডায়রিয়া ছোঁয়াচে অসুখ । আঁই জানিহুনি মারে চাইতাম গেছি হুইনলে তোর দুলাভাই বেজার হইবো । “

***

মা প্রায় শুনা যায়না কন্ঠে বলেছিলেন “ আঁরে হানি দে ।“
কিশোরের চোখে পানি “ আঁই কেমনে হানি দিয়ুম । হানি খাওয়া আর বিষ খাওয়া হমান । আঁই কেমনে আন্নেরে বিষ খাবাই মারি হালাইতাম নিজ হাতে । “

শেষে বন্ধ হল প্রস্রাব । পায়খানা । সামান্য রোদ এর দেখা মিলল । সোনালী আলোয় ভিজা ভিজা বাতাস । মাথার উপরে ঝিলমিলে বাতাস ।নিজের হাতে লাগানো নারিকেল গাছের পাতাগুলোর উপর দিয়ে শনশন করে বাতাস বয়ে চলেছে । গাছে ভর্তি ডাব । সব কিছু সবুজ । কিন্তু আলাদা আলাদা রং এর সবুজ । সবুজ ও কত রকম হয় ।মাঠঘাটে পানি থৈ থৈ । বাতাসে ঢেউ খেলে যাচ্ছে । শাপলা ফুল ফুটে জমি গুলো ভরে আছে । ঢেউ এর তারা ভেসে যায় না । শিকড় গাঁথা আছে নীচে । ডাহুক পরিবার শাপলার পাতার উপর দিয়ে হালকা শরীর নিয়ে হেঁটে হেঁটে শিকার ধরছে । অনেক দূরে হাডারি বাড়ির কাছে হাডারি জ্যাডা জমির মধ্যে জাল মেরে মাছ ধরছে । অনেক পুকুর ভেসে যায় । মাছের অভাব নাই খালে বিলে মাঠে ঘাটের বর্ষার পানিতে । ঘরের চালের নীচে বসে বেজোড় শালিক টি কেঁদেই চলেছে ।

পরিস্থিতি তো ভাল । তবু চারিদিকে কান্নার রোল কেন । মা বেঁচে উঠবে । মা তো ঘুমাচ্ছে । মায়ের ঘুম ভাংবে অবশ্যই ।

কিশোর দেখলো , মা হানি হানি করতে করতে চুপ হই গেলেন । মা আর জাগেনো । মা মরি গেছে । আংগোরে হালাই চলি গেসে । কি ডায়রিয়ায় ধরছে , এক্কানা হানি দিতাম হারিনো মায়ের মুখে । অথচ শাওনমাইয়া দিন , চারিদিকে হানি আর হানি । হানির লাই কবরস্থান পর্যন্ত ডুবি গেছে । হুরান বাড়ির কবরস্থান উঁচু । হানির নীচে ডুবি যায়নো । মারে হুরান বাড়ির কবর স্থানে দাফন করতে হইছে ।
***
সময় কিভাবে বয়ে যায় !! হাউ টাইম ডাজ ফ্লাই ? মা মারা গেছে কত যুগ চলে গেলো । এখন চিকিতসা কত পালটেছে । সেই সময় ছিল একরকমের চিকিতসা , এখন আরেক রকমের আসছে । তখন ছিল ডায়রিয়া রুগীর মুখে পানি দেয়া যাবেনা , রোগী মরে যাবে । মায়ের লাগানো নারিকেল গাছে এখনো ডাবে বোঝাই । তখনো ছিল ডাবে বোঝাই । একটা ডাব ও মাকে খেতে দিতে পারিনি । আর এখন পানি , স্যালাইন এগুলিই প্রধান চিকিতসা । এখন কত মানুষ বাঁচে । কিন্তু আমার মা বাঁচলো না । বড় অল্প বয়সে মা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন । হিন্দুদের দুর্গাপ্রতিমায় যেমন দীঘল কোকড়ানো চুল দেয় , মায়ের ছিল অত সুন্দর দীঘল চুল । মায়ের গায়ের রং ছিল ডালিমের মত টকটকে ফর্সা । আমি মায়ের সুন্দর নাকটা ছাড়া আর কিছু পাইনি ।

আমি অভাগা মা , আপনার গায়ের সেই পাতা পাতা গন্ধ ভুলে গেছি । চুলের গন্ধ ভুলে গেছি । ভুলে যেতে বসেছি আপনি হাসলে কেমন লাগতো , রাগ করলে কেমন লাগতো ।
মা আপনার আদর ভুলি গেছি । কেমন ছিল ? সেটা কি জালালী কবুতরের বুকে গাল ছোঁয়ানোর মত ? নাকি কেমন ? , আপনি মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলে এই কঠিন দুনিয়ার কাঁটা বিছানো পথ আমি কত সুন্দর করে হেঁটে যেতে পারতাম । এখন তো বড় কষ্ট আমার । মা , আপনার অভাব আর কিছু দিয়ে পূরণ হয়নি । বুকের যে অংশ খালি হয়ে গেছে , সে অংশে বড় পুরাতন শ্যাওলা ধরা স্মৃতি । প্রায় মুছে যাওয়া স্মৃতি । আমি মাঝে মধ্যে সেই পুরাতন স্মৃতির রাজবাড়ির অলিতে গলিতে হাঁটি । নানা রকম প্রতিধ্বনি আটকে পড়ে আছে সেই বাতাসে ।
ভালা করি হড়া লেয়া করিছ বাপ । হাঁশ মুরগীগুন খড়ে ভরি খড়ের দুয়ার দে । হাঞ্জা হই গেছে । ঘরে চেরগ দে । এরে বাপ চুলার আগুন এক্কানা বেড়াই দে আই এক্কানা আই । নামাজ নো হইড়ে হাতে ভাত দিতাম নো কই দিলাম । ইরে না খাই ঘুমযাস কিল্লাই , এইউঠ উঠ বাপ , দুগা খাই ঘুম যা ।

আমার বুকে বিশাল খালি শূণ্যস্থানে দীর্ঘশ্বাস । শুণ্য হৃদয়ের কষ্ট আর কিছু দিয়ে তো মা পূরণ হইলনা মা ।
ওগো আল্লাহ , আমাকে মাকে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দিও ।তাঁর গুনাহখাতা মাফ করে দিও । তাঁর কবরের আযাব মাফ করে দিও । রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানী ছাগীরা ।













সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:৪১
১০টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:০২



ইউটিউব হুজুর বললেন, মৃত্যুর আগে ইবলিশ ঈমান নিয়ে টানাটানি করে। তখন নাকি নিজ যোগ্যতায় ঈমান রক্ষা করতে হয়। আল্লাহ নাকি তখন মুমিনের সহায়তায় এগিয়ে আসেন না। তাই শুনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×