somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রুদ্ধ মায়ার নীল দুয়ার

৩০ শে মে, ২০১৩ দুপুর ১২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমি তিনরাত ধরে একটা স্কেচ বানাচ্ছি। প্রতিরাতই ফেসবুক থেকে লগআউট হয়ে স্কেচটা বানাতে বসি। প্রতিদিনই শেষ করি। কিন্তু পরদিনই মনে হয় না স্কেচটা ঠিকঠাক হয়নি। বিষিয়ে যায় মনটা তখন। স্কেচটাকে কুটিকুটি করে ছিড়ে ফেলি। নিজের প্রতি প্রচণ্ড রাগ হয়। অকারণেই রাগ হয়! যে মানুষকে জীবনে দেখিনি শুধু তার সাথে ফেসবুক চ্যাটে কথা বলেছি তার স্কেচ করাটা অনেক দুঃসাধ্য মনে হতে থাকে। আমি চেয়েছিলাম স্কেচে তার চেহারা না ফুটিযে চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে। অবশ্য তার চেহারাও কোনদিন দেখিনি।

- শিল্পীদের কল্পনা শক্তি হতে হয় প্রখর!
- হুম আসলেই!
- আপনি নিজেকে শিল্পী মনে করেন?
- হ্যাঁ করি তো!
- কেন করেন?
- কারণ আমি পেইন্টিং করতে পারি। এটাকে কি শিল্প বলবেন না?
- পেইন্টিং শিল্প কিন্তু আপনি পেইন্টার হলেই যে শিল্পী হয়ে যাবেন এটাই বা কে বলেছে!
- ওয়েট আপনাকে আমি আমার পেইন্টিং দেখাচ্ছি এলবামে আছে।
- না লাগবে না। আপনাকে আমি শিল্পী মেনে নিতে পারছি না। জোর করে শিল্পী প্রমাণ করতে চাচ্ছেন নিজেকে!
- জোর করবো কেন!
- আপনি স্কেচ করা শিখেছেন?
- হ্যাঁ শিখেছি।
- তাহলে আমার একটা পেন্সিল স্কেচ করবেন। আমাকে দেখাতে হবে না। আপনি নিজেই দেখবেন।
- আচ্ছা করবো আপনার ছবি দিন।
- হা হা হা...
- হাসছেন কেন!
- ছবি চাইলেন যে তাই। অথচ একটু আগেই বলেছেন আপনার কল্পনা শক্তি প্রখর! আমার সাথে চ্যাটে কথা বলে যতটুকু চিনেছেন ততটুকুতে কতটুকু কল্পনা করতে পেরেছেন তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। পরীক্ষার্থী এবং পরীক্ষক দুটোই আপনি। বলেন রাজি?
- ওকে। আমি করবো।
- শুভরাত।
- শুভরাত।

অপমানে আমার গাল লাল হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। পেইন্টিং আমার শখ। মন ভাল থাকলে মন খারাপ থাকলে আমি পেইন্টিং করতে বসি। এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম সেদিন। আমি আকঁতে বসলাম।
ক্যানভাস আর একগাদা পেন্সিল নিয়ে বসেছিলাম। লোকটাকে একটু রাশভারি মনে হয়। স্কেচটাতে রাশভারি একটা চেহারা ফুটিয়ে তুলতে লাগলাম। আচ্ছা চোখ দুটো মনে হয় চকচকে। রাশভারি লোকেদের চোখগুলো কেমন চকচকে হয়। বয়স কত হতে পারে? উমম… আনুমানিক ত্রিশ। তাহলে চেহারায় ভাঁজ দিবো না। ফেসটা কেমন গোল নাকি লম্বা? মনে হয় গোল। নাহ ! লম্বাও তো হতে পারে! আচ্ছা একটু ব্যালান্স করে দিই তাহলে।
একটানে স্কেচটা শেষ করে তৃপ্তির হাসি হেসেছিলাম। সাথে সাথে একমাসের মান অভিমান ভুলে অদিত কে ফোন দিয়ে বসি।

- এই ফোন ধরতে এত দেরী হলো কেন!
- নীলা!
- তো কার ফোনের জন্যে ওয়েট করছিলে?
- কারো জন্যে না। তবে তুমি ফোন দিবে ভাবতেই পারি নি! এই মেয়ে কেমন আছিস?
- ভাল আছি খুব ভাল আছি! একটা স্কেচ করলাম এই মাত্র!
- আমার?
- ধুর! তোর হবে কেন!
- আচ্ছা এই শোন কাল তুমি কফি শপে থাকবে আমি ওয়েট করবো!
- আচ্ছা আসবো কিন্তু খবরদার কালো টিশার্ট আর ওই সানগ্লাসটা যদি পড়ে আসিস তাহলে ঝগড়া করবো কিন্তু!
- ওরে বাবা আমি তোর হুমকি শুনে এখুনি শহীদ হয়ে গেলাম! কুলখানির দাওয়াত রইলো!
- যাহ ফাজিল কোথাকার! ফোন কাট!
- তুই কাট!

তখন খুশি আকাশ স্পর্ষ করেছিলো। কিন্তু পরদিন সকালে বারান্দার রোদে দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে স্কেচটা খুটিয়ে দেখতে লাগলাম। কোথায় কি? রাশভারি লোকের তুলনায় এতো কচি খোকা লাগছে! বয়স কতো আন্দাজ করা যাচ্ছে না। পনেরো ও হতে পারে পচিশ বা পয়তাল্লিশ হওয়াও অসম্ভব না। চকচকে দুটো চোখ শুধু যেন স্কেচটা থেকে উকি দিয়ে আছে। ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি! ভিতরটা বিষাদে ছেয়ে গেল। ভিটামিন ডি যু্ক্ত রোদের আদর যেন সূঁচ হয়ে বিধছে আমার গায়ে। পরপর তিনদিনেও আমি পারলাম না স্কেচটা বানাতে। প্রতিবারই যেন স্কেচটা আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসে। আর অদিতও প্রতিদিন কফিশপে অপেক্ষা করে আমার জন্যে।
আমি মনে হয় স্কেচটা না করতে পারলে পাগল হয়ে যাবো। স্কেচটা করার মাঝখানেই অদিত ফোন দেয় কখনো পাগলের মতো তার সাথে ভালবাসার কথা বলি কখনো গালিগালাজ। অদিত অসহায় ফিল করে। আমার মনের অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। মনে হতে থাকে অস্থির আমাকে দেখে ওই লোকটা মিটমিট করে হাসছে। বিদ্রুপের হাসি! প্রবল মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম আমি! আমার মাথায় ঢুকে গেছে পেন্সিল স্কেচ!
আমি দিনে শান্তই থাকি কিন্তু রাত বাড়ার সাথে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। একবার ভাবি আজকে ফেসবুকে লগিন করবো না। কিন্ত কিসের আকর্ষণ আমাকে ল্যাপটপ ওপেন করতে বাধ্য করে।

- হ্যালো!
- আরে নীলঞ্জনা যে! কেমন আছেন?
- হুম! ভালো আছি! আপনি?
- আমিও ভালো আছি। আপনার স্কেচ বানানো কতদুর?
- এই তো...

লগাউট হয়ে আজ রাতেও বসলাম স্কেচ নিযে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে খুব। জানালা খুলে দিলাম। একটিবার বৃষ্টির ছাটের আদর উপভোগ করি চোখ বন্ধ করে। এরপর স্কেচ নিয়ে বসি। আজকে খুব ইচ্ছা করছে কেন জানি অয়েল পেইন্ট করতে। আমি সব আয়োজন নিয়ে বসলাম। প্যালেটে রং ঢালবো কিনা দ্বিধা দন্দে আছি। করবো তো পেন্সিল স্কেচ। অয়েল পেইন্ট বের করলাম কেন! ফোন বাজতে থাকে। নির্ঘাত অদিত! মাথায় আগুন ধরে গেল যেন! নিজেকে শান্ত করে ফোন রিসিভ করলাম।
- নীলা!
- হ্যাঁ বল।
- তুমি কি করছো?
- পেইন্টিং নিয়ে বসেছি। আমাকে ডিস্টার্ব করবে না প্লিজ।
- আচ্ছা!
ফোন রেখে দিয়ে অদিতের জন্যে খুব মায়া হতে লাগলো। দিবো নাকি ওকে ফোন! নাহ থাক!

বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। খোলা জানালা পেয়ে বৃষ্টির ছাট একরাশ বাতাস নিয়ে আমাকে একটিবার ছুয়ে দেবার চেষ্টায় রত। প্রতিবারই ব্যার্থ হচ্ছে। কিন্তু এরপর আবারো হুড়মুড় করে ঢুকছে। ঘরের একটি কোণে লাইট জ্বালিয়ে আমি ক্যানভাসের সামনে প্যালেটে রং মিশাচ্ছি। বিভিন্ন সাইজের ব্রাশগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। লেবুফুলের হালকা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি কেন জানি! আমি একটা ঘোরময় জগতে প্রবেশ করলাম।

ক্যানভাসের লোকটাকে ফুঁটিয়ে তুলতে লাগলাম। চেয়ারে বসে থাকা একটা লোক। হাত পা তার বাঁধা। চারিদিকে অসুস্থ হলুদ রঙ্গের আলো। যেন ডিমের পঁচা কুসুম! লোকটির চোখ বাঁধা হাতের বাঁধন খোলার প্রাণান্ত চেষ্টার ব্যর্থ অনুভুতি তার মুখে ফুটে উঠেছে। আমার হাতের ব্রাশ তার মুখের এক্সপ্রেশনটাকে ক্রমেই মূর্ত করে তুলতে লাগলো। কি প্রবল যন্ত্রনা লোকটির! মুখখানি উপরের দিকে তোলা তার দাঁতে দাঁত চেপে আছে।
এবার লোকটির বাচ্চাকে নিয়ে আসলাম ক্যানভাসে। অতিকায় এক যন্ত্রমানব। মাথা থেকে বিভিন্ন ধরনের তার বেরিয়ে এসেছে। জ্বলজ্বল করছে সবুজ একটা যান্ত্রিক চোখ। অন্যটা নষ্ট। হাতে বিশাল এক হাতুড়ি। হাতুড়িটা উপরের দিকে তোলা। রোবটের মতো জিনিশটি তার বাচ্চা।
এবার তার স্ত্রী। অর্ধনগ্ন এক নারী। সে অর্ধেক মানবী অর্ধেক পাথি। ঈগলের মতো পায়ে মজবুত একটি শেকল বাঁধা। মানবীটির চোখ দুটোকে গভীর মমতা দিয়ে সাজালাম। টলটলে দীঘির মতো শান্ত দুটি চোখ। পড়নে সদ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শাড়ি। গলা থেকে ঝুলছে। রক্তাক্ত তার দেহ।
পেইন্টিং অবশেষে শেষ হয়। আকাশ যেন অকৃপণ হাতে আজকে বারি ঢেলে দিয়েছে। শ্রাবণজল বর্ষণের বিরাম নেই। নাকি আমাকে এখনো ছুঁতে পারেনি বলে সে শ্রাবণজল ঢেলেই চলেছে?

আমি ফোন হাতে নিলাম। অদিতের মেসেজ “পেইন্টিং শেষ হলে মেসেজ দিও একসাথে ভিজবো দুজন দুদিকে।” মনটা আনন্দে পূর্ণ হলো আমার। আবারো ফেসবুকে লগিন করলাম। লোকটিকে মেসেজ দিলাম। সে এখনো আছে আমি জানি।

- হ্যাঁ আমি পেরেছি।
- কি পেরেছেন?
- আপনাকে কল্পনা করতে।
- পেন্সিল স্কেচ করে ফেলেছেন?
- শিল্পকে আপনি কল্পনা বলেছেন। তো কল্পনাকে শুধু পেন্সিল স্কেচে বন্দী করাটা কি বোকামি নয়?
- হ্যাঁ তা তো বটেই! আচ্ছা পেইন্টিংটা কি আমাকে দেখানো যায়?
- না যায় না। আপনিই বলেছেন পরীক্ষার্থী আর পরীক্ষক দুটোই আমি। আপনাকে দেখাবো না। নিজের রুপ দেখে ভয় পেতে পারেন। আরেকটি কথা কল্পনাকে ধরে ফেলে উপস্থাপন করেছি আমি। এটাকে শিল্প বলবেন না কি বলবেন আমি জানি না। তবে আমি রূপ দিতে পেরেছি। আমি খুশি। বিদায়।
ফেসবুক ডিএক্টিভ করলাম অবশেষে। এবার মানসিক যন্ত্রণার পালা লোকটির। আমি এবার অদিতের সাখে বৃষ্টিতে ভিজবো।
- এই অদিত ঘুমিয়েছো?
- নাহ!
- চলো ভিজি! আমি ছাদে যাচ্ছি।
- আচ্ছা চলো।

শ্রাবণ জলধারা আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে জলস্পর্ষ উপভোগ করতে লাগলাম।



(দুঃখিত ভাইয়া আপনি অনেক স্নেহ দিয়েছেন এই বোনটাকে। ধন্যবাদ দিবো না। ছোট্ট কৃতজ্ঞতাটুকু গ্রহণ করুন। :) )
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৪
৪৮টি মন্তব্য ৪৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×