সেদিন রাত্রে ফেসবুকে টাইম লাইন দেখছি, এমন সময় 'এমিলিয়া' নামের ফিমেইল আইডি থেকে একটা ম্যাসেজ আসল "আরিয়ান" 'আমি কি আপনার ফ্রেন্ড হতে পারি'? প্রথমে ভাবলাম হয়তো কোন বন্ধু দুষ্টুমি করার জন্য ফেইক নামে ফিমেইল আইডি খুলে ম্যাসেজ দিছে, তারপর ভাবলাম যেহেতু ফ্রেন্ড হওয়ার জন্য বলছে তাই ফেইক হোক অথবা রিয়েল হোক হ্যা বলাটাই বেটার। তো আমি রিপ্লে দিলাম হ্যা অবশ্যই হতে পারেন। তখন এমিলিয়া রিকু দিলে আমি একসেপ্ট করি এবং একটু পর লগ আউট করে ফেসবুক থেকে বের হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন কিছুটা সময় বিরতি দিয়ে দিয়ে ফেসবুকে থাকি এবং রাতে এক বন্ধুর সাথে যখন ম্যাসেজিং করছিলাম তখন এমিলিয়া Hello? লিখে ম্যাসেজ করল। আমিও Hello, How are u? লিখে রিপ্লে করলাম। তারপর এমিলিয়া কি করে কোথায় পড়াশোনা করে, আমি কি করি কোথায় পড়াশোনা করি এবং আরো বিস্তারিত পরিচয় নিয়ে ম্যাসেজিং চলল। আর পরিচয়ের এক পর্যায়ে জানতে পারলাম এমিলিয়া তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। গত বৎসর তার মা হঠাৎ অসুস্হ হয়ে মারা যান, আর তার মায়ের মৃত্যুতে এমিলিয়া মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে এবং সকল বন্ধু বান্ধবদের থেকে ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যায়। এই আলাদা হওয়ার ফলে একসময় সে একাকীত্বে ভোগতে শুরু করে। আর এদিকে এমিলিয়ার মায়ের মৃত্যু ও এমিলিয়ার মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ায় তার আব্বুও চিন্তিত হয়ে পড়ে। এ অবস্হার মধ্যেও তার সবচেয়ে ভাল বন্ধু হচ্ছে তার বাবা। সে তার বাবার সাথে বন্ধুর মতই সকল কিছু শেয়ার করে।
আর এমিলিয়ার সাথে ম্যাসেজিং করতে করতে কখন যে গভীর রাত হয়ে গেল তা টেরই পাইনি। যখন পেলাম তখন রাত দুইটা পঁয়ত্রিশ। এক সময় দু'জনেই good night লিখে লগ আউট করে ঘুমিয়ে পড়ি
তারপর যখন এমিলিয়ার কথা ভাবতাম তখন তার মানসিক কষ্টগুলোও মনে পড়ত, আর তার কষ্ট যেন আমাকেও কষ্ট দিতে লাগল এবং তাকে কিভাবে এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্ত রাখা যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম আর তার মানসিক কষ্টের কথা ভেবে তার প্রতি এক প্রকার ভালবাসা জন্ম নিল। এভাবেই আমাদের মধ্যে প্রতিদিন ম্যাসেজিং চলত, এক সময় আমরা আপনি থেকে তুমি করে সম্বোধন করা শুরু করি।
প্রথম প্রথম ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও ধীরে ধীরে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগল। বিশেষ করে আমি প্রায় সময়ই ওর ম্যাসেজের অপেক্ষায় থাকতাম, তবে সে আমার ম্যাসেজের অপেক্ষায় থাকত কিনা সেটা জানতাম না, কিন্তু আমার কাছে মনে হত সেও অপেক্ষা করত।
দিন যতই গেল ততই আমরা আরো ঘনিষ্ঠ ফ্রেন্ড হয়ে গেলাম। এক সময় ফেসবুকের পাশাপাশি মোবাইলেও যোগাযোগ শুরু হল।
একদিন এমিলিয়াকে বললাম তোমাকে তো এ পর্যন্ত দেখিইনি, তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। এমি বলল তোমাকেও দেখতে অনেক ইচ্ছে করছে, যদিও তোমার ছবি তোমার প্রোফাইলে সবসময়ই দেখি। ওইদিন আব্বুকেও তোমার ছবি দেখিয়েছি, তখন আব্বু বলল তোমাকে দেখতে নাকি অনেকটা লাজুক স্বভাবের, বলেই এমি খিল খিল করে হাসতে শুরু করল।
আমি বললাম তুমি আঙ্কেলকে আমার ছবি দেখিয়েছ এটাতো আমাকে বলনি? এমি বলল তোমাকে বলতে ভুলেই গেছিলাম তাই বলা হয়নি, আজতো বললাম তাই না?? এটা বলেই আবার খিল খিল করে হেসে উঠল।
ওর খিল খিল হাসি শুনে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। তাই মুচকি হেসে বললাম আজ অনেক রাত হয়ে গেছে কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্ট করতে হবে, এখন না ঘুমালে কাল অ্যাসাইনমেন্ট করে জমা দিতে পারব না। এমি বলল ঠিক আছে তাহলে আজকের মত ঘুমিয়ে পড় Good night. আমিও Good night বলে লাইন কেটে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভোরে মোবাইলে রিং হচ্ছে, আমি ঘুম ঘুম চোখে স্ক্রীনের দিকে না তাকিয়েই সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কে? ওপার থেকে সালামের জবাব দিয়ে উত্তর আসল এখনো ঘুমিয়ে আছো আবার জিজ্ঞেস করছ কে?? অ্যাসাইনমেন্ট কখন করবে? আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম আচ্ছা এখনি উঠছি, যা ঘুম দিছিলাম তুমি ফোন না দিলে তো আজ উঠতেই পারতাম না। এমি বলল ঠিক আছে এখনি উঠ, আর একটা কথা বলব রাখবে? আমি বললাম হ্যা বল। এমি বলল আজ বিকেলে চল দেখা করি। আমিতো শুনেই মহাখুশি, বললাম সত্যি?? এমি বলল হ্যা একেবারে সত্যি। আমি বললাম তাহলে কোথায় আসতে হবে এমি? এমি বলল তোমার প্রিয় জায়গাতে। আমি বললাম দিয়াবাড়িতে? এমি বলল হ্যা দিয়াবাড়িতে। আমি বললাম দিয়াবাড়ি শুধু আমার প্রিয়, তোমার বুঝি প্রিয় না?? এমি বলল হ্যা আমার তোমার দু'জনেরই প্রিয় তাই ওখানেই দেখা করব। আর এখন তুমি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে অ্যাসাইনমেন্ট করতে বসবে, নইলে কিন্তু দেখা করব না। আমি বললাম জ্বি ম্যাডাম তাই করব। এমি বলল, তাহলে এখন আর কোন কথা নয় good bye. আমিও good bye বলে রেখে দিলাম। আর তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে ফেললাম
।
ভার্সিটির ক্লাস শেষে দ্রুত বাসায় ফিরে রেডি হয়ে গেলাম। কারণ আজকে আমার প্রিয় মানুষটির সাথে প্রথম দেখা হবে তাও আবার আমার ফেভারিট জায়গায়। আর এমির কথা ভাবতেই হৃদয়ে ভালবাসার হিমেল হাওয়া বয়ে যেতে লাগল, প্রাণ হয়ে উঠলো আরো উৎফুল্ল।
যাই হোক বিকেল চারটা পনেরতে দেখা করার কথা। আমি ঠিক চারটায় দিয়াবাড়িতে পৌছলাম। যখন ব্রিজের পাশে লেকের ধারে বসার জন্য গেলাম তখন দেখি নীল শাড়ি ও ম্যাচিং করে ব্লাউজ পড়া ও লম্বা চুলগুলো ছড়িয়ে দিয়ে অপরূপ একটি মেয়ে লেকের টলটল পানির দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আর মেয়েটিকে দেখেই মনে হল এই-ই হচ্ছে আমার এমি। তবুও শিউর হওয়ার জন্য নরম সুরে এমি বলে ডাক দিলাম। সাথে সাথেই সে হরিণীর মত আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল 'আরিয়ান'। আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে বললাম হ্যা, তুমি কখন এসেছ?? এমি কিছুই বলল না শুধু আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকল। আমিও এমির চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকলাম। আর এভাবে দুজন দুজনের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম তা বুঝতে পারলাম না।
একটু পর অপরিচিত মুখে 'তুমিই আরিয়ান' কথা শুনে চমকে উঠে কথার উৎসের দিকে তাকালাম। দেখলাম একজন মধ্যবয়ষ্ক লোক এদিকে আসছে। তখন এমি কাছে এসে বলল আমার আব্বু তোমাকে দেখতে চেয়েছে তাই নিয়ে আসলাম, বলেই মুচকি হাসতে লাগল। আমি এমির এই ছেলে মানুষী দেখে কিছুটা লজ্জ্বায় পড়ে গেলাম। ততক্ষণে এমির আব্বু কাছে এলে আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন আঙ্কেল জিজ্ঞেস করলাম। উনি সালামের উত্তর দিয়ে বলল আমি ভাল আছি, তুমি কেমন আছ বাবা?আমিও ভাল আছি, বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। এমির আব্বু হেসে বলল ছেলেদের কি এত লজ্জ্বা থাকলে চলে?? আমি মাথা নিচু করেই মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তখন এমির আব্বু বলল, তুমি আমার মাথা থেকে বিরাট বোঝা নামিয়ে দিয়েছ বাবা। আগে আমার এমিটা মন খারাপ করে থাকত, কারো সাথে কথা বলতে চাইত না। যেদিন থেকে তুমি ওর বন্ধু হলে ঐদিন থেকেই ও আগের মত স্বাভাবিক হতে লাগল, সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলা শুরু করল। এমির অন্য কোন বন্ধু না থাকায় বাবা হিসেবে আমিই ছিলাম ওর বেস্ট ফ্রেন্ড, তাই তোমার সব কথাই সে আমাকে বলত।
আজ তোমাদের প্রথম দেখাতেই তোমাদের মাঝে যে গভীর বন্ধুত্ব(ভালবাসা) দেখলাম, আমি চাই সারা জীবনের জন্য তোমাদের এ বন্ধুত্বের বাঁধন অটুট থাকুক। তুমি কি পারবে না বাবা আমার এই পাগলী মেয়েটাকে সারা জীবন বন্ধুত্বের বাঁধনে আটকে রাখতে?? আমি লজ্জ্বায় কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু এমির চোখের দিকে একবার তাকালাম, দেখি ওর চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝড়ছে, যে অশ্রু পাওয়ার যে অশ্রু আনন্দের সে অশ্রুতে এমির মুখ অশ্রুধোয়া হয়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ১০:৪৮