সেই ফেব্রুয়ারিতেই কি-না ভাষা লইয়া নতুন চিন্তার উদ্রেক হইলো।
অন্তত বঙ্কিম, রবীন্দ্র, জীবনানন্দ যতটুকু পাঠ করিয়াছি, তাহাতে ধারণা হইয়াছে শব্দের অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব কিংবা উৎপত্তি লইয়া মৌলিক ভাবনা প্রসব কোন সাধারণের কর্ম নহে। ভাষার অলিগলি এবং মহাসড়কে বেধড়ক ড্রাইভিং করিয়া যাহারা কবি, লেখক, ভাষাবিদ বা উজির না হইয়াছেন, তাহারা আর যাহাই হউক শব্দ-বাক্য লইয়া কেলি করিতে পারেন না।
শব্দের ব্যবহারে কবি, লেখক বা ভাষাবিদের নৈপূণ্যের প্রসঙ্গটি অতিশয় পুরনো। কিন্তু উজিরও যে শব্দের অস্তিত্ব লইয়া পাণ্ডিত্যপূর্ণ তথ্য প্রদানপূর্বক ভাষার বিকাশে অতি বড় ভূমিকা রাখিয়া চলিয়াছেন, এই আবিষ্কার সাম্প্রতিক বটে।
বঙ্গদেশের সচেতন নাগরিক মাত্রই অবগত রহিয়াছেন, জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মতো একটি অতিশয় বৃহৎ সমস্যার সমাধানকল্পে বেশ বহুদিন ধরিয়া একটি প্রকল্প প্রকাশ্যে-গুপ্তে বাস্তবায়িত হইতেছে। ব্যক্তিগত, দলীয় বা অন্য কোন দ্বন্দ্বের ছুতায় মানুষকে ধরিয়া লইয়া অদৃশ্য করিয়া দেয়া হইতেছে। শুরুতে কিছুকাল এই ধরণের নিখোঁজ কারো কারো মৃতদেহ মিলিতেছিল। কিন্তু জীবিত মানুষের মৃতদেহ দেখিয়া স্বজনদের শোক উত্তরোত্তর বাড়িয়া যাওয়ায় প্রকল্পের নেপথ্যের প্রজ্ঞাবান সজ্জনেরা পরিকল্পনায় সংশোধনী আনিলেন। স্বজনদের কষ্ট কমাইতে এর পর মৃতদেহও নিখোঁজ হইতে লাগিল। জনসংখ্যা কমাইতে এ যে একটি অতি বিজ্ঞানসম্মত, সৎ ও দেশপ্রেমিক কর্মসূচি, তাহাতে সুধীমহলের বিন্দুমাত্র সন্দেহ কখনই ছিল না।
কিন্তু জগতের সকল সৎকর্মই বাধার মুখোমুখি হইয়া থাকে। এইখানেও ব্যতিক্রম হইলো না। বিভিন্ন শ্রেণীপেশার স্বল্পজ্ঞান মানুষ এই প্রকল্পের প্রতিবাদে সোচ্চার হইলো। অবাক হইয়া ভাবিতে হয়, এই স্বল্পজ্ঞানদের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, পত্রিকার সম্পাদক এমনকি এমনতর ব্যক্তিরাও ছিলেন যাহারা ইতোপূর্বে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে গুরুদায়িত্ব পালন করিয়াছিলেন। অতিশয় পরিতাপের সহিত লক্ষ্য করি, এই সমস্ত উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরাই কি-না ভাষার ব্যবহারে অসামান্য অজ্ঞতার পরিচয় দিয়া পার পাইয়া যাইতেছিলেন।
মানুষের অধিকার লইয়া কাজ করিবার জন্য যে সভ্যকে দায়িত্ব দেয়া হইয়াছিলো, তিনি ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একজন আচার্য। আচার্য হইয়াও ভাষার ব্যবহারে নিতান্তই অজ্ঞতার পরিচয় দিয়া বসিলেন তিনি। কহিলেন, 'গুম' বন্ধ করিতে হইবে। সম্পাদকরা 'গুম' শব্দ লইয়া সম্পাদকীয় রচনা করিতে লাগিলেন। এই তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ একটিবার অভিধান দেখিবার প্রয়োজন অনুভব করিলেন না- যে শব্দটি তাহারা ব্যবহার করিতেছেন, আদৌ তাহার অস্তিত্ব রহিয়াছে কি-না।
ভাগ্যিস, আমাদের স্বরাষ্ট্রউজির ভাষা লইয়া অগ্রসর জ্ঞান রাখিতেন। তিনি সাংবাদিক মারফত জাতিকে জানাইলেন, গুম বলিয়া কোন শব্দ নাই। অভিধান না হউক (অভিধানে ভরসা করাটাও বাস্তবিক বোকামি হইয়া উঠিয়াছিল, কারণ ইহার রচয়িতারা সকলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও আচার্যসম), অন্তত আইনের একটি পুস্তকের দোহাই দিয়া তিনি কহিলেন, 'গুম' বলিয়া আইনি কিতাবে কিছুই নাই। যে অতিশয় বৃহৎ ভুলটি সমাজে ছড়াইয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছিল, তাহার প্রসার বন্ধে অন্তত আইনি ব্যবস্থা লইবার একটি পথ এক্ষণে উন্মুক্ত হইলো। নিষ্পাপ শিশু-কিশোররাও ভুল শিখিবার হাত হইতে রেহাই পাইলো।
স্বরাষ্ট্রউজিরের এহেন মহৎ আবিষ্কারের পর এই স্বল্পবুদ্ধি লেখকের মস্তিষ্কে একটি চিন্তার উদ্রেক হইয়াছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিষয়টি ভাবিয়া দেখিতে পারেন। অস্বীকার করিবার জো নাই যে, যে সমস্ত উচ্চশিক্ষার লেবাসধারী অজ্ঞ ব্যক্তিদের লইয়া আমরা আলোচনা করিলাম, উহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় পদ দখল করিয়া বসিয়াছেন, পত্রিকার সম্পাদকের আসনটিও তাহাদের। যেহেতু আমাদের কোমলমতি সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষা বন্ধ করিবার উপায় নাই, তাই এই অজ্ঞ ব্যক্তিবর্গদের শুধরাইবার জন্য সাপ্তাহিক বিবেচনায় কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা হউক। সেখানে স্বরাষ্ট্রউজির বা তাঁহার মতো যারা ভাষা বিষয়ে অত্যাগ্রসর জ্ঞান রাখিয়া থাকেন, তাহারা এই অজ্ঞ শিক্ষক-সম্পাদকদের ত্রুটিগুলি শুধরাইয়া দিবেন।
পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের যে প্রয়াত শিক্ষককে একুশে পদক প্রদানের জন্য বাছাই করা হইয়াছে, তাহার বদলে জাতিকে একটি সুবৃহৎ শব্দবিভ্রাট থেকে বাঁচাইবার জন্য স্বরাষ্ট্রউজিরকে এই পদক দেয়ার বিষয়টি বিশেষ বিবেচনা করিবার দাবি জানাইতেছি। এখানে উল্লেখ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই প্রয়াত শিক্ষকের রচিত পুস্তকেও আমরা গুম শব্দের ভুল ব্যবহার প্রত্যক্ত করি।
ভাষার মাসে অন্তত এইটুকু না করিলে ভাষা শহীদদের প্রতি অসম্মান করা হইবে বলে আন্তরিকভাবে বিবেচনা করি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৮:০১