ছোটবেলায় খেলার সাথী, বন্ধু-বান্ধবরা সবাই মুসলমান ছিলো। আমার কিছু বয়স্ক আত্মীয়-স্বজন ছোটবেলায় আমাকে শিখিয়েছিলেন, "ওরা হলো গরু খাওয়া মুসলমান, ওদের সাথে মিশবে না।" ধর্মীয় ব্যাপারে আমার নিজের পরিবারের আগ্রহ কম ছিলো, আমারও সেই বন্ধুদের ছাড়া খেলতে ভালো লাগতো না। শিশুকাল শুরু হয় ধর্মীয় মৌলবাদকে কাঁচকলা দেখিয়ে, কিছু "গরু খাওয়া মুসলমানের" সাথে খেলতে খেলতে।
মুসলিমপ্রধান দেশে থাকার কারণে সারা জীবনই অতিবাহিত হয়েছে মুসলমানদের সাথে। আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু মাসুদ আল কাওসার একজন মুসলমান, জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বলে যাকে মানি, সেই শাহীন আখতার ম্যাডাম একজন মুসলমান। প্রথম শর্ট ফিল্ম তৈরি করি একজন মুসলমানের সাথে, প্রথম শাস্ত্রীয় সংগীত শিক্ষা সানী জুবায়েরের কাছে, একজন মুসলমান।
জীবনে প্রথম প্রেম শিখিয়েছে একজন মুসলমান, স্কুল-কলেজ জীবনে যাদের ছাড়া বেঁচে থাকাই অসম্ভব ছিলো, প্রায় প্রতিটি মানুষ ছিলো মুসলমান। যে আমাকে একদিন "গরু খাওয়া মুসলমানদের" সাথে মিশতে মানা করা হয়েছিলো, সেই আমার জীবনটাকে তৈরিই করেছে মুসলমানেরা।
কোরবানি ঈদের সময় খুব সচেতনভাবে প্রতিবেশিদের বাসা থেকে আমাদের বাসায় খাসির মাংস পাঠানো হতো। বাংলাদেশের সাধারণ শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের এই অসাধারণ মনুষ্যত্ব ছোটবেলা থেকেই আমাকে মুগ্ধ করতো। সেজন্যই দিনের পর দিন এই মানুষগুলোর ভালোবাসার জালে আমি আটকে পড়ি, দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে জন্ম নেয়া একজন মানুষ। এই মানুষগুলোর ভালোবাসা পেতে আমার আধা ইঞ্চি চামড়ার পার্থক্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না।
আমাদের দেশের প্রতিটি হিন্দু বা সংখ্যালঘু পরিবারের বোঝা উচিৎ, একটা বাচ্চার ধর্ম বা খাদ্যাভাস তার নিজের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়না, হয় তার পরিবারের দ্বারা। তাই, শুধু "গরু খাওয়া মুসলমান" ট্যাগ লাগিয়ে তাদের সাথে মেশার ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা একেবারেই যুক্তিহীন। মানুষ আসলে খারাপ হয়না, তাদের খারাপ বানায় তাদের ধর্মীয় অন্ধত্ব, তাদের সমাজ, তাদের রাজনীতি, তাদের পারিপার্শ্বিকতা।
দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর চলতে থাকা অত্যাচারের একটির ওপরেও হাত নেই শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের, বরং অনলাইনে সংখ্যালঘুদের পক্ষ নিয়ে কথা বলা বেশির ভাগ মানুষই মুসলমান বংশোদ্ভুত। আমি ছোটবেলা থেকে যে চিত্র দেখেছি, গ্রামের মানুষেরা সেই চিত্র দেখে না। তারা দেখে ধর্মের উন্মাদনায় পশুতে রূপান্তরিত হওয়া কিছু অমানুষের কার্যকলাপ। এই দায় কখনোই দেশের শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের ওপর বর্তায় না। একজন ধর্মান্ধের দোষ কখনোই চাপানো যায় না একজন নিরপরাধের ওপরে। ধর্ম নির্দেশ দিলেও যেসকল মানুষ সেটিকে অতিক্রম করে "বিবেকবান" হতে পারেন, তিনিই প্রকৃত প্রস্তাবে ভালো মানুষ, মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ। ধর্মান্ধরা মানসিকভাবে অসুস্থ।
কোরবানির ঈদ এসেছে। পশু হত্যা নিয়ে উৎসব আমি কখনোই সমর্থন করি না, যেমন করি না হিন্দুদের বলিদান। তাই বর্বরতার অংশ হতে আমার বিস্তর আপত্তি আছে। বাঙালি এমনিতেই খুব উৎসবহীন জাতি, তাদের উৎসবের সংখ্যা খুবই কম। সেজন্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশির অনুরোধে বা চাপাচাপিতে আমাদের নাস্তিকদের প্রায়ই বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হয়। বলাই বাহুল্য, সেসব অংশগ্রহণের মধ্যে ধর্ম একবিন্দুও থাকে না। যেটা থাকে, সেটা শুধুই আনন্দ ও সামাজিকতা, আর কিছুই নয়।
প্রিয়জনের সাথে মিলনের যে আনন্দ, অনেকদিন পরে বন্ধু-বান্ধব একত্র হয়ে মজা করার যে আনন্দ, ধর্মীয় ভেদাভেদ তার কাছে অতি তুচ্ছ, অতি নগণ্য। তাই উৎসবের মধ্যে ধর্ম আর বর্বরতাকে আমাদের সরিয়ে রাখতে হবে একপাশে, বড় করে তুলে ধরতে হবে উৎসবটাকেই। "ঈদ" শব্দের অর্থ তো আনন্দ, তাই বড় হয়ে উঠুক আনন্দ, বড় হয়ে উঠুক আমাদের মনুষ্যত্ব।
এবারের ঈদে আমাদের মুক্তমনাদের আহবান, কোরবানির রক্ত ও কাটাকাটি সংক্রান্ত ভয়াবহ ব্যাপারগুলো থেকে দূরে রাখা হোক প্রতিটি শিশুকে। ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ থেকে মুক্ত হোক আমাদের শিশুরা। "গরু খাওয়া মুসলমান", "আকাটা হিন্দু" না হয়ে প্রতিটি শিশু হয়ে উঠুক একজন "মানুষ"।
উৎসবের সবচেয়ে বড় শিক্ষা এটাই, সবাইকে আনন্দের অংশীদার করতে পারা। এটা না হলে সকল উৎসব ব্যর্থ, সকল ঈদ, পূজা, সকল আনন্দ - সব ব্যর্থ। সুখী দেশের তালিকায় আমরা যতো নম্বরেই থাকি, সুখটা সার্বজনীন করার শিক্ষা, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে খাঁটি আনন্দ অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে ভাগ করে নেয়ার শিক্ষা তাই প্রতিটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই দিতে হবে।
আমাদের দুঃখী দেশের প্রতিটি মানুষ সুখী হোক।
সকলকে ঈদের শুভেচ্ছা।
ঈদ মোবারক।