শুরুটা অনলাইনে হলেও অফলাইনেও সফল রাবেয়ার ব্যবসা। ছোটবেলা থেকে ভাবতেন নিজে কিছু করবেন। সে ইচ্ছা থেকে দেশের ঐতিহ্য জামদানি শাড়ি নিয়ে কাজ শুরু করেন। একক প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন ‘রুপকথা জামদানি’। মেয়ে হয়েও যে অনেক ভালো উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়া যায় তার আরেক উদাহরণ শারমিন রাবেয়া । শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ শিক্ষার্থীর উদ্যোক্তা হওয়ার পথে বাধা হতে পারেনি লোক প্রশাসন বিভাগের উচ্চ ডিগ্রীও।
নিজে কিছু করার প্রেরণা
ছোটবেলা থেকে রাবেয়া অন্যের অধীনে চাকরি করার ইচ্ছা ছিল না। যদিও কিছুটা বাধ্য হয়ে বছর খানেকের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তারপরেও তিনি ভাবতেন নিজেই কিছু করবেন। অবশেষে দেশীয় কোনো পণ্য নিয়ে কাজ করতে চাইলেন। সেজন্য তাঁতি পাড়ায় নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন। এক সময় জানতে পারলেন ‘চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব’ গ্রুপের কথা। নিয়মিত এ গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। অবশেষে কথা বললেন গ্রুপের অন্যতম উদ্যোক্তা মুনির হাসানের সাথে। তার সাথে কথা বলে তাঁতশিল্প নিয়ে কাজ করার আগ্রহটা আরও বেড়ে যায় রাবেয়ার।
শুরুটা যেভাবে
নিজের ডিজাইনের কিছু শাড়ি আর জামা নিয়ে ২০১২ সালের আগস্টে ঈদের একটি প্রদর্শনী করেন শারমিন রাবেয়া। আনুষ্ঠানিক যাত্রা বলা যায় এটিকেই। এর মাত্র দুই মাসের মধ্যে চাকরি ছেড়ে দিলেন। পুরোপুরিভাবে কাজ শুরু করতে চাইলেন। ভাবলেন প্রচলিত মার্কেটিং করতে গেলে অনেক খরচ। তার মতো নতুন উদ্যোক্তার পক্ষে তা অনেকটাই অসম্ভব। তাই শুরু করেন অনলাইনে প্রচারণা। ‘রুপকথা জামদানি’ নামে ফেইসবুকে একটি পেইজ খোলেন। এরপর ই-বাণিজ্য মেলা, উদ্যোক্তা উৎসবসহ বিভিন্ন প্রদর্শনী ও মেলায় অংশগ্রহণ করেছেন। উদ্যোক্তা গ্রুপের সহযোগীতায় এসব প্রদর্শনী ও মেলায় অংশ নিয়ে পুরোদমে শুরু হয় রুপকথা জামদানির কার্যক্রম।
প্রথম প্রতিবন্ধকতা পরিবার
নতুন এ উদ্যোগ নিতে প্রথমে রাবেয়ার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবার। সবার ধারণা, তিনি মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত চাকরির পর বাসায় ফিরে কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতেন। বিসিএসের জন্য নিজে পড়াশুনা করতেন। এরই মধ্যে রুপকথার জন্য প্রোডাক্টের ডিজাইন করা, সেগুলো নিয়ে ছুটির দিনে তাঁতি পাড়ায় যাওয়া, একটা একটা করে শাড়ি বানানো, জামা বানানো চলতে থাকে। তখন বাসায়, পাড়া-প্রতিবেশি বারবার বোঝাতে থাকেন, লোক প্রশাসনের একজন ডিগ্রীধারীর সরকারি চাকরির জন্য মন দিয়ে পড়াশোনা করা উচিত। যেদিন প্রথম প্রদর্শনীর কথা সবাইকে জানালেন রাবেন, সেদিন সবাই বাহবা দেওয়ার পরিবর্তে তাকে নিয়ে বাকা কথা বলা শুরু করল।
রাবেয়া বলেন “আত্মীয়-স্বজনরা আমাকে বোঝাতে না পেরে আমার মাকে বোঝাতে থাকে। আমার যাতে সুমতি ফেরে। আমাকে বিভিন্ন পরিসংখ্যান দেখাতে থাকে, যে মেয়ে ১ম শ্রেণি থেকে এখনও পর্যন্ত ১ম ছাড়া ২য় হয়নি, তাকে এগুলো মানায় না। আমার কাছ থেকে তারা অনেক বেশি কিছু আশা করে। তারা বলে, যারা কোথাও চান্স টান্স পাবে না, ব্যবসা হলো তাদের জন্য।” এভাবে প্রতিনিয়ত বোঝাতেন তারা। তবে হাল ছেড়ে দিয়ে থেমে থাকেননি তিনি।
এগিয়ে চলা
২০১২ সালের অক্টোবরে চাকরি ছেড়ে দিলেন ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে চতুর্থ রাবেয়া। সেদিন তার মনে হয়েছে তার মতো স্বাধীন আর কেউ নেই। প্রিয়জনদের নানা কথা শোনার পর তার আরও জেদ চেপে বসত। আর এই জেদ দেখে অবশেষে রুপকথার পাশে এসে দাঁড়ালেন তার মা।
ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১২ তে অংশগ্রহণ করার পর থেকে পরিচিতজনরা রাবেয়ার কাজের প্রতি উৎসাহী হতে থাকেন। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি বলেন “যে কোনো সমস্যায় ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব’ গ্রুপের মুনির হাসান ও মোশাররফ স্যারসহ আরও অনেকে সারাক্ষণ পাশে থেকে সাহায্য করে গিয়েছেন। আরও অনেকেই আছেন যারা আমাকে থেমে থাকতে দেননি।”
রুপকথার ৫ তাঁতে কর্মী এখন ২১
রুপকথার প্রথমে তাঁত ছিল একটি। বর্তমানে তাঁতের সংখ্যা ৫টি। এতে ৬ জন প্রধান তাঁতি ও ১৬ জন সহযোগী তাঁতি রয়েছে। প্রথম দিকে অনলাইন, প্রদর্শনী ও মেলাভিত্তিক হলেও প্রচুর সাড়া পায়। তাই নিজ জেলা চট্রগ্রামে একটি শোরুম খুলেছেন। অনলাইনের পাশাপাশি অফলাইনেও দারুন সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
দেশীয় ঐতিহ্য ‘জামদানি’ নিয়ে রুপকথাই প্রথমে অনলাইন ও অফলাইনে কাজ শুরু করেন। তাই এখানকার নারী ও মেয়েদের থেকে সাড়াও মিলছে বেশ।
রাবেয়া বলেন, “আমি আজ খুবই খুশি। যখন ৮ বছর আগের সেই স্কুল ফ্রেন্ডরা আমার শোরুমে আসে, আমার আত্মীয়-স্বজনরা তাঁদের বন্ধু বান্ধবদের গর্বের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমার স্কুল কলেজের শিক্ষকরা আমার শোরুমে এসে যখন আশীর্বাদ করে যায়, যখন তাঁরা তাঁদের পরিবারকে নিয়ে এসে গর্ব করে শুধু পরিচয়-ই করে দেন না, আমার কার্ড আর লিফলেট নিয়ে কলেজে অনেককে বলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে ভীষন আনন্দের। আর যখন দেখি ভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা শোরুমে এসে বলে আমি তাঁদের অনুপ্রেরনা, তাঁদের প্রিয় প্রিয় স্যারদের কাছে আমার রুপকথার কথা এত্ত শুনেছে, শুধু একবার দেখতে হলেও আসে, আজ ওরাও স্বপ্ন দেখে নিজেরাই কিছু করবে, বিভিন্ন পরামর্শ আর নানান দিক নিয়ে কথা বলতে আসে, এটা যে কত বেশি প্রেরনা দেয় আমাকে!”
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রুপকথার বিক্রি থেমে থাকেনি। বরং আগের চেয়ে রুপকথার পণ্য বিক্রির পরিমান দ্বিগুন বেড়েছে। আগের চেয়ে বেশি অর্ডার আসছে। রুপকথার ওয়েবসাইট ও ফেইসবুক পেইজে পছন্দের পোশাক দেখে কিনতে পারছেন ক্রেতারা, শোরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। এটিও বিক্রির পরিমান বাড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন শারমিন রাবেয়া।
আগামীর পরিকল্পনা
খুব শিগগির রুপকথার ঢাকাতেও শোরুম চালু করা হবে। শারমিন রাবেয়া প্রত্যাশা করেন প্রতিটি বিভাগীয় শহরে রুপকথার আউটলেট থাকবে, একটি করে গ্রাহক সেবা কেন্দ্র থাকবে, যেখানে ক্রেতারা তাঁদের বিভিন্ন অভিযোগ জানাবে, তাঁদের প্রোডাক্টের সমস্যা হলে কি কি করনীয় তা জানতে পারবে। যে কোন প্রোগ্রামে কোন ধরণের জামদানি পরবে ইত্যাদি নানান সমস্যার সমাধান করবে রুপকথা। আগামীতে রুপকথার তাঁতের সংখ্যা আরও বাড়ানোর ইচ্ছা রয়েছে তার। কারণ যেহেতু চাহিদা বাড়ছে তাই দ্রুততম সময়ে পণ্য সরবরাহ দিতে এটি করতে হবে।
স্বপ্ন থেমে নেই রাবেয়ার। তিনি জানান, তার চাপে নারায়নগঞ্জের তাঁতি পাড়ায় ইতিমধ্যেই অনেকেই তাঁদের ছেলে মেয়েদের হেল্পারের পরিবর্তে স্কুলে পাঠাচ্ছে। খুব শিগগিরই প্রতিটা পরিবারের হাতে ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট পৌঁছে দিবেন। তাঁতিদের উন্নয়ন করতে চান তিনি। কারণ তাদের মাধ্যমে তিনি সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন।
এছাড়া সারাবিশ্বকে মসলিনের মত জামদানি দিয়ে তাঁক লাগাতে চান। অস্কার জয়ীরা তাঁদের ডিজাইনারদের পাঠাতে বাধ্য হবে জামদানিতে ড্রেস করে দিতে, কান উৎসবে দেশের তারকারা তো অবশ্যই সারাবিশ্বের সবাই জামদানির তৈরি পোশাক পড়বে এটাই স্বপ্ন দেখেন তরুণ এই উদ্যোক্তা।
এ ছাড়া রুপকথার মোবাইল শপ চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। খুব শিগগির এটি চালু করা হবে। পলে যারা শোরুমে অথবা অনলাইনে আসেন না তাদের কাছেও রুপকথা জামদানি পৌছে যাবে।
রুপকথার শোরুম এর ঠিকানা
২য় তলা, স্যানমার স্প্রিং গার্ডেন, ১১৮ নং শোরুম, জামালখান রোড,চট্টগ্রাম।
ওয়েবসাইট :www.rupkothaa.com
ফেইসবুক পেজ: facebook.com/rupkotha.jamdani
--------------------
ধন্যবাদান্তেঃ টেকশহর
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:৪৪