somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চিলেকোঠার স্মৃতি

২৭ শে জুন, ২০২৩ বিকাল ৪:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমাদের সবার ছোটবেলার কিছু গোপন স্মৃতি থাকে, একান্ত নিজের, আর কেউ জানে না। আমাদের ভাবনার তরঙ্গ যেন রাতের নিকশ কালোয় কখনও বা একটু দোলা দিয়ে যায়। তখন মনে পড়ে, তখন আমরা মিলিয়ে দেখি সেই দুরন্ত শৈশবের ভাজ করা, প্রায় ভুলে যাওয়া অভিজ্ঞান পর্বে।

আমাদের চিলোকোঠা। আমার কাছে খুব ছোটবেলা থেকে এ একরহস্যময় খাসমহল ছিল। বয়স পরম্পরায় আমি এখানে দেখেছি আমার মেঝভাইকে প্রথম থাকতে (হয়ত বাবলুভাই থাকার সময় আমি প্রথম স্মৃতিচিহ্নের কাছাকাছি স্মরণে এসেছিলাম)। ছোট কক্ষ। তিনদিকে কাঠের জানালা। একদিকে ছাদের দরোজা আর নিচে চলে যাওয়া লালচে মসৃন সিঁড়ি। দক্ষিণের দরোজায় সাদা চক দিয়ে লেখা ‘বিকল্প পথ’।

ছাদে আমার দাদী খতেজান বিবির নারকেল শুকাতো, শরিষা আর শুপারী শুকাতো। আমরা গরমের সময় ছাদে ঘুমাতাম। ঈদ বা বিয়ের মতো বড় কোন উৎসবে যখন বাড়ী আত্মীয়স্বজনে ভরে যেত আমরা তখন হুল্লোড় করতে করতে ছাদে চলে আসতাম। রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশে একমনে তাকিয়ে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমোতাম। মাঝরাতে কখনও ঘুম ভেঙে গেলে চোখে পড়তো দিগন্তজোড়া আসমানে ছায়াপথের থমকানো আলো; হয়ত কালপূরুষ, নিহারিকা, প্রক্সিমা সেন্টারায়; আমি তখনও কোন তারা চিনতাম না। তবে অনেকবার তারা খসা দেখেছি। হয়ত উল্কার মতো ঠান্ডা উজ্জ্বল আলোর বলয় দেখেছি, তবে তা স্বপ্নে না বাস্তবে তা আর মনে নেই।

অনুভাই মাথায় ঠান্ডা লাগবে বলে একটা চেয়ার উল্টো করে কাপড় দিয়ে মাথার উপরে গিয়ে রাখতো। উত্তর দিকে মাথা দিয়ে জামরুল গাছ আর মিষ্টি আমের গাছ ভেদ করে জামাল সাহেবের দোতালার অস্পষ্ট আলো আসতো মিটমিট করে। তখনও বিদ্যুত আসেনি আমাদের গ্রামে। রাত দশটা মানে অনেক রাত। ছাদ থেকে আশে পাশের যতদূর দেখা যায় যেন বিকট এক অন্ধকার গ্রাস করেছে অতিকায় দানবের মতো। তবে কখনও টক্কো সাপ ডেকে উঠতো, একটা ভুতুম বা নিশাচর কোন পাখির ডানা ঝাপটানি। চোখ কচলে নিলে অগুনন জোনাকির গুল্ম যেন ম্লান থমকানো আলেয়ার মতো দুর ঝোপঝাড়ে ওত পেতে থাকতো। কখনও নিচের ফুলবাগান থেকে আব্বার লাগানো ফুলের অপার্থিব ঘ্রাণ পেতাম। মাথার কাছে টর্চ আর হারিকেন নিভিয়ে রাখা হতো।
আমার মা একদিতে কোরআন তেলওয়াতের সময় নাকি সামনে সাদা কি ভেসে যেতে দেখেছিলেন। একরাতের কথা মনে পড়ে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে দেখি ছাদে কেউ নেই, আমি একা শুয়ে, সাদা জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ, একটু পরে বুঝলাম, আমাকে রেখে সবাই নিচে গিয়েছে সেহেরী করতে। প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম।

যাহোক, আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র তখন আমার দখলে চলে আসে এই রহস্যমন্ডিত চিলেকোঠাটি। একটা খাট, একটা চেয়ার টেবিল, দেয়ালে খুদিত বুকসেলফ এটাই চিলেকোঠা। প্রথম দিকে থাকতে ভয় করতো তাই আমার বন্ধু শাহাজান মাঝে তার স্পিকার আর ওয়াকম্যান নিয়ে আসতো থাকতে। আমরা রাতে কপিয়ার টু, মাইলস আর ডিফারেন্ট টাচের গান শুনতাম। কখনও সোলস বা ফিডব্যাকের গান শুনতাম। শাজাহান একটা মাটির ভাড়ের মুখে তার খোলা স্পিকারটি রাখতো, একটা বেজের শ্রুতিমুখর বিট বের হতো, আমরা লিরিক শোনার চেষ্টা করতাম। মাঝে মাঝে চানাচুর মুড়ি আর বিস্কুট খেতাম। তখন অবশ্য বিদ্যুত এবং অন্যান্য আধুনিক দ্রব্যসামগ্রী সহজলভ্য হয়েছে আমাদের কাছে। নিচে সেজকাকার ঘরে টেলিভিশন বাজতো, শুধু বুধবারে ম্যাকগাইভার আর শুক্রবারের দুপুরে থান্ডার ক্যাটস দেখতাম।

চিলেকোঠায় আমার ভয় করতো সবসময়। কিন্তু কি এক অপার্থিব টানে আমি পুরো দুবছর এখানে থেকেছি। পায়ের কাছে জানালা খুলে দিলে অন্ধকারে সটান অর্জুন গাছটি বা দুরের বাদুরের পাখা ঝাপটানি আমাকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখতো।

আমি রাতজেগে প্রচুর গল্পের বই পড়তাম। ততদিন গ্রামে আমাদের লাইব্রেরীটা গড়ে উঠেছে। মাসুদ রানা থেকে শুরু করে দস্যু বনহুর সব বই অনায়সে গিলেছি এই চিলেকোঠায় বসে।

এবার দেশে গিয়ে চিলেকোঠাটি আমাকে অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যের বিষয় বহুবছর এই চিলেকোঠায় আমার উঠা হয় নি। এটি সম্ভবত এখন পরিত্যক্ত, বসবাসের অযোগ্য ধ্বংসস্তুপ। কিংবা আমাদের শত স্মৃতির ভারে ভারাক্রান্ত হয়ে নিজেই জবুথুবু বিধস্ত হয়ে কালের চিহ্ন হয়ে আছে।

কিন্তু আমার হৃদয়ের গহীনে এখনও সেই লাল মসৃন সিঁড়ি বেয়ে উঠা, সিঁড়ি কোণায় রাখা দাদীর সুপারীর জালা, লোহার গরাদের জানালার ওপাশে শূণ্য আকাশ, দুরের মসজিদের বারান্দা আর শাজাহানের স্পিকারে চলতে থাকা অরবিটের গান আমাকে ভুলাতে দেয় না এর অস্তিত্ব!

কামরুল বসির
২৭/০৬/২০২৩
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০২৩ বিকাল ৪:১২
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার ১৫ বছর

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ২৯ শে নভেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৫:১৭

১৫ বছর পূর্তির এই পোস্টটা যখন লিখছি, তখন আমি একটা বড় পারিবারিক দূর্বিপাকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমার ছোটভাইয়ের কনিষ্ঠ পুত্র, যার বয়স ১১ মাস, সে দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

জিম্মি বিনিময়ের সুনামে হামাস দেশ ত্যাগ করলে, ফিলিস্তিনের জন্য ভালো হতো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৯ শে নভেম্বর, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৫৬



হামাস জিম্মি/বন্দি বিমিয়মে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে: তারা নেতানিয়াহুর সামরিক নিষ্ঠুরতা ও গণহত্যা, অসফলতা ও বিশ্বের চাপকে কাজে লাগিয়ে, জিম্মি বিনিময়ের কন্ট্রোল নিজের হাতে রেখেছিলো। তারা জিম্মিদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিব্যক্তি

লিখেছেন আরোগ্য, ২৯ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:০০





১. অদ্ভুত মোহ মায়ার জগৎ এটা। সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হবে জেনেও বারবার আঁকড়ে ধরার ব্যর্থ চেষ্টায় রত থাকি। শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে কেউ আর বেশি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কবিতা কিংবা বচন-২

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ৩০ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:২৪

আগের বচনগুলোর লিংক :

১। অম্লতিক্ত অপ্রিয় সত্যাবলি

২। অম্লবচন-১

৩। অম্লবচন-২

৪। অম্লবচন-৩

৫। রম্যমধুর অম্লবচন

৬। অম্লবচন মধুরবচন - আমাদের মন ও মানবতা

৭। কবিতা কিংবা বচন

নিঠুর পৃথিবী

আমি এক আলাভোলা ঘরকুনো প্রেমখোর বাঁদর
ভালো লাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একদিন প্রেম খুলবে স্বর্গ দ্বার।

লিখেছেন সামরিন হক, ৩০ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ২:০৪

একদিন অভিমানি সব চোখ,জলে ভরে উঠবে ।
একদিন তোমারআমার ক্ষোভ ওপারে ফিরবে ।

২৫শে জুলাই ২০২০

একদিন আধাঁর ,আলোকিত করবে সব বোধ।
একদিন তোমারআমার হাসি ,আকাশের নেবে কোল।

২৮শে জুলাই ২০২০

একদিন ধু ধু মরুভূমি ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×