নগ্নতা আমার ভীষণ প্রিয়। সকল কদর্যতা ছাপিয়ে নগ্নতার এক অপরূপ সৌন্দর্য রয়েছে, সে হোক দেহের, সে হোক মনের। দেহের নগ্নতা তবু মানুষ দু'একজনের কাছে প্রকাশ করে কিন্তু মনের নগ্নতা সে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। দেহের আবরণ হোল বসন, আর মনের আবরণ মিথ্যা পরিচয়! দেহের নগ্নতা সুন্দর ও প্রাকৃতিক কিন্তু মনের আবরণ বেশীর ভাগই কুৎসিত, বীভৎস, ভয়ংকর।
মনে প্রাণে সৎ থাকার প্রচেষ্টার মধ্যে এক ভীষণ মানসিক যন্ত্রণা লুকিয়ে থাকে। কারণ সকলের সামনে মিথ্যার আভরণ পরে ঘুরে বেড়ানো তার কাছে অসততা মনে হয়। কিন্তু সমাজ তাকে মিথ্যা আভরণেই দেখতে চায়। নগ্নতাকে সমাজ কিছুতেই গ্রহণ করতে রাজী নয়!
প্রকৃতি সুন্দর তার নগ্নতার জন্যই। আদম ও ইভ নগ্ন অবস্থাতেই স্বর্গের বাগানে ঘুরে বেড়াতেন। লজ্জার সামাজিক অনুভূতি তাদের তখনো গ্রাস করেনি। প্রথম পাপবোধ তাদের বসন আবরণে আবৃত করতে বাধ্য করল। আভরণের আড়ালে চাপা পরে রইল তাদের যত পাপ। সেই পাপ থেকেই জন্ম নিলো মনুষ্য জাতি। জন্ম নিলো পাপকে ঢেকে রাখার অসততা। পাপ করা কোন অন্যায় নয়, অন্যায় প্রকাশ্যে পাপ করা, অন্যায় পাপ প্রকাশ করা! ক্রমে সামাজিক আভরণের আড়ালে অসংখ্য প্রকার পাপ ঢেকে রইল, মানুষ গড়ে তুলল অসততার সমাজ।
একদিন সৈকত সরলতাকে তার এইসব অনুভূতির কথাই বলছিল। সরলতা নিজের জীবনের সাথে সৈকতের কথাগুলো মিলিয়ে দেখল, কথাগুলো মিথ্যে নয়।
সরলতার ভাবনার জগতে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সারা জীবনের ঘটনাবলী একে একে তার মানস পটে ভেসে উঠল। তার অনেক কিছুই একান্তই তার নিজের। যার অনেকগুলোই এমন কি তার স্বামীর কাছেও প্রকাশ করতে পারেনি। এই প্রকাশ করতে না পারাটা তাকে অপরাধী করে তুলেছে। নিজেকে মনে হয়েছে একাকী, নিঃসঙ্গ।
মেয়ে হয়ে জন্মানোতে তাকে অনেক কিছুই চাপা দিয়ে রাখতে হয়েছে। সমাজই তাকে শিখিয়েছে, এসব চেপে রাখতে হয়। তার ভাল লাগা, মন্দ লাগা তার হাতে নেই, আছে সমাজের হাতে। এমন কি তার উপর পুরুষদের চাপিয়ে দেয়া হস্তক্ষেপও তাকে চেপে রাখতে হয়েছে। মেয়ে হয়ে সে ধীরে ধীরে জানতে পেরেছে কৌশলই মেয়েদের টিকে থাকার অস্ত্র। ছেলেদের অস্ত্র হোল দৈহিক শক্তি, তাদের কৌশলী বুদ্ধি নেই। বোকা পুরুষদের দৈহিক শক্তিকে মেয়েরা বুদ্ধি দিয়ে বশে আনতে পারে, এমন কি পুরুষদের দৈহিক শক্তি কাজে লাগিয়ে তারা অন্য অবাঞ্ছিত পুরুষদের প্রতিহতও করতে পারে। বোকা পুরুষেরা ভাবে অন্য পুরুষদের কু-নজর থেকে তারা তাদের নারীদের রক্ষা করছে কিন্তু নারীরা জানে কু-নজরকারী পুরুষদেরই বশে আনাটা খুব সহজ এবং এটা তারা উপভোগই করে!
--- তো, এই যে তুমি আমার পাশে বসে আছ..... এই তুমি কি আসল তুমি নও?
সরলতা হাসতে হাসতে সৈকতের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
সৈকতের সাথে মাস খানেক হোল তার পরিচয়। খুব ভোর বেলায় আফতাব নগরের এই অংশের নিরিবিলি অনেকটা গ্রামীণ রাস্তায় অনেক প্রাতঃ ভ্রমণকারীরাই হাঁটতে আসে। তারা দু'জনাই এই প্রাতঃ ভ্রমণকারী দলের সদস্য। ভ্রমণ শেষে টং দোকানে চা খেতে খেতে তাদের পরিচয়। সব সময় অন্যমনস্ক সৈকতের চোখের ভাবালুতা সরলতাকে আকর্ষণ করে। তারপর থেকে দুজনই দুজনার ভ্রমণ সঙ্গী। হাঁটতে হাঁটতে টুক টাক কথাবার্তা দুজনকে কাছাকাছি নিয়ে আসে।
সৈকতের অদ্ভুতুড়ে ভাবনা গুলোয় সরলতা মজা পায়, তাকে ভাবিয়েও তোলে। কখনো কখনো পাশাপাশি নিঃশব্দ হেটে চলাও ভাল লাগে। নিঃশব্দতার ইথারে কি এক অনুভূতি সরলতার মনে সঞ্চারিত হতে থাকে। সেই অনুভূতির ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না, সৈকতকে চিনেও চেনা যায় না। হাঁটতে হাঁটতে হঠাত কখনো কখনো সৈকত সরলতার হাত ধরে এগুতে থাকে। নিঃস্পৃহ সেই স্পর্শের অনুভূতি সরলতাকে গ্রাস করে ফেলে, সে হাত সরাতে পারে না! আবার কখনো ঘাম চুয়ে পড়া চুলের সুতো চোখের উপর থেকে আলতো স্পর্শে সরিয়ে দেয়, যার ভাষা বুঝা খুবই কঠিন। সৈকতের কাছে যেন সম্পর্কের কোন অর্থ নেই। কিন্তু প্রতিটি স্পর্শ সরলতাকে আপনত্মের গভীর থেকে গভীরতায় নিয়ে যায়।
পুরুষের স্পর্শের ভাষা বুঝতে পারা সরলতার পক্ষে খুবই সহজ। প্রতিটি নারীই তা পারে। মেয়েবেলা থেকেই এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। খালু ফুফা জাতীয় পুরুষদের কোলে নিয়ে স্নেহের স্পর্শের ভাষা তাদের অজানা নয়। এই স্পর্শ যে তাদের খারাপ লাগে তা নয়, অনেক সময় উপভোগও করে। অনেক সময় নিজেরাই স্ব প্রণোদিত হয়ে সম্পর্কিত বড় ভাইদের কোলে চড়ে বসে! এইসব অযাচিত স্পর্শ বাল্যকালে যে যৌনতার অনুভূতি জাগায় সেটাই বড় কালের পাথেয়। এর বিপরীতে বাবা মায়ের অতিরিক্ত শাসন এবং পাপবোধ বাল্যকালে যৌনতা সম্পর্কে এক ভীতিকর ধারণা দেয়, যা পরবর্তীতে বিবাহিত জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই অসুখকর সম্পর্কের জন্য দায়ী। সরলতা তার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই এসব দেখেছে। কিন্তু সৈকতের স্পর্শের ভাষা সরলতা বুঝতে পারে না।
সরলতার প্রশ্নের জবাবে কিছুক্ষণ চুপ থেকে অনেকটা স্বদোক্তির মতো সৈকত বলতে থাকে--- তোমার কাছে আমি আমার সম্পূর্ণটুকু নই। ইনফ্যাক্ট, মানুষের কাছে মানুষের শুধু খণ্ডিত অংশই প্রকাশ পায়। তোমার কাছে আমার পরিচয় একজন বিবাহিত ভদ্রলোক হিসেবে। অবশ্য বন্ধু হিসেবে তুমি পরিচয়ের আর একটু ভিতরে প্রবেশ করেছ।
---- আর তোমার কাছে আমার পরিচয়? সরলতা পাল্টা প্রশ্ন করে।
--- আমার কাছে তোমার পরিচয় একজন বিবাহিতা লিবারেল ভদ্রমহিলা হিসেবে। অবশ্য 'বিবাহিতা', 'লিবারেল', 'ভদ্রমহিলা' এই সংজ্ঞাগুলো সমাজই দিয়েছে এবং আমাদের পরস্পরের প্রতি আচরণও এই সংজ্ঞায় নির্ধারিত রয়েছে। এভাবে সমাজ মানুষকে খণ্ড খণ্ড ভাবে উপস্থাপন করে।
--- তাহলে তোমার কাছে আমি শুধু একজন ভদ্র মহিলা মাত্র? সরলতার কণ্ঠে কিছুটা উষ্মা প্রকাশ পেল যেন।
--- সমাজ এর বেশী কিছু স্বীকার করবে না। তবে আমার কাছে তুমি একজন ভাল বন্ধু।
--- বন্ধু? ঠিক বলেছ, আমিও তোমাকে বন্ধু মনে করি। তোমার কাছে যা প্রকাশ করতে পারি এমন কি আমার স্বামীর কাছেও সেটা পারিনা।
--- 'স্বামী' 'স্ত্রী' সংজ্ঞাটাও সমাজ প্রদত্ত। তোমরা দু'জন পরস্পরের সম্পত্তি। নির্ধারিত কর্তব্যের বাইরে তোমরা যেতে পার না। লাগামহীন বন্ধুত্ব তোমাদের সম্পত্তি সম্পর্ককে আঘাত করতে পারে। তাই এই সম্পর্কে অধিকাংশ দম্পতিই বন্ধু হতে পারে না। এমন কি বিবাহপূর্ব সকল বন্ধুত্বকেও খারিজ করে দিতে হয়।
--- বিবাহ একটি বন্ধন, একটি নিরাপত্তা। যার আশ্রয়ে আমার সন্তানেরা বেড়ে উঠে। সবার উপরে আমি একজন মা!
সৈকতের মুখে যেন একটা হাসির আভাষ ফুটে উঠল--- তাহলে তুমি কোথায়?
--- আমি?
সরলতা প্রশ্নটির এপিঠ ওপিঠ উলটে পালটে দেখার চেষ্টা করল। মেয়েবেলার কয়েকটি বছর ছাড়া আর কোথায়ও নিজেকে খুঁজে পেল না। তখনো পরিবার ও সমাজের অনুশাসন অনুধাবন করতে শিখেনি। তার শৈশবটা কেটেছে গ্রামে। শহরের বান্ধবীদের তুলনায় তার স্বাধীনতা একটু বেশিই ছিল। খেলার সাথিদের সাথে হৈ হুল্লুর করে বনে বাদারে ঘুরে বেড়ানোতে তাকে বিরত রাখা যায়নি। সে ছিল তার আপন জগতে, নিজের মতো করে। প্রাণবন্ত উচ্ছলতায় ভরপুর এক কিশোরী। সে ছিল তার দলের রানী। সেই রাজত্বের ভাষা ছিল ভিন্ন, আচার আচরণ আলাদা। সেই জীবন বড্ড বেশী বানর ঘেঁষা! কথাটা ভাবতেই সরলতার হাসি পেয়ে গেল। তার দাদী প্রায়শই তাদের বান্দরের দল বলে তাড়া করত।
সরলতা ভেবে দেখল, আসলেই তারা বাঁদর ছিল। বড় হতে শুরু করে তারা মানুষ হতে থাকে এবং নিজের ব্যক্তিসত্তা হাড়িয়ে ফেলে।
বিবাহের পর সে হোল স্ত্রী, বৌমা, তারপর মা এবং একজন পরিপূর্ণ গৃহিণী। তার জীবন আটকে গেল কিছু চরিত্রে, একটি সীমিত গণ্ডির সীমানায়। সেই থেকে একজন সার্থক অভিনেত্রীর মত একই সাথে বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছে। অভিনয় এই জন্য যে তার ভিতরের বাঁদর প্রকৃতি, তার আসল রূপ সে সবার কাছে আড়াল করে রেখেছে।
স্বামীর সাথে রাতের বিছানায় তার যে রূপ তাতে স্বামী সন্তুষ্ট। কিন্তু সম্ভোগের সময় সে যে কিশোরী বয়সের সাথী রনবিরের সাথে প্রণয়ের দৃশ্য কল্পনা করে শিহরিত হচ্ছে সে খবর তার স্বামী জানে না। সন্তানের কাছে সে স্নেহময়ী মা, দেবীতুল্য। সমস্ত ধরণের পঙ্কিলতার ঊর্ধ্বে। এই দেবীর রাতের অশ্লীল শীৎকারের চিত্র কল্পনায়ও আনা যায় না। সে যে প্রতিদিন প্রাতঃ ভ্রমণে এসে সৈকতের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে সে খবর স্বামী বা সন্তান কেহই জানে না। সে একই সাথে বিভিন্ন চরিত্রে বিভিন্ন ভাবে অভিনয় করে যাচ্ছে। তার ভিতরের বাঁদর চরিত্রের খবর কেউ জানছে না, সেও জানতে দিচ্ছে না। সেখানে সে একা নিঃসঙ্গ।
সরলতা সৈকতের প্রশ্নের জবাব পেয়ে যায়। কিছুটা লজ্জাতুর কণ্ঠে জবাব দেয়--- আমার আমি আছি লুকিয়ে, আমার বানর প্রকৃতির মাঝে!
সৈকত পরিপূর্ণ চোখে সরলতাকে তাকিয়ে দেখল। ধরা পরে যাওয়া রক্তিম মুখ নিয়ে সরলতা আঁচলের কোণা কাটছে।
--- শুধু তুমি নও। সকলেই তাদের বাঁদর প্রকৃতিকে অর্থাৎ নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে সমাজ প্রদত্ত মুখোশের আড়ালে।
নিগুড় সত্যকে আবিষ্কার করে দুজনেই চুপ হয়ে যায়। চুপ চাপ হাঁটতে হাঁটতে তারা একদম পূবের সীমানায় চলে এসেছে। সেখান থেকে উঁচু জমি অনেকটা ঢালু হয়ে দূর দূরান্তে নেমে গেছে। মাঠের পর মাঠ ধান ক্ষেত ভোরের কুয়াশার আড়ালে অদৃশ্য। অদৃশ্য উদীয়মান সূর্যের আভায় ধূসর সোনালী ঊষা চৌক আলের জলে গলিত রুপা ঢেলে দিয়েছে। এখানে সেখানে দুই একটা ধ্যানমগ্ন ধবল বক এক পায়ে ঠায় বসে আছে। কিছুটা দূরে জল কাদা ছাপিয়ে গাছ গাছালী ঢাকা একটি উঁচু ঢিবি। আড়ালে একটি কুঁড়ে ঘরের চাল বেয়ে সাদাটে ধুয়া যেন নাইয়র ছেড়ে চলে যাওয়া নব বধূর বেদনা বিধুর ধীর পদক্ষেপ। এক পাশে একটি সাদা কালো গাভী হাম্বা হাম্বা রবে নীরবতার বুকে শব্দের জাবর কাটছে। এই সবকিছুর আড়ালে এক মানব মানবীর ঘরকন্নার কল্পনা করা যায়। নিকানো মেঝেতে এক উদোম মানব শিশু হামাগুড়ি দিচ্ছে, হাসছে, খেলছে। এখানে তাদের সামাজিক পরিচয়ের কোন প্রয়োজন নেই। যেমন বকগুলো জানে না কি তাদের সামাজিক পরিচয়। গাভী জানে না, জানেনা গাছ গাছালী। সময়ের রীল যদি পিছনের দিকে চালিয়ে দেই তাহলে স্বল্প বসনা এই মানব মানবীর এই বসন গুলোও ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাবে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ মানব মানবী ও একটি শিশু জানেনা কি তাদের সম্পর্কের অর্থ। শুধু কি এক মায়ার বাঁধন তাদের বেঁধে রেখেছে, যা আদি ও অকৃত্রিম। যা শুধুই মানব মানবী ও শিশুর বন্ধন। যেমন চাঁদের বাঁধন পৃথিবীর সাথে, পৃথিবীর বাঁধন সূর্যের সাথে।
সৈকত ও সরলতা একদিকে শহরের সভ্যতা ও আর এক দিকে গ্রাম্যতার প্রান্ত সীমায় ঘাসের উপর বসে পরে। দীর্ঘ নীরবতার পর সৈকত বলে ---- মানুষের সাথে মানুষের বাঁধন একমাত্র স্পর্শের মাধ্যমে সম্ভব হয়ে উঠে।
সরলতা জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে সৈকত বলে যায়--- তুমি আমার কাছ থেকে দুই হাত দূরে বসে আছ। তোমার অবয়ব থেকে আলোর প্রতিফলন আমার চোখে আসতে সময়ের কয়েকটা মুহূর্ত পার হয়ে যায়। তাই আমার কাছে তুমি কয়েক মুহূর্তের অতীত! তোমার আর আমার স্থান ও কাল এক নয়। আমি তোমার অতীত প্রেতাত্মার সাথে কথা বলছি। তুমিও তাই। কিন্তু তুমি যদি আমাকে স্পর্শ কর তাহলে স্পর্শের স্থানটুকুতেই কেবলমাত্র স্থান ও কাল এক হয়ে বাঁধন সম্ভব হয়।
সরলতা যেন একটু ভয় পেয়ে যায়। কুয়াশা ঘেরা এই প্রান্তরে যতদূর চোখ যায় অন্য কোন মানুষ দেখা যাচ্ছে না। সৈকতের দিকে আড় চোখে চেয়ে বুঝার চেষ্টা করল, সত্যিই কি সে একটা প্রেতাত্মার সাথে বসে আছে?
সৈকত বলে যাচ্ছে---- এই যে তুমি আর আমি পাশাপাশি বসে আছি এর মধ্যে একটা দৈব ব্যাপারও রয়েছে।
--- কি রকম?
--- তোমার আমার এই সন্ধিক্ষণের পূর্বেও অনন্তকাল আর পরেও অনন্তকাল। অনন্তকালের একটি অতি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য কত মানুষ এই পৃথিবীতে এসেছে, আছে, আসবে, আবার কালের গর্ভে হাড়িয়ে যাবে। এই ক্ষুদ্র সময় ও স্থানের বাইরে কারো সাথে কারোর কখনো দেখা হবে না। এই পৃথিবীতে একটা অতি ক্ষুদ্র সময়ের জন্য আমরা এসেছি। অর্থাৎ এই পৃথিবীটা বেঁচে থাকা মানুষদের একটা মিলন স্থল। তোমার আর আমার এই মিলন সম্ভব হয়েছে কারণ দৈবক্রমে উভয়েরই স্থান ও কাল কাছাকাছি রয়েছে।
সরলতা চারিদিকে তাকিয়ে দেখে কুয়াশা আবৃত দৃষ্টি গোচরিভুক্ত এই স্বল্প পরিসরের স্থানটি যেন স্থান ও কালকে সংকুচিত করে শুধু তাদের দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। একই স্থান-কালের সন্ধিক্ষণ দুজনের মিলনকে সম্ভব করে তুলেছে।
--- কিন্তু এই মিলনের মর্মবাণী মানুষ অনুধাবন করতে পারে না..... সৈকত হতাশা জড়িত কণ্ঠে বলে চলে
--- এই পৃথিবীকে আমরা হিংসার কুরুক্ষেত্র বানিয়ে ছেড়েছি! মানুষের সাথে মানুষের ভালোবাসার চেয়ে হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিযোগিতাই মুখ্য হয়ে উঠেছে।
--- কেন এমন হোল?
সরলতার কণ্ঠেও যেন হতাশার সুর সঞ্চারিত হয়েছে।
--- কারণ সমাজ মানুষকে হাজারো খণ্ডে খণ্ডিত করে ফেলেছে। সব কিছুর এক একটা বিমূর্ত সংজ্ঞা দাঁড় করে মানুষকে বিভাজিত করেছে। নারী, পুরুষ, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, জাতি, গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, অঞ্চল, দেশ ইত্যাদি হাজারো খণ্ডে মানুষ বিভক্ত। এই বিভাজনের গণ্ডী পেরিয়ে মানুষের মিলন আর সম্ভব হয়ে উঠে না।
সৈকতের সহজ উত্তর। সবকিছু সহজভাবে ভাবার সহজাত স্বভাব সৈকতের রয়েছে। যদিও তার সংস্পর্শের সঙ্গী সাথীরা তার ভাবনার থই খুঁজে পেত না। সরলতার মত তারও বাল্যকাল বাঁদর স্বভাবের ছিল। সমাজের বিধি বিধান অমান্য করাই সেই বাঁদরদের কাজ। তার ভাষায়,
প্রতিদিন মসজিদে কায়দা পড়তে গিয়ে আমার বাল্য সাথীরা সুর করে পড়ত
-- আলিফ, বে, তেরছা
হুজুরের দাঁড়ি ধরে হেড়ছা !!
অথবা শুক্রবারে নামাজের শেষে প্রায়ই মিলাদ থাকত আর মিলাদের শেষে জিলাপির প্যাকেট পাওয়া যেত। দীর্ঘ মিলাদে বিরক্ত হয়ে ছেলের দল সুর করে পড়ত
-- ইয়া নবী ছালার ভিতর কি?
গরম গরম রসগোল্লা আর জিলাপি
ইয়া হুজুর কখঅঅন বিলাবি !!
রসগোল্লা আর গরম জিলাপি......।।
আমাদের দলের ধেড়ে বাঁদর ছিল শৈবাল।
শৈবাল বলতো---- চল ছোঁয়া ছুঁয়ি খেলি!
আমরা সবাই তৎক্ষণাৎ সায় দিয়ে হৈ হৈ করে উঠতাম। গোরা থেকে অনেক ডালপালা ছড়ানো একটি বয়স্ক আম গাছ ছিল আমাদের ছোঁয়া ছুঁয়ি খেলার মাঠ। সেখানে বাঁদরদের মত এক ডাল থেকে আর এক ডাল, এক শাখা থেকে আর এক শাখায় লাফিয়ে, ঝুলে, নাগর দোলা দুলে শৈবালকে ছুঁতে চেষ্টা করতাম।
রীতা বলতো--- চল দাঁতই গোটার ভর্তা খাব।
তখনি হৈ হৈ করে আমরা জঙ্গলের দিকে ছুটে যেতাম। সারা জঙ্গল চষে বেড়িয়ে আমরা পাকা দাঁতই গোটা সংগ্রহ করে নিয়ে আসতাম। রীতা ভর্তা বানিয়ে দিলে আমাদের আনন্দ আর দেখে কে?
বড়দের অনুকরণ করাও আমাদের খেলার অংশ ছিল। বড়দের নির্বাচনী মিছিল ছিল আমাদের খুবই প্রিয় একটা খেলা। হাতে ডাল পালার ব্যানার নিয়ে মিছিল করে পাড়ায় চক্কর দিয়ে বেড়াতাম--- মা বোনেদের বলে যাই
বাঁদর মার্কায় ভোট চাই।।
আর ছিল রান্না বান্না খেলা। শৈবাল বাঁজার করে আনত আর গৃহিণী হত রীতা। আমরা বাচ্চা কাচ্চারা রীতার কোলে শুয়ে দুদু খেতাম। রীতা জামার হাতাটা একটু নামিয়ে দিয়ে মা হয়ে উঠত।
আমাদের যৌন শিক্ষা হয়েছে বাঁদরদের গ্রুমিং-এর অনুকরণে। এই খেলার নাম ছিল চিদ্দি চিদ্দি খেলা। এর বর্ণনায় আর নাই বা গেলাম! তবে আর একটি খেলার নাম ছিল পলান্তি পলান্তি। শৈবাল আর রীতা লুকিয়ে পড়ত পাট ক্ষেতে। উঁচু উঁচু পাট ক্ষেতের জঙ্গলে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যেত না। আমরাও জোড়ায় জোড়ায় খুঁজতে বেড়িয়ে প্রায়ই একে অপরকে জড়িয়ে ধরতাম। তাতে ঠিকই একটা শিহরণ বয়ে যেত।
এই পলান্তি খেলতে গিয়ে রীতা একদিন সবাইকে লুকিয়ে আমাকে বৈঠকখানা ঘরে নিয়ে এলো। সেখান থেকে একটা বই নিয়ে প্রায় অন্ধকার দোতালায় উঠে এলো।
সে ফিস ফিস করে বলল---- শুন এটা নামাজ শিক্ষা বই। কিন্তু তার আগে তোকে সঠিকভাবে অজু করতে হবে।
আমি---- আমি অজু করা জানি।
--- চুপ গাধা! কি করলে অজু ভেঙে যায় জানিস?
আমি ফিক করে হেসে ফেললাম--- পাদ দিলে!
--- এক থাপ্পড় দিব ফাজলামি করলে। শোন এটা দিয়ে ওটা ঠেকালে অজু ভাঙ্গবে না।
আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।
--- বুঝলি না? তোরটা খোল!
বলে সে নিজেই আমারটা খুলে তারটাও খুলল।
---- দেখ, তোরটা আমার এখানে শুধু লাগালে অজু ভাঙ্গবে না।
আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম---- কখন ভাঙ্গবে তাহলে?
তখন সে ঘষতে ঘষতে বলল---- এরপর এটা দিয়ে যদি মনি বের হয় তবেই অজু ভাঙ্গবে।
আমি--- মনি কি?
সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে-- ধেৎ গাধা। তোকে দিয়ে হবে না!
খেলাটা আমার ভালই লেগেছিল। তারপর আমি নিজেই বৈঠকখানা থেকে ওই ধরণের বই পড়ে অনেক কিছু জেনেছিলাম। আর তখন থেকেই বড়দের গোপন জগত সম্পর্কে আমার একটা ধারণা হয়েছিল। বড়দের দুটি জগত রয়েছে, প্রকাশ্য জগত আর গোপন জগত। বাঁদর স্বভাবটা থাকে গোপন, তাই বাইরের আচরণ দিয়ে তাদের চেনা যায় না।
কথায় কথায় সৈকত সরলতার কাছে অনেক কিছুই প্রকাশ করেছিল। নিজের মনকে এভাবে উলঙ্গ করে দেখাতে গিয়ে যেন কালিমার বোঝা হালকা হয়ে যাচ্ছিল। নিজের অনুভূতিগুলো এভাবে উলঙ্গ করে দেখানোর আকাঙ্ক্ষা ইউরোপে অভিব্যক্তিবাদী দর্শনের জন্ম দিয়েছিল। নিটচসে ছিলেন তাদের একজন।
--- মানুষের সামাজিক মুখোশগুলো একে একে সরিয়ে ফেললে থাকে শুধু খাওয়া, ঘুমানো ও যৌনতা। খাদ্য সংগ্রহের তাগিদ থেকে মানুষ অনুসন্ধানী হয়ে উঠে। যৌন আকাঙ্ক্ষা ও যৌন হিংসা থেকে জন্ম নেয় পরিবার, সমাজ, যুদ্ধ, আধিপত্য বিস্তারের ক্রূরতা।
সরলতা মনে মনে সৈকতের দার্শনিক কথাবার্তাগুলো অনুধাবনের চেষ্টা করল। চেষ্টা করল নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার। তার পরিচয়, তার ভাষা, সমাজ থেকে প্রাপ্ত সবকিছু গায়ের অলংকারের মত একে একে খুলে নিলো। সে কল্পনায় নিজেকে দেখতে পেল কুঁড়ে ঘরের সেই উলঙ্গ নারীর মাঝে। পরম মমতায় শিশুটিকে তার নগ্ন বুকে তুলে নিলে শিশুটির স্তন পান তার দেহ মনে শিশুটির সাথে একটা তীব্র একাত্মবোধ জাগ্রত করে। পুরুষটি যখন তার পাশে এসে বসে তখন মেঝের পাশে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের উষ্ণতায় সমগ্র কুটীরটিকেই একাত্মতা জড়িয়ে রাখে। এই একাত্মবোধ যে পরিবারের জন্ম দিয়েছে সেই সচেতনতা তাদের নেই। কোন মন্ত্র নেই, কোন ধর্ম নেই, নেই কোন পাপ পুণ্যের হিসেব নিকেশ, এই একাত্মবোধে আছে শুধু মানবতা!
গ্রামীণ এই প্রান্তরে কুয়াশা যেন আরও জেঁকে বসেছে। আশে পাশের ঘাসের ডগা রুপালী আভায় চিক চিক, ক্রমশ দূরে দিগন্তের সাদা চাদরে মিশে গেছে। পাশের ক্ষেতে মিষ্টি কুমড়ার জাংলায় বড় বড় সবুজ পাতায় শিরা উপশিরার সাদা নকশা আঁকা। একটি দুটি গেরুয়া রঙের ফুল এখানে সেখানে ফুটে আছে। কিছু দূরে খড়ের গাঁদার উপরে বাঁশের কঞ্চীর আগায় একটি কালো ফিঙ্গে উড়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। তারও নীচে আউশ ক্ষেতে ধান কাটার পর রয়ে যাওয়া নাড়ায় আগুন দেয়ার পর পুরো ক্ষেতটি কালো ছাইয়ে কলঙ্কিত। স্থানে স্থানে নাড়ার স্তূপ থেকে এখনও সাদা ধুঁয়া উঠছে। সাথে একটা পোড়া উষ্ণ গন্ধ চারিদিকের কুয়াশা ঢাকা জন মানবহীন বদ্ধ পরিসরকে আদিম উত্তেজনায় নেশাগ্রস্থ করে তুলেছে। সৈকত আলতোভাবে তার হাতে সরলতার হাত তুলে নিলো। সরলতা জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাতে সৈকতের চোখে নেশাগ্রস্থ মোহাচ্ছন্নতা দেখতে পেল। ফিস ফিস করে বলল--- আস নগ্ন হই!
সৈকত উঠে দাঁড়িয়ে সরলতাকে এখনও উষ্ণ আউশ ক্ষেতের পাশে নিয়ে এলো। খড়ের গাঁদায় গা এলিয়ে দুজন মানব মানবী পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল। আশ্চর্য ভাবে দুটি দেহের প্রতিটি খাঁজ মিলে মিশে একাকার। দুটি দেহ ও মনের মাঝে স্থান ও কালের কোন দূরত্বই আর রইলো না! একটি পরা বাস্তব দৃশ্যের মধ্যে দুজনে হারিয়ে গেল। নিটচসের ভাষায় মানব জন্মের পিছনে কোন উদ্দেশ্য নাই। মানুষই তার নিজের উদ্দেশ্য নিজেই নির্মাণ করে।