ধীরে ধীরে কলকাতা যখন শহর হয়, তখন নাগরিক পরিষেবা বাড়ানো লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশদের । নাগরিক পরিষেবার মধ্যে অন্যতম ছিল পানীয় জল । এর জন্য কয়েকটি পুকুর কাটা হয়। হেঁদুয়া, ওয়েলিংটন স্কোয়ার, ভবানীপুরের পুকুর থেকে সে সময় জল সরবরাহ করা হতো । কিন্তু শহর যখন ক্রমশ বাড়তে শুরু করল, তখন জলের প্রয়োজনটাও বাড়ল ।
তৎকালীন পুর ইঞ্জিনিয়র মিস্টার ডেভেরাল একটি ট্যাঙ্ক (পড়ুন রিজর্ভর) তৈরির প্রস্তাব দেন । প্রস্তাবটি তৈরি করেছিলেন তাঁর সহকারি মিস্টার পিয়ার্স । প্রস্তাবের সঙ্গে সহমত হয় বেঙ্গল গভর্নমেন্টও । ১৯০১ সালের প্রস্তাব কর্পোরেশন গ্রহণ করে ১৯০২ সালে । এর ঠিক এক বছর পর এই প্রস্তাবে সামান্য অদলবদল আনেন পুরসভার নয়া নিযুক্ত ইঞ্জিনিয়র ডব্লু বি ম্যাকক্যাবে । তাতে প্রস্তাবিত অঙ্কের পরিমাণ বেড়ে হয় ৬৯ লক্ষ ১৭ হাজার ৮৭৪ টাকা । তবে আরও উন্নত জল পরিষেবা সম্ভব বলে তাতে সম্মত হয় পুরসভা ।
কিন্তু কোথায় হবে এই ওভারহেড ট্যাঙ্ক ? বেছে নেওয়া হয় টালাকেই । আজ টালা ট্যাঙ্ক যেখানে সেখানে তখন ছিল বেশ কয়েকটি পুকুর । ঠিক হয়, পুকুর বুজিয়ে গড়ে উঠবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ওভারহেড রিজর্ভর। ১১০ ফিট উঁচুতে । যেখান থেকে মাধ্যাকর্ষণের স্বাভাবিক নিয়মে জল পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হবে । অর্থাৎ বলা যেতেই পারে কলকাতাবাসীকে জল দিতে কয়েকটি পুকুরকে মাটি থেকে ১১০ ফুট উঁচুতে তুলে দিয়েছিল ব্রিটিশরা।
১৯০৯-এর ১৮ নভেম্বর টালা ট্যাঙ্ক নির্মাণের উদ্বোধন করেন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার এডওয়ার্ড বেকার । প্রথমেই শুরু হয় পুকুর বোজানো । পুকুরগুলিকে জলশূন্য করা হয়, চারদিকে শাল-বল্লার খুঁটি দিয়ে ২০-২৫ ফুট পাইল করে খোয়া দিয়ে ভর্তি করা হয় । ভারী স্টিম রোলার দিয়ে সমান করে তার ওপর খোয়া দিয়ে ৯ ইঞ্চি পুরু আরও একটি স্তর তৈরি করা হয় । এরপর আড়াই ফুট পুরু কংক্রিট সিমেন্টের ওপর ফ্ল্যাট স্টিল টাঁই-এর সঙ্গে বোল্ড স্টিল জয়েন্টের ওপর স্তম্ভগুলিকে দাঁড় করানো হয়।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য টালা ট্যাঙ্কের ফাউন্ডেশনের কাজটি করে টি সি মুখার্জি অ্যান্ড কোম্পানি । কংক্রিট ফাউন্ডেশনের কাজটি করেন স্যার রাজেন্দ্রলাল মুখার্জির মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানি । বাকি কাজ করে লিডসের ক্লেটন কোম্পানি । ১৯১১-র ১২ জানুয়ারি কাজ শেষ হয় এবং সে বছরের ১৬ মে থেকে এটি চালু করা হয় । ট্যাঙ্কটি তৈরি করতে খরচ হয় ২২ লক্ষ ২৫ হাজার ৪১ টাকা ।
এবার আসা যাক কয়েকটি খুঁটি নাটি বিষয়ে। টালা ট্যাঙ্ক বিশ্বের বৃহত্তম ওভারহেড রিজর্ভর। মাটি থেকে ১১০ ফুট উঁচু । মানে প্রায় ১০ তলা বাড়ির সমান । আয়তন ১ লক্ষ বর্গফুট । একটি ফুটবল মাঠ অনায়াসে ঢুকে যাবে। গভীরতা ১৬ ফুট। একটি দোতলা বাড়ি যেখানে ঢুকে যাবে । জলধারণ ক্ষমতা ৯ লক্ষ গ্যালন। যে পরিমাণ জল ধরে তার ওজন ৪০ হাজার টন এবং লোহার খাঁচাটির ওজন ৮ হাজার ৫০০ টন, ট্যাঙ্কে যে পাইপ দিয়ে জল ঢোকে বেরোয় সেই পাইপ ধরেই ।
বলা বাহুল্য, ট্যাঙ্কটি চারটি কম্পার্টমেন্টে বিভক্ত যাতে জল সরবরাহ বন্ধ না রেথেই এক বা একাধিক কম্পার্টমেন্ট পরিষ্কার বা সারাই করা যেতে পারে। টালা ট্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে বিশেষ গ্রেডের ইস্পাত দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান টালা ট্যাঙ্কে বোমা ফেলে । জাপানি বোমায় টালা ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়নি । তাতে ৯টা মাত্র ফুটো হয় । ১৯৬২ ও ১৯৭১-এর যুদ্ধেও যথাক্রমে চিন ও পাকিস্তানের টার্গেট ছিল টালা ট্যাঙ্ক ।
এমনই শক্তিমান এই বিশাল জলাধার।
তথ্য সহায়তা : সৌমিত্র দাস; ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত