আর মাত্র কয়েকটা বছর বাকি। কোন কিছু পাওয়ার জন্যে এই অপেক্ষা হলে এই কয়েক বছরটা
অনেক বেশিই মনে হবে। কিন্তু যদি এই অপেক্ষাটা হয় মৃত্যুর জন্যে ? তাহলে কয়েক বছর সময়টা খুব কমই। রাফসান জানে যেই রোগটা ওর শরীরে বাঁধা বেঁধেছে এই কয়েক বছরে আস্তে আস্তে ওটা এখন বেশ পাকাপোক্তভাবেই ওর শরীরের প্রতিটি কোষ নিজের দখলে নিয়ে নিচ্ছে।
মাথাটা কেমন জানি করে এসব ভাবতে। সবকিছু মিথ্যে হয়ে যাবে ? ২১ বছর ধরে যেই স্বপ্নের ভিত্তিটা সে তৈরি করেছিল হটাৎ করেই ওটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে? আর ১.৫ বছর গেলেই নামের আগে ইঞ্জিনিয়ার লিখার সার্টিফিকেট পেয়ে যাওয়ার কথা তার।কিন্তু তাকে কি এই ১.৫ বছর সময় দেওয়া হবে?
নাকি তার আগেই তার নামের আগে প্রয়াত শব্দটা বসে যাবে ?
প্রতিদিন সকালে উঠে সবার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দেখে তার প্রচণ্ড হিংসে হয়। ভাইবোন সবাই অনেক মজা করছে।তাদের জীবনে কোন দুঃখ নেই।সেও ওদের সাথে মজায় যোগ দেয়। কিন্তু তারা যদি জানতো আর কদিন পরেই ওদের প্রিয় ভাইটা "নেই" হয়ে যাবে তারা হয়তো তখন তাকে ঘিরে বসে থাকতো।তাকে আকডে ধরে রাখতো যাতে তাদের ভাইকে কেউ কেডে নিতে না পারে। কিন্তু না! ওরা কিছুই জানে না।রাফসান চায়নি তার জন্যে ফ্যামিলির সবার জীবনই ধ্বংস হয়ে যাক।
সবাইকে না জালিয়ে সে একাই চলে যাক না! এতে ক্ষতির পরিমানটা কমই হবে। এখন থেকে সবাই কষ্ট না পেয়ে ও মরার পর তা পেলে ওটা সহ্য করার মতই হবে। এখন থেকে জানলে যতোটা পেত তার মতো নিষ্ঠুর না।
নিশ্চিত মৃত্যুর ক্যালেন্ডার উল্টাতে উল্টাতেও রাফসান থেমে থাকে না। যতদিন আছে সে অন্যে সবার মতো করে সবার মাঝে থাকতে চায়।কিন্তু কাউকে তার সাথে জডিয়ে ফেলতে চায়নি।তাইতো ভাইবোন থেকে নিজের বাঁধনটাও হাল্কা করে ফেলে।রাখেনি অনন্যার সাথে সম্পর্কটাও।
অনেক কষ্ট হয় অনন্যাকে ছাডা থাকতে।তারপরও শেষ মুহূর্তে নাটক
করে ব্রেক-আপটা করার দরকারই ছিল। না হয় অনন্যা তার মৃত্যুর পর
কষ্টটা সহ্য করতে পারতো না।এখন অনন্যার মনে রাফসানের জন্যে
অনেকখানি ঘৃণা। রাফসান জানে অনন্যা তাকে আর কখনো ফোন দিবে না।
তাকে মিস করলেও যখনই রাফসানকে কল দেওয়ার জন্যে ফোন হাতে নিবে তখন শেষ মুহূর্তে
রাফসানের শেষ ব্যবহার আর ধোঁকার কথা মনে পডে গেলেই ফোন থেকে হাত পিছলে যাবে।এটাই রাফসান ছেয়েছিল।
কিন্তু তারপরও রাফসানের খুব জানতে ইচ্ছে করে ও মরার পর নিশ্চয়ই অনন্যা জেনে যাবে
রাফসান শেষ পর্যন্ত তার সেই "ভালো ছেলেটি"ই ছিল, শুধু অনাগত ভবিষ্যতে তার কষ্টটুকু কমিয়ে দেওয়ার জন্যেই মিথ্যের আশ্রয়টা তাকে নিতে হয়েছিল।
রাফসানের খুব ইচ্ছে করে মৃত্যুর পরও যদি সবকিছু সে দেখতে পেতো। অস্তিত্বহীন জীবন নিয়েও সে যদি সবার মাঝে বেঁচে থাকতে পারতো ! হয়তো বন্ধুদের আড্ডায় তার উপস্তিতি অন্য কেউ বুঝত না, কিন্তু সে তো সবার আবেগ অনুভব করতে পারতো ! রাফসান ভালো করেই জানে, তার অনেক ইচ্ছের মত এই ইচ্ছেটাও অপূর্ণ থেকে যাবে।
রাফসান একটা ব্যান্ড দলের সাথে যুক্ত ছিল।মৃত্যু আর স্মৃতি নিয়ে "হারানো স্মৃতি" গানটার লিরিক্স যখন লিখে সে বন্ধুদের জানায় তখন বন্ধুরাও লিরিক্স দেখে মুগ্ধ হয়।হয়তো নিজের অনুভূতি থেকেই লেখা তাই গানটা এতো জীবন্ত হয়ে উঠে।
রাফসান এখন মৃত। সব দেখছে সে !! বাসা ভর্তি মানুষ। ছুটির সময় হল থেকে যখন বাসায় আসতো তখন বাসায় ঢুকেই এতো মানুষ দেখলে সে বুঝে যেতো কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে ভেতরে।কিন্তু এখন সে জানে এই অনুষ্ঠান তাকে শেষবারেরর মতো বিদায় জানানোর ! ঘরের কোনে কোনে তাকাল সে।একি ছোট চাচু চোখ মুছছে? ছোটবেলা থেকেই দেখে আসা চরম কঠিন মানুষটাও তার জন্যে কাঁদছে! ছোট বোনের রুমে গেলো সে।বোনের বিছানা ঘিরে আছে অনেক মানুষ। জ্ঞানহীন বোনকে দেখে তার বুকে মোচড দিয়ে উঠে।বারবার তাকে জডিয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করে "লক্ষ্মী বোন,প্লিজ কাঁদিস না।দেখিস আর কয়দিন পরই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।" কিন্তু ওর কথা ওর বোনটি শুনতে পায়না।রাফসানকে যেখানে শুইয়ে রাখা হয়েছে তার পাশেই মাটিতে বসে কাঁদছিল ছোট ভাই ইশান। তার কাছে যায় রাফসান। কাঁধে হাত দিয়ে বলে,"ধুর পাগল! তুই ও মেয়েদের মতো কাঁদতেছিস ক্যান? তুই এরকম করলে মা-বাবাকে কে দেখবে? প্লীজ ভাই কাঁদিস না। আমি তো নেই,তোর মাঝে এখন মা-বাবা আমার ছায়া খুজে বেডাবে। ওদের একটু দেখে রাখিস ! ইশান আমার গিটার ল্যাপটপ এসবে ভাগ বসাতে সবসময় তোর সাথে ঝগড়া লেগেই ছিল মনে আছে? এখন সব তোর নামে লিখে দিলাম।।কান্না থামা ইশান !!"
হায় ! কেউ তার কথা শুনছে না। সবাই কেঁদেই যাচ্ছে।আবার রাফসান তাকে যেখানে শুইয়ে রাখা হয়েছে ওখানে গিয়ে বসে।চারপাশে তাকে ঘিরে কোরআন শরীফ পডছে মাদ্রাসার ছোট ভাইরা। হটাত বাবা, ছোট চাচু আর মামারা সবাই একসাথে রুমে ঢুকল।
একি ! ওরা আমাকে কাঁধে তুলে নিচ্ছে কেন? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বাবা আমি কোথাও যাবো না। প্লিজ বাবা !!
মামা-চাচা-বাবাদের কাঁধে চডে যখন আজানা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে তাকে নেয়া হচ্ছিল তখন বাসার গেট থেকে বের হওয়া মাত্রই কালো গাডিটা দেখতে পায় রাফসান।হ্যা! অনন্যাদের গাডিই তো এটা! কিন্তু ও এখানে কি করছে? ভেতরে উকি দিতে চাইলো রাফসান। মাথা নিচু করে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে অনন্যা অঝোরে কাঁদছে! গাডি কালো কাঁচে ঘেরা থাকায় কেউ অনন্যার কান্না না দেখলেও রাফসান ঠিকই দেখতে পায় সব।
খুব কষ্ট হচ্ছে তার।এই মেয়ের চোখে কখনো কান্না না দেখার জন্যে সে অনেক কিছু করেছে। সারাদিন অনন্যাকে খুশি রাখতে তার কতোই না চেষ্টা ছিল! অনান্যা কি আজ তার জন্যে কিছুই করতে পারবেনা? লাফ দিয়ে নেমে গাডির কাচে গিয়ে সে চিৎকার করে বলে,
"please ananna stop crying.
i'm scared...i dont know where they are taking me! they are taking me far far away from you...please ananna tell them to stop this.।..i'm always with you dear! i'm always here for you"
নির্জন এক জায়গায় এসে থামলো সবাই।চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা।কেমন ভুতুডে একটা পরিবেশ। সবাই থাকায় এখনো ভয় পাচ্ছে না রাফসান।কিন্তু সে বুঝতে
পারছে না তারা এখন কি করবে?
বাবা ! অন্ধকার জায়গাটায় আমাকে রেখে তোমরা চলে গেলা কেন বাবা? বাবা প্লীজ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও।আমি সেই লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে থাকবো।
মা আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।প্লিজ মামাদের বলো আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে। মা আমি এখানে থাকবো না। প্লীজ মা! আমি আরও কয়েকদিন তোমার কোলে ঘুমাতে চায় মা! নাহ তার কোন আবদারই আর কারো কানে যাচ্ছে না। বড্ড অভিমান হয় তার।রাফসান স্পষ্ট শুনতে পায় তারই গাওয়া "হারানো স্মৃতি" গানটা অনেকদূর থেকে ভেসে আসছে।
সেও ঠোঁট মেলায় "হারাতে চায়নি তবুও হারাবো বলে মনে হচ্ছে. . ."
উৎসর্গ - ক্যান্সার আক্রান্ত সেই মানুষগুলো যারা নিষ্ঠুর ভাবে হিসেব কষে কষে মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে! রাফসানদের বেঁচে থাকার আকুতি হয়তো মিথ্যে হয়ে যায়।কিন্তু আমরা অনেক রাফসানই ফ্রিতে পাওয়া জীবনটা নিয়ে হতাশায় ভুগে
শেষ হয়ে যেতে চাই।মাদকের মাঝে খুজে ফিরি আমাদের অস্তিত্ব।কিন্তু একবার রাফসানের জায়গায় ভেবে দেখুন আপনাকে! মাদকের দখলে থাকা আমাদের আত্মাটা এভাবেই হয়তো রাফসানের মতো বেঁচে থাকার জন্যে আর্তনাদ করে যায়।কিন্তু
আমরা শুনতে পায়না!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



