অফিসের কাজে ২০১০ সালের শেষ নাগাদ বেশ কিছুদিন খুলনায় অবস্থান করেছিলাম। ঐ সময় আমার অফিসিয়াল এক বন্ধু বললেন, মাহবুব ভাই চলেন এলএলবি তে ভর্তি হই। কালকে ভর্তির লাস্ট ডেট। তাঁর কথায় কেন যেন মনটা খুব সাড়া দিল। সাথে সাথে কাগজপত্র নিয়ে খুলনা সিটি ল কলেজে চলে গেলাম ও ভর্তি হলাম। কিন্তু আমার ঐ বন্ধুটির সাক্ষাত পেলাম না। অনেকবার ফোন করেও তাকে পেলাম না। কি আর করা, বোকার মত একা একা ভর্তি হয়ে চলে এলাম। যদিও তিনি পরে ভর্তি হয়েছিলেন। এরপর স্থায়ীভাবে ঢাকায় অবস্থান করি। খুলনা তেমন যাই না বললেই চলে। ভর্তি হওয়ার পরে এলএলবি'র কোন বইও কেনা হয়নি। এক বছরের অধিক হলো পরীক্ষা বা পড়ালেখার ব্যাপারে কোন খোজ খবর রাখিনা। বউ সবসময় আমাকে বই কেনা ও পড়ার তাগিদ দেয়, যদিও তার স্বামী উকালতি করে তার ভরণপোষন করুক এটা সে মনে প্রাণে চায় না। হয়তোবা তাঁর স্বামী উকালতিও করতেও পারে এই গর্ব নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে চায়।
২০১২ ফেব্রুয়ারীতে আচমকা জানতে পারি যে এলএলবি-২০১১ এর পরীক্ষার্থীদের ফর্ম পুরণের আর মাত্র ৫ দিন বাকী আছে। সাথে সাথে খুলনা সিটি ল কলেজের একজন কর্মকর্তাকে ফোন করে নিশ্চিত হলাম। খুলনাতে অবস্থানরত আমার এক কলিগকে দিয়ে ফরম পূরণ করাই। তারপর বউকে সাথে নিয়ে নিলক্ষেত থেকে এলএলবির একটি গাইড বই ও দুইটা সাজেশনস কিনে আনি। তবে বই বা সাজেশন তখনো উল্টে পাল্টে দেখার তেমন ইচ্ছা জাগেনি। মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে হঠাৎ জানতে পারলাম যে, পরীক্ষা শুরু আগামী ৬ই এপ্রিল ২০১২ থেকে চলবে ১৮ই মে ২০১২ পর্যন্ত। প্রত্যেক শুক্রবার পরীক্ষা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েব সাইট থেকে পরীক্ষার রুটিনটি ডাউনলোড করে বউকে দেখালাম। বউতো রাগে গরগর, কেন তারপরেও আমি বই পড়ছি না এটাই নিয়েই তার মাথাব্যাথা। বললাম, আচ্ছা আমি কিন্তু পাশ করে উকালতি করবো, বউ তাতে বাগরা দেয়। বলে, না তোমার উকিল হতে হবে না, শুধু পাশ করলেই হবে।
শেষমেশ একটু আধটু পড়া শুরু করি। গাইড বইটাকে কেটে কেটে সাবজেক্ট গুলো আলাদা আলাদা করি। কিন্তু মোট ভাগ হলো ৯টা, যেখানে হবার কথা ৭টা। বুঝতেই পারছেন যে, কি ছাত্র সাবজেক্ট সম্পর্কেও ধারণা নেই। যাহোক পরে খুজে পেলাম যে, কনট্রাক্ট আইন ও টর্ট আইন মিলে একটি সাবজেক্ট এবং ইকুটি ট্রাস্ট আইন ও হিন্দু আইন মিলে একটি সাবজেক্ট হবে, যেখানে আমি সেগুলি আলাদা আলাদা করে ভেবেছিলাম। এবার পড়ার পালা ও পরীক্ষার চুড়ান্ত প্রস্তুতির পর্ব। একদিকে চাকুরী, আরেকদিকে লেখাপড়া ও অন্যদিকে বউ। সবগুলোকে সমন্বয় করা কতটা কঠিন তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তবে আমি এখানে সফলই বলা যাবে। অফিস আমাকে প্রত্যোক বুধ ও বৃহষ্পতিবার ছুটি মঞ্জুর করলো যতদিননা পরীক্ষা শেষ হয়। ঝামেলা হলো পরীক্ষাগুলো দিতে হবে খুলনায় গিয়ে। কি আর করা, প্রত্যোক বৃহষ্পতিবার ভোরে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা হই এবং বিকালে পৌছাই। শুক্রবার পরীক্ষা শেষ করে গোপালগঞ্জ চলে আসি। একদিন বাড়ীতে থেকে শনিবার বিকালের বাসে ঢাকা এসে পৌছাই। এই নিয়মিত মাত্রারিক্ত জার্নিতে লাইফটা হচপস হবার উপক্রম। সামাল দিতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তারপরে আবার বউ আমার মাস্টারের মত দিনরাত শুধু পড়ার কথা বলতে বলতে কানে ঝি ঝি লাগিয়ে দিয়েছে। কি আর করা, বেচারাতো আমার ভালোর জন্যই বলে, এই ভেবে অনেক কষ্টের মধ্যেও শান্তি খুজে পাই। ৭টি পরীক্ষার ৫টি ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। আর মাত্র ২টা বাকি...ভাবতে ভালই লাগছে। বউয়ের অনুপ্রেরণা পরীক্ষাগুলো দিতে আমাকে বেশ উৎসাহ যুগাচ্ছে।
এবার মূল ঘটনায় আসি যার জন্য এতকিছু বলা, সেই আসল ঘটনাটাই এখনো বলা হলো না। গতরাত্রে আমার অনেক রাত পর্যন্ত পড়ার কথা ছিল, কারণ বউ আমাকে আইপিএলের খেলা দেখার সুযোগ দিয়েছে সেই শর্তে। যাহোক রাত্র ১১টার দিকে বউ আমাকে বললো আমি ঘুমতে গেলাম তুমি টিভি বন্ধ করে এস। আচ্ছা বলে সায় দিলাম ও বউকে মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমতে বললাম। বউ বলল, আজকে মশা নেই, মশারী না টাঙ্গালেও চলবে। আচ্ছা। রাত তখন প্রায় ১২টা বাজে। খেলা শেষ হলো। কোলকাতা নাইট রাইডারস জয়ী হলো। ভালই লাগলো খেলা দেখে। ভাবলাম একটু বালিশে মাথা রেখে, আবার উঠে পড়া শুরু করবো। মশারী বিহীন বিছানা। তেমন একটা মশা নেই। বালিশে মাথা রেখে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি কিছু বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ অনেক রাতে ঘুম ভাঙল মশার কামড়ে। বউয়েরও ঘুম ভাঙলো, বললাম মশারীটা টাঙ্গাতে পারবা, কোথায় কোথায় বাধতে হবে আমি খুজে পাই না। বউ বললো, থাক তুমি পড়তে বসো, মশারী টাঙ্গানো লাগবে না। আশ্চার্য, কিসের পড়া। উঠলাম না, ঘুমতে চেষ্টা করলাম কিন্তু মশা আমার রক্তে মনে হয় খুবই তুষ্ট হয়ে মুখ দাবাতে চেষ্টা করছে। বউ উঠে নামাজ আদায় করলো, আমাকেও তাগিদ দিল। আমি স্ট্যান্ড ফ্যানটাকে জোরে ছেড়ে শুয়ে পড়লাম, সারারাত না ঘুমানোর জেরে এমন ঘুম পেল যে এক ঘুমেই সকাল ৮টা বেজে গেল।
ঘুমথেকে জেগে বউকে বললাম, তুমি কেমন মানুষ বলতো! মশারী না টাঙ্গিয়ে আমার ঘুম হারাম করেছ ক্যান? বউ খুব ঠান্ডা মেজাজে উত্তর দিল, তাওতো তোমাকে একটু বই নিয়ে বসাতে পারলাম না। ও..তাহলে তুমি ইচ্ছে করেই এই কাজটা করেছ? তা নয়তো কি, বউ একটু ক্ষিপ্ত হয়ে বললো। খুব ভাল লাগলো বউয়ের এমন মাস্টারিপনার। বউকে হুমকি দিলাম যে এই ঘটনা আমি আজই স্যামহয়ারের সকল ব্লগারদের জানাবো। বউ বললেন যতক্ষণ এই ঘটনা লিখবা তার মধ্যে তোমার দুইটা প্রশ্ন পড়া হইয়া যাবে। উহ...আবারো বই পড়ার কথা! অফিসে চলে আসলাম। ভাবলাম ঘটনাটা সবাইকে জানিয়েই দেই। কারণ বই পড়া নিয়ে বউয়ের উদ্যোগে এমন একটি নির্ঘুম রাত হয়তো আর ফিরে আসবে না। এই স্মৃতিময় নিঘুমরাতটিকে স্মরণীয় করে রাখতে এতবড় ব্লগটি লিখে ফেললাম। আশাকরি আপনাদের ভাল লাগবে। ধন্যবাদ!#
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১২ বিকাল ৫:৪৪