জনগণের নজর অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে নিজেদের উদ্দেশ্যসাধন একটি রাষ্ট্রনীতি, যা স্বৈরশাসকদেরই বেশি পছন্দ। লালনের ভাস্কর্যঅপসারণের ঘটনায় সংস্কৃতির প্রতি যে-আগ্রাসন, তার তীব্র প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি এই দিকেও প্রতিবাদী সংস্কৃতিকর্মীদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি। গত বছর ঠিক এইভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিটি উঠেছিল। সে-দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি পদক্ষেপও নেয়নি। নিলে সম্প্রতি গ্রেফতারি পরোয়ানাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াতে পারত না মুজাহিদ। লালনের প্রতি অসম্মান বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতিকে অগ্রাহ্য করার সামিল। এর প্রতিবাদ না-করা কাপুরুষতা। গর্জে উঠুক বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি। সেই সঙ্গে এ-ও খেয়াল রাখতে হবে, কোনও অশুভ শক্তিই যেন এর ফায়দা লুটতে না-পারে। শোনা যাচ্ছে, ঘোষিত তারিখে ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভণ্ডুল করার জন্য নানারকম ষড়যন্ত্র চলছে।
যেখানে অপসারণ, সেখানেই লালনের ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনের দাবি উঠুক। তবে তার নির্মাতা মৃণাল হকই হবেন কিনা, তা নিয়ে ভাবার আছে। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিল্পী যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সস্তা লোহালক্কড়ের স্তূপ জড়ো করে তা ভাস্কর্য বলে চালিয়ে দিয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন, তখন শিক্ষক হত্যাকারী সালেহীনসহ ছাত্র শিবির ছিল তার সমর্থক। এ কথাও ভুললে চলবে না।
আমার পৈতৃক শহর নারায়াণগঞ্জে প্রথম প্রকাশ্য ভাস্কর্য লাকি ওসমানের 'বিদ্রোহী নজরুল'। চুনকা পৌর পাঠাগার ও মিলনায়তনের সামনে ভাস্কর্যটির মোড়ক-উন্মোচন করেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। এর জন্য কোনও বাণিজ্যিক স্পন্সর জোগাড় করতে হয়নি উদ্যোক্তাদের। ধাবমান ও শ্রুতি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর কর্মীরা নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থে সেটি দেশকে উপহার দিয়েছেন। ধর্মান্ধরা যেন নির্মাণকালে নজরুলের ভাস্কর্যটির কোনও প্রকার ক্ষতিসাধন করতে না-পারে, সে জন্য রাতজেগে পাহারাও দিয়েছিলেন তারা। প্রেসিরিলজ পাঠানোর পরও 'প্রথম আলো' সহ ঢাকার অনেক জাতীয় দৈনিক খবরটি ছাপায়নি। এমনকী কবি শামসুর রাহমান মোড়ক-উন্মোচন করার পরেও নয়।
আজকের প্রায় সব কাগজেই সংস্কৃতিকর্মীদের গতকালের দ্রোহের খবর প্রকাশিত হয়েছে। 'আমাদের সময়'এর প্রথম পৃষ্ঠায় শুধু মোল্লাদের খবর। তা-ও আবার সচিত্র।
প্রতিবাদের ফসল ঘরে তুলতে হলে ভাবতে হবে সব কিছুই। উত্তেজনায় নয়, যা করার করতে হবে লালনের প্রতি ভক্তি নিয়ে। লালনের গানের কয়েকটি কলি দিয়ে শেষ করছি এই পোস্ট :
এমন মানব জনম আর কি হবে
মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে
কত ভাগ্যের ফলে না জানি
মনরে পেয়েছে এই মানবতরণী
বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায়
যেন ভারা না ডোবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০০৮ সকাল ১১:৪৯