সিদ্দিক সালিকের ভাষ্যে ২৬ মার্চ, ১৯৭১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
২৫ মার্চ, ১৯৭১।
রাতে শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারেই আক্রান্ত হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর এদেশীয় দোসর আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের সশস্ত্র সহযোগিতায় শনাক্ত করা হল বুদ্ধিজীবীদের। অসংখ্য ছাত্র-জনতার পাশাপাশি ২৫ মার্চের নির্মমতার বলি হলেন তাঁরাও।
ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর রাতব্যাপী এই উন্মত্ততা যখন চলছিলো, তখন ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসকের সদর দফতরে উপস্থিত ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের জনসংযোগ অফিসার মেজর সিদ্দিক সালিক।
মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর এই তরুণ মেজর দেশে ফিরে ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ নামে একটি গ্রন্থ প্রনয়ণ করেন। স্মৃতিচারণমূলক সেই গ্রন্থটিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা ২৫ মার্চের বিবরণ পাই, মেজর সিদ্দিক সালিকের বর্ণনায় আবিষ্কার করি বিপরীত প্রেক্ষাপটের এক ২৬ মার্চকে। কেমন ছিল সিদ্দিক সালিকের দেখা ১৯৭১ সালের মার্চের সেই ২৬তম দিনটি?
“...২৬শে মার্চের সূর্য উদিত হবার আগেই সৈনিকরা তাদের মিশন সমাপ্তির রিপোর্ট প্রদান করলো। জেনারেল টিক্কা ভোর পাঁচটায় সোফা ছেড়ে উঠলেন এবং নিজের অফিসে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর রুমাল দিয়ে চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন। ভাল করে চারদিকে দেখে নিয়ে বললেন, ‘একটা মানুষও নেই!’ আমি তখন বারন্দায় দাঁড়িয়ে। তাঁর স্বগতোক্তি শুনে নিশ্চিত হবার জন্যে বাইরে দৃষ্টি ফেললাম। একটি মাত্র বেপথো কুকুর দেখতে পেলাম। পেছনের দুপায়ের মাঝে লেজ গুটিয়ে চোরের মত শহরের দিকে যাচ্ছে।
বেলা বাড়তেই ভুট্টোকে তাঁর হোটেল কক্ষ থেকে বের করে আনা হল এবং সেনাবাহিনীর প্রহরায় বিমান বন্দরে নিয়ে যাওয়া হল। ভুট্টো প্লেনে ওঠার আগে গত রাতে সেনাবাহিনীর কাজের প্রশংসা করে একটি সাধারণ মন্তব্য করলেন। সশস্ত্র প্রহরীদের প্রধান ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে বলেন, ‘আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ, পাকিস্তানকে রক্ষা করা গেছে।’ করাচী পৌঁছে তিনি এই উক্তির পুনরাবৃত্তি করেন।
যখন ভুট্টো এই আশাব্যঞ্জক মন্তব্য করেন তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গণকবরগুলো দেখছিলাম। পাঁচ থেকে পনের ব্যাসার্ধের তিনটি গর্ত দেখতে পেলাম। সেগুলো সদ্য তোলা মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। কোন অফিসারই মৃতের সংখ্যা প্রকাশ করতে চাইলো না। ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের চারপাশ দিয়ে আমি হাঁটতে শুরু করলাম। দূর থেকে মনে হয়েছিল, হামলার ফলে দুটি ভবনই মাটির সাথে মিশে গেছে। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হল, ইকবাল হলে মাত্র দুটি এবং জগন্নাথ হলে চারটি রকেট আঘাত হেনেছে। কক্ষগুলো বেশিরভাগই পুড়ে কয়লায় পরিণত হয়েছে কিন্তু দেয়াল অক্ষত আছে। কয়েক ডজন অর্ধদগ্ধ রাইফেল ও কিছু ছড়ানো ছিটনো কাগজ তখনো ধিকি ধিকি জ্বলছিল। ক্ষতির পরিমাণ ছিল নিদারুণ।
...বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বেরিয়ে আমি ঢাকা নগরীর প্রধান প্রধান রাজপথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়ালাম। নজরে এলো বিসদৃশ্য মৃতদেহসমূহ পড়ে আছে ফুটপাতের ওপর কিংবা কুণ্ডলী পাকানো অবস্থায় রাস্তার কোণে।
...শহর ঘুরে ফিরে দেখার পর আমি ধানমন্ডিতে মুজিবের বাড়িতে গেলাম। বাড়িটি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত, জনহীন। জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকাতে মনে হল- তন্ন তন্ন করে বাড়িতে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্টে রাখা প্রমাণ সাইজের একটি প্রতিকৃতি ছাড়া তেমন স্মরণযোগ্য কিছুই আমার চোখে পড়লো না। প্রতিকৃতির ফ্রেমটি জায়গায় জায়গায় ফেটে গেছে। কিন্তু ভাবমুর্তি রয়েছে অবিকল।
বাড়ির বাইরে গেটের মূল্যবান ডেকোরেশন নষ্ট হয়ে গেছে। মুজিবের শাসনের সময় আওয়ামী লীগাররা পিতলের প্লেটের উপর ছয় দফার প্রতিরূপ ছয়টি তারকাবিশিষ্ট প্লেট গেটে বসিয়ে দেয়। কিন্তু এখন গেটের কালো রডগুলো আছে মাত্র। রড সন্নিবেশের গর্তগুলোও দৃষ্টিগোচর হল। যে দ্রততার সাথে গৌরবোজ্জ্বল দীপ্তির বিকিরণ ঘটেছিল তত দ্রুততার সাথে সেটা মিলিয়ে গেল।
দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্যে আমি তাড়াতাড়ি ক্যান্টনম্যান্টে ফিরে এলাম। এখানকার পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্নতর দেখলাম। শহরের হৃদয়-বিদারক ঘটনা সামরিক বাহিনীর লোকজন এবং তাদের ওপর নির্ভরশীলদের স্নায়ুবিক অবস্থাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে। তাদের অনুভূতি এই রকম- দীর্ঘদিন পর ঝড় থেমেছে এবং দিগন্তকে নির্মল করে অবশেষে বয়ে গেছে। স্বস্তির সাথে গা এলিয়ে দিয়ে অফিসার মেসে অফিসাররা বসে গল্প করছে। কমলা লেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে ক্যাপ্টেন চৌধুরী বললেন, বাঙালিদের ভাল করে এবং ঠিকমত বাছাই করা হয়েছে, অন্তত একটি বংশধরের জন্যে তো বটেই। মেজর মালিক তার সঙ্গে যোগ দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ওরা শুধু শক্তির ভাষাকেই চেনে। ওদের ইতিহাসই এ কথা বলে।...”
সিদ্দিক সালিকের ভাষ্যানুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মধ্যাহ্নে মেজর মালিকের ধৃষ্টতাপূর্ণ উচ্চারণ অসারতায় পর্যবসিত হয় দ্রুতই। মার্চ থেকে ডিসেম্বর, মাত্র নয় মাসের ইতিহাসে প্রমাণিত হয় যে, অন্যায়ভাবে শক্তি প্রয়োগ করা হলে মুখ বুজে মেনে নেয়া তো নয়ই, বরং তার প্রত্যুত্তর বাঙালি বেশ ভালভাবেই দিতে সক্ষম।
কৃতজ্ঞতা: নিয়াজীর আত্মসমর্পণের দলিল, মাসুদুল হক
ছবি: সংগৃহীত
২২টি মন্তব্য ২২টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!
রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।
আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!
এই... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাঁচতে হয় নিজের কাছে!
চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু। লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা
২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন
নিউ ইয়র্কের পথে.... ২
Almost at half distance, on flight CX830.
পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১
হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন
সামুতে আপনার হিট কত?
প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন