তৃতীয় শ্রেণীর ফাইনাল দিয়েছি; এখন কাজ হলো, খামারে গরুছাগল দেখা আর বিকেলে ফুটবল খেলা। সাপ্তাহিক বাজারের দিন ছিলো, খেলায় ছেলেপেলে কম, বেলা ডোবার আগেই খেলা শেষ করে, গরুগুলোকে ঘরে নিচ্ছি; মেঠো পথ ধরে একটি কমবয়সী মহিলা আমাদের উ্ত্তর গ্রামের দিকে যাচ্ছেন, হাতে একটি পুটলী; আগে কখনো দেখনি, মোটামুটি ভালো কাপড়, পায়ে স্পন্জের স্যান্ডেল, হাতে ছাতা। আমি গরুগুলোকে ঘাস টাস দিয়ে, পানি টানি খাওয়ায়ে, ছাগলগুলোকে ঘরে নেয়ার সময় দেখি একটি মা-ছাগল তখনো মাঠে; উহাকে আনতে গিয়ে দেখি, মহিলা একই পথে ফিরে যাচ্ছেন; আমার পাশ দিয়ে যাবার সময়, আমাকে বললেন,
-শোন, তুমি কোন বাড়ীর ছেলে?
আমাদের বাড়ীটা এখান থেকে দেখা যায়, আমি হাতের ইশারায় দেখালাম; মনে হলো, উনি চিনেন। এরপর, উনি আমাকে বললেন,
-তুমি নাসের উল্লাহদের বাড়ী চেনো?
-হ্যাঁ, উনাদের বাড়ীটি চিনি, পাশেই আমাদের স্কুল।
-তুমি একটা কাজ করতে পার? নাসের উল্লাহ আমার বাবা, আমি শহরে (চট্টগ্রাম শহর) থাকি, মাকে দেখতে এসেছিলাম; বাড়ির কাছে গিয়ে দেখি, বাবা বাড়ির সামনে বসে আছেন; উনার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো নয়, আমি বাড়ী যাইনি; শহরে ফিরে যাচ্ছি; তুমি এই পুটলিটা আমার মাকে দিও।
-এখন সন্ধ্যা, আপনি কি বাস পাবেন? আমাদের বাড়ীতে থেকে যান।
-না, এই এলাকায় আমার থাকা নিষিদ্ধ; আমি বাস পাবো। বাড়ীতে বাবা থাকলে তুমি যেওনা।
উনি পুটলিটা খুলে ৩/৪ টা লজেন্স আমার হাতে দিলেন; পুটলিতে একখানা শাড়ী, একজোড়া স্যান্ডেল ও একটা কাগজের প্যাকেটে কিছু লজেন্স। পুটলিটা আমার হাতে দিয়ে উনি ট্রাংক রোডের দিকে চলে গেলেন। রাতে খাবার সময় ঘটনাটা আমি মাকে বললাম। মা বললেন, মেয়েটা আরো ২ গ্রাম দুরের এক বেবীট্যাক্সী ড্রাইবারের সাথে চলে গিয়েছিলো; ছেলেটা শহরে বেবীট্যাক্সী চালায়; কিন্তু শেষে মেয়েটাকে বিয়ে করেনি। গ্রামের লোকজন রটায়েছে, মেয়েটা দেহপসারিনী। আমি পরদিন ২ বার চেষ্টা করে, পুটলিটা মহিলার মায়ের কাছে পৌঁছায়ে দিলাম; মহিলার মা পুটলিটা হাতে নিয়ে কাঁদলেন; পুটলি খুলে, ভেতরে লজেন্স দেখে আমাকে দিতে যাচ্ছিলেন, আমি বললাম যে, উনার মেয়ে আমাকে দিয়েছেন; উনি ১ গ্লাস সরবত বানায়ে আমাকে দিলেন।
এরপর, বছর কেটে গেছে; সামনে চতুর্থ শ্রাণীর পরীক্ষা; স্কুলে ফুটবল খেলে দেরীতে বাড়ী ফিরছি; দুর থেকে দেখছি নাসের উল্লাদের বাড়ীর সামনে কয়েকজন লোক চীৎকার দিয়ে কথা বলছে, কয়েকজনের হাতে লাঠিসোঠা। বাড়ীর সামনে আসার পর দেখি; সেই গ্রামের কয়েকজন লোক একজন মহিলাকে টানাহেঁচড়া করে বাড়ী থেকে বের করছে। আমি কাছে গিয়ে দেখি, গত বছর আমার দেখা সেই মহিলা, নেসার উল্লাহ'এর মেয়ে; নেসার উল্লাহ'র বউ কাঁদছে। তাদের পাশের বাড়ীর এক লোক, হাতে লাঠি, সে মেয়েকে লাঠি দেখায়ে বলছে,
-তুই এখন গ্রাম চড়ে যা, না হয়, তোর পিঠের চামড়া থাকবে না।
আমি লোকটাকে লক্ষ্য করে চীৎকার করে বললাম,
-আপনি কি পেয়েছেন, গ্রাম কি আপনার? আপনি এখান থেকে যান, না হয় ভয়ংকর কিছু ঘটবে।
লোকটা মহিলাকে ফেলে আমার দিকে তেড়ে আসছিলো, আমি বইগুলো ছুঁড়ে ফেলে, তৈরি হলাম; বাকী লোকজন লোকটাকে থামালো। আমি মহিলাটির পেছনে পেছনে এলাম। মহিলা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আমাকে বললো,
-এসবের ভেতর আসা তোমার ঠিক হয়নি।
-এক'শ বার ঠিক হয়েছে, আমি বললাম।
মহিলা মেঠো পথ ধরে বাসের রাস্তার দিকে যাচ্ছেন; আমি খামার বাড়ী অবধি আসলাম উনার সাথে। আমি বললাম,
-আগামীতে আপনি আপনার মায়ের সাথে দেখা করতে আসলে, আমাদের খামারে আসবেন, আমি আপনার মাকে এখানে নিয়ে আসবো।
উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, ট্রাংক রোডের দিকে চলে গেলেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০২০ সকাল ৯:৪৩