আমি তখন ষষ্ট শ্রেণীতে; ধান কাটা হয়ে গেছে; ছুটির দিন, পড়ন্ত বেলা, আমি উঠানে বসে পিঠা খাচ্ছিলাম; বাড়ীর আংগিনা থেকে সুন্দর গলায় গজল ভেসে আসছে; মাদ্রাসার লোকজন চাঁদা নেয়ার জন্য এসেছেন। আমি একটি টুকরীতে ধান নিয়ে কাছারীর সামনে এলাম; গজল গাচ্ছে মাদ্রাসার এক ছাত্র, আমার বয়সী হবে, অনেক লম্বা, দরিদ্র কাপড়চোপড়; আমাকে দেখে সে থামলো। অদুরে তার কয়েকজন সাথী ধানের টুকরীসহ বসে আছে।
-তোমার গলা অনেক ভালো, গানটান গাও? আমি প্রশ্ন করলাম।
-না, গান গাওয়া নিষিদ্ধ! গজল ভালো লেগেছে তোমার?
-মাদ্রাসা ছেড়ে স্কুলে চলে আস, তখন গান গাইতে পারবে।
-আমার বাবা নেই; স্কুলের বেতন দেয়ার ক্ষমতা নেই।
আমাদের বাড়ী থেকে ৪ মাইল দক্ষিণে এদের মাদ্রাসা। আমি ক্লাশ সেভেন, এইটে পড়ার সময় ছেলেটার সাথে বাজারে টাজারে দেখা হয়েছে অনেকবার; মাদ্রাসা শেষ করা হয়নি, পেটের দায়ে কৃষি মুজুর হয়ে গেছে। পরের বছরগুলোতে তাকে আর দেখিনি, তার কথা ভুলে গেছি।
তখন চাকুরী করি; একদিন খুব ভোরে কাছারীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি, দেখি সামনের রাস্তা দিয়ে অনেক লম্বা একজন যুবক বেশ গতিতে হেঁটে যাচ্ছে, গায়ে শুভ্র সাদা আলখাল্লা ও সাদা লুংগি, হাতে অস্বাভাবিক লম্বা লাঠি। আমি তাকিয়ে আছি, সে কোনদিকে না তাকিয়ে উত্তর দিকে চলে গেলো। নাস্তার সময় ছোটভাই থেকে জানলাম, ইনি 'জ্বীনের বাদশাহ' নামে পরিচিত, ছোটভাই আসল নামও জানে না; আমাদের বাড়ী থেকে ৫/৬ মাইল দক্ষিণে বাড়ী, ছোটকালে খুবই দরিদ্র ছিলো, ১৫/১৬ বছর বয়সে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলো, জ্বীনেরা নিয়ে গিয়েছিলো; ১১/১২ বছর পর ফিরে এসেছে; অনেক টাকার মালিক; বাড়ীর সামনে মসজিদ করেছে, বৃহশ্পতিবার রাতে উনার মসজিদে উনার কিছু অনুসারী একত্রিত হয়, জিকির ইত্যাদি করে, খাওয়া দাওয়া হয়, দোয়া খায়ের হয়; জ্বীন নাকি টাকা পয়সা দিয়ে যায়।
পুরো সপ্তাহ গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে বেড়ায়; কারো সাথে কথা বলে না, মানুষের সাথে বসেও না, একাকী চলে। উত্তর দিকে যায় এক লোকের কবর জেয়ারত করতে, সেটা ৬/৭ মাইল হবে। ঘন্টা দু'য়েক পরে এই রাস্তা হয়ে ফিরে যাবে। আমি নাস্তা করে, আনুমানিক দেড় ঘন্টা পর সামনের রাস্তা ধরে ধীর গতিতে হেঁটে তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠিকই দুই ঘন্টা পর, সে উত্তর দিক থেকে আসছে হন হন করে। আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছে, দৃষ্টি সামনে, আমার চোখের দিকে তাকায়নি। আমি চিনলাম, অনেক বছর আগের দেখা মাদ্রাসার সেই ছেলেটি। আমি বললাম,
-হ্যালো!
সে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো।
আমি নিজের নাম বলে হাড় বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করলাম।
সে হেসে বললো,
-আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। তুমি আমাকে স্কুলে পড়তে বলেছিলে; আমি স্কুলে যেতে পারিনি, মাদ্রাসাও শেষ করতে পারিনি। তুমি কি কর?
-চাকুরী।
অনেকক্ষণ কথা হলো। তার লাঠিটি দেখার মতো, ৬/৭ সের ওজন হবে, মসৃন। আমি বললাম,
-এট বড় লাঠি কেন?
- এতে আমার ব্যায়াম হয়।
তার বাড়ীতে যাবার জন্য অনুরোধ করলো। তার নাম জানলাম।
-তোমাকে জ্বীনের বাদশাহ নামে জানে লোকজন।
-লোকজনের কথা বলিও না, আমাদের লোকজন যা মুখে আসে তাই বলে, ওরা ভেবেচিন্তে কিছু বলে না। আমার সামান্য আয় আছে, আমার আয় নিয়ে আমি কিছু বলি না, ওরা মনে করে যে, জ্বীনেরা আমাকে টাকা দেয়; তুমি নিশ্চয় আমাদের অশিক্ষিত মানুষদের বেকুবী বুঝ।
সে খুব করে বললো, আমি যেন তার বাড়ী যাই, গেলে খুবই খুশী হবে। সে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। আমি বাড়ী ফিরে এলাম, বাড়ীর অনেকই কাছারীর সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলো যে, আমি ওর সাথে কথা বলছি। ছোটভাই বললো,
-এই লোক তো রাস্তায় কারো সাথে কথা বলে না, আপনার সাথে কি নিয়ে আলাপ করলো?
-সাধারণ আলাপ, আমি স্কুলে থাকতে ওর সাথে আমার পরিচয় ছিলো।
-তার টাকা পয়সা নিয়ে আলাপ করেছে?
-সে নিজের থেকে আলাপ করেছে, তার সামান্য আয়ের পথ আছে, সে বললো!
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:২৩