আমাদের গ্রামের দরিদ্র মামা-মামীর সংসারে বড় হওয়া এক কিশোরীর জীবনের কষ্টকর একটি রজনীর কথা।
আমাদের গ্রামের পশ্চিমপাড়া এলাকায় আমাদের একটা ছাড়া-বাড়ী ছিল; বাড়ীটি বেশ বড়; ওখানে কোন ঘর ছিলো না, ৪ টুকরো উঁচু জমি ও মাঝারী আকারের একটি পুকুর ছিলো; আমরা ওখানে নিজেদের জন্য ও বিক্রয়ের জন্য কয়েক ধরণের সবজী করতাম। বাড়ীটির চারিদিকে পাটিপাতা, কাঁটালতা, বেত, বিবিধ ফলগাছ, কলাগাছ, ঝোপঝাড় ছিল অনেক; বাহির থেকে ভিতরটা তেমন দেখা যেতো না, কিছুটা ভুতুড়ে ভুতুড়ে মনে হতো; আবার চারিপাশে চওড়া নালা থাকায়, শুধু মাত্র প্রবেশ পথ ব্যতিত ভেতরে যাওয়া যেতো না।
আমি তখন নবম শ্রেণীতে, ছাড়া-বাড়ীর একটা জমিতে বেগুন করা হয়েছিলো, সেইবারের বেগুনের জাতটা ভালো ছিলো না; গাছ বেশ উঁচু হয়েছিলো, এবং শাখা-প্রশাখা বেশী বিস্তার করেছিলো। শীত শেষ হয়ে আসছে, খেজুরের রসও শেষ হওয়ার পথে; আমাদের বুড়োমিয়া সন্ধ্যার দিকে খেজুর গাছে বাটালী করে, হাঁড়ি লাগায়; আমি খুব ভোরে গিয়ে রস নামিয়ে আনি। এক ভোরে আমি একটা উঁচু গাছ থেকে রস নামানোর সময়, বেগুন খেতের দিকে আমার দৃষ্টি যায়; মনে হচ্ছে, বেগুন গাছের সারির মাঝে শাড়ীপরা কেহ একজন পড়ে আছে, কিংবা শুয়ে আছে! আমি রসের কথা ভুলে গেলাম, তাড়াহুড়া করে নেমে, বেশ উদ্ভিগ্ন হয়ে কাছে গিয়ে দেখি ঠিকই একটি মেয়ে শুয়ে আছে, শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকা; খড়ের গাদা থেকে বেশকিছু খড় এনে, বিছায়ে দিয়ে উহার উপর শুয়ে থাকায়, আমি নিশ্চিন্ত হলাম যে, সে নিজেই এই ব্যবস্হা করেছে, এবং শোয়ার ভংগি থেকে বুঝা যাচ্ছে, সে জীবিত! আমি আরো কাছে গেলাম, বুঝা যাচ্ছে সে শ্বাস নিচ্ছে, আমার চিন্তা কেটে গেলো।
-এটা কে?
মেয়েটি মুখের উপর থেকে কাপড় সরায়ে, উঠে বসলো; আমাদের পশ্চিম পাড়ার আবুল কাকার ভাগনেয়ী শমসু, ১২ বছরের কিশোরী।
-কিরে শমসু, কি হয়েছে, তুই এখানে ঘুমায়েছিস কেন?
-আমি রাতে ঘরে যাই নাই, মামী মারবে।
-কি হয়েছে?
-আমি দুপুর বেলায় চুরি করে আনু মামীদের ভাত খেয়ে ফেলেছি।
-বাড়ী থেকে কখন পালিয়েছিস?
-কাল দূপুরে?
-রাতে তো না খেয়ে আছিস?
-তোমাদের জমি থেকে একটা মুলা তুলে খেয়েছি।
-ক্ষুধা লাগছে?
-না।
-ঠিক আছে, এখন বাড়ী চলে যা।
-না, আমি যাবো না, গেলে মারবে।
-আমি তোর সাথে যাবো, তোকে মারবে না।
-তুমি চলে গেলে মারবে। তুমি গিয়ে দেখ, মামা ঘরে আছে, নাকি পাহাড়ে চলে গেছে; মামা থাকলে যাবো।
-খেজুরের রস খেতে পারবি?
সে উঠে গিয়ে কলসী থেকে খেজুরের রস খেলো অনেকটুকু। আবুল কাকাদের একটি মাত্র বোন, বিয়ে টিকেনি, ছয়-সাত বছরের মেয়ে নিয়ে বড় ভাইয়ের কাছে এসে উঠেছিল; মেয়েসহ কেহ বিয়ে করতে চাহে না, সেজন্য বিয়ে বসেনি চার-পাঁচ বছর; অবশেষে, একদিন বিয়ে বসতে বাধ্য হয়েছে, গরীব ভাই কতদিন টানবে! মেয়েটা এখন মামার পরিবারে।
মেয়ে পুকুরের ঘাটে বসে রলো; আমি তার মামার বাড়ী গেলাম; আবুল কাকা পাহাড় থেকে পাথর নামায়, ভোরে ভোরে কাজে চলে গেছে; মেয়েকে হয়তো খুঁজেছিলো; কিন্তু এই ভুতুড়ে বাড়ীতে লুকিয়ে থাকতে পারে তা ভাবেননি।
আমি ফিরে এসে দেখি,শমসু আবারো সেই খড়ের উপর শুয়ে আছে; রাতে ভয়ে ঘুমায়নি নিশ্চয়।
আমি বললাম,
-আমাদের বাড়ী চল।
-কেহ দেখলে মামীকে বলে দেবে।
-তোর মামী তোকে খুঁজতে আমাদের পাড়ায় যাবে না, চল।
এত ভোরে শমসুকে আমার সাথে দেখে আমার মা বুঝতে পারলেন, কিছু একটা ঘটেছে; মাকে বললাম যে, সে মামীর ভয়ে পালিয়ে আছে। মা বললেন,
-তুমি খেয়ে পড়তে যাও, আমি ওর ব্যবস্হা করবো।
বিকেলে আমি স্কুল থেকে ফিরে আসার পর মা বললেন যে, শমসুর মামীকে ডেকে আনিয়ে বুঝায়ে বলেছেন, মেয়েকে যেন না মারে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৮:২৭