বয়স বাড়লে ঘনঘন ডাক্তারের কাছে যেতে হয়; বছর তিনেক আগে, এক সোমবার সকালে এক নতুন স্পেশালিষ্টের অফিসে যেতে হলো; রোগীদের বসার রুমে প্রবেশ করে দেখি সবগুলো বয়স্ক, হতাশ হওয়ার মতো ব্যাপার, কারো মুখ তেমন প্রশান্তি নেই; এক কোণে বসে এক আফ্রিকান আমেরিকান কালো চশমা চোখে, হাতে-ধরা একটা ডিভাইসে সিনেমা দেখছে; মনে হয়, ভয়ের সিনেমা, এক মেয়ের ভীতিপুর্ণ চীৎকার শোনা যাচ্ছে! তারপাশে গিয়ে বসলাম; মনে হয়, তার সাথে আলাপ জমানো যাবে!
-কেমন আছ, ভয়ের সিনেমা দেখছ?
-না, সাধারণ ডিটেকটিভ!
-কালো চশমা পরে, ডিটেকটিভ সিনেমা দেখছ, পুলিশ কি তোমাকে খুঁজছে?
-আরে না, পুলিশ টুলিশ না, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি ডান চোখ ফুলে গেছে!
-বামহাতী গার্লফ্রেন্ড নিয়ে রবিবারে পার্টি করে বেড়ালে ডান চোখ তো ফুলবেই, সৌভাগ্য যে, একটা ভালো আছে!
-পার্টি মার্টি আরো ১০ বছর আগে ছেড়ে দিয়েছি!
-গতকাল তো ঠিকই কয়েক গ্লাস হুইস্কি চালান করে দিয়েছ; তারপর, অন্যের মেয়ে নিয়ে টানাটানি করেছ নিশ্চয়!
-আরে না, এখন সেই বয়স, আর সেই আয় আছে নাকি! ৪/৫টা বিয়ার খাইছি মাত্র।
-তো, ঘুষি কে মারলো, তোমার গার্লফ্রেন্ড, নাকি অন্য মেয়ের বয় ফ্রেন্ড?
-আরে না, সেই রকম কিছু ঘটেনি; ঘুম থেকে উঠে দেখি চোখ আপনা-আপনিই ফুলে গেছে!
-৪/৫ টা বিয়ারের পর এই অবস্হা, কে ঘুষি মারছে, সেটারও খবর নেই; চোখ আপনাআপনি ফুলে নাকি?
আমাদের আলোচনায় বাকী রোগীরা জেগে উঠেছে; আমাদের কথা শুনছে মনোযোগ দিয়ে, ২/১ জন হাসছে; আফ্রিকান মিয়ার ডাক পড়লো, ডাক্তার এসে তাকে ভেতরে নিয়ে গেলো; আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখালাম বাকীগুলোর সাথে জমবে না; আমার সামনে ৬/৭ জন রোগী, হাতে ঘন্টাখানেক সময় আছে; বাইরে গিয়ে হেঁটে আসি, সম্ভব হলে, ছোটখাট গন্ডগোল মন্ডগোল করা যাবে।
রাস্তার উল্টোদিকে একটি বেকারী, ভেতরে গেলাম; লোকজন তেমন নেই; দুইটি কিশোরী অর্ডার-লাইনে; তাদের পেছনে লাইনে দাঁড়ালাম; কাউণ্টারের কাছে, এক টেবিলে দুইজন বয়স্ক মহিলা কফি নিয়ে বসেছে; দুরের কোণে একটি তরুণ আইসক্রিম খাচ্ছে ও ফোন চেক করছে। কিশোরীদের অর্ডার সম্পুর্ণ হয়েছে, একজন ২ টি কেকের টুকরা নিয়ে এক টেবিলে গিয়ে বসলো; অন্যজন পয়সা দিয়ে, কোকের গ্লাস নেয়ার জন্য হাত বাড়ানোর সময়, হাতে লেগে গ্লাস পড়ে গেলো নীচে।
ক্যাশের মধ্যবয়সী মহিলা ছোট মেয়েটাকে ধমক দিলো,
-পংগু নাকি, হাত থেকে গ্লাস পড়ছে কেন?
-স্যরি! মেয়েটা হতাশ।
-সর, সামান্য কোকের গ্লাসও ধরতে জান না; মা কিছুই শিখায়নি?
মহিলা দ্রুত যায়গাটা পরিস্কার করে আমার অর্ডার নেয়ার জন্য ক্যাশে দাঁড়ালো। মেয়েরা বসে কেক খাচ্ছে। বয়স্ক মহিলা ২ জন ক্যাশিয়ারের আচরণে খুশী নন; কিন্তু কিছু বললেন না।
আমি বললাম,
-আমার অর্ডার নেয়ার আগে তুমি মেয়েদের কোক দাও!
-কিসের কোক? ওরা নতুন করে কোকের অর্ডার দিয়েছে নাকি?
-যেটা পড়ে গেছে, সেটা তুমি পুরণ করে দেবে না?
-এটা রেডক্রস নয়, এটা ব্যবসা! মেয়ে ফেলেছে কোক, আমি ফেলিনি!
-মেয়ের হাত থেকে কোক পড়েছে বলে তুমি মেয়েদের কোক দেবে না?
-দরদ লাগলে তুমি পয়সা দাও, আমি কোক দেবো।
আমি কোকের পয়সা দিলাম; কোক নিয়ে মেয়েদের টেবিলে রাখলাম; ২ জনই ধন্যবাদ দিলো। আমি ফিরে এসে মিডিয়াম কফির অর্ডার দিলাম। কফি কাউন্টারে রাখতেই, পয়সা দেয়ার আগেই আমি কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম,
-এই বিশ্রী কফি তুমি বিক্রয় কর এখানে?
সে কিছু উত্তর দেয়ার আগেই আমি পাশের গার্বেজ ক্যানে কফিটা ফেলে দিলাম। মহিলার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে,
-তুমি কফি কেন ফেলেছ?
-উহা কফি নয়, উহা বলদের মুত্রের মতো বিস্বাদ!
মহিলা কাকে উঁচু গলায় ডাকলো,
-রিক এদিকে আস, এক লোক গন্ডগোল করছে।
কাউন্টারের পেছনে দরজা খুলে ৫০/৫৫ বছরের একটা লোক ক্যাশে আসলো; গায়ে আটা ময়দা লেগে আছে; মনে হয়, বেইকিং করছিলো। সে ক্যাশিয়ারকে বললো,
-কি হয়েছে?
-এই লোক কফির অর্ডার দিয়েছিল, আমি কফি দেয়ার পর, সে এক চুমুক খেয়ে, কফি ডাস্টবীনে ফেলেছে; বলছে, কফি নাকি বলদের মুত্রের মতো।
লোকটা আমাদে দিকে তাকালো। আমি বললাম,
-স্যরি, মহিলা আমাকে খুবই বিস্বাদ কফি দিয়েছে।
-তা বলে তুমি কফি ফেলে দেবে? তুমি চাইলে বদলে দেয়া যেতো শতবার! কফি ফেলা কিন্তু অপমানের সমান; এখান থেকে চলে যাও।
-আমি কোথায়ও যাচ্ছি না; আমি এখানে বসার জন্য এসেছি।
-ঠিক আছে, বসে থাক'গে!
-আমাকে এক কাপ চা দাও!
মহিলা বললো,
-তোমাকে কোন চা দেয়া হবে না।
লোকটা গিয়ে চা বানালো, জিজ্ঞাসা করলো, "দুধচিনি লাগবে?"
-না।
আমি পয়সা দিতে গেলাম; মহিলা ক্যাাশ থেকে সরে গেলো! লোকটা পয়সা নিলো।
মহিলা লোকটাকে বললো,
-তুমি তো কাহিনী জানো না!
-আমার জানার দরকার নেই; আমার কাজ আছে! তোমার কাজ তুমি করো।
আমি চা নিয়ে বসলাম; কিশোরীরা অনেক আগেই কেক শেষ করেছে; বসে আমাদের কান্ড-কারখানা দেখছিলো; যাবার সময় আমাকে হাত নাড়লো। মহিলা রেগেমেগ মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললো,
-এখানে তোমাদের আর যেন না দেখি!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৪৩