১৯৭১ সালে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে, ১ কোটী বাংগালী ভারতে আশ্রয় নেন; চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর মানুষ আশ্রয় নেন ত্রিপুরাতে; জুন মাসেরর শুরুতে পাকী বাহিনী নোয়াখালী-ত্রিপুরা সীমান্ত এলাকা দখল করে নেয় অনেকটা; দিনে মানুষ সীমান্ত দিয়ে ওপারে পার হতে পারতো না; রাতে সীমান্ত পার হতে গিয়ে শতশত মানুষ পাকিদের ব্রাস-ফায়ারে প্রাণ হারান; এটি চট্টগ্রামের ১টি পরিবারের সীমান্ত পার হওয়ার কাহিনী:
১৯৭১ সালের জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ, মধ্যরাত; নোয়াখালীর ফাজিলপুরের ভারতীয় সীমান্তবর্তী গ্রাম, মুরাদ নগরের পুর্ব সীমানার এক বাড়ীর পেছনের পুকুরের পাড়ে, বড় একটা আম গাছের নীচে, অন্ধকারে চারজন মানুষ পুর্বদিকের মাঠের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন, এঁরা হচ্ছেন: সীতানাথ চক্রবর্তী, উনার স্ত্রী কল্পনা চক্রবর্তী, উনাদের পনর বছরের মেয়ে যামিনী চক্রবর্তী ও উনাদের গাইড শফি উল্ল্যাহ; পরিবারটি ত্রিপুরায় প্রবেশ করবে, শ্রী নগরের শরণার্থী ক্যাপ্পে যাবে, সেখান থেকে কলিকাতা। এটি হচ্ছে, এক সপ্তাহের মাঝে উনাদের তৃতীয় প্রচেষ্টা, গত দুইটি প্রচেষ্টা সফল হয়নি; সামনে মাত্র আধ মাইল প্রশস্ত একটি শুন্য মাঠ; মাঠের পুর্ব পাশ দিয়ে ঢাকা ট্রাংকরোড, উত্তর দক্ষিণে প্রলম্বিত; ট্রাংকরাড থেকে ২০০ গজের মাঝে বর্ডার; এই আধা মাইল পথ কিছুতেই পার হতে পারছে না পরিবারটি, এক সপ্তাহ ধরে; দিনে পাকী বাহিনীর গাড়ী চলাচল করে ট্রাংকরোডে, স্হানে স্হানে বাংকার আছে, রাতে পাকীরা স্হানে স্হানে পাহারা দেয়; এ সপ্তাহে, শরণার্থীদের উপর গুলি হয়েছে দুইবার; পাকীরা গ্রামের রাস্তায়ও আসে সন্ধ্যার দিকে; গ্রামটি মোটামুটি ফাঁকা, সামান্য কয়েকটি বাড়ীতে মানুষ আছে; সন্ধ্যার আগেই লোক চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
সীতানাথ বাবু স্কুল শিক্ষক, পটিয়া থেকে কখনো হেঁটে, কখনো রিকসায়, কখনো নৌকায় করে, কখনো লুকিয়ে থেকে, একসপ্তাহে পরিবারসহ মোটামুটি ৭৫ মাইল অতিক্রম করে, অবশেষে গাইড শফি উল্ল্যার সাহায্য নিয়ে এই গ্রামে এসে লুকিয়ে আছেন, শেষ আধা মাইল পার হওয়ার জন্য। উনার বর্তমান নাম মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, স্ত্রীর নাম জাহানারা বেগম, মেয়ের নাম মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ; উনারা পাঁচ কলেমা জানেন; শিক্ষক মানুষ সবকিছু প্ল্যান করে, সতর্কতার সাথে স্ত্রী ও মেয়েকে ট্রেনিং দিয়েছেন; মেয়ে যামিনীর চুল কেটে, ঢোলা শার্ট ও লুংগি পরায়ে ছেলে বানিয়েছেন। টাকা পয়সা, পরিবারের স্বর্ণ তিনভাগ করে কোমরের সাথে রেখেছেন; কিছু রেখেছেন ছোট ট্রাংকে, ধরা পড়লে দিয়ে দেবেন।
শফি গত ২ মাসে শতশত লোক পার করেছে; তবে, এখন খারাপ সময়, গত দুই সপ্তাহ থেকে পাকীরা পুরো এলাকায় টহল দিচ্ছে দিনরাত; এই সপ্তাহে ২০ জনের বেশী শরণার্থী নিহত হয়েছে পাকীদের গুলিতে; পাকীদের অভিযানের মুল লক্ষ্য টাকা পয়সা ও স্বর্ণ; তা'ছাড়া পাকীরা শরণার্থীদের দেশের শত্রু মনে করে; পাকীরা রাজাকারদের সাহায্যে গ্রামগুলোর উপর নজর রাখছে। এই পরিবারটির সাথে শফি বেশী জড়িয়ে গেছে, শিক্ষক মানুষ, এরা অমায়িক; এখানে ব্যবসা বড় নয়, পরিবারটির প্রতি তার অসীম সমীহ; পরিবারটিকে ত্রিপুরায় পৌঁচানোর দায়িত্বকে সে মহান কাজ হিসেবে নিয়েছে; সে জানিয়ে দিয়েছে যে, সে উনাদের থেকে কোন টাকা পয়সা নেবে না।
শফি অপেক্ষা করছে, প্রথমে কিছু শরণার্থী পার হোক; সে জানে আশেপাশের বাড়ীতে কয়েকটা গ্রুপ অপেক্ষা করছে। শফি তার ছোট কালো কাপড়ের থলির মাঝে হাত ঢুকিয়ে ছোট টর্চের আলোয় সময় দেখলো, শফি টর্চের কাঁচে কালো কাপড় লাগিয়ে, খুবই ছোট ছিদ্র করে আলো নিয়ন্ত্রণ করছে; রাত একটা'র থেকে সামান্য বেশী; থলির মাঝে সে একটা লুংগি বহন করে; লুংগির মাঝে দুইটি ক্যামি ঘড়ি ও এক ডজন উইংসাং কলম লুকানো আছে; সে এগুলো ত্রিপুরায় বিক্রি করবে। সবার দৃষ্টি মাঠের উপর, কেহ পার হচ্ছে কিনা! পনের বিশ মিনিট পর, যামিনী হাত নেড়ে উত্তর দিকে সবার দৃষ্টি আকর্যন করলো; তাদের থেকে এক'শ দেড়'শ গজ উত্তরে অন্ধকারে কিছু মুর্তি পুর্ব দিক থেকে (ত্রিপুরা থেকে) দ্রুত হেঁটে গ্রামে প্রবেশ করছে; শফি ফিশফিশ করে বললো"
-স্যার, এগুলো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে, দেশে প্রবেশ করছে।
-পাকী সৈন্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে? সীতানাথবাবু প্রশ্ন করলেন।
-না, রাতে পাকীরা মাঠের মাঝ দিয়ে গ্রামের দিকে আসতে সাহস করবে না, স্যার। আমরা আরো ১৫ থেকে ২০ মিনিট অপেক্ষা করে যাত্রা শুরু করবো।
যামিনীর বুকের মাঝে একটা উত্তেজনা অনুভব করলো, অবশেষে মুক্তির সময় এসেছে; সে মায়ের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিল; মায়ের হাতটা সামান্য কাঁপছে। ঠিক ১৫ মিনিট পর, শফি উঠে দাঁড়ালো:
-স্যার, এখন আমাদের সময় !
( চলবে না )
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০২১ সকাল ৯:৪০