আমি প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময়, আমাদের স্কুল আমেরিকান ইউএস-এইড'এর রিলিফ হিসেবে মাসে ২/৩ বার গুড়োদুধ দিতো; বেশীরভাগ গরীব বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারতো না; দুধ পাউডার দেয়ার দিন, সামান্য দুধ পাউডারের আশায় কেহ কেহ স্কুলে আসতো; কিন্তু নির্দয় শিক্ষকেরা এদেরকে রিলিফের সামান্য গুড়োদুধটুকু দিতো না; এটা সেই সময়ের একটি ঘটনা:
পাকিস্তানী আমলে, আইয়ুব খানের বদৌলতে পুরো জাতি মোটামুটি ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছিলো; আমরা তখন উহা বুঝতাম না; সর্বস্তরে রিলিফে এটাসেটা দিতো; স্কুলে গুড়োদুধ দিতো। প্রথমে, খুবই উৎসাহভরে দুধ আনতাম; তবে, পরে লাইনে দাঁড়িয়ে দুধ নিতে লজ্জা লাগতো। আমাদের ২টি গাভী ছিলো সব সময়ে, এবং আমাদের নিজের দুধ পরিবারের জন্য যথেষ্ট ছিলো। ২য়, ৩য় শ্রেণীতে পড়ার সময়, দুধ পাউডার দেয়ার দিনটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিলো, সারা গ্রাম কিভাবে জেনে যেতো যে, আজকে স্কুলে গুড়োদুধ দেবে; আমরা ছোট একটা টিনের পট নিয়ে যেতাম; দুধ দিতো স্কুল ছুটির পর; দুধ নিয়ে বাড়ী ফেরার পথে, স্কুলে না-যাওয়া শিশুরা গুড়োদুধ চাইতো, তাদেরকে হাতে সামান্য পরিমাণ দিলে, ওরা খেতো, অনেক খুশী হতো।
আমি দুধ আনার সময় যেই কয়টি শিশু দুধ চাইতো, তাদের মাঝে জিরাধন ছিলো খুবই উৎসাহী; জিরাধন এমনভাবে হাত এগিয়ে দিতো যে, যেন আমি তাকে দেয়ার জন্যই স্কুল থেকে দুধ আনতাম; তাকে ৩/৪ বার দিতে হতো। তার ১ বছরের বড় বোন নুরজাহান অদুরে দাঁড়ি্যে থাকতো, কখনো দুধ চাইতো না, আমি দিতে চাইলেও নিতো না; ছোটবোন জিরাধন তাকে দিলে, সে সমান্য পরিমাণ নিতো।
নুরজাহান আমার থেকে ২/১ বছরের বড় ছিলো; পরিবারে সে অবহেলায় বড় হচ্ছিলো; তার মাথার চুল উসকো-খুসকো ছিলো বরাবরই, মায়ের সাথে তার খুব একটা ঘনিষ্ঠতা ছিলো না; তাকে আমি তার বাবার সাথে দেখতাম প্রায়ই, এবং সে অন্য শিশুদের মতো হাসিখুশী ছিলো না।
তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়, একদিন দুধের লাইনে আমার পেছনে কয়েকজনের পর দেখি নুরজাহান; নুরজাহানের চাচাতো ভাই স্কুলের ২য় শ্রেণীতে পড়তো, নুরজাহান দুধের জন্য এসেছে। আমি জানতাম, যেই শিক্ষকটি দুধ দিচ্ছেন, উনি নুরজাহানকে দেবেন না; সেটাই ঘটলো। নুরজাহান চুপ করে তার চাচতো ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করলো; একটু পরে, সে যখন চাচাতো ভাইয়ের সাথে চলে যাচ্ছে, আমি নিজের দলকে ফেলে ওদের পেছনে পেছনে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলাম।
কিছুদুর আসার পর, আমি ওদের সাথে কিছুক্ষণ হাঁটার পর, নুরজাহানকে বললাম,
-নুরজাহান, আমাদের ঘরে অনেক দুধ, তুই আমার দুধের পটটা নিয়ে যা।
-না, দরকার নাই, নুরজাহান বললো।
আমি তাকে দেয়ার চেষ্টা করলাম কয়েকবার, সে নিলো না। সে ক্রমেই আস্তে হেঁটে আমার পেছনে পড়ে গেলো। ওদের বাড়ীর কাছে আসতেই জিরাধন দৌড়ে এলো; আমি পেছনে ফিরে দেখি নুরজাহান নেই, সে পাশের বাড়ীতে ঢুকে গেছে। আমি জিরাধনকে ২ বার দুধ দেয়ার পর পটটা তার হাতে দিয়ে বললাম,
-পটটা নিয়ে যা, দুধগুলো নুরজাহানের জন্য, তুইও সামান্য নিস; তবে, পটটা নুর জাহানের জন্য।
-তোর মা কিছু বলবে না?
-না, বলবেন না, আমাদের গাভীর দুধ আছে।
২ দিন পর, সন্ধ্যার আগে আমি খামারে গরুকে পানি খাওয়াচ্ছি, সেইসময় দেখি জিরাধন পটটি ফেরত দিতে এসেছে।
-তুই নুরজাহানকে দিয়েছিলি?
-দিয়েছি, আমরা ২ জনে খেয়েছি, এখনো অনেক দুধ আছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০২১ রাত ২:৪৯