আমার জীবনে আমি অসুন্দর নারী দেখিনি এখনো; শৈশবে অনেক নারীকে আমার এত সুন্দর লাগতো যে, এঁদের কথা মনে হলে এখনো মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠে; এটি সেই রকম একজন নারীর কাহিনী:
আমাদের গ্রামের মাঝামাঝি বরাবর, উত্তর দক্ষিণে প্রলম্বিত রাস্তাটি গ্রামটিকে পুর্ব ও পশ্চিম পাড়ায় ভাগ করেছে; আমরা পুর্ব পাড়ায়; এই পাড়ার পুর্বদিকে ধানের মাঠ; এই মাঠে আমাদের চাষবাস, খেলাধুলাও এই মাঠে। পশ্চিম পাড়ার উত্তরদিকটা আমার কাছে বরাবরই রহস্যময় ছিলো: ওখানে ৬টা বাড়ী পরস্পরের সাথে লাগানো ছিলো, পরিবারগুলো পরস্পরের আত্মীয়স্বজন, সবাই দরিদ্র; এদের কেহই চাষাবাদে দিনমুজুরের কাজ করতো না, সবাই পাহাড় থেকে বাঁশ, কাঠ, পাথর এনে বিক্রয় করে চলতো। বাড়ীগুলো বাঁশ, বেত, গাছ গাছড়ায় ভরা ছিল; ওদের সামনের রাস্তায় কেয়াকাঁটার বন ছিলো। পশ্চিম পাড়ার পশ্চিমের মাঠে শীতে বলখেলা খুবই জমতো; তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়, শীতেকালে আমি পশ্চিমের মাঠে খেলার শুরু করলাম। গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে একটি বড় রাস্তা হয়ে, অনেকটা ঘুরে আমি আসা যাওয়া করতাম; ৬টি বাড়ীর মাঝামাঝি একটা খালের মতো ছিল, বর্ষাকালে সেই খাল হয়ে গ্রামের পানি পশ্চিম দিকে যায়; খালের পাড়গুলো কেয়াকাঁটা ও নানা গাছের জংগলে ভরা, এর মাঝ দিয়ে এসব বাড়ীর লোকজন চলাচল করতো; আমি সাপের ভয়ে সেই পথ হয়ে যেতাম না।
এক বিকেলে, গরু টরু বেঁধে খেলায় যেতে দেরী হয়ে গেলো, আমি দ্রুত খেলার মাঠে পৌঁছার জন্য খালের পাড়ের সরু পথ দিয়ে দৌঁড়ে মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম; এই সরু পথে আমার সামনে পড়লেন একজন মহিলা; উনার কোলে ৫/৬ বছরের একটি অতি সুন্দরী, বিষন্ন একটি মেয়ে ছিল; মহিলাটি একটি ছাগলকে বাড়ীর দিকে নেয়ার চেষ্টা করছেন; কিন্তু ছাগলটি কেয়াকাঁটার উপর জড়িয়ে-থাকা লতার পাতা খাওয়ার চেষ্টা করছে; মহিলার কোলে বড় বাচ্চা থাকায় উনি ছাগলটিকে টেনে নিতে হিমসিম খাচ্চিলেন। আমি দাঁড়ালাম, বাচ্চাটির ২টি পায়ে সমস্যা ছিল; আমি এই মহিলাকে প্রথমবারের মতো দেখলেও অনুমানে চিনলাম, এটি তাজুর মা। গত ঈদে মা উনার জন্য ফিতরার টাকা দিয়েছিলেন আমাকে, আমি দিয়ে এসেছিলাম; উনি ঘরে ছিলেন না, উনার মায়ের কাছে টাকাটা দিয়ে এসেছিলাম। উনি দিনের বেলায় বাড়ীর আশেপাশে খুব একটা বের হতেন না।
বছর দু'য়েক আগে উনার বিচার হয়েছিলো, উনাকে একঘরে করা হয়েছে। বছর ছ'য়েক আগে, মেয়ে হওয়ার পরপরই উনার স্বামীর মৃত্যু হয়েছিলো; উনি অনিন্দ্য-সুন্দরী ছিলেন; স্বামীর মৃত্যুর পর, অনেকই উনাকে বিয়ে করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলো; কিন্তু মেয়েটা পংগু হওয়ায় তিনি বিয়েতে আগ্রহ দেখাননি। বছর দু'য়েক আগে, পাশের বাড়ীর এক যুবক রাতে উনার ঘরে প্রবেশ করে, উনি যুবককে বের করে দেন; কিন্তু এই ব্যাপারে নালিশ করেননি; বাড়ীর কে একজন ব্যাপারটা জেনে সবাইকে জানিয়ে দেয়; যুবক পালিয়ে যায়। গ্রামের সবাই মিলে মহিলার বিপক্ষে বিচায় বসায়; অপরাধ: যুবক যদি ঘরে গেলো, কেন তিনি নালিশ করেননি।
মহিলাটি খুবই পুরাতন, বিবর্ণ একটি কাপড় পরেছিলেন; উনার মুখের দিকে আমি কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম আমি জানি না; মহিলা বললেন,
-তুমি জালাল মিয়ার ছেলে?
-জ্বি।
-তুমি বল খেলতে যাচ্ছো!
-জ্বি।
-যাও!
-আপনি ছাগল নিতে পারছেন না, আমি দিয়ে আসি?
-তোমার খেলায় দেরী হবে না?
-অসুবিধা নেই।
-তোমার মা আমাদেরকে মাঝে মাঝে সাহায্য করেন, উনাকে সালাম বলিও।
আমি জীবনে এমন সুন্দরী কোন মহিলা দেখিনি; আমার মনটা কেমন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো, আমি বল খেলছিলাম, নাকি বাতাসে উড়ছিলাম, আমি বুঝতে পারছিলাম না। উনার চোখ দু'টি আমার চোখে ভাসছিলো; উনার দু'চোখে যেন দুনিয়ার বিষণ্ণতা জমা হয়েছিলো; বাচ্চাটাও বিষন্ন। কয়েকদিন আমার সব কাজের মাঝে উনাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। এরপর প্রতিদিনই সেই পথ হয়ে খেলতে গেলাম; ভাবতাম, মহিলাটির সাথে দেখা হবে; কিন্তু দেখা হয়নি। সপ্তাহ'খানেক পরে, একদিন দেখি উনার ছাগলটা খালের পাড়ে লতাপাতা খাচ্ছে; আমি খেলতে না গিয়ে কাছে অপেক্ষা করতে লাগলাম; আমি আশা করছিলাম উনি ছাগল নিতে আসবেন, আমি উনাদের বাড়ীর পথের দিকে চোখ রেখে অপেক্ষা করছি; হঠাৎ আমার পেছনের দিক থেকে উনি এলেন; উনি পাশের বাড়ী গিয়েছিলেন, আমাকে ওখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে উনি কি ভেবেছিলেন আমি জানি না; উনি আমাকে বললেন,
-তুমি খেলতে যাওনি?
-যাচ্ছি!
-আমি অনেকক্ষণ আগের থেকে তোমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি, কোন সমস্যা?
আমি মাথা নীচু করে মাঠের দিকে চলে গেলাম।
উনার জীবন খুবই কষ্টের, কেহ পাটীপাতার গাছ দিলে উনি পাটী তৈরি করে দেন; উনার বুড়ো বাবা মাঝে মাঝে পাহাড় থেকে বাঁশ আনেন, তিনি কুলা, ডালা বানান; সম্প্রতি ঘরে কেরোসিন তেল, সামান্য তামাক ও বিড়ি রাখেন; পাড়ার কেহ কেহ নেয়।
আমাদের পরিবার গ্রামের শেষপ্রান্তে অবস্হিত আমু ভাইয়ের মুদি দোকান থেকে সব ধরণের তেল কিনতো; একদিন সাহস করে, আমি সন্ধ্যার দিকে তাজুর'মার বাড়ী গেলাম কেরোসিন তেল কিনে আনতে; উনি আমাকে দেখে হতভম্ব। উনি বললেন,
-তোমার মা জানে, তুমি তেলের জন্য এতদুর আসবে?
-না।
-উনাকে বলিও, তুমি আমার থেকে তেল নিচ্ছ!
আমি মাকে বলিনি; টাকা পয়সা আমার হাতেও থাকতো; ফলে, বলার দরকার হয়নি। আমু ভাইয়ের দোকান থেকে সরিষার তেল ও নারিকেলের তেল আনছিলাম বরাবরের মতো; ৩/৪ সপ্তাহ পরে আমু ভাই একদিন জিজ্ঞাসা করলো,
-কিরে, তোরা কেরোসিন তেল কোথা থেকে কিনিস আজকাল?
-বুড়োমিয়া ১ টিন তেল নিয়ে এসেছে, এখন কিছুদিন কেরোসিন তেল কেনা লাগছে না।
আমু ভাই এমনভাবে তাকালেন, বুঝলাম উনি বিশ্বাস করেননি। ২/৩ দিন পর, আমি কেরোসিনের টিনটা হাতে নিয়ে বের হচ্ছি, মা বললেন,
-দোকানে যাচ্ছ?
-কেরোসিন আনতে যাচ্ছি, অন্য কিছু লাগবে?
-তুমি আজকাল তো আমুর দোকান থেকে নাকি কেরোসিন আনছ না! কোথা থেকে কিনছ?
-তাজুর মা থেকে আনছি!
মা আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রলেন।
-আমু ভাইয়ের দোকান থেকে আনবো?
-না, তুমি যেখান থেকে আনছ, ওখান থেকেই নিয়ে আসগে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০২১ রাত ৮:৩৬