রেড ব্যারনের সাথে আমার পরিচয় ঘটে ভিডিও গেম খেলতে গিয়ে। ‘এম্পায়ার আর্থ’ গেমের জার্মান ক্যাম্পেইন খেলার সময় গেমে হিন্ট দেখায়, বিমান বন্দর তৈরী করার জন্যে। বিমান বন্দর তৈরী হবার সাথে সাথেই কোথা থেকে একটা লাল যুদ্ধ বিমান ছুটে আসে। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় পরিস্থিতি। আমার আকাশ সীমা সম্পূর্ণ নিরাপদ হয়ে যায়। RAF (Royal Air Force) এর বিমানগুলো ছত্র ভংগ হয়ে পালাতে শুরু করে। বিমানের প্রোফাইল ওপেন করে দেখি, সেখানে বড় বড় করে লেখা ‘দ্যা রেড ব্যারন’।
গেমের অভ্যন্তরে রেড ব্যারনের একচ্ছত্র আধিপত্য দেখে আগ্রহ জাগে, কে এই রেড ব্যারন? জানতেই হবে আমাকে। নেটে সার্চ দিয়ে জেনে গেলাম পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাইটার পাইলটের কথা। এমন একজন পাইলট, যিনি সম্ভবত জীবদ্দশায় কখনো পরাজিত হননি।
‘দ্যা রেড ব্যারন’ উপাধির পিছনে লুকিয়ে থাকা মানুষটির নাম ছিলো Manfred Albrecht Freiherr von Ricthophen.
যদিও তার সকল কৃতিত্ব একজন ফাইটার পাইলট হিসাবে, তিনি আদতে ছিলেন একজন Cavalry man. ১৯১৪ সালে Anti aircraft machine gun আবিস্কার হবার পর তাকে জার্মান বিমান বাহিনীতে নিয়ে আসা হয়। তিনি ছিলেন JASTA 2 এর একেবারে প্রথমদিককার সদস্য। পরবর্তীতে তিনি এই গ্রুপের নেতা হয়ে ওঠেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার নেতৃত্বে জার্মান বিমান বাহিনী RAF এর জন্য ত্রাসরূপে আবির্ভূত হয়।
রেকর্ড অনুযায়ী ম্যানফ্রেড ৮০ টি অফিসিয়াল air combatজেতেন। যা এখনো পর্যন্ত একজন ফাইটার পাইলটের জন্যে সর্বোচ্চ হিসাবে টিকে আছে। কিন্তু তার শুরু ছিলো অনেক হতাশা ব্যাঞ্জক। ১৯১৫ সালে প্রথম তাকে observer এর দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। এখানে থাকাকালীন তিনি একটি ফ্রেঞ্চ বিমান ভূপাতিত করেন। কিন্তু তাকে অফিসিয়ালী কোন কৃতিত্ব দেয়া হয় না। কারন, যে বিমানটিকে তিনি গুলি করেছিলেন, সেটি জার্মানীর মিত্র পক্ষের সীমা অতিক্রম করে গিয়ে তারপর বিধ্বস্ত হয়।
এর কিছুদিন পর, ম্যানফ্রেড সৈভাগ্যক্রমে তার গুরুর দেখা পান। তার নাম Oswald Boelcke. তিনি ম্যানফ্রেডকে পাইলট হিসাবে প্রশিক্ষণ নেয়ার সুযোগ করে দেন। ১৯১৬ সালে ম্যানফ্রেড যুক্ত হন বোমারু বিমানের বহরে। তিনি তখন চালনা করতেন এলবেট্রস সি ৩ নামের বিমানটি। প্রাথমিক অবস্থায় তিনি নিজের বিমান নিয়ন্ত্রনে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দেন, একাধিকবার ক্রাশ করেন। ২৬ শে এপ্রিল ১৯১৬, তিনি একটি ফ্রেঞ্চ বিমান ভূপাতিত করেন। কিন্তু আগেরবারের মতই তাকে সকল কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়।
এই ঘটনায় কিছুটা হতাশ হয়ে পড়েন ম্যানফ্রেড। ঠিক এক সপ্তাহ পর ঝড়ো আবহাওয়ায় তিনি বিমান উড্ডয়ন করেন। মিশন শেষ করে নিরাপদে ফিরে আসলেও স্বীকার হন তীব্র তিরস্কারের। তাকে বলে দেয়া হয়, তিনি যেন আর কখনো এই ধরণের আবহাওয়ায় বিমান উড্ডয়ন না করেন।
কিন্তু ম্যানফ্রেড হেরে যাওয়ার মানুষ ছিলেন না। তিনি আবার দেখা করেন তার গুরুর সাথে। আগষ্ট ১৯১৬, অসওয়াল্ড তখন তার নতুন গঠিত বাহিনীর জন্যে লোকবল সংগ্রহ করছিলেন। রত্ন চিনতে তিনি কোন ভুল করলেন না। নিয়োগ দিলেন ম্যানফ্রেডকে।
১৭ সেপ্টেম্বর ১৯১৬, ম্যানফ্রেড তার প্রথম লড়াই যেতেন, JASTA 2 কে সঙ্গে নিয়ে এলবেট্রস ডি ২ তে সওয়ার হয়ে। ফ্রান্সের আকাশ সীমায় ঢুকেও নিজের বাহিনী নিয়ে ফিরে আসেন বিজয় সাথে করে, নিরাপদে। কিন্তু এই যুদ্ধে ম্যানফ্রেড হারান তার গুরুকে।
অসওয়াল্ডের বিমান ধাক্কা খায় তার দলেরই আরেক বিমানের সাথে। দুটি বিমানই ভূপাতিত হয়। এবং চালকেরা নিহত হন। এই সময় ম্যানফ্রেড ছিলেন অসওয়াল্ডের বিমানের ঠিক পিছনে। এরপর তিনি কাঁধে তুলে নেন নেতৃত্ব, এবং জেতেন।
ম্যানফ্রেডের জীবনের সবথেকে বড় সাফল্য আসে ২৩ নভেম্বর ১৯১৬, এইদিন তিনি ব্রিটিশ মেজর হকার কে হত্যা করেন। দীর্ঘ সম্মুখ বিমান সমরের পর তিনি জিতলেও অনুভব করেন তার আরো ক্ষিপ্রতার বিমান দরকার। তার জন্যে যদি গতি একটু কম হয়, তবুও।
তিনি এলবেট্রস ডি ৩ চালানো শুরু করেন। এই বিমানটিকে অনেক পছন্দ করতেন ম্যানফ্রেড। কিন্তু ম্যাটেরিয়ালস ফেইলিয়ারের জন্যে এই বিমানকে তিনি পরিত্যাগ করেতে বাধ্য হন। তারপরও তার অনেক অমর কীর্তির সাক্ষী হয়ে থাকে এই এলবেট্রস ডি ৩।
এলবেট্রস পরিত্যাগ করার পর তিনি চালানো শুরু করেন Fokker Dr I. Triplane. তিনি স্কোয়াড্রন কমান্ডার হবার পর নিজের বিমানকে গাড় লাল রঙ্গে রাঙ্গিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই লাল রঙের বিমানে চড়ে তার কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ জার্মান সরকার তাকে ‘দ্যা রেড ব্যারন’ উপাধি দেয়। এই বিমান এবং তার আরোহীর দক্ষতার কাছে অসহায় হয়ে ওঠে RAF. একের পর এক যুদ্ধে তাদের পরাজিত করতে থাকে ম্যানফ্রেডের নেতৃত্বাধীন JASTA 11.
রেড ব্যারনের ক্ষিপ্রতার সাথে কোনভাবেই পেরে না ওঠা RAF সিদ্ধান্ত নেয় তাদের বহরের কিছু বিমানের সামনের অংশ রেড ব্যারনের বিমানের মত লাল রঙ করে নেওয়ার। এই দলের কাজ হবে শুধুমাত্র রেড ব্যারনকে দেখা মাত্র ধাওয়া করা এবং ভূপাতিত করার চেষ্টা করা। বলাই বাহুল্য যে, এই কাজে তারা ক্রমাগত ব্যর্থ হয় এবং নিজেরাই একে একে ভূপাতিত হতে থাকে।
১৯১৭ সালের এপ্রিলে, ম্যানফ্রেড একাই ভূপাতিত করেন ২২ টি শত্রু বিমান। যার মধ্যে ৪ টি ছিলো একই দিনে। তার এই সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তার দলকে ‘দ্যা ফ্লাইং সার্কাস’ উপাধি দেয়া হয়।
৬ জুলাই ১৯১৭, ম্যানফ্রেড দূর্ঘটনার স্বীকার হন। শত্রুর বুলেট বিদ্ধ হয় তার মাথায়। ফলস্বরূপ, তিনি সাময়িক সময়ের জন্যে অন্ধ হয়ে যান এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। দ্রুতই তার জ্ঞান ফিরে আসে এবং তিনি বুঝতে পারেন তার বিমান শত্রু সীমায় ভূপাতিত হতে চলেছে। সেই অবস্থায় তিনি বিমানকে নিয়ন্ত্রনে আনেন এবং মিত্র সীমার মাঝে একটি মাঠে অবতরণ করতে সক্ষম হন, যা ছিলো সত্যিই বিষ্ময়কর।
এই ঘটনার পর ম্যানফ্রেডের কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। ডাক্তার তাকে পরামর্শ দেন আর উড্ডয়ন না করার জন্যে। কিন্তু উড়ন্ত সার্কাসের নেতা মাটিতে নেমে আসতে অস্বীকৃতি জানান। তখন ডাক্তার তাকে এই বলে সাবধান করেন যে, অনেক বেশি নিচে দিয়ে উড্ডয়ন ম্যানফ্রেডের জন্যে প্রানঘাতী হতে পারে।
১৯১৮ সালের ২১ শে এপ্রিল, ঘনিয়ে আসে জার্মানীর ইতিহাসের সেই কালো দিন। এদিন ম্যানফ্রেড ধাওয়া করছিলেন লেফটেন্যান্ট উইলফ্রিড এর বিমানকে। সেই মুহুর্তে RAF এর পাইলট আর্থার রয় ব্রাউন দেখে ফেলেন তাকে। দ্বিমুখি আক্রমন সামলে, নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন ম্যানফ্রেড। মিত্র সীমার কাছাকাছি জায়গায় একটি বুলেট ম্যানফ্রেডের হৃদযন্ত্র ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। আপাত দৃষ্টিতে শেষ হয় এক অধ্যায়ের। মহাকালের হাতে সমর্পিত হন মহানায়ক।
কিন্তু, এতো সহজেই কি হাল ছেড়েছিলেন ম্যানফ্রেড?
না। তিনি মারা যাওয়ার পুর্বে নিজের বিমানকে নিরাপদে অবতরন করান এক পাহাড়ের পাদদেশে। যদিও সেই অবতরন কোন কাজে আসেনি, কিন্তু সাক্ষী হয়ে আছে ম্যানফ্রেডের সীমাহীন মনোবলের।
রেড ব্যারনের মৃত্যু কে জার্মানীর জন্যে অপূরণীয় ক্ষতি বিবেচনা করে দিনটি কে জার্মানীর ইতিহাসে কালো দিন আখ্যায়িত করা হয়।
রেড ব্যারন ১৯১৮ সালে মারা গেলেও শেষ হয় না বিতর্ক। ব্রাউন দাবী করেন তার গুলিতেই নিহত হয়েছেন রেড ব্যারন। এই জন্যে তাকে পুরস্কৃত করে বৃটিশ সরকার। ব্রাউনের এই পুরস্কার RAF এর ক্রমাগত ব্যর্থতার মাঝে হয়ত কিছুটা মলমের মত কাজ করে।
একই সময়ে, ঐ অঞ্চলে থাকা একজন Anti Aircraft Machine Gunner দাবী করেন, তার গুলিতেই ভূপাতিত হয়েছে রেড ব্যারনের বিমান। কিন্তু RAF তার দাবী আমলে নেয় না।
সত্য প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে ম্যানফ্রেডের ডেথ সার্টিফিকেট আবিস্কৃত হলে। সেখান থেকে জানা যায়, গুলি ম্যানফ্রেডের বুক দিয়ে ঢুকে কাঁধ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো। ব্রাউনের অবস্থান ছিলো ম্যানফ্রেডের বিমানের উপরে। তাই নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ম্যানফ্রেডের মৃত্যু হয়েছিলো মেশিনগানেরই গুলিতে।
ম্যানফ্রেডের মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন তারই ছোট ভাই। এবং ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন তিনি। ম্যানফ্রেডের ভাইও ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন ৪০ টি লড়াই জিতে, যা ম্যানফ্রেডের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৩