somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সহযাত্রীর গল্প- সত্য ঘটনার অনুলিপি

২০ শে এপ্রিল, ২০১৩ ভোর ৫:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত সাড়ে নয়টা বাজে মাত্র, অথচ আমার মনে হচ্ছে বারটার বেশি বেজে গেছে। এতো ক্লান্ত লাগছে, শুধু বাসে ওঠার অপেক্ষা। নিজের সিটে গিয়ে শুধু বসতে পারলেই লম্বা ঘুমে হারিয়ে যাব। খুলনা পৌছাবার আগে ঘুম ভাঙ্গবে বলে মনে হয় না।

টার্ম শেষে সবাই যখন বাড়ি বসে কি করবে খুঁজে পাচ্ছে না, তখন আমি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রেনিং করার জন্যে প্রায় একমাস ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম করে বেড়াচ্ছি। অবশেষে আজকে ট্রেনিং শেষ হলো। হরতালের কল্যানে চারদিন আগেই শেষ করে দিতে বাধ্য হয়েছে ফ্যাক্টরী কর্তৃপক্ষ। একথা শোনার পর আর দেরী করিনি, আজকে রাতেরই খুলনার টিকেট কেটেছি। যত কষ্টই হোক, একেবারে বাড়ি পৌছে ঘুমানোর যে শান্তি, সেটা মনে করেই অনেক বন্ধুর পথ অনায়াসে পাড়ি দেয়া যায়।

গাড়ী ছাড়বে রাত দশটায়। ভয় হচ্ছে, গাড়ী আসার আগেই না ঘুমিয়ে যাই। ট্রেনিং এর কারনে যত কষ্টই হোক, চট্টগ্রামে গত ২ সপ্তাহ বন্ধুদের সাথে আনন্দেই কেটেছে। সবার ট্রেনিং শেষ হয়নি। যাদের শেষ হয়নি, তাদেরকে রেখেই চলে যাচ্ছি। ওরা আসতে দিতে চায়নি অবশ্য। কিন্তু মনের উপর কি আর জোর চলে?

আমার পাশের সিটের লোকটাই আমাকে জাগিয়ে রাখার দায়িত্ব নিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, “ভাই কোথায় যাবেন?” উত্তর দিলাম, “আমি খুলনা যাবো। আপনি?”
- যশোর। আমি যশোর পল্লীবিদ্যুৎ এ চাকরী করি। আপনার বাড়ি কি খুলনায়?
- হ্যা, আপনার?
- সিরাজগঞ্জ।
- সর্বনাশ
- সর্বনাশ কেনো?
- ভাই, আপনি সিরাজগঞ্জের মানুষ হয়ে যশোরে চাকরি করেন কিভাবে? বাড়ি থেকে এতো দূর! বাড়ি যান কতদিন পর পর?
- শুধু ২ ঈদে যাই। কি করব, চাকরী তো করতে হবে। এটা আমার প্রথম চাকরী। চেষ্টা করব পরের চাকরীটা বাড়ির কাছাকাছি নিতে।
- সেটাই।
- বসেন ভাই, আমি আসতেছি।
- ওক্কে।

লোকটা উঠে টয়লেটের দিকে গেলো। কাজ না থাকলে যা হয়, উষ্টুম-ধুষ্টুম চিন্তা-ভাবনা মাথায় ভর করে। এই মূহুর্তে আমি একটা প্রশ্ন নিয়ে ভাবছি। সেটা হলো, ‘এই লোক বেশী প্রাকটিক্যাল নাকি আমার মধ্যে হোম সিকনেস বেশী?’ তবে উত্তর যাই হোক, হোম সিকনেস যার মধ্যে নেই, তাকে আমি মানুষ বলে গন্য করার কোন কারন দেখি না।

ইতিমধ্যে গাড়ি চলে এসেছে। এতো লম্বা বাস ভ্রমনে জানালার পাশের সিট না পাওয়ার ক্ষোভ এখন অনেক পীড়া দিচ্ছে। পাশের সিটের সহযাত্রী যদি জানালা বন্ধ রাখে তাহলে তো বিপদ।

সকল যাত্রীই আসন গ্রহন করেছে, শুধু আমার পাশের সিটটা খালি। সুপারভাইজার বার বার কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছে কোথায় সেই যাত্রী। একসময় তাকে পাওয়া গেলো। সেই সিরাজগঞ্জবাসী, যশোরগামী, কাউন্টারে আমার পাশে বসে থাকা সেই লোকটা।

গাড়ী ছাড়তে না ছাড়তেই লোকটা আবার কথা বলা আরম্ভ করলো।
- যশোর যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে জানেন?
- বার ঘন্টা কমপক্ষে।
- প্রথম আসলাম তো তাই । কিছুই জানি না।
- ও

আমি কিছুটা অনীহা নিয়েই উত্তর দিলাম। কেননা আমার তখন আলাপ জমানোর কোন ইচ্ছা নেই। লোকটা ও তা বুঝতে পারলো। আর কোন কথা বললো না।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। ঘুম ভেঙ্গেছে কারণ বাস একটু পর পর ‘সর্ট জাম্প’ দিচ্ছে। ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়েতে এইরকম জায়গা একটাই। গোমতী সেতু। জানলা দিয়ে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম। আমার সহযাত্রী জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই আছেন। তাকে এখন খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। নাকি আমার চোখের ভুল? বাসের সকল লাইট অফ। অন্ধকারে বোঝা খুব মুস্কিল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “ভাইকি অফিসের কাজে চিটাগাং এসেছিলেন?”

লোকটা উত্তর দিলো, “আপনি উঠেছেন? গাড়িতো অনেকক্ষণ জ্যামে ছিলো, আপনি টেরই পেলেন না।”
- অনেক ক্লান্ত। আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না।
- এসেছিলাম ব্যক্তিগত কাজে। ১ দিন ছুটি নিয়ে (এই কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ বিরতি নিলেন, তারপর আবার বলতে শুরু করলেন) আপনি কি করেন?
- আমার নাম চপল। বন্ধুরা আদর করে ডাকে ডাবল। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার চেষ্টা করছি। তার ফলস্বরূপ ট্রেনিং করতে চট্টগ্রাম এসেছিলাম।
- ডাবল নামটা কিন্তু আপনার সাথে মানায় ভালো। আপনার সাথে তো আমার আর কখনো দেখা হবে না। আপনার যদি বিরক্ত না লাগে, একটা ঘটনা শেয়ার করতাম।
- না, বিরক্ত লাগবে না। তবে ঘটনা শুনতে আমার একটা শর্ত আছে।
- কি শর্ত?
- জানালাটা অর্ধেক খুলে রাখবেন সারারাত।

শর্তের কথা শুনে লোকটা খুব অবাক হয়েছিলো, শর্ত শুনে হেসে ফেললো। এতো জোরে হেসে ফেললো যে আমাকে সাবধান করতে হলো, “এতো জোরে হাসলে কিন্তু অন্য যাত্রীরা পেটাবে” ।


এবার লোকটা বলা শুরু করলো,
- সমস্যা নেই, জানালা খোলাই থাকবে সারারাত । আসলে ঘটনাটা আমাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছে। কারো সাথে শেয়ার না করে শান্তি পাচ্ছি না। আপনার সাথে আর কখনো দেখা হবে না, তাই আপনার সাথেই শেয়ার করা ভালো হবে। তাছাড়া আপনি আমাকে হয়তো কোন সাজেশানও দিতে পারবেন।
- ভাইয়ের ঘটনা কি প্রেম বিষয়ক?
- ঐরকমই
- তাহলে আমার সাজেশানে কোন কাজ হবে না। আমি প্রেমে পড়িনি, প্রেম করিওনি
- তাতে কি? আপনার বিচার-বুদ্ধি যা বলে আপনি তাই বলবেন।
- ওকে। তাহলে দেরী না করে শুরু করেন।


শুরু হলো লোকটার কাহিনী বলাঃ
- আমি বাবা-মার একমাত্র সন্তান। চাকরি পাওয়ার ৫-৬ মাস পর থেকেই মা বার বার বলছে বিয়ে করার কথা। বাড়ি গেলেই আজ এই মেয়ে, কাল সেই মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা বলে। আমি বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে গেছি। মাসখানেক আগে আমার কাছে একটা চিঠি আসে, মা’র হাতে ঠিকানা লেখা। আমি খুব অবাক হই, এই মোবাইল ফোনের যুগে চিঠি কেনো? খামের মধ্যে শুধু একটা ছবি ছাড়া আর কিছু নেই। ৪ টা মেয়ের গ্রুপ ফটো।

আমি সাথে সাথে মাকে ফোন দিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম “এসব কি?”
মা উত্তর দিলো, “মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা বললেই তো তুই বিভিন্ন কথা বলিস। তাই ছবি পাঠালাম। বাম থেকে ২ নাম্বার মেয়েটা। তোর মামার কলিগের মেয়ে।”


মায়ের সাথে কথা যখন বলছিলাম, ছবি আমার হাতে ধরাই ছিলো। এতোক্ষণে খেয়াল হলো, ছবিটা যেনো বাম থেকে ২ নাম্বার মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করেই তোলা হয়েছে। কেনো জানি মায়ের সাথে ঝগড়া করতে গিয়েও পারলাম না। মেয়েটা আসলেই অনেক সুন্দর। সেই মূহুর্তেই আমার মনে হলো, সারাজীবন যদি এই মেয়ের সাথে কাটানো যায়, তাহলে আর এতো লুকোচুরি কেনো? আমি মায়ের সাথে কথা শেষ করে মামাকে ফোন দিলাম।

(এই পর্যায়ে এসে শ্রোতাকে কিছু বলতেই হলো)

- ভাই, ছবি দেখেই এতো? আপনিতো ভাই বেশী রোমান্টিক।

(আমার কথা শুনে লোকটা সদ্য কথা বলতে শেখা বাচ্চাদেরকে নাম জিজ্ঞাসা করলে যেভাবে হাসে, সেইভাবে লাজুক হেসে আবার তার কাহিনী বলা শুরু করল)

- মামার কাছ থেকে জানলাম, মেয়েটা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্ডারে ইতিহাসে অনার্স পড়ছে। সেকেন্ড ইয়ার।
- “কোন কলেজ?” জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
- সে কথা থাক। মামার বাসা কাপ্তাই লেকের কাছে। মামাই আমাকে বললেন ছুটি নিয়ে চিটাগাং আসতে। তাহলে কাপ্তাই বেড়ানোও হবে, মেয়ে দেখাও হবে। অবশ্য আমি চাইলে মামা মেয়ের ফোন নাম্বারও এনে দিতে পারবে। মামা মুরুব্বী, তার কাছে ফোন নাম্বার চাইতে সঙ্কোচ হচ্ছিলো। মামা অবশ্য নিজে থেকেই বললেন, দেখা কবে হবে তার তো ঠিক নেই, ফোন নাম্বার উনি পাঠিয়ে দেবেন। আরো জানালেন, মেয়েকে নাকি আমার ছবি অনেক আগেই দেখানো হয়েছে। মেয়ের বাড়ির লোকেরা আমার ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। তাই ফোনে কথা বলতে কোন সমস্যা নেই।
- “মেয়ের বাড়ির লোকেরা আপনার বিষয়ে আগ্রহী বলে, মেয়েও যে আপনার বিষয়ে আগ্রহী তা তো নয়”, বললাম আমি।
- তা তো বটেই। কিন্তু সেটা তো ফোনে কথা বললে বোঝাই যাবে। নাম্বার পেলাম। এর ২ দিন পর থেকেই আমাদের কথা শুরু হলো।
- কতদিন আগের কথা এটা?
- ২ সপ্তাহ।
- মাত্র???
- হুমম। প্রথম ২/১ দিন ফোন দিয়ে আগে ওর আব্বা-আম্মার সাথে কথা বলতাম, আস্তে আস্তে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তার সাথেই কথা বলি। যত কথা বলি, তত মনে হয় সে আরো কাছে চলে আসছে…..

- ভাই দাড়ান, কি ধরনের কথা হত? মানে কাছে যে চলে আসছে কেনো মনে হলো আপনার?
- সেটা আসলে ব্যখ্যা করা সম্ভব না। সে আমার বিষয়ে প্রশ্ন করত, আমি উত্তর দিতাম। আমি তার বিষয়ে তেমন কিছু জিজ্ঞাসা করতাম না।
- কেনো?
- যদি সে না বলতে চায় এই ভয়ে। আসলে জীবনে কোন অপরিচিত মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলিনিতো তাই কেমন বাধত।
- কি আশ্চর্য!তারপর?
- তারপর আমি ছুটি নিলাম রবিবার। বৃহঃষ্পতিবারে রওনা দিলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। মোট ৩ দিন ছুটি। এসে শুক্রবার প্রথম দেখা করলাম মেয়েটার সাথে।
- মেয়ের বাসায়?
- না, প্রথমে বাসা থেকে তাকে সাথে নিয়ে তারপর আমরা ঘুরতে বের হলাম। মেয়ে এমনিতে অনেক ধর্মভীরু। আমি তার চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারছিলাম না।
- মানে বুঝলাম না। মেয়ে আপনার সাথে ঘুরতে বের হলো, তার আগে এতোদিন ফোনে কথা হলো, সেগুলো কোন সমস্যা না ধর্মের দৃষ্টিতে? যাইহোক, বলতে থাকেন।
- আমি তার জন্যে উপহার নিয়ে গিয়েছিলাম কিছু ইসলামী বই। সেগুলো দিলাম। সে দেখে বললো, এগুলো তার আগেই পড়া আছে। তবুও সে রাখলো বইগুলো নিজের কাছে।
- সে কি গিফট দিলো আপনাকে?
- কিছুই না, তাকে তো আমি বাসা থেকে নিয়ে আসলাম। গিফট কিনবে কখন?
- এটা সে বলেছে?
- না, আমি এমনিতেই বললাম।
- আপনি তো তখনই মেয়ের প্রেমে শুধু হাবুডুবু না একেবারে ডুব সাঁতার দিচ্ছেন।
- (আবারো সেই লাজুক হাসি) আমি সরাসরি মেয়েকে বললাম, “তুমি জানো আমি শুধু তোমার জন্যে এতোদূর এসেছি। শুধু তোমার মুখে একটা কথা শোনার জন্যে। তুমি আমাকে বিয়ে করবে কিনা ?”
- গুড গুড
- কোনটা গুড?
- না, ওটা আমার মূদ্রাদোষ। আপনি বলেন।
- মেয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিলো, “বিয়ে করলে আপনাকেই করব”
- অ্যাঁ? এতো সহজেই? বিশ্বাস হচ্ছে না আমার।
- ভাই, আমি আপনার সাথে মিথ্যা কিছু বলছি না। তারপর মেয়েটা বলল, “আপনি আমার একটা উপকার করবেন?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি উপকার। তারপর সে আমাকে একটা ইসলামী বইয়ের লিস্ট দিলো। বললো, “এগুলো অনেক দুষ্প্রাপ্য বই। আপনি ফিরে যাওয়ার আগে এই বইগুলো আমাকে কিনে দিয়ে যাবেন?” আমি সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম। কথা থাকলো, রবিবার আবার আমাদের দেখা হবে। তাকে বাসায় পৌছে দিতে গেলাম। মেয়ের আব্বা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে আমাদের মধ্যে কি কথা হয়েছে। আমি বললাম যে মেয়ে আমাকে কথা দিয়েছে। শুনে উনি বললেন, “আমার মেয়ে কথা দিলে তা কখনো ভংগ করে না।” আমার প্রচন্ড আনন্দ হচ্ছিলো। যেনো সারা জীবনে আর কিছুই চাওয়ার নেই আমার।


বাসায় ফিরে মামাকে জানিয়ে দিলাম সব কথা। মামা বললেন, “মাঝে শনিবারতো সময় আছে। এরমধ্যে আমি মেয়ের ফ্যামিলির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখি।”

মামা শনিবার খোঁজ নিতে গেলেন। আশেপাশের প্রতিবেশীদের থেকে খোঁজ নিয়ে ফিরে আসার পর রাতে মেয়ের মা ফোন করলো মামার মোবাইলে। ফোন করেই আক্রমনাত্মক কথা শুরু করলো। তার কথার সংক্ষিপ্ত রূপ ছিলো এরকম, “আপনার পরিবারের সাথে আমার পরিবারের ২৩ বছর ধরে জানাশোনা। অথচ আপনি আমাদের কথা বিশ্বাস না করে প্রতিবেশীদের কাছে খোঁজ নিলেন কেনো?”
- অদ্ভুত ব্যপার। বিয়ের আগে মানুষ খোঁজ নিবে না?
- সেটাইতো মামা বুঝানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু মেয়ের মা বুঝতেই চায়না।
- ভাই, একটা প্রশ্ন, মেয়ের বাড়ি কোথায়?
- চিটাগাং
- আপনার সাহস আছে ভাই।
- মানে?
- কোথায় সিরাজগঞ্জ আর কোথায় কাপ্তাই লেক। কালচারতো মেলেই না, তার উপরে ভাষা। যাইহোক। বলেন।
- এইভাবে যুক্তি দিতে দিতে মেয়ের মা একসময় বলে বসেন, যে পরিবার এই সামান্য বিশ্বাস্টুকু রাখতে পারে না, সেখানে তার মেয়েকে বিয়ে দেবে না। মামা শেষ পর্যন্ত এটা বলে সামাল দেন যে, যেহেতু পরদিনই দুই জনের দেখা হবার কথা, যাদের বিয়ে, তাদেরকেই সিদ্ধান্ত নিতে দেয়া হোক।

আজ, অর্থাৎ রবিবার ছিলো সেই দিন। কথা ছিলো, অন্দরকিল্লা থেকে বই কিনে সেখানেই তার সাথে আমার দেখা হবে। তারপর আমি চলে আসব।

বইগুলো অনেক দামী। সেগুলো কেনার পর আমার কাছে খুব সামান্য টাকা বাকী ছিলো। তাতে আমার সমস্যা হবার কথা না। কারন ফিরতি টিকেট বুকিং করা আছে। সেখানে ২০০ টাকা মাত্র বাকী।

আমি গেলাম তার সাথে দেখা করতে। তার প্রথম কথাই ছিলো, “বইগুলো এনেছেন?” আমি তাকে বই গুলো দিলাম। সরাসরি জিজ্ঞাসা করলাম, “তোমার বাসার লোকজন এখন আমাদের বিয়ের বিপক্ষে। তোমার কি মত? তোমার সিদ্ধান্তের উপরই সব নির্ভর করছে।”

- মেয়ে কি আজকেও শুধু চোখ বের করে এসেছিলো?
- না, আজ বোরখা ছিলো। কিন্তু সম্পুর্ন মুখ ঢাকা ছিলো না।
- হাস্যকর। তারপর?
- কি হাস্যকর?
- আগে শেষ করেন, তারপর বলব।
- সে উত্তর দিলো, “ভাগ্যে থাকলে হবে, নাহলে আমার কিছু করার নেই”।
- সেকি???
- আমি বললাম, “তুমি তো আমাকে কথা দিয়েছিলে, মাত্র ২ দিন আগে।”

সে কোন উত্তর দিলো না। আমি আবার বললাম, “আমি শুনেছি তুমি কথা দিলে তার ব্যতিক্রম কখনো করো না। তারপরও যদি তোমার কোন ভিন্ন কথা থাকে আমাকে সরাসরি বলে দাও। আজ আমি ফিরে যাবো যশোরে, তুমি আজ কিছু না বললে আমি ভীষণ এক পিছুটান নিয়ে ফিরে যাবো।”

সে তারপরেও কোন উত্তর দিলো না। কোন উপায়ন্তর না দেখে আমিও চুপ করে গেলাম। কয়েক মূহুর্ত পর সে বললো, “সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আমাকে যেতে হবে”,
জিজ্ঞাসা করলাম “উত্তর দিয়ে গেলে না?” কিছু না বলেই সে উঠে চলে গেলো।

আমি বাস কাউন্টারে এসে দেখি, মানিব্যাগে মাত্র ৫০ টাকা অবশিষ্ট আছে। কাউন্টারের লোকটাকে বুঝিয়ে বললাম সব। অনুরোধ করলাম, আমাকে টিকেট দিতে। আমি যশোর পৌছেই সকালে তার টাকা পাঠিয়ে দেবো। প্রথমে অনেক চিল্লা-পাল্লা করলো। আমি অনেক কষ্ট করে তাকে বুঝাতে সক্ষম হলাম। বিনিময়ে সে আমার ঐ পঞ্চাশ টাকাও নিলো না।

- সত্যি কথা শুনতে খারাপ লাগে। কিন্তু ভাই, আপনি কিঞ্চিৎ উজবুক টাইপের মানুষ। বই একটা কম কিনলে কি হতো? তাছাড়া, আপনি তো আপনার মামার থেকেই টাকা নিতে পারতেন।

- না, পারতাম না। কারন মামার কাছে যাওয়ার মত সময় ছিলো না। ফোনে মামাকে আজকের ঘটনা জানানোর পরেই ব্যালান্স শেষ হয়ে গেছিলো। আর ঐ পঞ্চাশ টাকা দিয়ে আমি কি বা করব? দিশেহারা হয়ে আসলে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।
- প্রেমে পড়লে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না, এটা শুনেছি অনেকবার। আপনাকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। তো আপনার মামা কি বললো শেষ পর্যন্ত?
- মামা আগামী পরশু মেয়ের বাড়িতে যাবে। সেদিন ই ওদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে। এটাই হচ্ছে আসল পয়েন্ট। আমি বুঝতে পারছি না কি হবে। সে কি আমাকে ফিরিয়ে দেবে?
- যদি ফিরিয়ে দেয় কষ্ট পাবেন?


(এতক্ষণ সে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিলো, আমার এই কথা শুনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। কারন বুঝতে পারছি পরিস্কার। কয়েক মূহুর্ত পরে সে আবার আমার দিকে তাকালো। আমিই কথা বললাম)


“শোনেন ভাই, আপনার যদিও কষ্ট হবে, তবুও বলি, আপনার যে কোন কথা শোনার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। আপনি একজন সচেতন মানুষ হয়েও অনেক কিছু এড়িয়ে গেছেন। বিয়ের আগে মানুষ খোঁজ খবর নেবে, এটাই স্বাভাবিক। তাতে এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানোর কারন কি? আপনি বলেছেন মেয়ে অত্যন্ত ধার্মিক, মিথ্যা বলে না, ওয়াদা ভঙ্গ করে না। কিন্তু আমি আপনার কাছে শুনে তার কোন নমুনা পেলাম না। যে মেয়ের কথা মাত্র ২ দিনে পাল্টে যায়, সে ওয়াদা ভঙ্গ করে না, এটাতো একবারে অলীক। মানছি, পৃথিবীতে কেউ সাধু নয়। কিন্তু মেয়ের এবং মেয়ের বাড়ির সবার আচরনই তো সন্দেহজনক”।

এরপর অনেক্ষণ আমাদের কোন কথা হয়নি। ভোরের আলো ফুটেছে বাইরে। বাস তখন ফেরীতে চড়ে পদ্মা পাড়ী দিচ্ছে। আমি ফেরীর ডেকে দাঁড়িয়ে ভাবছি, শীতকালে পদ্মার পানি এতো পরিস্কার হলো কিভাবে? ভারত হঠাৎ কি মনে করে পানি ছাড়ল অসময়ে? বুঝতে পারিনি কখন লোকটা আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে। সে জিজ্ঞাসা করলো, "তাহলে কি মেয়েটা আমাকে ভালোবাসে না?"

- সেকথা আমি জানি না। নারী হৃদয় সম্পূর্ন বুঝতে পেরেছে এমন একজন পুরুষও পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ। আর আমি তো বলেছিই, Women Psychology তে আমার জ্ঞান ততটুকুই, যতটুকু একটা ভূগোলের ছাত্রের কোয়ান্টাম মেকানিক্সে থাকে। তারপরেও আমার মনে হচ্ছে, আপনি আগ্রহ বেশী দেখাচ্ছেন। আপনি যদি আর আগ্রহ না ও দেখান (যদিও সেটা আপনার পক্ষে অসম্ভব) মেয়ের বাড়ি থেকে পজিটিভ সিগনালই আসবে।

আর যদি আমার সাজেশান চান, যদিও আমার কিছু বলা উচিত না, তবুও বলি, এতো বেশী বিশ্বাস নিজের মা ব্যতীত কাউকে করা উচিত বলে আমি মনে করি না। ধৈর্য্য ধরেন, আল্লাহর উপর ছেড়ে দেন। তিনিই আপনাকে সঠিক পথ দেখাবেন। Definitely, there is some problem with this family. হতে পারে এটা একেবারে অমূলক ধারনা। কিন্তু নিশ্চিত হবার আগে পা বাড়ানোটাই আপনার ভুল হয়েছে। এখন তাড়াহুড়া করে আরো ভুল করবেন না।


**** এটাই ছিলো লোকটার সাথে তার প্রেম নিয়ে আমার শেষ কথা। যশোরে নেমে যাওয়ার মূহুর্তে সে বলেছিলো, “আপনি ধৈর্য্য ধরে আমার কথা শুনে আমাকে ভারমুক্ত করেছেন। অনেক ধন্যবাদ। আপনার কথা আমার মনে থাকবে সারাজীবন। আরেকটা শেষ অনুরোধ, আমার জন্যে একটু দোয়া করবেন। যেনো আমি সুসংবাদটা ই পাই।” আমি তার কথার কোন উত্তর দেইনি, শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম। তার শর্ত অনুযায়ী, তার এই অসমাপ্ত কাহিনী কাউকে বললেও তার পরিচয় ফাঁস করা যাবে না। তাই ‘লোকটা’ বলেই সম্বোধন করলাম।

জানি না কি ছিলো তার প্রেমের শেষ পরিণতি। তবুও এটাই ধরে নেয়া ভালো যে, মেয়েটি সত্যিই তাকে ভালোবেসেছিলো। সেদিনের সন্ধ্যায় মেয়েটির নিরবতা তার অসম্মতির জন্যে ছিলো না, ছিলো ক্ষণিকের অভিমান। শুধু এই একটা মাত্র ব্যখ্যাই মনে হয় লোকটার মনে শান্তি আনতে পারে। আমি/ আমরা সেটাই কামনা করি। ****

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১০:৩০
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তোমাকে লিখলাম প্রিয়

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০২ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০১


ছবি : নেট

আবার ফিরে আসি তোমাতে
আমার প্রকৃতি তুমি,
যার ভাঁজে আমার বসবাস,
প্রতিটি খাঁজে আমার নিশ্বাস,
আমার কবিতা তুমি,
যাকে বারবার পড়ি,
বারবার লিখি,
বারবার সাজাই নতুন ছন্দে,
অমিল গদ্যে, হাজার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

×