আগেই বলে নিচ্ছি, ছাত্র রাজনীতি বিষয়ক সেই পুরনো প্যাচাল বিষয়েই এই লেখা। যারা এই বিষয়ের উপর ভিত্তি করে বানানো বাংলা নাটক দেখতে দেখতে এবং সুশীল সমাজের মাথা যন্ত্রনা সহ্য করতে করতে বিরক্ত বোধ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাদের জন্যে এই লেখা নয়। আমি ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে নই, এবং এর উপকারীতা সম্পর্কে ও আমাকে জ্ঞান দেবার প্রয়োজন নেই।
আমি আজন্ম শহুরে। তাই গ্রাম থেকে হঠাৎ শহরে আসা ছেলেদের মত রাজনীতিকে ভয় পাইনি কখনো। তাই, খোলা চোখে, প্রথম যেদিন কলেজে গিয়েছিলাম ভর্তি ফর্ম উঠানোর উদ্দেশ্যে, সেদিন ই চোখে পড়েছিলো বর্তমান ছাত্র রাজনীতির চাটুকারী রূপ।
ভর্তি মৌসুমে প্রত্যেকটা সরকারী কলেজের মেইন গেটের চিত্র প্রায় একই রকম হয়। আমার কলেজও তার ব্যতিক্রম ছিলো না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে নবীণদের শুভেচ্ছা (!) এবং সেই সাথে নিজ নিজ সংগঠনের নাম কীর্তন সম্বলিত ব্যানারের ছড়াছড়ি । দেখতে ভালোই লাগে তখন, কেননা এইসব রঙ্গীন ব্যানার কিছুটা হলেও গেটের সাজসজ্জা বাড়িয়ে দেয়।
গেট দিয়ে ঢুকলেই অনেক গলা একসঙ্গে ডাকতে থাকে নিজ দলের টেবিলের দিকে। আমি নির্দিষ্টভাবে কোন দলের নাম বলতে চাই না। এই কাজের ক্ষেত্রে ইসলামী ও সেক্যুলার সকল দলের আচরন একই।
সুকৌশলে যারা ফর্ম নেয়, তাদের নাম এদের কোন না কোন টেবিলে থাকা খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। অনেক সময় নামের সত্তাধিকারীর অজান্তেই।
তারপর???
নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি।
বাংলাদেশে বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে লোক বেশি থাকে। আমার ফি বুকে যথারীতি ততকালীন ক্ষমতাসীন দলের সীল পড়েছিলো। ভালো কথা, জিনি এই কাজের হোতা ছিলেন, তার বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। কারন, মৃতদের নামে বাজে কথা বলা অনুচিত। তিনি অপঘাতে মারা যান, যেটা আত্মহত্যা নাকি হত্যা, তা সমাধান হয়নি কোনদিন।
যা বলছিলাম, ভর্তির দিনে আমার ফি বুকে সরকারী দলের সীল পড়ল। সেই সূত্র ধরে ছাত্র সংসদের সেক্রেটারি বক্তব্য জারী করলেন, যাদের ফি বুকে তার সংগঠনের সীল আছে, তাদেরকে দলীয় মিটিঙ্গে থাকতে হবে এবং হবেই। আমি থাকতে না চাওয়াতে আমার ফি বুক আটকে রাখা হলো।
উপায়ন্তর না দেখে সরকার সমর্থিত এক প্রভাবশালী শিক্ষকের নিকট ব্যাচে পড়তে যাওয়ার মিথ্যা কথা বলে নিজের বেতন বহি ছাড়াতে হয়েছিলো আমাকে।
ঘটনা এখানেই শেষ হলে হতো। সপ্তাহ পার না হতেই পরিচয় পত্রের জন্যে বেতন বই আবার জমা দিতে হলো। সেখান থেকে সেটা চলে গেলো আরেক সংগঠনের হাতে (বলাই বাহুল্য, আমি তাদের হাতে দেইনি, ওনারা নিজেদের লোকবল বাড়ানোর লক্ষ্যে অফিস থেকে সেটা সংগ্রহ করেছিলেন) । তারা আগের সংগঠনের নাম মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করে অতঃপর নিজের সংগঠনের নাম সেখানে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ব্যাপক ঘষা-মাজা করেন। যার ফলশ্রুতিতে আমার বেতন বই তার পোশাক হারিয়ে উলঙ্গ হয়ে পড়ে।
এরপরের ঘটনা আরো চমকপ্রদ। আমার লাইব্রেরী কার্ড গায়েব। বিভিন্ন জায়গায় খুঁজতে খুঁজতে সেটার হদিস পাওয়া গেলো স্বয়ং ভিপির ড্রয়ারে। কিন্তু কেনো? আমার মত নিরীহ ছাত্রকে নিয়ে কেনো এতো টানাটানি?
কারন, আমি নাকি একমাত্র ব্যক্তি, যে কখনো ছাত্র সংসদে যাইনি, এমনকি ছাত্র সংসদের কমিটিতে কে কে আছে, তা ও জানি না।
খুব সহজ ভাবে উত্তর দিয়েছিলাম, "এসব নাম জেনে আমার লাভ?"
তারপর ভিপি সাহেব আবির্ভুত হয়েছিলেন স্বমূর্তিতে।
কিন্তু সেবারো আমি বেঁচে গেলাম, কারন আমার পিছনে 'জ্যাক' ছিলো।
এভাবেই চলে এইসব সংগঠনের কার্যকলাপ। কে স্বেচ্ছায় সংগঠনে যোগ দিচ্ছে, সেই খবর এরা খুব কমই রাখে।
সবার পিছনেতো জ্যাক থাকে না। তাহলে সেইসব জ্যাক বিহীন ছাত্রেরা কি করে?
তারা আমার মত দুঃসাহস দেখিয়ে ভিপির সাথে তর্ক করতে যায় না, তারা সবসময়ই কোন একটি সংগঠনের সাহায্য নিতে থাকে। ভুলেও অন্য সংগঠনের ধারে কাছে যায় না, কোপানলে পড়ার ভয়ে। তারপর নিজের সকল অফিসিয়াল কাজে সেই সংগঠনের লোকেরা তাকে অযাচিতভাবে সাহায্য করে। নিজের অজান্তেই সে কলেজে সেই সংগঠনের সদস্য বলে পরিচিত হয়। জড়িয়ে যায় এক অদ্ভুত জালে।
যেসব ছাত্রেরা আরেকটু সরেষ, তারা নিজের গরজেই নিজের পছন্দের সংগঠনে যোগদান করে। করবে না ই বা কেনো? রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য হলে ক্যাম্পাসে সালামের অভাব হয় না, গেট দিয়ে ঢুকতেই সামনে চাটুকারের ভীড়, কখনো কখনো শিক্ষকেরাও এদের দেখে পথ ছেড়ে দেয়।
যে ছেলেটা গ্রাম থেকে হঠাৎ এসেছে শহরে, শহরে ছেলেরা তার কাছে ঘেষতে চায় না। সে নিয়মিত সামনে বসে বলে টিটকারীর অভাব হয় না, কখনো কখনো তার প্রশ্ন শুনেই ক্লাসে হাসির রোল পড়ে যায়, সেই ছেলেটাই যখন রাজনৈতিক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ন নেতা হয়ে ওঠে এর কোনটাই আর থাকে না।
কারন সে আর ক্লাসে যায় ই না, টিটকারী আসবে কিভাবে? আর সেইসব টিটকারী করা বন্ধুরাও তাকে দেখলে আর টু শব্দ করে না। আফটার অল, অযথা মার খেতে কে ই বা চায়?
তার চারপাশের দুনিয়ার এই হঠাৎ পরিবর্তন সে উপভোগ করতে শুরু করে। আর এভাবেই দীর্ঘায়িত হয় তার মায়ের কান্না।
মা প্রতিদিন জিজ্ঞাসা করে, "কেমন আছিস বাবা? সব ঠিকঠাক চলছে তো?"
ছেলের উত্তর, "খুব ভালো আছি মা। সবকিছু ঠিকমত চলছে। (ঠিক না থাকলে আগুন লাগিয়ে দিবো না?) তুমি কোন চিন্তা কোর না, খুব শীঘ্রই আমি আয়ের পথ ধরছি। (অলরেডী চাঁদাবাজি শুরু করেছি)"
মা ব্র্যাকেটের কথা গুলো শুনতে পান না। প্রত্যুত্তরে বলেন, "থাক, টাকা নিয়ে বেশী চিন্তা করিস না। এতোদিন যেমন চলেছে, আরো কিছুদিন চলবে"।
মা নিজের ছেলের কথায় আশ্বস্ত হয়ে দিন গুনতে থাকেন কবে ছেলে হোমরা-চোমরা হয়ে ঘরে ফিরবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, গ্রাম থেকে আসা এই সহজ সরল ছেলেগুলোকে সকল সংগঠনের ই পছন্দ। আর তাই, ডন হবার স্বপ্ন দেখতে এদের খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না।
শেষ পর্যন্ত কি হয় এদের?
কেউ কেউ সত্যি ডন হয়ে ওঠে। মায়ের অশ্রুজল নিয়ে তাদের চিন্তা করার অবসর থাকে না। তার থেকে সমাজ সেবা (!!!) এদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ন। সমাজ সেবা বলতে তারা সেই ভুল জিনিষটাকেই বোঝে, যেই ভুল তার পূর্বসুরী করেছিলো একদিন তার প্রতি।
এটাই এদের চোখে সমাজ সেবা। দুঃখিনী মায়ের নিরীহ ছেলেগুলোকে খুঁজে বের করা। তারপর তাদেরকে সাময়িক সুখের খবর দিয়ে ডন হবার স্বপ্ন দেখানো এবং শেষে আজন্ম রক্ষিত আদর্শিক জাল থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে সকল নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে সুখী হবার পথে নিয়ে যাওয়া।
মা দেখেন, ছেলে টাকার মালিক হয়েছে বটে, কিন্তু এই নৈতিকতা বর্জিত সন্তান কি তিনি চেয়েছিলেন?
অশ্রুজল আর বাঁধ মানে না।
আর সবশেষে, আমার মত নিরীহ শহুরে ছাত্র, যে কিনা সেই প্রিয় সহজ-সরল গ্রাম্য বন্ধুকে একদিন অন্য বন্ধুদের টিটকারীর আঘাত সামলানোর জন্যে সান্তনা দিতাম, একদিন সেই বন্ধুকেই আবিষ্কার করি ক্যাম্পাসের সামনে রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে পাবলিক পরিবহন থামিয়ে চাঁদাবাজি করতে।
তার কিছুদিন পর দেখি মিছিলে নেতৃত্বদানকারী ছেলেটা আমার এক সময়ের বোলিং পার্টনার সেই অপার সম্ভাবনাময় ছেলেটা।
তার ও কিছুদিন পর সেই ছেলেটা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে মারামারির ফলে attempt to murder কেইস এর আসামী হয়ে ফেরারী হয়।
অথবা আমারই এক বন্ধুর কোন এক ঘনিষ্ট বন্ধুর নাম চলে আসে বিশ্বজিতের খুনিদের নামের তালিকায়।
ঘৃনা হয় নিজের প্রতি, একদিন তাকে বন্ধু ভাবতাম বলে।
ঘৃনা হয় নিজের প্রতি, কারন আজো সমাজকে বদলানোর দ্বিবা স্বপ্ন দেখি ঘরে বসে।
ঘৃনা হয় নিজের প্রতি, কারন আমিও এই সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ।
(কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমন করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার বাবা এক সময়ের দাপুটে ছাত্র নেতা। ক্ষোভ তার প্রতি ও কম নয়। কেননা, সেই সময়কার রাজনীতিতে তারা হয়ত দেশের জন্যে অবদান রেখেছেন অনেক, যা অনস্বীকার্য। কিন্তু উত্তরসূরিদের সঠিক পথের সন্ধান দিয়ে যেতে পারেন নি। এই ব্যর্থতা তারা অস্বীকার করতে পারবেন না।)