মনে হয় মাত্র এই সেদিনের কথা, অথচ এরই ভিতর সুদীর্ঘ ত্রিশটি বছর পার হয়ে গেছে। ১৯৮১ সালের এপ্রিল মাস। সদ্য আঠার বছর উত্তীর্ণ এক তরুণ ঢাকার বিখ্যাত সোনারগাঁও হোটেলে তার চাকুরীজীবন শুরু করে। যারা এই হোটেলের চাকুরীতে যোগদান করতে পারেনি অথবা পার্শ্ববর্তী বড় রাস্তা বা রেললাইন দিয়ে চলমান যাত্রীদের কাছে এই হোটেল একটি স্বপ্নপূরীর মত ছিল।
এই তরুণের চাকুরী প্রক্রিয়া আরো প্রায় আট মাস আগে থেকে শুরু হয়েছিল। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের আওতাধীন পর্যটন প্রশিক্ষন কেন্দ্রের (টি,টি,আই) এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘ফুড এন্ড বেভারেজ সার্ভিস’ কোর্সে এক মাসের প্রশিক্ষনের জন্য ভর্তিচ্ছুদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহবান করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা ছিল যে সফলভাবে কোর্স সমাপনকারী ছাত্রদের তখন নির্মানাধীন দেশের প্রথম পাঁচ তারকা বিশিষ্ট হোটেল সোনারগাঁওয়ে চাকুরী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। উল্লেখ্য, পর্যটন প্রশিক্ষন কেন্দ্রটি UNDP এবং ILO’র কারিগরী সহায়তার আওতাধীন এবং কোর্সগুলি তাদের বিশেষজ্ঞ দ্বারা পরিচালিত হত। যদিও এটি একটি প্রশিক্ষণ কোর্স, ভর্তিচ্ছুদেরকে আই, এল, ও এবং টি,টি, আই প্রশিক্ষকদের একটি দল ইংরেজী ভাষাতে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে নির্বাচিত করেছে। গ্রামে বড় হওয়া, স্থানীয় স্কুল এবং জেলা সদরের কলেজ থেকে পাশ করা এই তরুণের জন্য এটাই প্রথম কোন বিদেশীর সাথে সরাসরি ইংরেজীতে কথা বলা। প্রশ্নগুলি যদিও তেমন কঠিন ছিলনা – যেমন, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের প্রথম কয়েকটি লাইন বলা এবং তার ইংরেজী অনুবাদ করা, লেখকের নাম বলা ইত্যাদি। (ইংরেজীতে অনুবাদ করাটা তেমন কঠিন ছিল না কারণ তৎকালীন সময়ের বহুল প্রচলিত হারুন ডায়েরীর ভিতরে শুরুর দিকেই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত এবং তার ইংরেজী অনুবাদ ছাপানো থাকত।)
তারপর তাকে বলা হল টেবিল থেকে পিরিচ সহ একটি চায়ের কাপ উঠিয়ে কয়েক কদম হাটার জন্য। সাক্ষাৎকার শেষে আত্মবিশ্বাসের সাথে সাথে কিছুটা হলেও ঘাবরে যাওয়া এই তরুনকে বলা হল কতগুলি স্বাস্থ পরীক্ষা করিয়ে তার রিপোর্ট নিয়ে আবার এই প্রশিক্ষন কেন্দ্রে আসার জন্য। স্বাস্থ পরীক্ষার ভিতর ছিল বুকের এক্স-রে (যক্ষা রোগ নির্ণয়), রক্ত এবং মল-মূত্র পরীক্ষা। সব রিপোর্টই ভাল থাকায় এই তরুনকে বলা হল প্রশিক্ষন কেন্দ্রের ব্যাংক একাউন্টে ফি জমা দিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য। কোর্সে অংশ গ্রহনকারী ছাত্রদের নির্ধারিত পোষাক ছিল কাল প্যান্ট আর সাদা শার্ট।
সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ক্লাস চলত, মাঝে সকাল পৌণে দশটায় পনের মিনিটের বিরতি। পৌণে আটটায় দৈনিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা / পরিপাটিত্ব পরীক্ষা করা হতো – শেভ করা, নখ কাটা, পরিষ্কার ও ইস্ত্রী করা কাপড়, পরিষ্কার জুতা ও কাল মোজা ইত্যাদি। প্রশিক্ষণ গ্রহনের জন্য এই তরুণ প্রতিদিন নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা যাওয়া করত।
প্রথম ব্যাচে দুইজন মহিলা সহ প্রায় চল্লিশ জনের মত প্রশিক্ষণার্থী ছিল। এর ভিতর অনেকেই টি,টি,আই এর ক্যটারিং কোর্স সম্পন্ন করা প্রাক্তন ছাত্র, এমনকি কেউ কেউ আবার পূর্ববর্তী কোর্স শেষ করে তৎকালীন ইন্টারকন্টিনেন্টাল বা পূর্বানী হোটেলে প্রশিক্ষণ ও নিয়েছেন। ক্লাসে প্রতিটি বর্গাকার টেবিলে চারজন করে ছাত্র বসার ব্যবস্থা ছিল। প্রতিটি টেবিল টেবিলক্লথে আবৃত থাকার কারণে কামরাটিকে প্রশিক্ষণ কক্ষের তুলনায় রেষ্টুরেন্ট বলে বেশী মনে হত। আই,এল,ও বিশেষজ্ঞ মিঃ ডেভিড বার্কার মূলতঃ ক্লাস পরিচালনা করতেন যদিও প্রতিটি ক্লাসেই টি,টি,আইয়ের এক বা একাধিক প্রশিক্ষক উপস্থিত থাকতেন যদি কোন কারণবশতঃ বাংলায় তরজমা করার প্রয়োজন হত। মিঃ বার্কারের প্রথম ক্লাসের পর মিসেস জেন ব্রাউন নামের মিষ্টভাষী একজন ভদ্রমহিলা ইংরেজী ক্লাস নিতেন, তিনি সবার কাছেই খুব প্রিয় ছিলেন। মিসেস ব্রাউনের স্বামী বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের প্রধান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। সম্ভবতঃ মিসেস ব্রাউন ব্রিটিশ এবং ওনার স্বামী মার্কিন নাগরিক ছিলেন। মিসেস ব্রাউনের ক্লাসের পর আমরা বিরতি পেতাম এবং তারপর আবার যথারীতি মিঃ বার্কারের ক্লাস।
প্রশিক্ষণের কাজে মাঝেমধ্যে অডিও-ভিজ্যুয়াল পদ্ধতি ব্যবহার করা হত। উপরন্তু, প্রশিক্ষণের সুবিধার জন্য আমাদেরকে প্রয়োজনীয় হ্যান্ডআউট দেয়া হত।
এর ভিতরই সোনারগাঁও হোটেলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা আমাদের ক্লাস পরিদর্শনে আসতেন এবং আমাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – রেসিডেন্ট ম্যানেজার, কম্পট্রোলার এবং এক্সিকিউটিভ শেফ।
পর্যটন প্রশিক্ষন কেন্দ্রে শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে আমাদেরকে হাতে-কলমে জ্ঞাণ দেয়ার উদ্দেশ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল ও পূর্বানী হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমরা সেখানে মিটিং রুম এবং রেষ্টুরেন্টের সেট-আপ দিয়েছি। এছাড়াও আমাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ পর্যটন কর্পোরেশনের আওতাধীন সাকুরা রেষ্টুরেন্টে উইকেন্ড ডিনার এবং আউটসাইড ক্যটারিংয়ে অংশ নিয়েছি।
সোনারগাঁও হোটেলের জন্য বিশেষভাবে পরিকল্পিত পর্যটন প্রশিক্ষন কেন্দ্রের এই ফুড এন্ড বেভারেজ সার্ভিস কোর্সে তখন আনুমানিক আটটি ব্যাচ এবং শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য দুইটি বিশেষ ব্যাচ পরিচালনা করা হয়েছিল। আমরা প্রথম ব্যাচে ছিলাম, অন্যদিকে দ্বিতীয় ব্যাচের ক্লাস শুরু হত দুপুর দুইটা থেকে।
ফুড এন্ড বেভারেজ সার্ভিস কোর্স ছাড়াও সোনারগাও হোটেলের জন্য তখন ফ্রন্ট অফিস এবং হাউজকিপিংয়ের উপড় আলাদা আলাদা কোর্স করানো হচ্ছিল।
আমাদের কোর্স শেষ হয়ে যাবার পর আমার দুই সহপাঠি সহ আমরা তিনজন মিলে আমাদের প্রিয় শিক্ষিকা মিসেস জেন ব্রাউনকে বাংলাদেশ বিষয়ক একটি ইংরেজী বই উপহার হিসেবে দেই।
কোর্স শেষে সার্টিফিকেট পাবার জন্য সকল প্রশিক্ষণার্থীকেই চুড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হয়েছে। ৮৫% বা তার চেয়ে বেশী নম্বর প্রাপ্তরাই শুধুমাত্র সোনারগাও হোটেল কর্তৃক প্রদত্ত একমাসের আরেকটি প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেয়ার সুযোগ পায়।
পর্যটন প্রশিক্ষন কেন্দ্রটি তখন ৫ নম্বর গজনবী রোড, মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ছিল, রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুলের ঠিক উত্তর পার্শ্বে। প্রশিক্ষকমণ্ডলীতে ছিলেন মিসেস জুলফিয়া আহমদ (চীফ ট্রেনিং অফিসার), গোলাম মাসুম চৌধুরী, আনিসুর রহমান, উ খি মং, মাহতাব উদ্দীন আহমদ (স্বেচ্ছা কর্মী) প্রমুখ।
১৯৮১ সালের জানুয়ারী মাসের শেষে বা ফেব্রুয়ারীর প্রথমদিকে টি,টি,আই থেকে সাফল্যজনকভাবে কোর্স সম্পন্নকারীরা মার্চ মাসে সরাসরি সোনারগাঁও হোটেলের ম্যানেজমেন্ট কর্তৃক পরিচালিত এক মাসের একটি ট্রেনিং কোর্সে অংশগ্রহনের আমন্ত্রনপত্র পায়। ১লা মার্চ তারিখে মীরপুর রোডস্থ গোল্ডেন গেট হোটেলে (ঢাকা কলেজের বিপরীতে) ট্রেনিং কোর্সটি শুরু হয়। এক সপ্তাহ বা দিন দশেক পরে সবাইকে নিউ ইস্কাটন রোডে স্থানান্তরিত করা হয় যেখানে তিনটি পৃথক ভবনে ট্রেনিং প্রদান আব্যাহত থাকে। ১) ২৯ নিউ ইস্কাটন রোডে অবস্থিত হোটেলস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এর অফিস ভবন (সোনারগাঁও হোটেলের মালিক কোম্পানী), ২) রাস্তার বিপরীত দিকে অবস্থিত YMCA ভবনে, এবং ৩) গলির ভিতরে অবস্থিত YMCA স্কুল ভবন।
টি,টি, আই থেকে নির্বাচিত ১২০ জন প্রশিক্ষণার্থী ও সেই সাথে হোটেল কর্তৃক সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ফুড এন্ড বেভারেজ সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের কর্মীরা এই মাসব্যাপী প্রশিক্ষণে অংশ নেয়। টি,টি,আই’য়ের প্রশিক্ষণার্থীরা মূলতঃ সর্বনিম্ন শ্রেণীর পদে নিয়োগের জন্য নির্বাচিত ছিল আর নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিল দেশ বা বিদেশ হতে পূর্ব অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ওয়েটার ও রেষ্টুরেন্ট সুপারভাইজার এবং ম্যনেজাররা। এই ট্রেনিংযের মূল উদ্দেশ্য ছিল হোটেল চালু হবার পর সবাই যেন সমমানের সেবা প্রদান করে।
ফুড এন্ড বেভারেজ ডিপার্টমেন্টের ট্রেনিং প্রদানকারীদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনাবঃ ওয়াহাবুজ্জামান আহমেদ (ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে সুদীর্ঘ ১৪ বছরের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতাধারী) – ট্রেনিং ম্যানেজার; বিলাল হোসেন জয় – সেলস এন্ড মার্কেটিং ডিরেক্টর; ফিলিপ লিয়ং – কম্পট্রোলার; মাইক হারম্যান – ফুড এন্ড বেভারেজ ম্যানেজার; হর্ষ্ট ম্যুলার – এক্সিকিউটিভ শেফ; গুন্থার এরেনহোল্ড – রেসিডেন্ট ম্যানেজার; ফিলিপ গোমেজ – ক্যাফে বাজার ম্যানেজার; আলমগীর খান – কারওয়ান সরাই ম্যানেজার; জহিরুল হক চৌধুরী – রুম সার্ভিস ম্যানেজার; মোফাজ্জল হোসেন ভুঞা – খৈয়াম বার ম্যানেজার; শাহাদত হোসেন – ব্যাঙ্কুয়েট ম্যনেজার। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলত।
মোটামুটি দুই সপ্তাহের মত সম্মিলিত প্রশিক্ষণের পর সকল প্রশিক্ষণার্থীকে একে একে ডেকে সকল রেষ্টুরেন্ট ম্যানেজাররা একযোগে প্রাথমিকভাবে তাদেরকে আলাদা আলাদা রেষ্টুরেন্টের জন্য মনোনীত করেন। এর পর থেকে সম্মিলিত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী তার নিজস্ব শাখার / রেষ্টুরেন্টের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করতে থাকে। আমাকে বারের জন্য নির্বাচন করা হয়।
ট্রেনিং শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগে ঘোষনা করা হয় যে মাসের শেষে অনুষ্ঠিতব্য চুড়ান্ত সমাপনী পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে টি,টি,আই’য়ের ১২০ জন প্রশিক্ষণার্থীর মধ্যে মাত্র ৯০ জনকে ১লা এপ্রিল থেকে নিয়োগদান করা হবে। তবে আপাততঃ নিয়োগ না পাওয়া ৩০ জনের আশাহত হবার কোন কারণ নাই। যেহেতু হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের জন্যও সময় এবং অর্থ বিনিয়োগ করেছে, ভবিষ্যতে প্রয়োজন অনুযায়ী তাদেরকেও পর্যায়ক্রমে চাকুরীতে নিয়োগ দান করা হবে।
সকল প্রশিক্ষণার্থীই তখন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে ১লা এপ্রিলে কি খবর শুনবে। ৩১শে মার্চ রাতে স্নায়বিক চাপ কমানোর জন্য জীবনে প্রথমবারের মত আমি ঘুমের ঔষধ খেয়ে শুতে যাই, তবে এতেও কাজ হয়েছিল কি না বলা বাহুল্য। নির্দ্দিষ্ট দিনটিতে, ১লা এপ্রিল সকালে, সবাই প্রচন্ড মানসিক চাপের ভিতর সময় পার করছে। সুখের বিষয় এই যে আমার ঘনিষ্ট বন্ধু মাহবুবুল হাসান ও কার্তিক চন্দ্র সাহা সহ আমিও সফল প্রশিক্ষণার্থীদের দলে ছিলাম। সফল প্রত্যেক প্রার্থীকে সেদিন থেকে যার যার কর্মচারী পরিচিতি নম্বর নির্দ্দিষ্ট করে দেয়া হয় এবং সেদিন থেকেই ছয় মাসের প্রবেশনারী পিরিয়ড সাপেক্ষে প্রত্যেকের নিয়োগ কার্যকর গণ্য হয়। তবে হোটেল চালু না হওয়া পর্যন্ত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। পূর্ব ঘোষনা অনুযায়ী প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে মার্চ মাসের জন্য ১০০ টাকার প্রশিক্ষণ ভাতা প্রদান করা হয়।
তবে সেদিন সকালবেলা সকল প্রশিক্ষণার্থীই হতবাক হয়ে যায় পারভীন আক্তার নামের একজন খুবই সম্ভাবনাময় প্রশিক্ষণার্থীনি নিয়োগ না পাওয়াতে, যদিও শুনা যাচ্ছিল যে হোটেলের শো-কেস রেষ্টুরেন্ট বলে অভিহিত কারওয়ান সরাই রেষ্টুরেন্টের হোষ্টেস হিসেবে তাকে প্রাথমিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
অবশ্য অনেক পরে তার নিয়োগ না পাওয়ার কারণটি শোনা গিয়েছিল। চুড়ান্ত পরীক্ষার একদিন আগে পারভীন অন্য আরেকজন প্রশিক্ষণার্থী সহ “সকল প্রশিক্ষণার্থীদের পক্ষ থেকে” রেষ্টুরেন্ট ম্যানেজারদেরকে অনুরোধ করেছিল সেদিন সবাইকে তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেয়ার জন্য যাতে করে পরেরদিনের পরীক্ষার জন্য সবাই ভালভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে। এর থেকে ধরে নেয়া হয়েছিল যে কখনো শ্রমিক ইউনিয়ন সংগঠিত হলে সেখানে তার কার্যকর ভূমিকা থাকতে পারে এবং হোটেলের ম্যানেজমেন্ট এধরনের কোন ঝুঁকি নিতে মোটেও রাজী ছিল না।
ট্রেনিং ক্লাস আগের মতই চলছিল এবং ম্যানেজাররা জানালেন যে অল্পদিনের ভিতরই সবাই হোটেলে যেতে পারবে। এরই ভিতর যেসব ম্যানেজার হোটেলের ভিতরে ঘুরে এসেছেন তারা বললেন যে হোটেলের সাজ সজ্জা এবং অলঙ্করণ খুবই জাকজমকপূর্ণ যা কিনা তারা এই হোটেলে যোগদানের আগে মধ্যপ্রাচ্যের যে সব হোটেলগুলিতে কাজ করেছেন সেখানেও এমনটা দেখেননি।
তখনকার ট্রেনিংয়ের প্রধান বিষয়বস্তগুলির একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল হোটেলশিল্পে ব্যবহৃত বিশেষ শব্দকোষ, অতিথিদের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ের সম্ভাব্য কথোপকথন, অতিথিদের সেবা, সন্তুষ্টি, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্য্যা ও সাজ-সজ্জা / পরিপাটিত্ব, অভিযোগ মোকাবেলা করা – মোটকথা সর্বোচ্চ অতিথিসেবা, সন্তুষ্টি ও মান বজায় রেখে হোটেল / রেষ্টুরেন্ট পরিচালনা করার সকল পদ্ধতি তখন আমাদেরকে শিখানো হত। সত্যি বলতে, আমাদের অতিথিরা কখনোই বুঝতে পারতেন না যে তাদেরকে এত ভাল সেবা প্রদানকারী বেশিরভাগ কর্মীই হোটেল পেশাতে একেবারে নতুন। প্রশিক্ষণের উপড় হোটেল কর্তৃপক্ষের এমন গুরুত্ব আরোপ এবং সেইসাথে অতিথিপরায়ণ আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণেই এগুলি সম্ভব হয়েছিল। পেশাগত জীবনের শুরুতেই আমাদেরকে এমন গুরুত্ব ও যত্নের সাথে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের জন্য সকল রেষ্টুরেন্ট ম্যানেজার ও প্রশিক্ষকদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ও বিনম্র শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
অল্প কিছুদিনের ভিতরই আমাদের ট্রেনিং ক্লাস হোটেলের বলরুমে স্থানান্তরিত হল। আরও কিছুদিন পরে ষ্টাফ ক্যফেটেরিয়া চালু হল আর আমাদের ডিউটিকালীন সময়ের খাওয়া দাওয়া ও সেখানেই হত। এই সময়ের দিকেই পার্সোনেল ম্যানেজার জনাব আবু আবদুল্লাহ হোটেলে যোগদান করেন এবং বলরুমের ভিতর ট্রেনিং চলাকালীন সময়ে এফ এন্ড বি ডিপার্টমেন্টের সবার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। ততদিনে ট্রেনিং কার্য্যক্রম যার যার নিজস্ব রেষ্টুরেন্টের ভিত্তিতে চলতে লাগলো আর আমাদেরকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত হোটেলে থাকতে হত।
হোটেল থেকে লাঞ্চ খাওয়ানোর আগে আমাদের বার ম্যানেজার জনাব মোফাজ্জল হোসেন ভুঞা তার কর্মচারীদের প্রতি একটা সৌহার্দপূর্ণ মনোভাব দেখান। যেহেতু আমাদেরকে নিজস্ব ব্যবস্থায় বাইরে লাঞ্চ করতে হত; তিনি প্রতিদিন একজন করে বারের ষ্টাফকে ওনার বাসায় লাঞ্চের জন্য নিয়ে যেতেন। আর শাহীন আক্তার বারের একমাত্র মহিলা কর্মী বলে বিশেষ বিবেচনায় তাকে প্রতিদিনই নিয়ে যেতেন। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এবং বারের কর্মচারীদের সাথে ম্যনেজার হিসেবে ওনার সম্পর্ক সহজতর করে তুলেছে।
সোনারগাঁও হোটেল যেহেতু জাপানী আর্থিক সহযোগীতায় নির্মিত ও জাপানী হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোম্পানী দ্বারা পরিচালিত; জাপানী সম্রাট হিরোহিতো’র জন্মদিন ২৮শে এপ্রিল তারিখে হোটেলটির প্রাথমিক অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করার সিদ্ধান্ত হয়। সম্রাটের জন্মদিন উপলক্ষে ওইদিন সন্ধায় জাপানী দূতাবাস হোটেলের ফেরদৌস গ্র্যান্ড বলরুমে প্রায় ৫০০ নিমন্ত্রিত অতিথির জন্য এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুরুতেই এমন একটি বিশাল ও জমকালো অনুষ্ঠান নিয়ে হোটেলের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা উৎকন্ঠিত ছিলেন। যাই হোক, অনুষ্ঠানটি খুবই সুন্দর এবং সফলভাবে সম্পন্ন হওয়াতে সকলেই খুশী।
শুরুতে শুধুমাত্র ক্যাফে বাজার কফি শপ, রুম সার্ভিস; ব্যাঙ্কুয়েটিং আর খৈয়াম বারের কাউন্টার খুলে দেয়া হয়। পরে পর্যায়ক্রমে সুইমিং পুল, কারওয়ান সরাই, ঝর্ণা রেষ্টুরেন্ট, ডেলিক্যাটসেন শপ এগুলি চালু করা হয়।
বারের কয়েকজন ষ্টাফকে সার্ভিস বারে কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় – যেখান থেকে কফি শপ ও রুম সার্ভিসের পানীয় সামগ্রীর অর্ডার সরবরাহ করা হয়। বার কাউন্টারে সার্ভিস দেয়ায় নিয়োজিত ষ্টাফরাই কেবল দুপুরের শিফটে কাজ করত, বারের বাকী সব ষ্টাফই দিনের বেলায় কাজ করত; যদিও করার মত তেমন কিছুই ছিল না – পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখা, নিজেদের মধ্যে পারষ্পরিক আলাপচারিতা এই সবই।
একটি দুখঃজনক ঘটনা – একদিন সকালে সিদ্দিকুল ইসলাম নামে বারের এক সহকর্মী আমার রুমে আসে। সে জানায় যে আগের দিনের একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার চাকুরী চলে গেছে। কোন একজন রেষ্টুরেন্ট ম্যানেজার বারে ফোন করলে সিদ্দিক ফোনটি ধরে এবং যথারীতি সম্ভাষণ জানায়, কিন্তু যিনি কলটি করেছেন তার কাছে মনে হয়েছে যে ফোন ধরার সময় সিদ্দিকের মুখে কিছু ছিল। এই অভিযোগের ভিত্তিতে সিদ্দিককে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে। তার জন্য দুখিঃত হওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার ছিলনা।
ছয়মাসের প্রবেশনারী পিরিয়ডটি একটি রীতিমত ভয়ানক অস্থিতিশীল ও ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না এমন একটি সময়; কার কখন চাকুরী চলে যাবে সেটা আগে থেকে বলার কোন উপায়ই ছিল না। কেউ হয়ত ডিউটি শুরু করেছে কিন্তু যাওয়ার সময়ে দেখলএ যে তার টাইম কার্ডটি নেই, সেখানে ছোট্ট একটি চিরকুট রাখা যেন সেই কর্মচারী পার্সোনেল ডিপার্টমেন্টে গিয়ে দেখা করে। অথবা কেউ ডিউটি শেষ করে গেল, পরদিন এসে দেখল যে তার টাইম কার্ডটি নেই। আরেকটি ঘটনাঃ টি,টি,আই তে আমার একই ব্যাচের ছাত্র মঞ্জুর এলাহী যে কি না কফিশপে কাজ করত, চাকুরীচ্যুত হয় কারন স্যু শেফ মিওরা তাকে একটি সালাদ খাওয়ার সময় দেখে ফেলে। এই ঘটনা দুটি উল্লেখ করার কারণ হোটেল কর্তৃপক্ষ তখন নিয়ম শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে কতোটা দৃঢ় ছিল এটিই বুঝানোর জন্য।
হোটেল চালু হবার পর থেকে প্রায় একমাস কেটে গেছে। এরই মধ্যে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত ৩০শে মে তারিখে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামে হত্যা করা হয়। যার ফলশ্রুতিতে রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করা হয়। তবে হোটেল কর্তৃপক্ষ রাতের ১১টা বা ১২টার দিকে ডিউটি শেষ করে এমন সব কর্মচারীদের জন্য কারফিউ পাশের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমি যেহেতু হোটেলের কাছাকাছি এলাকা কাঠালবাগানে থাকতাম, বার লাউঞ্জে সন্ধ্যাবেলায় কাজ করার জন্য আমাকে তখন দুপুরের শিফটে ডিউটি দেয়া হয়। সেইসময়ের আরেকটি ছোট্ট ঘটনা এখানে উল্লেখ্য। একদিন ডিউটিতে এসে শুনি যে আগের রাত্রে বার বন্ধ করার সময় কলাপসিবল বাঁশের পার্টিশনটি নাকি তালাবদ্ধ করা হয়নি। এজন্য সারারাত ওখানে সিকিউরিটি গার্ড রাখা হয়েছিল। যেহেতু এটি একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল ছিল এবং কোন কিছু চুরিও হয়নি তাই এর জন্য কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
সোনারগাঁও হোটেলে কাজ করা তখন সত্যিই খুব উপভোগ্য ছিল। হোটলে যেমন শুধুমাত্র সমাজের একেবারে উঁচু শ্রেণীর মানুষদেরই আসা যাওয়া ছিল, কর্মচারী হিসেবেও আমরা নিজেদেরকে তেমনি সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করতাম। হোটেলে আমরা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার নামকরা লোকদেরকে দেখতে পেতাম – রাজনৈতিক, কূটনীতিবিদ, অভিনেতা-অভিনেত্রী, লেখক, সঙ্গীতশিল্পী, শিক্ষাবিদ এবং আরো অনেককে। সোনারগাও হোটেলে চাকুরী করি এটা শুনলে বাইরের অনেকেই ঢোক গিলত। তারপরও একটা ব্যাপার ছিল। হোটেলের চাকুরী খারাপ বা অনৈতিক মনে করে কেউ কেউ নাক শিটকালেও তারাই আবার মনে মনে এটা ঠিকই ভাবতো যে ইস, তাদের নিজেদের পরিবারের কেউ বা কোন আত্মীয় যদি এই চাকুরীটা করতে পারত তাহলে কত ভালই না হত !
জুন (১৯৮১) মাসের শুরুতে শোনা গেল যে অচিরেই সার্ভিস চার্জ বন্টন শুরু হবে। পদমর্যাদার কোনরূপ ভেদাভেদ না রেখে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী সমানভাবে সার্ভিস চার্জের অংশ পাবে। প্রতিমাসের সার্ভিস চার্জ পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখে বিতরণ করা হবে। সেই হিসাবে জুনের ১৫ তারিখে মে মাসের সার্ভিস চার্জ বাবদ আমরা প্রত্যেকে ৩০০ টাকা করে পাই। তবে পরবর্তী মাসগুলিতে অবশ্য হোটেলের ব্যবসা বাড়ার সাথে সাথে এই টাকার পরিমাণও বেড়েছে। মাসের ১৫ তারিখে সার্ভিস চার্জ বন্টন হবে বলে বারের সব ষ্টাফরা মিলে তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমাদের টিপসের টাকা প্রতি মাসের ৮ এবং ২১ তারিখে ভাগাভাগি করব যাতে করে প্রতি সপ্তাহে আমাদের হাতে টাকা আসে – মাসের শুরুতে বেতন, ১৫ তারিখে সার্ভিস চার্জ আর মাঝখানে ৮ ও ২১ তারিখে টিপস। উল্লেখ্য, প্রত্যেকটি রেষ্টুরেন্টের টিপস সেই রেষ্টুরেন্টের সকল ষ্টাফের মধ্যে কে কোন শিফটে কাজ করছে সেটার ভেদাভেদ না রেখে সমানভাবে ভাগাভাগি করা হত।
উল্লেখ্য, হোটেলের সর্বনিম্ন প্রারম্ভিক পদে মাসিক মূল বেতন ছিল ৫০০ টাকা যা আনুষাঙ্গিক ভাতাদি মিলিয়ে এবং প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা কেটে নেয়ার পর সর্বসাকুল্যে ৭০০ টাকার কিছু বেশী হত। বেতন প্রদানের জন্য হোটেলের পক্ষ থেকে সবার জন্য ব্যাংক একাউন্ট খুলে দেয়া হয়েছিল।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে আমরা যখন দিন গুনছি আমাদের ছয়মাসের প্রবেশনারী পিরিয়ড শেষ হয়ে ১লা অক্টোবর থেকে চাকুরী স্থায়ী হওয়ার, ঠিক তার কয়দিন আগেই হঠাৎ একদিন আমাদের বারের হোষ্টেস শাহীন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। যদিও পরস্পর বিরোধী বিভিন্নরকম খবর শোনা যাচ্ছিল, পরে যখন জানা গেল যে হোটেলেরই ব্যাঙ্কুয়েট সেকশনের এক সহকর্মীর সাথে তার বিয়ে হয়েছে (তাদের ভিতর প্রেম ছিল) তখন আমরা সবাই স্বস্তি পেয়েছি।
১লা অক্টোবর থেকে আমাকে কারওয়ান সরাই রেষ্টুরেন্টে বদলী করা হয়। এই রেষ্টুরেন্টটি খুবই উঁচু মানের এবং হোটেলের শোকেস বলে বিবেচিত হত বিধায় এখানে বদলী হওয়াতে আমি খুশী হয়েছি। তাছাড়া এই রেষ্টুরেন্টের ষ্টাফরা যে শুধুমাত্র স্মার্টই ছিল তা না, বলতে গেলে এরা ছিল ফুড এন্ড বেভারেজ ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে চৌকশ কর্মচারীবৃন্দ।
এই রেষ্টুরেন্টে দিনের বেলায় বুফে লাঞ্চ এবং রাতের বেলায় ফ্রেঞ্চ সার্ভিস ডিনার পরিবেশন করা হত। আমাকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৬টা পর্যন্ত শিফটে ডিউটি দেয়া হয় আর অন্যান্য ষ্টাফরা দুই শিফটে ডিউটি করত যেমনঃ ৯টা-১২টা আবার ৬টা-১২টা অথবা ১২টা-৩টা আবার ৬টা-১২টা। আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু মাহবুব শুরু থেকেই এই রেষ্টুরেন্টে কাজ করত, তার সাথে আমার বন্ধুত্ব সেই টি,টি,আইয়ের দিনগুলি থেকে। এই রেষ্টুরেন্টের সকল সহকর্মীই আমাকে বলত যে মর্নিং শিফটে একবেলার ডিউটি করি বলে আমি নাকি ভাগ্যবান কারণ টি,ভি তে প্রচারিত নাটক বা অন্যান্য অনুষ্ঠান দেখার আমার সুযোগ আছে যা কিনা ওরা পায় না। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস – আমি তখন ব্যাচেলর হিসেবে মেসে থাকি নিজের কোন টি,ভি ছাড়া। লাঞ্চ সার্ভিসের পরে আমরা বুফে থেকে খাবার খেতাম (অবশ্যই লুকিয়ে!)। আমি যেহেতু বারের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তাছাড়া পশ্চিমা খাবার সমন্ধে আমার সম্যক ধারণা নাই, যে কারণে আমি প্রতিদিন শুধুই বিরিয়ানী আর ক্রীম ক্যারামেল খেতাম। উল্লেখ্য, বয়সের দিক থেকে হোটেলের চার পাঁচজন সর্বকনিষ্ঠ কর্মচারীদের মধ্যে আমি একজন ছিলাম। এইকারণে বড়দের অনেকেই আমাকে স্নেহ করতেন যার মধ্যে বুফে টেবিল তত্বাবধানকারী কয়কেজন কুকের কথা আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে। তাদের মধ্যে দুইজনের নামই ‘জন’ এবং একজনকে আমরা দাদু বলে ডাকতাম। বুফে টেবিল থেকে খাবার তুলে নিয়ে যাবার আগে তারা আমার জন্য প্লেটে খাবার তুলে টেবিলের নীচে রেখে দিতেন। এটা এমনই নিয়মিত হয়ে গিয়েছিল যে কোন কোনদিন খাবারের কথা না বললেও তারা ঠিকই আমার জন্য প্লেট বানিয়ে বুফে টেবিলের নীচে রেখে যেতেন। বুফে টেবিলের সবদিক যেহেতু স্কার্টিং দিয়ে ঢাকা থাকত আমি টেবিলের নীচে বসে লুকিয়ে খাবার খেতাম আর শুনতে পেতাম কামরুল নামের আমাদের এক সুপারভাইজার আমাকে খুজতেন। তখন আমার অন্যান্য সহকর্মীরা এটা সেটা বলে আমাকে বাচিয়ে দিত। এভাবে খাবার খাওয়া যদিও নিয়ম পরিপন্থী, সবাইই এটা করে তবে অন্যের চোখ বাচিয়ে। আস্তে আস্তে আমি ষ্টেক, গ্রীলড চিকেন ও অন্যান্য কিছু কিছু পশ্চিমা খাবার খেতে শুরু করলাম কারণ কুকরা ততদিনে আমাকে ঠাট্টা করে বলত যে তারা দেখবে আমি কতদিন একটানা বিরানী খেতে পারি!
এরই মধ্যে হঠাৎ করে হোটেলের সিকিউরিটি গার্ডরা কর্মবিরতি পালন করে। এফ এন্ড বি ডিপার্টমেন্টের আরও কিছু সহকর্মীর সাথে আমাকেও সিকিউরিটির ডিউটি করতে হয়েছে কমবেশী এক সপ্তাহের মত। এই সময়টাতে অবশ্য নতুন কিছু অভিজ্ঞতাও হয়েছে।
মোটামুটি ছয় মাসের মত মর্নিং শিফটে কাজ করার পর আমাকে ডিনার শিফটের ডিউটি দেয়া হয়। তারপরও দুই শিফটের ডিউটি আমার পিছু ছাড়েনি। ডিনারে কাজ করা আমার জন্য একটি সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা যা কিনা আমার ভবিষ্যত কর্মজীবনের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে আছে। সুপারভাইজার সহ সকল সহকর্মীরাই আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। অন্যন্য হোটেলে যে সকল দায়িত্ব সাধারণতঃ রেষ্টুরেন্ট ক্যাপ্টেন বা সুপারভাইজাররা পালন করে থাকে এখানে ওয়েটার বা বাসবয় হয়েই আমরা সেই সব কাজ করতাম।
সন্ধ্যা ৭টায় ডিনারের জন্য রেষ্টুরেন্ট খোলার আগে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬-৩৫ মিনিটে ব্রিফিং নেয়া হত। যেসব ষ্টাফ দুই বেলা ডিউটি করত তারা ৬টা বাজার আগেই কার্ড পাঞ্চ করে অন্যদের সাথে ডিনার খেয়ে ব্রিফিংযে দাড়াত। প্রত্যেক ষ্টাফের জন্যই ব্রিফিংয়ে দাড়ানোর আগে সেদিনের শেফ’স স্পেশাল বিশেষ খাবার, কি কি সব্জী এবং আলু আছে অথবা মেনুর কোন খাবার সেদিন না থাকলে সে সব জেনে নেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। রেষ্টুরেন্ট ম্যানেজার জনাব আলমগীর খান যে কোন ষ্টাফকে এগুলি নিয়ে এবং শেফ’স স্পেশাল ডিশের প্রস্তুত প্রণালী সমন্ধে প্রশ্ন করতেন এবং সেই সাথে ষ্টাফদের বাহ্যিক পরিপাটিত্ব, চকচকে পরিস্কার জুতা এবং কাল মোজা পরা কি না এসব পর্যবেক্ষণ করতেন। (চাকুরীজীবনে পরবর্তীতে অন্যান্য অনেক হোটেলেই এমন ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হতে না দেখে তখন শ্রদ্বাভরে জনাব আলমগীর খানকে স্মরন করতাম।)
ফুড এন্ড বেভারেজ বিভাগের ক্রস এক্সপোজার প্রোগ্রামের আওতায় মাঝখানে আমাকে এক মাসের জন্য রুম সার্ভিসে পাঠানো হয়, একইভাবে রুম সার্ভিস থেকেও অন্য আরেকজন ষ্টাফ গ্রীলরুমে আসে। ওই একমাসে রুম সার্ভিসের যত বেশী সম্ভব কাজের বাস্তবিক ধারণা পাওয়ার জন্য আমাকে সকাল, দুপুর এবং রাত্রিকালীন সব শিফটেই কাজ করতে দেয়া হয়েছে। রুম সার্ভিসে কাজ করার সময়ের একটি মজার ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করছি। একদিন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ঢাকা-লন্ডনের একটি ফ্লাইট বাতিল হওয়াতে লে-ওভার প্যাসেঞ্জারদেরকে হোটেলে রাখা হয়। এমনই এক প্যাসেঞ্জারের রুমে আমি লাঞ্চের অর্ডার সার্ভিস দিয়ে আসি যারা কিনা এক (বাংলাদেশী-ব্রিটিশ) বয়স্ক দম্পতি ছিলেন। এর কিছুক্ষন পরই হোটেলের সিকিউরিটি অফিসার আমাকে ওই রুমে যাওয়ার জন্য ডেকে পাঠায়। গেষ্ট তার একটি হাতঘড়ি হারানো গেছে বলে অভিযোগ করছেন। হোটেলের দুইজন কর্মচারী তাদের রুমে ঢুকেছিল – লাঞ্চ সার্ভিস দেয়ার জন্য আমি আর রুম পরিষ্কার করার জন্য জাস্তিনা নামের এক চেম্বারমেইড। সিকিউরিটি অফিসার আমাদের দুইজনকেই ঘড়ি সমন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করাতে আমরা দুইজনই খুব অবাক হই। যাই হোক, এরপর সিকিউরিটি অফিসার যখন গেষ্টকে বুঝিয়ে বলল আর অনুরোধ করল তাদের স্যুটকেসগুলি আরেকবার ভাল করে দেখার জন্য, গেষ্ট তখন একটি স্যুটকেসের ভিতর তার ঘড়িটি খুজে পান আর আমরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। আগে যদিও কখনো জাস্তিনার সাথে আমার কোন কথা হয়নি এই ঘটনার পর থেকে ক্যাফেটেরিয়া বা অন্য কোথাও দেখা হলে তার সাথে সম্ভাষণ বিনিময় হত।
১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সালের ভিতর হোটেলে অনুষ্ঠিত কিছু উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠানসমুহঃ
প্রিন্স করিম আগা খানের সম্মানে দেয়া রাষ্ট্রীয় লাঞ্চ এবং ফিরতি ডিনার
সংসদ ভবনের নর্থ প্লাজাতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সরকারী অনুষ্ঠান
নিরালাতে বিশ্ব বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক পল রোমান্সকি’র প্রেস কনফারেন্স
নিরালাতে তৎকালীন কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডো’র প্রেস কনফারেন্স
বলরুমে নিউ ইয়ার ইভ ডিনার ড্যান্স
মিঃ টনি ব্রুগামেন্সের বিদায়
১৯৮২ সালের শেষ বা ১৯৮৩ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের সকল মোটেলের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় সোনারগাও হোটেলকে। মোটেল কর্মচারীদেরকে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য হোটেলের অনেক ম্যানেজার ও সুপারভাইজারদেরকে বিভিন্ন মোটেলে পাঠানো হত।
১৯৮৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ও,আই,সি দেশসমুহের পররাষ্ট্র মন্তীদের সম্মেলনে সকল সদস্য দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীরা যোগ দেন এবং তাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল সোনারগাও হোটেলে। তাদের নিরাপত্তার জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। হোটেলের ষ্টাফদেরকে বিশেষ পরিচয়পত্র দেয়া হয় যার প্রতিটিতে ক্ষেত্রভেদে যার যার প্রবেশাধিকারের সাংকেতিক চিহ্ন ছিল। হোটেলের সব জায়গায় এমনকি কর্মচারীদের হোটেলে ঢুকবার/বের হবার গেটেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তারক্ষীরা নিয়োজিত ছিল।
১৯৮৩ সালের নভেম্বর মাসে ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফরের আগে ঢাকার মিন্টু রোডে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের জীর্ণসংস্কার ও সফরকালীন সময়ে ভবনটির পরিচালনার দায়িত্ব সোনারগাও হোটেলের উপর ন্যস্ত করা হয়। ঢাকায় অবস্থানকালে রানী বর্তমান সুগন্ধা ভবনে থাকতেন যেখানে হোটেলের ব্যাঙ্কুয়েট, রুম সার্ভিস, হাউজকিপিং ও ইঞ্জিনিয়ারিং কর্মচারীদের একটি দল কর্তব্যপালন করে এবং তারা বলতে গেলে প্রায় ২৪ ঘন্টাই ওখানে কর্তব্যরত থাকতো এবং বাইরে আসবার সুযোগ ছিলনা।
রানী তখন ঢাকার গাজীপুরের শ্রীপুর থানাধীন বৈরাগীরচালা নামে একটি আদর্শ গ্রামও পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি ঢেঁকিতে ধান ভানা, মুড়ি ভাজা ও মুরগি পালনসহ মানুষের জীবনধারা উপভোগ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ট্রেনে করে তাদেরকে সেখানে যেতে হবে বলে বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি ট্রেনকে বিশেষ রঙে রং করা হয়। পরবর্তীতে এই বিশেষ নীল রংটিই বাংলাদেশ রেলওয়ের সকল আন্তঃনগর এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রয়োগ করা হয়। গাজীপুর যাত্রার জন্য রাণী, রানীর স্বামী ডিউক অব এডিনবার্গ প্রিন্স ফিলিপ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এইচ, এম, এরশাদ, নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল এম, এইচ, খান এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার সহ সম্পূর্ণ দলটি ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট ষ্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেন। ট্রেনে রানীর সার্ভিসের জন্য সোনারগাও হোটল থেকে তিনজন ষ্টাফ (আঃ হাসিব, মিজান ও শওকত – সকলেই গ্রীলরুমের) পাঠানো হয়। হোটেলের জি,এম মিঃ টনি ব্রুগামেন্স ও আমাদের সাথে যোগ দেন।
১৯৮৪ সালের আগষ্ট মাসে জাকজমকের সাথে হোটেলের ৩য় বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান পালন করা হয়। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ,জি,মাহমুদ এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠানের রাত্রে প্যান প্যাসিফিক হোটেলের শাখা পৃথিবীর অন্যান্য যেসব দেশে আছে সেসব দেশের কৃষ্টি / ভাবধারা অনুযায়ী বলরুমের ভিতর বিভিন্ন ষ্টল সাজানো হয় এবং হোষ্টেসদেরকেও তেমনি পোষাক ও সাজ সজ্জায় ভুষিত করা / সাজানো হয়। হোটেলের এনুয়্যাল ষ্টাফ পার্টি বা এ ধরনের প্রায় অনুষ্ঠানেই আমি কোরাস গানে অংশ নিতাম। তখনকার দিনের উঠতি সঙ্গীত পরিচালক আনিসুর রহমান তনু এসব অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনা করতেন, নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমদ অতিথি শিল্পী হিসেবে অংশ নিতেন।
১৯৮৪ সালে সংযুক্ত আরব আমীরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান বাংলাদেশ সফরে এলে সুগন্ধাতেই তার থাকার ব্যবস্থা করা হয় এবং যথারীতি সোনারগাও হোটেলের উপরই আগের মত পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে।
পরবর্তী অংশ - সোনারগাঁও হোটেলের সোনালী স্মৃতি .... ২য় খন্ড

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


