আমার আব্বা ১৯৬৩ সাল থেকে ইংল্যান্ডে চাকুরী করছেন। সেই সুবাদে একেবারে ছোটবেলা থেকেই ওই দেশের অনেক গল্প, আব্বার বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা শোনার সুযোগ হয়েছে। পরবর্তীতে আমার নিজের সোনারগাঁও হোটেলে চাকুরীর সুবাদে বিদেশে না গিয়েও দেশে বসেই অনেক কিছু দেখতে ও জানতে পেরেছি।
ইংল্যান্ডের এত এত গল্প শুনে আমার নিজের ওখানে যাবার ইচ্ছা করলেও আব্বা তখন পর্যন্ত আমাদেরকে ওই দেশে নিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেননা। ১৯৮৭ সালের শুরুতে দেশের একটি আন্তর্জাতিক ক্লাবের সদস্য হিসাবে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য ওই ক্লাবের বার্ষিক আন্তর্জাতিক সভায় যোগদানের আমন্ত্রণ পাই। বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত দুইজন সদস্যের মধ্যে অন্যজনের আগে থেকেই ইংল্যান্ডের দীর্ঘমেয়াদী MULTIPLE ENTRY ভিসা ছিল। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমার ভিসা হয়নি। ঢাকাস্থ একটি বিদেশী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আমার তখন মাত্র কয়েক মাসের চাকুরী। বৃটিশ হাইকমিশনের ভিসা অফিসাররা আমাকে ইন্টারভিউয়ের সময় বলেছেন যে ওই বিদেশী প্রতিষ্ঠানটির সাথে আরো কিছুদিন চাকুরী চালিয়ে গেলে আমি পরে আবার ভিসার জন্য আবেদন করতে পারব।
১৯৮৭ সালের শেষের দিকে চাকুরী নিয়ে আমি আবার সৌদী আরবে চলে আসি। আব্বা তখন আমার জন্য ইংল্যান্ড ভ্রমণের আমন্ত্রণপত্র পাঠান যা কিনা লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন কর্তৃক সত্যায়িত। সেই আমন্ত্রণপত্রে পরিষ্কারভাবেই লেখা ছিল যে আমি কোন ভাবেই ওই দেশে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করব না এবং আমার ফেরত আসার ব্যাপারে আব্বা পূর্ণ নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। জেদ্দাস্থ বৃটিশ কন্স্যুলেট আমার ভিসার আবেদন নাকচ করে দিয়ে পাসপোর্টে তাদের বিখ্যাত(!) লাল সীল মেরে দেয়। সাথে যে কাগজটি আমার হাতে ধরিয়ে দেয় তাতে লিখে দেয় যে আমার পারিবারিক অভিবাসনের ইতিহাস রয়েছে; সৌদীতে আমার চাকুরীর বেতন কম; তাই তারা নিশ্চিত হতে পারছে না যে ওই দেশে গেলে আমি আবার সৌদীতে ফেরত আসব। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপারটা হল তাদের এই সিদ্বান্তের বিরুদ্ধে আমি কোন আপীলও করতে পারব না।
দেখতে দেখতে সৌদীতে একই হোটেল চেইনের সাথে আমার চাকুরীর দশ বছর পার হয়ে গেছে, আর এরই মাঝে ভিন্ন ভিন্ন শহরে ওই চেইনেরই তিনটি হোটেলে আমি কাজ করেছি। ততদিনে আমার ম্যানেজারিয়াল লেভেলে পদোন্নতি হয়েছে, সেই সাথে বেতন ভাতা আর সুযোগসুবিধাদিও বেড়েছে। ১৯৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের পরপরই আমার আম্মা, একমাত্র বোন আর চার ভাই ইমিগ্রেশন নিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যায়। তাদের ইমিগ্রেশনের আবেদন অনেক বছর আগে করা হলেও অনেকদিন যাবত সেটা ঝুলে ছিল। আমার বয়সের কারণে আর ততদিনে আমি বিয়ে করে ফেলায় ওদের সাথে সাথে আমার জন্যও আবেদন করার সুযোগ ছিল না।
১৯৯৯ সালে আম্মা আমাকে ইংল্যান্ড ভ্রমণের আমন্ত্রণপত্র পাঠান। আমার কর্মক্ষেত্র তখন মদীনা, জেদ্দা থেকে ৪২৫ কিঃ মিঃ দূরে। প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র সহ জেদ্দাস্থ বৃটিশ কন্স্যুলেটে আবার আবেদন করলাম ইংল্যান্ডের ভিসার জন্য। আগে যে জেদ্দা থেকেই আমার ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল নিয়মানুযায়ী সেটার কপিও জমা দিতে হয়েছে। তবে এবার আমার একটা খুটির জোরও ছিল দরখাস্তের সাথে। আমাদের হোটেল চেইনের সৌদী আরবের রিজিওনাল ভাইস প্রেসিডেন্টের সাথে বৃটিশ কন্স্যুলারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমি আগে এই রিজিওনাল ভাইস প্রেসিডেন্টের হোটেলে কাজ করেছি বলে তিনি একটা ব্যক্তিগত স্লিপ লিখে দিয়েছিলেন কন্স্যুলারের উদ্দেশ্যে, যেটা আমি দরখাস্তের সাথে জমা দেই। যাইহোক, সেবার আমি ভিসা পেয়ে যাই। তবে ভিসা শাখার প্রধান, যে তার ব্যক্তিগত গ্যারান্টিতে আমার ভিসা দিয়েছে, আমাকে অনুরোধ করেছিল সৌদীতে ফেরত আসার পর আমি যেন পাসপোর্ট নিয়ে তার সাথে দেখা করি।
জুলাই-আগষ্ট মাসে সৌদীতে গ্রীস্মকালীন ছুটি থাকে বলে বিমান ভাড়া বেশ বেড়ে যায়, তাই আমি সস্তায় যাওয়ার জন্য জর্দান এয়ারলাইন্সের টিকেট কিনি। ফ্লাইটের আগের দিন আমি মদীনা থেকে জেদ্দা চলে আসি। সেই রিজিওনাল ভি,পি আগে থেকেই আমার জন্য যাওয়ার সময় এক রাত্রি আর ফেরার পথে এক রাত্রি থাকার জন্য বিনামূল্যে হোটেল রুমের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। জেদ্দা থেকে সকাল সাড়ে সাতটায় ফ্লাই করে দুই ঘন্টায় আম্মান পৌছে যাই। সস্তার টিকেট হলেও জর্দানিয়ান এয়ারলাইন্সের সার্ভিস খারাপ না। আম্মান বিমানবন্দর জেদ্দা বা রিয়াদের মত এত জাকজমকপূর্ণ না হলেও বেশ ভালই ব্যস্ত। সস্তার টিকেটের কারণে এশীয় অনেক যাত্রীও আম্মান হয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় আসা যাওয়া করে, আর মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ করেতে আসা পর্যটকরাতো আছেই। বলতে গেলে আম্মান হচ্ছে ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ গেটওয়ে। আম্মানের রাণী আলিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তিন ঘন্টার মত ট্রানজিটের পর লন্ডনের ফ্লাইটে ওঠার সময় দেখা গেল যে ফ্লাইটটি বার্লিণ হয়ে লন্ডন যাবে।
ফ্লাইট টেক-অফ করার পর আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল বিমানটি উপড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট গতি পাচ্ছেনা। ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে গাড়ীতে টপ গিয়ার দেবার পরও গতি কম থাকলে যেমন বুঝা যায় যে গাড়ী ধাক্কা খেতে খেতে এগুচ্ছে ঠিক তেমন। তো দেখা গেল যে টেক-অফের পর বিশ মিনিট পার না হতেই ঘোষণা করা হল যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি আবার আম্মান এয়ারপোর্টে ফেরত যাচ্ছে। বিমান থামার পর ঘোষণা করা হল যাত্রীরা যেন তাদের ভারী মালামাল বিমানের ভিতরই রেখে যান, শুধুমাত্র মুল্যবান বা একান্ত জরুরী কিছু থাকলে সেগুলি সাথে নিয়ে নামতে। বিমানে উঠার ঠিক আগে যে বোর্ডিং লাউঞ্জ থাকে যাত্রীদেরকে সেখানে বসানো হল আর সবাইকে স্যান্ডউইচ, জুস, পানি পরিবেশন করা হয়। বিমান কর্তৃপক্ষ তখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না যাত্রীদেরকে শহরে কোন হোটেলে পাঠিয়ে দিবে না কি বিকল্প বিমানের ব্যবস্থা করা হবে বা কি পদক্ষেপ নেয়া হবে। এরই মধ্যে বিমানের সমস্ত জ্বালানী তেল নিষ্কাশন করে আবার নতুন করে জ্বালানী ভরা হয়। প্রায় দুই ঘন্টা পর আগের সেই বিমানে করেই আমরা আবার রওয়ানা হই।
তখন পর্যন্ত আমার কোন মোবাইল ফোন না থাকায় আম্মানে আমাদের যে দেরী হয়েছে সেটা আমি ইংল্যান্ডে আমার আম্মা বা ছোট ভাইকে জানাতে পারিনি। প্রায় চার ঘন্টা পর বিমান বার্লিণে এসে থামে। এখানে শুধু যাত্রী নামানো হয়েছে, কাউকে তোলা হয়নি, আমরা বিমানেই বসা ছিলাম। উপড় থেকে বার্লিণ শহর দেখে ভালই লেগেছে। এয়ারপোর্টের আশেপশের দালানগুলি ব্লক ব্লক ভাবে বিন্যস্ত। একেকটি ব্লকের ছাঁদ একেক রঙে রঞ্জিত - লাল, নীল, সবুজ। মোটামুটি এক থেকে দেড় ঘন্টার যাত্রাবিরতির পর বিমান আবার লন্ডনের উদ্দেশ্যে আকাশে উড়ে এবং দুই ঘন্টার ভিতর লন্ডনে পৌছে।
হিথরো বিশ্বের ব্যস্ততম বিমানবন্দরগুলির একটি। তাই আমাদের বিমানটি নির্ধারিত সময়ে পৌছাতে না পারার কারণে ল্যান্ডিং পারমিশন পেতে দেরী হচ্ছিল। ফলে লন্ডনের আকাশে বিমানটিকে বাড়তি আরেকটি চক্কর দিতে হয়। হিথরোর কাছাকাছি পৌছানোর পরই বিমান থেকে নীচে লন্ডনের বিখ্যাত ল্যান্ডমার্কগুলি দেখতে পাচ্ছিলাম যেমন মিলেনিয়াম ডোম, টাওয়ার ব্রিজ, বিগ বেন, টেমস নদী, বাকিংহাম প্যালেস ইত্যাদি। বিমানের বাড়তি চক্করের সুবাদে সেগুলি দ্বিতীয়বার দেখার সুযোগ হল। উপর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম যে হিথরোতে বিমানের উঠানামা বেশ ঘন ঘন, গড়ে প্রতি দুই মিনিটে একটি বিমান ল্যান্ড করে। টার্মিনাল ভবনে নামার পর বেশ লম্বা করিডোর পার হতে হয় ইমিগ্রেশন হল পর্যন্ত পৌছানোর জন্য। পায়ে হেঁটে যাওয়ার পথের পাশাপাশি অবশ্য এই দুরত্বের বেশীরভাগ জায়গাতেই কনভেয়ার বেল্ট রয়েছে যাতে করে যাত্রীরা আরামে বেল্টে দাঁড়িয়ে পার হয়ে যেতে পারেন। আর বয়স্ক বা প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ধরণের গাড়ীর ব্যবস্থাও আছে। হিথরো বিমানবন্দরে তখন ৪টি টার্মিনাল ছিল। বেশীরভাগ বিদেশী এয়ারলাইন্স ৩ নম্বর টার্মিনাল দিয়ে আসা যাওয়া করত, আর ৪ নম্বর টার্মিনালটি তখন শুধুমাত্র বৃটিশ এয়ারওয়েজের জন্য ব্যবহৃত হত। ৩ নম্বর টার্মিনালের ইমিগ্রেশন হলটি বেশ বড়। বৃটিশ নাগরিকদের জন্য একটি শাখা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিকদের জন্য একটি শাখা, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে আগত যাত্রীদের জন্য সবচেয়ে বড় শাখাটি, আর সাথে বড় বড় ভ্রমণকারী দলগুলির জন্য আলাদা আরেকটি অংশ। এর মাঝে প্রথম দুইটি দলের ইমিগ্রেশনে বলতে গেলে সময়ই লাগে না, শুধুমাত্র পাসপোর্ট দেখিয়ে তারা পার হয়ে যেতে পারে। তৃতীয় অংশটির জন্যই যত সব আয়োজন। আগত যাত্রীদেরকে সাহায্য ও গাইড করার জন্য অনেক কর্মচারী কর্তব্যরত থাকে। একটিমাত্র আঁকাবাঁকা লাইনে দাঁড়িয়ে সবাইকে ইমিগ্রেশন ডেস্ক পর্যন্ত পৌছাতে হয়। গোটা বিশেক ইমিগ্রেশন ডেস্কের প্রায় সবকয়টাতেই ইমিগ্রেশন অফিসাররা কর্তব্যরত থাকেন। তারা আদি বৃটিশ, ভারতীয়, বাংলাদেশী, আফ্রিকান, ইউরোপীয় অথবা অন্য যে কোন বংশদ্ভুত হতে পারেন, তবে তখন তাদের একটাই পরিচয় যে তারা বৃটিশ নাগরিক এবং যার যার পেশাগত দায়িত্ব পালন করছেন। লাইনে অপেক্ষমান যাত্রীরা ইমিগ্রেশন ডেস্কের কাছাকাছি পৌছে গেলে তখন যে অফিসারের ডেস্ক খালি থাকবে সেই অফিসার NEXT বলে পরবর্তী যাত্রীকে ডাকবে। নিয়মমাফিক কিছু গতানুগতিক প্রশ্ন করে ইমিগ্রেশন অফিসার যদি সন্তুষ্ট হন তবেই পাসপোর্টে সীল মারবেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বৃটিশ ভিসার জন্য আবেদন করলে পাসপোর্টের উপর যে ভিসা দেওয়া হয় এটা কিন্তু বৃটেনে ঢুকার কোন নিশ্চয়তা নয়; চুড়ান্ত সিদ্বান্ত হবে এই ইমিগ্রেশন অফিসারের। সে যদি আগত কোন যাত্রীকে করা প্রশ্নের উত্তরে সন্তুষ্ট না হয় বা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত না হয় তাহলে সেই যাত্রীকে বৃটেনে ঢুকার অনুমতি না দিয়ে ফিরতি ফ্লাইটে তুলে দিতে পারে। সাধারণত যে সব প্রশ্ন করা হয় সেগুলি মোটামুটি এমন হতে পারেঃ নাম; কোথা থেকে এসেছে; নিজ দেশ ছাড়া অন্য কোন দেশ থেকে এসে থাকলে সেই দেশে আবার ফেরত যাবার ভিসা আছে কি না; ইংল্যান্ডে কতদিন থাকবে; কার কাছে থাকবে; তার সাথে সম্পর্ক; রিটার্ন টিকেট দেখতে চাইতে পারে। আরেকটা কথা, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বৃটেনের ভিসার জন্য আবেদন করলে পাসপোর্টে যে সীলটা দেয়া হত সেটা ছিল এন্ট্রি ক্লিয়ারেন্স, ভিসা সীল মারা হত এয়ারপোর্টের এই ইমিগ্রেশন ডেস্ক থেকে।
ইমিগ্রেশন ফর্মালিটিজ শেষ করে লাগেজ সংগ্রহের পালা। ইমিগ্রেশন হল থেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলেই বড় হলরুমে সারি সারি ব্যাগেজ কনভেয়ার বেল্ট। মনিটরে কোন এয়ারলাইন্সের ব্যাগেজ কত নম্বর বেল্টে আসবে সেটা দেখে ট্রলি সংগ্রহ করে (বিনামূল্যে) আমার মালামাল উঠিয়ে নিয়ে বের হয়ে আসি। কাষ্টমসের ঝামেলা আর পোহাতে হয়নি। এরাইভাল লাউঞ্জে আম্মা আর ছোট ভাই অপেক্ষা করছিল।
আমার ফ্লাইট বিলম্বিত হবার খবর আমি তাদেরকে আগে থেকে জানাতে না পারলেও বাসা থেকে রওয়ানা দেবার আগেই তারা সেটা জানতে পেরেছিল। ওই দেশের টেলিভিশনে টেলিটেক্সট নামে একটা চ্যানেল আছে যাতে মোটামুটি সব ধরণের তথ্যই দেখা যায় – আবহাওয়া, ফ্লাইটের সময়সূচী, গুরুত্বপূর্ণ টেলিফোন নম্বরসমূহ এবং আরো অনেক কিছু। আমার ফ্লাইট নম্বর যেহেতু তারা জানত, সেই অনুযায়ীই বাসা থেকে বের হয়েছে।
জুন মাসের বিকেলে বাইরে মনোরম দৃশ্য। সামারের সময়ে ইউরোপের সৌন্দর্য্য দু চোখ ভরে দেখার মত, চারিদিক রং বেরঙের ফুলে ফুলে শোভিত। নানা রঙের বাহারি ফুল, এমন সব রঙ যা সচরাচর আমাদের দেশে দেখা যায়না।
আম্মা আর ভাইয়েরা থাকে লন্ডন থেকে ৮০ মাইল দূরে ব্রাইটন নামে এক শহরে আর আমার বোন থাকে লন্ডনে। এই বোন আর অন্য আরেক ভাইয়ের সাথে আমার প্রায় দশ বছরের মত দেখা হয়না। তাই ভাই যখন জিজ্ঞাসা করল লন্ডন হয়ে বোনকে দেখে যাব কি না, রাজী হয়ে গেলাম। লন্ডন শহরের কেন্দ্রে ঢুকে ভাই আমাকে বিখ্যাত জায়গা / ল্যান্ডমার্কগুলি দেখাতে দেখাতে যেতে থাকল। আমি যখন ভাইকে বললাম যে আকাশ থেকেই আমি বিখ্যাত অনেক কিছু দেখে ফেলেছি ভাইতো অবাক যে এখানে এসে পৌছানোর আগেই আমি ওইসব ল্যান্ডমার্ক কি করে চিনতে পারলাম।
রাস্তার একপাঁশে দুই যুবক-যুবতী আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে চুমু খাচ্ছিল। এমন দৃশ্য আর যাই হোক আম্মা আর ছোট ভাইয়ের সাথে উপভোগ করার কথা নয়!
বোনের বাসায় পৌছাতে পৌছাতে প্রায় সন্ধ্যা। কেন জানি পূর্ব লন্ডনের ওই এলাকাটা দেখে আমার মন ছোট হয়ে গেছে। রাস্তার দুই পাশের সব বাড়ীঘর দেখতে একই রকম। সৌদী আরবের রাস্তাঘাট সন্ধ্যার পর উজ্বল আলোয় আলোকিত। সেই তুলনায় লন্ডনের রাস্তাঘাটের আলো কম বলে আমার মনে হচ্ছিল। এত বছর পর (১৯৮৯-১৯৯৯) ভাই বোনের দেখা হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে দুজনই উচ্ছ্বসিত। বোনের বাসায় চা নাস্তা খেয়ে আমরা ব্রাইটনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। লন্ডন-ব্রাইটন প্রায় দেড় ঘন্টার রাস্তায় আমি যে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম জানিনা। বাসার প্রায় কাছে এসে আমার ঘুম ভাঙে। এই এপার্টমেন্ট বাসাটি আমার ভাল লেগেছে – ৩ বেডরুম, ড্রয়িং কাম ডাইনিং, কিচেন। বাসার সামনে সবুজ মাঠ, তারপর রাস্তা, তার পরই ইংলিশ চ্যানেল।
চার ভাইয়ের সবাই যার যার কাজের জায়গায় থাকে, ছুটির দিনে বাসায় আসে। এর মধ্যে মেজো ভাই একটু দূরে থাকে। পরদিন মেজো আর ছোট ভাই মিলে আমাকে সাগর পাড়ে (ইংলিশ চ্যানেল) ঘুরতে নিয়ে যায়। মায়াবী নীলাভ-সবুজ রঙের (Turquoise) সাগরের পানি , আর সাগর পাড়ে বালির পরিবর্তে নুড়ি পাথর। লন্ডন শহরে থাকা মানুষদের সাগর দেখতে হলে এই ব্রাইটন অথবা ডোভারে যেতে হয়। সাগরের একেবারে পাড় ঘেঁষে রাস্তা, নীচে নুড়িময় সৈকতে মানুষজন শুয়ে সূর্য্যস্নান করে বা সাগরে সাঁতার কাটে। রাস্তাঘাট খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। ছোট ছোট পাহাড়ের উপরে, ঢালুতে অথবা উপত্যকায় বাড়ীঘর। সব মিলিয়ে ব্রাইটন আমার কাছে ভাল লেগেছে।
আমার পৌছানোর দিন দুয়েক পরেই এক বাংলাদেশী বাসায় জন্মদিন উপলক্ষে লাঞ্চের দাওয়াত ছিল। আম্মা আর ছোট ভাইয়ের সাথে ওই বাসায় যাই। আব্বা তখন বাংলাদেশে ছিলেন। ওই দেশে ততদিনে আম্মার প্রায় ৯ বছরের উপর চলছে। মূলতঃ আব্বার বন্ধুবান্ধব বা পুরানো সহকর্মীদের সাথেই সামাজিক যোগাযোগ, সেই সঙ্গে নতুন আরো কয়েকজনের সাথে। আমার ওই দেশে যাবার কথা আম্মার পরিচিত অনেকে জানত। দাওয়াত শেষে বাসায় আসার পর আম্মা হাসতে হাসতে বলে যে আমাকে দেখে ওই বাসায় আগত আতিথিদের মধ্যে এক মহিলা নাকি আম্মাকে জিজ্ঞাসা করেছে যে ওই দেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশী বংশদ্ভোত কোন বৃটিশ নাগরিক মেয়ের সাথে আমি বিয়ে করব কি না। আম্মা হাসতে হাসতে জওয়াব দিয়েছেন যে আমি বিবাহিত এবং দেশে আমার বউ-ছেলে আছে। ওই মহিলার এমনটা বলার কারণ এই যে, সাধারণত আমাদের দেশ থেকে যারা ইংল্যন্ডে যায়, বেশীরভাগ মানুষেরই চেষ্টা থাকে কিভাবে ওই দেশে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করা যায় সেই রাস্তা খুঁজে বের করা। আরেকটা ব্যাপার যেটা দেখা গেল তা হল সিলেটি আর নন-সিলেটিদের মধ্যে একটা অদৃশ্য বিভাজন।
কয়দিন পর আম্মা, মেজো আর সেজো ভাই সহ আমরা লন্ডনে বোনের বাসায় বেড়াতে যাই। দুই তিনদিন থেকে লন্ডনের প্রধান প্রধান ট্যুরিষ্ট স্পটগুলি ঘুরে দেখি আর প্রচুর ছবি তুলি। দেখলাম যে ইংরেজী বলতে আর বুঝতে পারলে লন্ডনে ঘুরে বেড়ানো মোটেও কঠিন কিছু নয়। প্রত্যেকটা ট্রেন ও পাতাল রেল (TUBE / UNDERGROUND) ষ্টেশনে ট্যুরিষ্ট ইনফরমেশন, ম্যাপ এসব পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখা থাকে। বড় বড় ট্রেন ষ্টেশনগুলিতে ইনফরমেশন কাউন্টার ও থাকে। এছাড়া বাসের ড্রাইভার, ট্রেন ষ্টেশনের এটেন্ডেন্ট যে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে তারা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেয়। সাহায্য করার জন্য সবাই সদা প্রস্তুত। পাতাল রেলের প্রতিটি বগিতে লন্ডন রেল নেটওয়ার্কের ম্যাপ আঁকা আছে, প্রতিটি নেটওয়ার্কের আলাদা আলাদা কালার কোড – বেকারলু, সেন্ট্রাল, সার্কেল, ডিট্রিক্ট, হ্যামারস্মিথ এন্ড সিটি, জুবিলী, মেট্রোপলিটান, নর্দার্ণ, পিকাডিলি, ভিক্টোরিয়া, ওয়াটারলু এন্ড সিটি লাইন। কোন ষ্টেশনে নামলে সেখানে অন্য লাইনের ট্রেন পাওয়া যাবে তার চিহ্নও দেয়া থাকে। এসব কিছুর পর রেকর্ডকৃত যান্ত্রিক ঘোষণাও দেয়া হয় পরবর্তী কোন ষ্টেশনে ট্রেন থামবে, সেখান থেকে অন্য কোন লাইনের ট্রেন পাওয়া যাবে, সর্বোপরি ট্রেনের বগি আর প্লাটফর্মের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা বা উচ্চতা সম্পর্কিত হুশিয়ারি ( MIND THE GAP ) ইত্যাদি। প্রথমদিন ঘোরাঘুরি করেই ম্যাপ ধরে কোন জায়গায় যাওয়া বা ট্রেন বদল করার ব্যাপারে আমি পরিস্কার ধারণা পেয়ে গিয়েছিলাম। লন্ডনে ঘোরাঘুরি করার জন্য শুধুমাত্র বাস অথবা পাতাল রেলের জোন ভিত্তক (১-৬) টিকেট কিনলেও চলে। তবে পর্যটকরা সুবিধার জন্য ট্রাভেল কার্ড কিনেন যাতে করে বাস ট্রেন/পাতাল রেল সব কয়টাতেই চড়া যায়, যদিও এতে কিছু বাড়তি পাউন্ড গুনতে হয়। ট্রেন ষ্টেশন থেকে বের হতে হলে ছোট ছোট EXIT GATE এর স্বয়ংক্রিয় মেশিনে টিকেট ঢুকালে পরে একজন মানুষ বের হয়ে যাবার মত অল্প সময়ের জন্য গেটটি খুলেই আবার বন্ধ হয়ে যায়। এক জোন ছেড়ে অন্য জোনে চলে গেলে ওই টিকেট আর সেখানে কাজ করবেনা। এটেন্ডেন্টদের সাহায্য চাইলে তারাও কোন খারাপ ব্যবহার করবে না, টিকেট বিক্রি করার মেশিনের কাছে নিয়ে গিয়ে বাড়তি টিকেটটি কিনে দিতে সহায়তা করে যাত্রীকে ধন্যবাদ যানাবে।
স্কুল, কলেজ, অফিস ছুটির সময়ে পাতাল রেলে প্রচন্ড ভিড় হয়। গাদাগাদি করে এই ভিড়ের মধ্যে ট্রেনে উঠার জন্য আমাদের দেশের মত ধাক্কাধাক্কি হয় না বা উঠার পরে পুরুষ-মহিলা গায়ে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনা।
সেন্ট্রাল লন্ডনের একটি সুন্দর জায়গার কথা আমি উল্লেখ করব। রিজেন্ট পার্কের একটি অংশের নাম কুইন মেরী’স গার্ডেন। এখানে বিভিন্ন রঙের বড় বড় গোলাপ ফুলের বাগান আছে। এত বড় গোলাপ ফুল শুধুমাত্র আমি কেন, অনেকেই হয়ত দেখেনি। এ ছাড়াও আছে আরো অনেক রঙ বেরঙের ফুলের বাগান যে সব রঙের ফুল আমাদের দেশে দেখা যায়না। ওখানে কয়েকটি লেক আছে যাতে আছে বড় বড় মাছ, আর সেই লেকের পানিতে নির্ভয়ে, মনের আনন্দে সাতার কাটে রাজ হাঁস, পাতি হাঁস সহ বিভিন্ন জাতের পাখী। আমাদের দেশে যেখানে বন কেটে উজার করা হচ্ছে সেখানে লন্ডনের মত ব্যস্ততম একটি শহরের মাঝখানেও যে কত বাগান, পার্ক আর খোলামেলা জায়গা যত্ন সহকারে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে দেখে অবাক হতে হয়।
এটা আমার প্রথম ইংল্যান্ড সফর বলে অথবা আব্বা নিজে সেদেশে চাকুরী করা কালীন সময়ে আমাকে নিয়ে যেতে পারেননি এই আক্ষেপের কারণেই হোক, আমি থাকতে থাকতেই আব্বা দেশ থেকে ব্রাইটনে আসেন। আমার বোনও তখন ব্রাইটনে বেড়াতে আসে। ওই সময়ে ঘরের ভিতরই আমরা বেশ কিছু পারিবারিক গ্রুপ ছবি তুলি। আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে আমি সৌদীতে আমার কর্মক্ষেত্রে ফেরত চলে আসি। আমি থাকা অবস্থায় আম্মা বেশ কয়েকবারই বলেছিলেন যে আমার স্ত্রী-পুত্রও যদি ওই সময়ে সাথে আসতো কতই না আনন্দ হত। আব্বার কয়েকজন পুরানো সহকর্মীর বাসায় দাওয়াত খাওয়ার সময় তাদের কেউ কেউ আমাকে বলেছেন যে আগে আমাকে স্বচোখে না দেখলেও তারা আমার মোটামুটি অনেক কিছু সমন্ধেই অবগত আছেন, পার্থক্যটা শুধু চোখের সামনে দেখার। এমন স্নেহভরা কথা শুনলে স্বাভাবিকভাবেই মনে দাগ কাটে। এখানে আরেকটা ব্যাপার উল্লেখ না করে পারা যায় না। ইংল্যান্ডে বসবাসকারী সিলেটীদের একটা প্রথা হচ্ছে দেশ থেকে যারা ইংল্যান্ডে বেড়াতে যায় তাদেরকে কাপড়চোপড় অথবা নগদ পাউন্ড উপহার হিসেবে দেয়া। আব্বার পুরানো সহকর্মীদের বেশিরভাগই যেহেতু সিলেটের অধিবাসী, সেই সুত্রে আমাকেও তারা সেভাবে উপহার দিয়েছে যদিও আমার বেশ সঙ্কোচ লাগছিল।
ইংল্যান্ড সফর আমার কাছে ভাল লাগলেও ব্যতিক্রমী কিছু বলে মনে হয়নি। অনেক কিছু সমন্ধে আগে থেকেই অবহিত থাকার কারণে আমার জন্য তফাতটা হয়েছে শুধুমাত্র স্বচক্ষে দেখার।
ইংল্যান্ডের একটা ব্যাপার আমার কাছে একটু বেমানান লেগেছে যেমন বিকেল ৫টার পরে সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। লন্ডনের বাইরের অন্য শহরগুলিতে গোটা শহরে বড়জোর একটি বা দুটি সুপারমার্কেট রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে, ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে এমন দোকান সব শহরে থাকেনা। রেষ্টুরেন্ট, বার এগুলি রাত ১১টা আর নাইটক্লাব রাত ১টা পর্যন্ত খোলা থাকে। অবশ্য ওই দেশের স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য এটা গা সওয়া হয়ে গেছে এবং তারা সেভাবে প্ল্যান করে কেনাকাটা করেন।
জ্বালানী তেলের দাম এবং গাড়ীর মেইন্টিনেন্স খরচ অনেক বেশী বলে অনেকেই নিজস্ব গাড়ী রাখার চাইতে পাবলিক টান্সপোর্ট ব্যবহার শ্রেয় মনে করেন। পাবলিক বাস নেটওয়ার্ক মোটামুটি শহরের প্রায় প্রতিটি এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। বাস চালক হিসেবে অনেক মহিলাকে দেখা যায়। এত বড় বড় বাসগুলি যখন কোন সরু রাস্তায় মোড় ঘুরে অথবা অন্য বাস বা গাড়ীকে সামান্যতম আঁচড়টুকুও না লাগিয়ে পাশ কেটে যায় দেখে তাদের গাড়ী চালানোর দক্ষতার প্রশংসা করতে হয়। আমাদের দেশে বা সৌদীতে এমনটা চিন্তা করতেও কষ্ট হয়। ভাল কথা, ইংল্যান্ডে পারতপক্ষে কেউ গাড়ীর হর্ণ বাজায় না। সামনের বা আশেপাশের কোন গাড়ী বা মানুষ একান্ত বিপদজনক কিছু করে ফেললে তখনই পিছনের গাড়ী থেকে হর্ণ দিবে। তারপরও যাকে উদ্দেশ্য করে হর্ণ বাজানো হয় তার পরিবর্তে যে হর্ন বাজায় আশেপাশের সব লোকজন তার দিকেই ঘৃণা বা তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে তাকাবে।
সৌদীরা যেখানে আমেরিকান বড় বড় গাড়ী ব্যবহার করে যেমন GMC যেটাতে একটি পরিবারের প্রায় ৬ থেকে ১০ জনের মত সদস্য বসতে পারে, তার বিপরীতে ইংল্যান্ডে দেখলাম বেশীরভাগই ছোট ছোট গাড়ী।
বিকেল ৫টায় অফিস ছুটির পর বেশীরভাগ মানুষজনই জগিং, সাইক্লিং বা পোষা কুকুর নিয়ে রাস্তায় হাটতে বেরিয়ে পরেন। ব্রাইটন সাগরতীরবর্তী শহর বলে অনেকে আবার বোট নিয়ে সাগরে চলে যান সেইলিং করার জন্য। সামারের সময় ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকেও প্রচুর সংখ্যক পর্যটক ব্রাইটনে বেড়াতে আসে।
ছুটি শেষে জেদ্দা পৌছেই পরদিন আমি বৃটিশ কন্স্যুলেটে গিয়ে সেই ভিসা অফিসারের সাথে দেখা করি। আমাকে দেখে সে খুবই খুশী হয় এবং আমাকে ধন্যবাদ জানায় ফেরত আসার জন্য। আমার পাসপোর্টের ফটোকপি করে রেখে সে আমাকে পাসপোর্টটি ফেরত দেয়।
ওইযাত্রায় যে পারিবারিক ছবিগুলি তুলেছিলাম কয়েকমাসের মধ্যেই সেই ছবিগুলি স্মৃতি চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়। ডিসেম্বরের শুরুতে আম্মা মারা যান। তাই ভাবি যে আমার ভিসা পাওয়া, ইংল্যান্ড যাওয়া বা পারিবারিক ছবিগুলি তোলার পিছনে নিশ্চয় মহান আল্লাহপাকের কোন অদৃশ্য ইঙ্গিত ছিল। আমার যাওয়া না হলে বা ওই ছবিগুলি না তুললে আব্বা-আম্মার সাথে আমাদের ভাইবোনদের এই গ্রুপ ছবি আর কোনদিনই তুলবার সুযোগ হত না। আম্মার লাশ দেশে এনে দাফন করা হয়েছিল আর তখন আমরা সব ভাইবোনই দেশে যাই।
পরের বছর জুলাই মাসে আমার বাৎসরিক ছুটির সময়ে আবার ইংল্যান্ডের ভিসার আবেদন করি। ধারণা করছিলাম যে আগেরবার সময়মত ফেরত চলে আসার কারণে এবার সহজেই ভিসা পেয়ে যাব। আগের সেই ভিসা অফিসার তখন আর নেই, নতুন ভিসা অফিসার এসেছে আর সেই সাথে গ্রীস্মকালীন ভিসা আবেদনের চাপ সামাল দেবার জন্য বাড়তি সাহায্যকারী ভিসা অফিসার। তবে আরেকটা অসুবিধা ছিল যে আমার ছুটি যদিও এক মাসের মত, অফিস থেকে আমার পাসপোর্টে সৌদীর EXIT / RE-ENTRY VISA লাগিয়েছে দুই মাসের। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের ভিসা যেহেতু ন্যূনতম ছয়মাস মেয়াদের তাই বৃটিশ কন্স্যুলেট পাসপোর্টে ছয় মাস মেয়াদের সৌদী EXIT / RE-ENTRY VISA চায়। উপর থেকে তারা আবার আমাকে ভিসার জন্য ইন্টারভিউয়ের এপয়েন্টমেন্ট দিতে চায়। ততদিনে আমার ছুটির অর্ধেকেরও বেশী এখানে রুমে বসে কেটে যাবে। তাই আমি আর আবেদনপত্র জমা না দিয়ে চলে আসি। আগে থেকেই আমি একই দিনের জেদ্দা-লন্ডন-জেদ্দা আর অন্যদিকে জেদ্দা-ঢাকা-জেদ্দার দুইটি টিকেট করে রেখেছিলাম যাতে একটা না হলে অন্য ফ্লাইট ধরতে পারি। সেই অনুযায়ী সেদিন রাতেই আমি ঢাকার ফ্লাইট ধরি।
দেশ থেকে ছুটি কাটিয়ে সৌদীতে ফেরত আসার পরে আমি আবার ভিসার জন্য এপয়েন্টমেন্ট চাই। ফ্যাক্সের মাধ্যমে যোগাযোগ করি আর তাতে আমার পাসপোর্ট নম্বর, সাথে আগের ভিসার নম্বর উল্লেখ করে দেই। তারাও আমাকে ফিরতি ফ্যাক্সের মাধ্যমে ইন্টারভিউয়ের তারিখ ও সময় জানিয়ে দেয়। এবার পাসপোর্টে ছয় মাসের EXIT / RE-ENTRY লাগাতে ভুল করি না। সৌদী থেকে অন্য যে কোন দেশের ভিসার জন্য আবেদন করলে সাধারণতঃ যার যার নিয়োগকর্তা বা কোম্পানী থেকে একটি চিঠি নিতে হয় যাতে আবেদনকারী কতদিন যাবত ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে, তার বেতন কত এসব উল্লেখ করতে হয় আর সাথে এই নিশ্চয়তা দিতে হয় যে সে আবার সৌদীতে ফেরত আসবে। উপর থেকে এই চিঠিটি আবার চেম্বার অব কমার্স থেকে সত্যায়ন করে নিতে হবে। তখন বৃটিশ কন্স্যুলেট ভিসার দরখাস্তের সাথে বাড়তি আরেকটি জিনিস চাইত – আবেদনকারীর বিগত ছয় মাসের ব্যাঙ্ক হিসাবের লেনদেনের বিবরণী। তবে এখন আর আগের মত ছয় মাসের EXIT / RE-ENTRY নিতে হয়না, আর ব্যাংক ষ্টেটমেন্টও ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাসে নামিয়ে এনেছে। নির্দিষ্ট দিনে আমি মদীনা থেকে জেদ্দা আসি। এবারের ভিসা অফিসার এক ভদ্রমহিলা; আটকে দেবার মত কোন কিছু জিজ্ঞাসা না করে মামুলী সব প্রশ্ন করেছে। এমনকি হাসতে হাসতে সে আমাকে বলে যেহেতু আমার স্ত্রী বাংলাদেশে থাকে আমি কেন সৌদীতে আরেকটা বিয়ে করছি না, আমাদেরতো একাধিক স্ত্রী রাখা বিধিসম্মত। দুপুর ১২:৩০ টার দিকে ইন্টারভিউ নিয়ে আমাকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। প্রায় ২টার দিকে এক ফাঁকে পাকিস্তানী এক ভিসা সহকারী এসে আমাকে বলে যে ওরা মদীনাতে আমার হোটেলে এরই মধ্যে যোগাযোগ করেছে। জেনারেল ম্যানেজার সেদিন হোটেলে না থাকায় ভারপ্রাপ্ত যে ম্যানেজার আছে তার সাথে কথা বলে আমি যে ওই হোটেলে কাজ করি সেটা নিশ্চিত করে এবং আমার চলতি বেতন উল্লেখ করে একটি চিঠি সরাসরি কন্স্যুলেটে ফ্যাক্স করে পাঠানোর অনুরোধ করেছে। তখন লাঞ্চের সময় বলে ওই ফ্যাক্সটি আসতে দেরী হচ্ছিল। এই ভিসা সহকারী যখন ভারপ্রাপ্ত সেই ম্যানেজারের নাম উল্লেখ করেছে তখন আর তাকে অবিশ্বাস করার মত কিছু ছিল না। কারণ দরখাস্তের সাথে নিয়মমাফিক যে চিঠিটি জমা দিতে হয় সেটি আমি আমার জেনারেল ম্যানেজারকে দিয়ে সই করিয়ে এনেছিলাম। হোটেলে ফোন করে কথা না বলে থাকলে সেইলোকের নাম তার জানবার কথা না। বিকেল প্রায় পৌণে চারটার দিকে ভিসা শাখার প্রায় সব লোকই চলে গেছে, সেই মহিলা ভিসা অফিসার আমাকে ডেকে দেখায় যে কম্পিউটারে ভিসা ষ্টিকার রেডি, শুধুমাত্র হোটেল থেকে ফ্যাক্সটি আসলেই পাসপোর্টে ষ্ট্যাম্প করে দিবে, আর সে শুধুমাত্র এটার জন্যই দেরী করছে। যাই হোক, কিছুক্ষণ পরেই আমি মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা লাগানো পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে যাই।
ইতোমধ্যে যারা বৃটিশ ভিসা নিয়েছেন অথবা ভিসার জন্য ইন্টারভিউ দিয়েছেন, খেয়াল করে থাকবেন যে এমন ইন্টারভিউয়ের সময় ভিসা অফিসারের মুখ আর হাত সমানে চলতে থাকে – মুখে যেসব প্রশ্ন করে এবং আবেদনকারীর প্রতিটি জবাব তারা সমান গতিতে লিখে রাখেন যা কিনা তাদের রেকর্ডে থেকে যায়। এই কারণে ভিসা ইন্টারভিউয়ের সময়ে কোন রকমের মিথ্যা তথ্য না দিয়ে সত্যি কথা বলাই শ্রেয়।
২০০১ এর শেষ দিকে আমার স্ত্রী-পুত্র সৌদীতে চলে আসে। ২০০২য়ের জুলাইতে সপরিবারে বৃটিশ ভিসার আবেদন করলে তখন ভিসা ফি জমা নিয়ে কোন ইন্টারভিউ ছাড়াই সরাসরি আমাদের তিনজনের ভিসা দিয়ে দেয়। ভিসা ফর্ম জমা নেয়ার সময়ে আগে আমার যে ভিসা রিফিউজালের কাগজটা ছিল, সেটাও খুলে ফেলে দেয়। তখন থেকে প্রতি বছরই আমার বাৎসরিক ছুটির সময়ে ঢাকায় না গিয়ে আমরা ইংল্যান্ডে চলে যেতাম, ভিসা নিতে আর কোন অসুবিধা পোহাতে হয়নি। প্রথমবারের ছয় মাসের ভিসার জায়গায় এখন আমার দশ বছরের ভিসা লাগানো।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


